দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণুর গুচ্ছ কবিতা
তুমি যেওনা ও অন্যান্য
এক.
বিরহী সরোদ
ক্ষয়ে ক্ষয়ে অক্ষয় হতে গিয়ে
পাথর সময়ের তিরবিদ্ধ হয়েছি
দহনের রঙ কী কিংবা অনুতাপের অনুভূতি
এমন প্রশ্নে বুকের ভেতর আকাশ ভেঙে পড়েছে বারবার।
কষ্টকে যত্নে রাখি, কী ভীষণ আকুলতায়
অসুখের মাঝেও নিত্যসুখ খুঁজি
পাঁজরের ভাঁজে ভাঁজে শুধুই বেদনার সংসার
নোনা জলের প্লাবনে সিক্ত দীর্ঘশ্বাস।
প্রাণের জন্য প্রাণ দেওয়া কঠিন কিছু নয়
বরং প্রাণ দেওয়ার জন্য প্রাণ খুঁজে পাওয়াই কঠিন
আনন্দের গোপন উৎস খুঁজতে গিয়ে
জন্মান্ধের কাতরতা নিয়ে ফিরে এসেছি।
কেবলই স্বপ্নের দুকূল ভাঙে দুঃস্বপ্ন
হৃদয় গহিন তলে শুধুই যেন বিষবাষ্প
ঋণাত্মক থেকে ধনাত্মক হতে গিয়ে পৌঁছেছি শূন্যে
তরমুজের ফালির মতো এক চিলতে রোদ্দুরের আকাঙ্ক্ষায় বয়স বাড়ে।
চারদিকে অবসাদের দেয়াল
শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বঞ্চনার কালো দাগ
আগুনের ঘ্রাণ নিয়ে বেঁচে আছি বহুকাল
তুমি যাও, এবার মৃত্তিকায় ডুব দেব।
ইচ্ছেগুলো বিনাশীদের হাওয়ায় উড়ে যায়
নিঃশব্দ-নির্জনে কাঁদে বিরহী সরোদ
জানতে বড় সাধ জাগে, বড় সাধ
নিজেকে কতটা শূন্য করে অন্যকে পূর্ণ করা যায়?
দুই.
বিষাদের বিসর্জন
আজ সন্ধ্যায় অপ্রাপ্তিগুলো ঝেড়ে ফেলে স্থির করলাম
প্রতিক্ষণ আনন্দ নিয়ে আর কখনও বিষাদের দিকে যাবো না
কখনও না, কিছুতেই না।
তোমরা আমার স্বজন, কাতর আত্মার আশ্রয়, নিরাশ্রয়ী গৃহীর গৃহ
বরং আরও একটু স্পষ্ট করে বলি, আড়ষ্টতার জাল ছিঁড়েই বলি
তোমাদের নির্মাণের ভাঁজে ভাঁজে গচ্ছিত রেখেছি সুখস্মৃতিগুলো
জানি, খুব করেই জানি; অগোচরে তোমরা তা খরচ করবে না কখনও
তোমাদের অনুভূতির স্পর্শে দুঃসময়ের কার্নিশ থেকে দুঃখরেখাগুলো মুছে গেছে।
তোমরা অনাবিল আনন্দ, মায়াময় আকুলতা, পরার্থে ব্যাকুল
আমার কাছে যারা জানতে চেয়েছে, ওদের ধম্ম কী গো?
বলেছি, শিকড় দিয়ে মাটি আঁকড়ে থাকা, ওদের ধম্মকম্ম শুধুই সৃজনরেখা
তোমরা যোজন যোজন পথ পেরিয়ে সৃষ্টি-নির্মাণের আরামদায়ক সমন্বয়
সময়ের বৈরী স্রোতেও রূপান্তরের আশায় প্রতিনিয়ত অনুশীলনে উজানমুখী
প্রেমময়, বন্ধুত্বপূর্ণ ও মনোমুগ্ধকর সম্পর্ক, নিরন্তর কথোপকথন।
আমার সকল অনুভূতি যখন সরলরেখায় চলছিল
আর সব আনন্দ হেঁটে যেত বিষাদের দিকে অবিরত
তখনই তোমরা শেখালে নির্মোহ অনুভূতির নামই ভালোবাসা
আর তাই আজ সন্ধ্যায় স্থির করলাম
আনন্দ নিয়ে আর কখনও বিষাদের দিকে যাবো না
কখনও না, কিছুতেই না।
তিন.
তুমি যেও না
যেও না, বারণ করছি; যেও না
স্থির জানি, গেলেই তুমি হারিয়ে যাবে।
তোমার নিয়তি হতে পারে না নিরুদ্দেশযাত্রা
তুমি সাগরের ক্ষুব্ধ তরঙ্গে আছড়ে পড়া ঢেউ
তুমি মিছিলে মিছিলে বজ্রমুষ্টির স্মারক
তোমাকে এভাবে প্রস্থান মানায় না, কখনও না
তুমি কালের যোগ্য উত্তরাধিকার।
লোডশেডিংয়ে অসহায় ল্যাম্পপোস্টের মাথা ছুঁইয়ে
অন্ধকার তাড়িয়ে তুমিই দেখাও আলো
আমাদের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জানুক
তাদের সরবরাহ বিদ্যুৎ না পেলেও আমরা আলোহীন নই
বহুমাত্রিক বিশ্লেষণে ও বহুরৈখিক বিবেচনায়
তোমাকে প্রয়োজন, খুব প্রয়োজন।
রাষ্ট্র-সমাজ শব্দ দুটি উচ্চারণমাত্র তুমি আরও বেশি
অপরিহার্য হয়ে ওঠো
মনে পড়ে বিদ্রোহ-বিপ্লবের স্বপ্নধ্যানে
তোমাকে স্তবের মতো উচ্চারণ করি
যেও না, বারণ করছি; যেও না
স্থির জানি, তুমি গেলেই অঙ্গীকারগুলো হারিয়ে যাবে।
তুমি প্রাত্যহিক জীবনের খুব জরুরি অনুষঙ্গ
তুমি তাবৎ নির্মাণের রূপকার, অনিন্দ্যসুন্দর
তুমি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের অববাহিকায় চরিত্রায়ণ
এত ক্লেদের মাঝেও তুমি দহনবেলার উচ্চারণ
তুমি হৃদয়ের গভীরে অন্তর্গত বোধ ও সৌন্দর্য
তুমি স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও নিঃসংশয়
পর্যবেক্ষণ তীক্ষ্ণ, সূক্ষ্ম, তোমার প্রকাশ অনবদ্য।
যেও না, বারণ করছি; যেও না
তুমি চলে গেলে রূপগত পরিচর্যার পরিচয়
মিশে যাবে ধুলোয়।
এইচআর/এমএস