মামুন রশীদ: দুর্বার এক আলোকচ্ছটা
বঙ্গ রাখাল
অমিয় চক্রবর্তী তাঁর ‘সমালোচকের জল্পনা’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘পরিচয় কাজটাকে বাদ দেওয়া চলে না। লোকটি কে হে?—যদি বলা যায় তাঁর জামার বোতামটা অসহ্য; তাঁর পিসীমা ভালো লোক নয়; তাঁর চোখের শূন্য দৃষ্টিতে,—‘শূন্য’ অর্থে চার্ব্বাক দর্শনের—; বিশ্বস্তসূত্রে জেনেছি পরশুদিন তিনি স্বপ্নে তিনটি ফ্রয়েডিয়ন ঘোড়াকে..., তাহলে প্রশ্নটা শূন্যেই থেকে গেল। তথ্যের তির্যক চাহনি, তত্ত্বও নয়, তাঁর পরিচয় চেয়েছিলাম।’ মানুষের সাথে মানুষের পরিচয়টা থাকা দোষের কিছু না। অনেকের সাথে পরিচয় থাকলে বৃদ্ধ বয়সে সম্পর্কের গুরুত্বটা সহজে অনুধাবন করা হয়। কবি মামুন রশীদের সঙ্গে কখন কীভাবে পরিচয়, বলা মুশকিল। তবে ব্যক্তি মামুন রশীদের সঙ্গে পরিচয়ের আগেই হয়তো তার নামের সঙ্গে পরিচয়। তবে অনেক সময়েই আমি গুলিয়ে ফেলি। আসলে কোন মামুন রশীদ? একজন ব্যাংকার; একজন ছড়া লেখক; নাকি কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক মামুন রশীদ? ফলে কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক মামুন রশীদকে চিনতে পাঠককে একটু বেগ পেতেই হয়, এটুকু নিশ্চিত করেই বলা যায়। মামুন রশীদ কবি, এই পরিচয়ের বাইরেও তিনি উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ছোটদের জন্য গল্প এবং জীবনী লিখেছেন। করেছেন অনেকগুলো সম্পাদনার কাজও।
২.
মামুন রশীদ—যাকে চিনেছি একজন কবি হিসেবে। একবিংশ শতকের প্রথম বা শূন্য দশকে যে কয়েকজন কবি বাংলা সাহিত্যে তাদের সৃষ্টিকর্ম দ্বারা কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ স্বাক্ষর রাখতে পেরেছেন, মামুন রশীদ তাদের অন্যতম। তার কবিতা ঋদ্ধ করে পাঠকের মন। হৃদয়ের গভীর থেকে নাড়িয়ে দেয় পাঠককে। এই কবিকে আমি একজন প্রেমিক হিসেবেই দেখতে পাই—তার কবিতা পড়লেই স্পষ্ট হয় তিনি কতটা রোমান্টিক। দিনের পর দিন প্রেমের মায়াজাল তিনি শুধুই ফেদে চলেছেন। একজন শিল্পীর কাজই তো মানুষের মনকে জাগ্রত করা। কবি মামুন রশীদ সেই কাজটিই করে চলেছেন। কবির কবিতাগুলো শুধু মুগ্ধতা নিয়েই পড়তে হয়। কবিতার কিছু কিছু পঙক্তি আমাকে বিস্মিতও করে। মনে হয় এই কবি সত্যিই কবিতা লেখায় সার্থক। সৌন্দর্যবোধের জায়গাটাও মামুন রশীদের পরিষ্কার। তিনি কবিতা লিখতে গিয়ে কবিতাকে কখনো অতিরঞ্জিত করে তোলেন না। আসুন তবে, তার কিছু কবিতার পঙক্তি পাঠ করা যাক—
ক.
মুক্তি, তার সমারোহ যে জলধারা নিয়ে
নেমে আসে ভেসে যায় এপার-ওপার, আদিগন্ত।
তাকে সবসময় আনন্দের ঝর্ণাধারা বলে
অভিহিত করার কিছু নেই। যে দেয়,
যে পায়, দুইয়ের মাঝে ফারাক বিস্তর।
কেনো নদী বারেবারে মিশে যেতে চাইবে নীলে,
কেনো ছোটাছুটি, কেনো দৃষ্টিসীমায় বেঁধে রাখার আকুতি।
ঘরের ভেতর থেকে কেনো প্রতিদিন সাঁকো বানানোর
বিপুল পরিশ্রম মিলিয়ে দিতে চাইবে হেসে খেলে?
(মুক্তি: আমি তোর রাফ খাতা)
খ.
এই সান্ধ্য আইন আর ভীষণ সাইরেনের মতো
সব নীতিমালা অমান্য করে সমস্ত শহরকে কাঁপিয়ে
অনভ্যাসের যে প্রথম চুমু এঁকেছিলে গালে,
তাকেও তো খিল এঁটে ঘষতে ঘষতে মুছে ফেলতে হয়।
(স্মৃতি: আমি তোর রাফ খাতা)
কবিতা কোনো ছেলের হাতের মোয়া নয় যে এটা ইচ্ছে করলেই হয়ে গেল; এর জন্য তপস্যা করতে হয়। নিজেকে অঙ্গারে পুড়িয়ে খাঁটি করে তুলতে হয়। তবেই না এই সমাজ-রাষ্ট্রের সত্যিকারের ভালোবাসা কিংবা ভেল্কিবাজি ধরাটা সম্ভব। কবি নামের সরল-মানুষগুলোকে সমাজের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঠোকর খেতে খেতে অর্জন করতে হয় অভিজ্ঞতা। তবেই না কবিতা পোক্ত হয়। আর কবি মামুন রশীদের কবিতায় সেই আলামতগুলোর লক্ষণ বিদ্যমান। তিনি যখন কবিতায় বলেন, গলি-অলিতে স্লোগান আঁকে বিভেদের দেয়ালে। এই বিভেদই তো আমাদের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আমাদের একের কাছ থেকে অন্যকে আলাদা করে তোলে। সমাজেও আজ একাকিত্বের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। কবির কবিতাগুলো যেন এক বাস্তব জীবনের দলিল। তিনি বানোয়াট কোনো কিছু বলতে রাজি নন। ইংরেজ কবি কোলরিজ গদ্য ও পদ্যের পার্থক্য নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘শব্দের সুনিয়ন্ত্রিত বিন্যাসই গদ্য এবং যথোপযোগী শব্দের অবশ্যাম্ভাবী বিন্যাসই পদ্য। শব্দভাবের বাহন, শব্দ বাঙ্গময়, শব্দ অর্থ সমন্বিত, চিত্রাত্মক এবং ব্যঞ্জনাময়। এই শব্দ যখন অনুভূতি বিগলিত, গীতি মূর্ছনায় সাবলীল স্রোতে অপরিবর্তনীয় ভাষায় আবেগ কম্পিত হয়ে ওঠে, তখনই সাহিত্য পদ্যাত্মক হয়ে ওঠে।’ কবি মামুন রশীদের কবিতা সেই সৌন্দর্যকে ধারণ করেই কবিতা হয়ে উঠেছে—
১.
বর্ণমালা, প্রেমে না অপ্রেমে তাকিয়েছিলাম, বুঝিনি।
প্রথম দেখার মুগ্ধতা তাড়িয়ে নিয়ে ফিরছিল।
সেই রেশ, চাইনি হারিয়ে যাক, তোমাকে ছুঁয়ে
দেখা যাবে, তোমার অফুরন্ত প্রাণশক্তির ভেতর
থেকে দুঃখ আর আনন্দের ঝর্ণাধারা
(বর্ণমালা: আমি তোর রাফ খাতা)
২.
স্মৃতিকে যতই দুমড়ে-মুচড়ে মড়মড় করে
সশব্দে ভেঙে ফেলো তোমার মনোভাবের বাইরে
বই হাতে ছোটাছুটি করা শিশু হয়তো
আচ্ছন্ন করে ফেলবে কোনো বিষণ্ন দুপুর।
(আমাকে তোমার মনে পড়ার কথা: আমি তোর রাফ খাতা)
আরও পড়ুন
৩.
নত হতে হতে কেঁচো হয়ে গেছি
হেরে যেতে-যেতে কেঁচো হয়ে গেছি
ভয় পেতে পেতে কেঁচো হয়ে গেছি
মুখোশ পরতে পরতে কেঁচো হয়ে গেছি।
(অভিশাপ: আমি তোর রাফ খাতা)
কবিকে তো সর্বদা কবিতার পেছনেই চলতে হয়—ছুটতে হয় কবিতা দেবীর মুখদর্শনে। এই কবির সহজাত প্রবৃত্তিই জন্ম দেয় কবিতার। কবি বড় জেদি, তিনি কবিতা দেবীর মুখ দর্শন করবেনই। জীবনের নিয়ন্ত্রিকতা কবি মানবেন কেন? সেই তো সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে তুলে ধরেন নিজের তলোয়ার। অনেকে ঈশ্বরকে খোঁজেন আলাদা আলাদা কৌশলে, ভিন্নভাবে। কিন্তু কবি সোজা-সাপ্টাভাবেই নিজের কবিতায় ঈশ্বরের সন্ধান করে থাকেন। এভাবেই বুঝি কবির হৃদয়কোণে নানা যন্ত্রণা নিয়ে কবিতার জন্ম দেন। কবি মামুন রশীদ সব বিবেচনায় একজন সার্থক কবি এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
৩.
মামুন রশীদ, তার দীর্ঘদিনের লেখার অভিজ্ঞতায় প্রবন্ধে নিজস্বতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি সর্বদাই ভালো লাগার জায়গা থেকেই প্রবন্ধ লিখে থাকেন। কারও খুশি বা ব্যক্তির ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য প্রবন্ধ লেখেন না। তিনি জীবিত কিংবা মৃতদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে প্রচুর লিখেছেন—বর্তমানেও লিখে চলেছেন। আমরা আজ অনেকটা অন্যদের খুশি রাখার জন্যই কাজ করি কিন্তু মামুন রশীদের কাজগুলো স্বপ্রণোদিত। গত পঁচিশ বছরেরও অধিক সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার প্রধান দৈনিক ও ছোটকাগজে নানা বিষয়ে লেখালেখির মধ্য দিয়ে তিনি নিজের অবস্থান পাকা-পোক্ত করে তুলেছেন। গদ্য ও পদ্য দু’মাধ্যমেই স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ তাকে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে সহায়তা করেছে। সমসাময়িক বিষয়ে সংবাদপত্রে নিয়মিত উপ-সম্পাদকীয় লেখার মধ্য দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন, একজন কবি-লেখকেরও বলার রয়েছে নানা বিষয়ে।
মামুন রশীদ লেখেনও নানা বিষয় নিয়ে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সামনে সংকট ও সম্ভবনাকেও তিনি তার কলামের মাধ্যমে প্রকাশ করেন পাঠকের কাছে। শিল্প-সাহিত্যের ভুবনের সঙ্গে যেমন তেমনই সংবাদপত্রের উপ-সম্পাদকীয় লেখার বেলায়ও তিনি সহজ, স্বচ্ছন্দ্য। তার রচনায় কোনো দ্বিধা নেই। তার গদ্যের ভাষা ও ভাব সহজ-সরল। যা বুঝতে কারও বেগ পেতে হয় না। তিনি সব সময় নতুন কিছু নিয়ে কাজ করতেই অভ্যস্ত। মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও মামুন রশীদ কাজ করেছেন। তিনি যেমন জেলা পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার কাজ করেছেন, তেমনই মুক্তিযুদ্ধের প্রান্তিক পর্যায়ের ইতিহাস তুলে আনার কাজেও আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পূর্ণতার প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণের গুরুত্ব অনুধাবন করেই তিনি প্রান্তিক পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকথা সংরক্ষণে এগিয়ে এসেছেন। তিনি পরিশ্রম না করে অন্যের তথ্যের ওপর নির্ভর করে কোনো কাজ করতে আগ্রহী নন। তিনি সর্বদা মানুষের ভেতর থেকে নির্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহী।
আমি একবার মামুন রশীদকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আপনি তো অনেকের জীবনী লিখেছেন-ডিরোজিও, নেলসন ম্যান্ডেলা, মাদার তেরেসা, বেগম রোকেয়া, হিটলার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান—এই মহৎ মানুষদের জীবনী নিয়ে কাজ করার পেছনের কারণ কী?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘ছেলেবেলা থেকেই আমি বিখ্যাত মানুষদের জীবনী পড়তে পছন্দ করি। পরবর্তীতে আমার পাঠে পছন্দের তালিকায় যোগ হয় সাক্ষাৎকার, আত্মজীবনী এবং ইতিহাস। বিখ্যাত মানুষের জীবনী আমি খুঁজে খুঁজে পড়ার চেষ্টা করি। আমার পছন্দের তালিকায় এ ধরনের বই, লেখাগুলো থাকে সামনের সারিতে। আমি যখন কোনো বিখ্যাত মানুষের জীবনী লেখার কাজ করেছি; তখন তার পেছনে আমার প্রকাশক বন্ধুদের আগ্রহ ও আমন্ত্রণ যেমন ছিল, তেমনই ছিল আমার ভালো লাগা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং সর্বোপরি তাদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ। যাদের নিয়ে কাজ করেছি, এই কাজ করার সুবাদে তাদের নিয়ে লেখা বিভিন্নজনের বই পাঠের সুযোগ হয়েছে। অজানা তথ্য জেনেছি, জেনেছি একজন মানুষের বড় হয়ে ওঠা, আদর্শ হয়ে ওঠার পেছনে তাদের শিক্ষা, ত্যাগ, মানুষের জন্য ভালোবাসাও।’
মামুন রশীদ এক ধরনের অনুসন্ধানী তৃষ্ণা নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন। এটা বুঝি তার পেশার কারণেই সম্ভব হয়েছে। কারণ সাংবাদিকদের তৃষ্ণা থাকতে হয়; তা না হলে তারা লেখা বা কোনো সূত্র আবিষ্কার করতে পারেন না। এ কারণেই অজানাকে জানা বা অচেনাকে চেনার ইচ্ছায় মামুন রশীদ দিনকে দিন নিজের গণ্ডি ছাড়িয়ে অচেনাকে চেনা, অজানাকে জানা বা জানানোর নেশায় লিখে চলেছেন। সৃষ্টির এই উন্মাদনা তাকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তুলবে—এ প্রত্যাশা করাই যায়। মামুন রশীদের সাহিত্যকর্ম তেমনই এক আলো, যা আমাদের দ্যুতির সন্ধান দেয়, অন্ধকার গহ্বরে নিমজ্জিত করে না। তিনি দুর্বার এক আলোকচ্ছটা, যে আলো হারিয়ে যায় না বরং চারপাশ আলোকিত করে তার রেশ রেখে যায়।
এসইউ/এএসএম