সুমি ইসলামের ছোটগল্প: রিজিক
অসম্ভব রকমের গরম পড়েছে। ঘর থেকে বের হলেই মনে হচ্ছে ডিমের মতন সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। এত গরম আর রোদের তেজে জীবনটা একদম সিদ্ধ ডিম হয়ে গেল। এর মধ্যে কয়েকদিন ধরেই খুব খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু প্রচণ্ড গরমের কারণে খিচুড়ি রান্না করতে পারছি না। মনটা তো সেই মেঘলা আকাশ আর খিচুড়ির ওপরে পড়ে আছে। আহা মুগ ডাল আর নাজিরশাইল চাল দিয়ে ভুনা খিচুড়ি। সাথে ইলিশের দোপেঁয়াজা। টকটকা লাল শুকনা মরিচ দিয়ে পেঁয়াজ ভর্তা। কালোজিরায় অল্প তেল, কাঁচা মরিচ আর রসুন দিয়ে ভর্তা এবং বোম্বাই মরিচের আচার। নাহ, আর থাকতে পারছি না। কবে যে বৃষ্টি হবে, প্রকৃতি ঠান্ডা হবে আর আমি খিচুড়ি রান্না করবো।
আমার ডেস্কের পেছনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি আকাশে মেঘ জমেছে। প্রচুর হাওয়া বইছে। মনে হয় ঝড় হবে। আকাশ মেঘলা দেখে মনটা ময়ূরের মতন নেচে উঠলো। টেবিলে জমে থাকা কাজগুলো দ্রুত শেষ করে বাসার দিকে রওয়ানা দেবো; সেই সময় বস বললেন, ‘ফারহানা আমার রুমে একটু আসেন। জরুরি কথা আছে।’ মনটা খারাপ করেই বসের রুমে গেলাম। এ মা আমার আগেই রিক্তা, শামীম, সুমাইয়া আর তানভীর বসের রুমে এসেছে।
আমি রুমে ঢুকতেই বস বললেন, ‘শোনেন আপনাদের পাঁচজনের টিমটা কাল সকালে পাবনার চরে রূপদিয়া গ্রামে যাবেন। সেখানে আমাদের একজন ভিকটিমকে উদ্ধার করতে হবে। সে তার শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতনের শিকার। আপনারা এখান থেকে যাবেন হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদে। ওখানকার চেয়ারম্যান তার দুজন গ্রাম পুলিশ দেবে আপনাদের সাথে। ভিকটিমের বাবা, চাচা ও ভাই যাবে আপনাদের সাথে। চেয়ারম্যান আপনাদের জন্য নৌকার ব্যবস্থা করে দেবেন। পাবনার চরে পৌঁছানোর পরে পাবনা থানার এসআই আপনাদের সাথে থাকবেন। আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না। আপনাদের মেইলে সব ডকুমেন্টস সেন্ড করেছি। সব ডকুমেন্টস সাথে করে নিয়ে নেবেন। আর হ্যাঁ, সাথে করে পানি ও স্যালাইন নেবেন কিন্তু। চর পাড়ি দিতে হবে। সাথে কিছু শুকনা খাবার রাখবেন। ওখানে দুপুরের লাঞ্চের জন্য কোনো হোটেল পাবেন না কিন্তু। সকাল ৭টার সময় অফিসে এসে পাঁচজন একসাথে রওয়ানা দেবেন। সকাল সকাল গেলে চর পাড়ি দিতে কষ্ট হবে না। দেরি করলেই রৌদ্রের তেজ বাড়তে থাকবে। আপনাদের কষ্ট হবে।’
বসের রুম থেকে বেরিয়ে আমরা পাঁচজন বসে চেক লিস্ট তৈরি করলাম। কী কী নিতে হবে, কী কী করতে হবে।
অফিস থেকে বের হয়ে দেখি টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। মনটা খুশিতে ভরে গেল। সারাদিনের ক্লান্তি যেন কর্পূরের মতো এক নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। ড্রাইভারকে ব্যাগ, ফাইল আর ল্যাপটপটা দিয়ে বললাম, ‘তুমি বাড়ি চলে যাও। আমি রিকশায় করে যাচ্ছি।’
‘না না ম্যাডাম, আপনি গাড়িতে করেই চলেন। স্যার জানতে পারলে আমাকে অনেক রাগ করবেন। আগের বারের কথা মনে নেই ম্যাডাম? আমার তো চাকরিই নট করে দিয়েছিল স্যার।’
‘তারপর চাকরিটা আবার কীভাবে পেলে রমিজ?’
‘আপনার জন্য ম্যাডাম। আপনিই তো স্যাররে কী কী বুঝাইলেন। তারপরও ম্যাডাম আপনি গাড়িতেই চলেন। স্যার অনেক রাগ করবে জানতে পারলে।’
‘আহা রমিজ, তুমি যাও তো। স্যার রাগ করলে বলবা ম্যাডাম নিজেই বলেছে বাসায় চলে যেতে।’
রমিজ মুখটা কালো করে চলে গেল। একটা মাঝবয়সী রিকশাওয়ালা দেখে উঠে পড়লাম। হুড খুলে দিয়ে গাইতে লাগলাম, ‘মন মোর মেঘেরও সঙ্গী, ভেসে চলে দূর দিগন্তেরও পানে, রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম’। রিকশাওয়ালা বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমার পাগলামি দেখে আর হাসে।
‘মামা, তুমিও আমার সাথে গান ধরো।’
‘নাগো মা, আমি গান পারি না।’
‘আরে মামা তাতে কী হয়েছে? আমরা তো আর কোনো কম্পিটিশনে গান গাইছি না। ধরো ধরো, গান ধরো। বুঝলা মামা, আল্লাহর কী রহমত দেখো। আধাঘণ্টা হাওয়া আর টিপটিপ বৃষ্টিতে দুনিয়াটাকে একদম ঠান্ডা করে দিলো। কী শান্তি তাই না মামা।’
‘হ, হাচা কইচুন।’
‘মামা আজ রাতে তুমি কী খাবা?’
‘কী খাবো জানি না তো। রিজিকে যা আছে তা-ই খাবো। রিজিকে না থাকলে খাইতাম না।’
‘তোমার বাড়িতে কে কে আছে মামা?’
‘আমার বউ, পোলা আর বউমা।’
‘আজ বাড়িতে গিয়ে তোমার বউরে খিচুড়ি রান্না করতে বলবা। বৃষ্টির রাতে মজা করে গরম গরম খিচুড়ি খাবা। বৃষ্টির সময় মজা করে খিচুড়ি খেতে হয়।’
‘রিজিকে থাকলে খাইবাম। আর রিজিকে না থাকলে কী আর করবাম কও।’
বৃষ্টির তেজ বাড়তে লাগলো। পুরো কাকভেজা হয়ে বাড়িতে ফিরলাম। ঘরের ভেতর লাইট জ্বলছে দেখে বুঝতে পারছি সজীব বাসায় ফিরেছে।
‘সজীব, আমার টাওয়ালটা আর জামাকাপড়গুলো বাথরুমে দাও না প্লিজ।’
‘কাজের সময় খালি ডিস্টার্ব করো কেন ফারহানা?’
‘আরে কাজের ফাঁকে বউয়ের কথাও একটু শুনতে হয়। আর তুমি বাড়িতে কাজ নিয়ে কেন আসো বলো তো? অফিসের কাজ অফিসে করতে হয়। দাও আমার জামাকাপড়গুলো দাও তো জলদি।’
‘আমি তো এত কথা শুনতে পারবো না।’
‘ঠিক আছে শুনো না। এখনকার মতন জামা-টাওয়াল দাও প্লিজ।’
‘আর তুমি গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছো কেন? আজাইরা রিকশায় করে ভিজতে ভিজতে এসেছো।’
‘বৃষ্টিতে আমার রিকশায় চড়তেই ভালো লাগে সজীব।’
‘কী সব ভালো লাগা বুঝি না। ফারহানা আমার অনেক ক্ষুধা লেগেছে। দ্রুত খাবার দিও।’
‘সজীব আজ খিচুড়ি রান্না করবো। সাথে ইলিশের দোপেঁয়াজা।’
‘যেটাই করো, তাড়াতাড়ি করবা। আমার অনেক ক্ষুধা লেগেছে।’
‘তোমাাকে এককাপ চা আর সাথে নাগেট সসেজ ভেজে দিই?’
‘যা ইচ্ছে দাওতো।’
আমার স্বামী সজীব পেশায় প্রকৌশলী। ভালো চাকরি করে। ভালো বেতন পায়। আমাদের কোনো কিছুর অভাব নেই। আমরা বেশ ভালো আছি। কিন্তু এই ভালো থাকার মধ্যেও একটা কষ্ট কাঁটার মতন বুকের মধ্যে বেঁধে মাঝে মাঝে। সেটা হলো সজীবের কথা। সজীব প্রচুর মুডি আর ইগোস্টিক। এই যে আমরা গত ছয় বছর ধরে একসাথে আছি। একই বিছানায় ঘুমাচ্ছি। তারপরও আমাদের মাঝে বিস্তর দূরত্ব। দূরত্বটা আসলে অন্যরকম। এই দূরত্বের কথা কাউকে বোঝানো যায় না। মাঝে মাঝে সজীবের বুকের ওপর মাথা রেখে ঘুমাই। তারপরও কেমন জানি একা লাগে। এই যে একই ছাদের নিচে থাকি। তারপরও আমরা কাছের মানুষ হতে পারছি না। একসাথে আকাশ দেখি না। দক্ষিণ জানালা খুলে দিয়ে বাতাস গায়ে মাখি না। সজীব কখনো বাসায় ফেরার সময় একগুচ্ছ দোলনচাঁপা বা বেলি ফুলের মালা নিয়ে এসে চমকে দেয় না। বৃষ্টিতে কখনো একসাথে ভিজি না। তারপরও আমরা একসাথে থাকছি।
শাওয়ার শেষ করে রান্নাঘরে ঢুকে সজীবকে চা-নাস্তা দিয়ে এসে খিচুড়ি রান্নার আয়োজন শুরু করলাম। ফ্রিজ থেকে ইলিশ মাছ বের করে ভিজিয়ে দিলাম। লাল লাল শুকনা মরিচ সরিষার তেলে ভেজে পেঁয়াজ কুচি করে কেটে নিয়ে বেশি করে সরিষার তেল দিয়ে ভর্তা বানালাম। টমেটো, শসা, ধনেপাতা কুচি, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ কুচি দিয়ে সালাদ বানিয়ে টেবিলে দিয়ে সজীবকে ডাকতে গেলাম।
‘কী ব্যাপার, তুমি শুয়ে পড়ছো কেন? খেতে চলো। কী হলো? কথা বলছো না কেন?’
‘খাবো না।’
‘আরে কেন খাবা না? তুমি না বললে ক্ষুধা লাগছে।’
‘তখন বলেছিলাম, এখন ক্ষুধা নেই।’
‘কত শখ করে খিচুড়ি রান্না করলাম। তখন বললে খাবা। আর এখন বলছো ক্ষুধা নেই। তুমি না খেলে আমিও খাবো না।’
‘না খেলে না খাবা। যাও তো এখান থেকে। কানের কাছে ভ্যান ভ্যান করো না।’
‘তুমি সব সময় এ রকম কেন করো বলো তো? কত শখ করে রান্না করি। খেতে বসার আগেই তুমি এ রকম কর। কীসে তোমার রাগ হয় আর কীসে মন ভালো হয় বুঝতে পারি না।’
‘এই যাও তো এখান থেকে। ঘুমাতে দাও।’
সেই খিচুড়ি আমার খাওয়া হলো না। রিকশাওয়ালা মামার কথা মনে পড়ে গেল, ‘রিজিকে থাকলে খাইবাম, রিজিকে না থাকলে কী আর করবাম কও।’ আসলেই রিজিকে না থাকলে সামনে টেবিল সাজানো খাবার থাকলেও খাওয়া হয় না।
পরের দিন সকালে উঠে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। অফিসে পৌঁছে কাগজপত্র সব নিয়ে আমরা বেরিয়ে পরলাম সকাল সাতটার দিকে।
হরিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি আমাদের সাথে দুজন গ্রাম পুলিশ দিলেন। ভিকটিমের বাবা, চাচা আর বড় দুলাভাইও গেলেন। চেয়ারম্যান নিজে এসে নৌকায় তুলে দিয়ে গেলেন। সকাল সাড়ে আটটা বাজে আমরা নৌকায় করে যাচ্ছি। এখনো বর্ষাকাল আসেনি। নদীর এপার থেকে ওপার দেখা যাচ্ছে। তারপরও নদীটা বেশ বড়। বর্ষাকাল এলেই এই পদ্মা গর্ভবতী নারীর মতন ফুলে ফেঁপে ওঠে।
নদী পার হতে আমাদের সময় লাগলো মাত্র সাত-আট মিনিট। নৌকা থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলাম। গতকাল রাতে বৃষ্টি হয়েছে। সেই সুবাদে সকালটা বেশ সুন্দর। নির্মল বাতাস বইছে চারিদিকে। নদীর কিনার ধরে কাশবন। কিনার থেকে ওপরে উঠতে হচ্ছে। ওপরে উঠে তো চক্ষু ছানাবড়া। যেদিকে তাকাই শুধু মাঠ আর মাঠ। বাড়িঘরের কোনো নির্দেশনা চোখে পড়ছে না। এ যেন ধূ-ধূ প্রান্তর। গ্রাম পুলিশ নাসির আলীকে বললাম, ‘চাচা আর কতদূর হাঁটতে হবে?’
‘ম্যাডাম অহনো পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবো।’
‘কী বলেন?’
‘জি ম্যাডাম, অনেক খানিক পথ। তয় যখন পুরা বর্ষাকাল; তখন পদ্মা এক্কেরে পাবনার গ্রামের কিনারে গিয়া ঠেকে। তহন নৌকায় গড়াই নদী থেইক্কা পদ্মা পাড়ি দিয়ে পাবনায় পৌঁছাতে আধাঘণ্টার মতন লাগে। পদ্মা তহন পুরো যৌবন ফিরে পায়। কী তার গর্জন, কী তার ঢেউ গো ম্যাডাম। আর রাতের বেলা যহন পূর্ণিমা হয়; তহন চান্দের আলোয় পদ্মার পানি মনে হয় রুপার থালি।’
‘ফারহানা আপা, আপনি এত হাঁপাচ্ছেন কেন বলেন তো?’
‘তানভীর আজ শরীরটা ভালো লাগছে না। এই ধূ-ধূ প্রান্তর দেখে আরও ক্লান্ত লাগছে।’ গতকাল রাত থেকে যে একদম একটা দানা-পানিও পেটে পড়েনি, সেটা তানভীরকে তো বলা যাবে না। তাই আর বেশি কথা বাড়ালাম না।
‘নাসির আলী, গ্রামের ভিতরে কি দোকান-টোকান আছে? চা পাওয়া যাবে?’
‘জি ম্যাডাম, চা পাওয়া যাবে। কলা ও ডাব পাবেন টাটকা। কিন্তু অন্য কিছু তেমন পাবেন না। পাউরুটি, কেক, বিস্কুট পাবেন। তয় হেইগুলান সব বাসি হইবো।’
‘ফারহানা আপা, আমার অবস্থা খুবই খারাপ। আর তো হাঁটতে পারি না আপা।’
‘রিক্তা, তুমি একটা স্যালাইন গুলায়ে খাও। দেখো একটু ভালো লাগবে।’
বেলা বাড়ার সাথে সাথে সূর্যের তেজও বাড়তে থাকলো। আমরা সবাই মোটামুটি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। যতটা না হাঁটার কারণে, তার চেয়ে বেশি সূর্যের তেজের কারণে। হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে গ্রামের দেখা পেলাম। এই চড়ের মধ্যে দু’একটা ছড়ানো ছিটানো বাড়ি আছে। খড় দিয়ে তৈরি। চালটাও খড় দিয়ে তৈরি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এগুলো অস্থায়ী বাড়ি।
‘নাসির আলী, এই বাড়িগুলো কাদের? এত ছোট ছোট ঘর।’
‘এরা বর্ষা চলে গেলে এখানে ঘর বানায়। এই চরের মধ্যে এরা চাষাবাদ করে। মহিষ পোষে, গরু, ছাগল ও ভেড়া পোষে। আবার বর্ষার সময় গ্রামের ভেতরে যেয়ে কারো জমিতে ভাড়া নিয়ে ঘর তুলে থাকে।’
বাড়িগুলো দেখতে এত সুন্দর। ছোট ছোট ঘর। প্রায় সব বাড়িতে লাউ গাছের ডালপালা ঘরের চালে উঠে গেছে। ঘরের সাথেই শাক-সবজি লাগানো। মরিচ গাছে লম্বা লম্বা মরিচ ধরে আছে। বেগুন গাছে বেগুন ধরে আছে। একদিকে পুই শাকের জাংলা। শসা গাছের মাচায় শসা ঝুলে আছে। দেশি হাঁস-মুরগি বাড়ির আঙিনায় খেলা করছে। উঠানের একদিকে খাঁচার মধ্যে আটকানো মুরগির বাচ্চা।
এমনই একটা বাড়িতে ঢুকলাম আমরা। ঘরের মধ্যে নেই কোনো ফ্যান। তারপরও কী ঠান্ডা। বাড়ির মালিকের নাম সুরুজ মিঞা। তিনি মাঠে গরু নিয়ে গেছেন। তার স্ত্রী জয়নাব আমাদের দেখে তাড়াতাড়ি মুড়ি আর আখের গুড় দিলো খেতে। নাসির আলী জয়নাবের সাথে যেন কী বললো। জয়নাব আস্তে করে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। বলল, ‘ভাইজান চিন্তা করবেন না। যান, কাজ শেষ কইরা আসেন।’ আমাদের জয়নাব বিবি বললেন, ‘আপনেরা যাওনের সময় আমার বাড়িতে আইবেন। একটু জিড়াইয়া নিয়া তারপর রওয়ানা দিবেন।’ আমরা তাকে আচ্ছা বলে রওয়ানা দিলাম আবার।
আরেকটু গেলেই গ্রামের শুরু। একেবারে অজপাড়াগাঁও। গ্রামে ঢুকেই একটা টঙের দোকানে ঢুকলাম। একটু জিড়িয়ে নিতে হবে। তা না হলে কোনো কাজই করতে পারবো না। নাসির আলী আর রাসেল মিয়া ডাব জোগাড় করে আনলো। দোকানে কলা পেলাম। সাথে রং চা। এটা খেয়েই আবার হাঁটা শুরু। প্রায় পনেরো মিনিট হাঁটার পরে রূপদিয়া গ্রামে এসে পৌঁছালাম। এসআই তারেকের সাথে দেখা হলো। তিনি আমাদের ভিকটিমের শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে গেলেন। আমরা গিয়ে দেখি, বাড়িতে গ্রামের মাতুব্বররা হাজির। উৎসুক পাড়া-প্রতিবেশীর ভিড়। অনেক কথা কাটাকাটি, বিচার-সালিশ করতে করতে কখন যে সাড়ে তিনটা বেজে গেছে খেয়ালই করিনি। ভিকটিম আর ভিকটিমের বাবা, চাচা আর গ্রাম পুলিশ রাসেল মিয়া গেলেন এসআই তারেকের সাথে। থানায় কিছু ফরমালিটিজ শেষ করে তারা পরে রওয়ানা দেবেন। পরের দিন তারা আমাদের অফিসে আসবেন।
কাজ শেষ করে আমরা রওয়ানা দিলাম চারটার দিকে। তখনো সূর্যের প্রখর তেজ। গরম হাওয়া বইছে। এখনই যদি রওয়ানা না দিই, তাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। দিনের আলো থাকতে থাকতেই চর পাড়ি দিতে হবে। আমাদের পাঁচজনের পেটেই তখন প্রচুর ক্ষুধা। কী করবো? কোথাও কোনো হোটেল নেই। ভালো দোকান নেই যে কিছু কিনে খাবো। অন্যদের থেকে আমার ক্ষুধাটা বেশি লেগেছে। কত শখ করে রাতে খিচুড়ি রান্না করলাম কিন্তু খেতে পারলাম না। আমার মাঝে মাঝেই এ রকম হয়। শখ করে নানা রকম আইটেম করি কিন্তু খাওয়া হয় না। সজীব এমন সব কাণ্ড করে। শুধু শুধু রাগ করবে। আমার দোষটা কোথায় সেটাই খুঁজে পাই না।
আমরা গ্রামের শেষ মাথায় চলে এসেছি। সেই ছোট্ট ছোট্ট বাড়িগুলো দেখা যাচ্ছে। সুমাইয়া আর শামীম বলল, ‘আপা চলেন জয়নাবের বাড়িতে যাই। কিছু মুড়ি আর গুড় নিয়ে হাঁটা শুরু করি। পেটে তো অন্তত কিছু পড়ুক।’ রিক্তা বলল, ‘ঠিকই বলেছেন শামীম ভাই। চলেন সেটাই করি। অন্তত হাঁটার মতন শক্তি তো পাবো।’
সবাই গেলাম সুরুজ মিঞা আর জয়নাবের বাড়ি। দেখি সুরুজ মিঞা ঘরের দাওয়ায় বসে আছেন। আমাদের দেখে তো মহা খুশি। নাসির আলীকে বলে, ‘নাসির ভাই তাদের নিয়া আইচো, খুব খুশি হইচি ভাই। এই জয়নাব লেবুর শরবত দাও।’ আমরা লেবুর পাতা আর লেবু দিয়ে আখের গুড়ের শরবত খেলাম। তারপর যা দেখলাম তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। জয়নাব আমাদের জন্য মুরগির ডিম ভুনা, শুকনা মরিচের টকটকে লাল ঝোলে ছোট আলু দিয়ে দেশি মুরগি, পুই শাক ভাজি, কচি লাউ দিয়ে নদীর কুচো চিংড়ি, মলা মাছের চচ্চড়ি আর মাসকালাইয়ের ডাল রান্না করেছে। এ যে স্বর্গীয় খাবার। চোখে পানি চলে এলো। তানভীর বলেই ফেললো, ‘এত খাবার?’
সুরুজ মিঞা বলেন, ‘স্যার সৃষ্টিকর্তা আপনাদের আজ আমার বাড়ির মেহমান বানিয়ে পাঠায়েছেন। আমি যে কত্ত খুশি হইছি স্যার। জয়নাব তো সেই কহন থিইক্কা খালি কয়তাছে তারা কহন আইবো? সারাদিন না খাইয়া আছে। বারবার সে বাড়ির বাইরে গিয়া দেখতাছে আফনেরা আইচেন কি না।’
‘তাই বলে এত কিছু?’
‘ম্যাডাম আফা, আজগে আফনাগো রিজিক আছে আমার বাড়িতে। আপনাগোর রিজিকে আজগে এই সকল পদ লেখা আছে ম্যাডাম আফা। ধর্মে আছে, সবাই তার নির্ধারিত রিজিক পাবে।’
আমরা পেট ভরে খাওয়া-দাওয়া করে রওয়ানা দিলাম। সুরুজ মিঞা আর জয়নাবের আপ্যায়নে আমরা মুগ্ধ। কত সহজ-সরল মানুষগুলো। কত আন্তরিক। কী অসাধারণ গুণবতী জয়নাব। অল্প কিছু নিয়েই কত সুখী।
এসইউ/