ছোটগল্প
যুবতী ও চাওয়ালার প্রেম
বাসা থেকে বের হয়ে গেটের সামনে দাঁড়ায় পাখি। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে ডায়াল করে। ওপাশ থেকে সাবিত ফোন ধরে,
‘হ্যালো।’
‘কোথায় আপনি?’
‘তুমি কোথায়?’
‘বের হচ্ছি। কোথায় আসবো?’
‘কোনো চাইনিজে?’
‘না, আমি কোনো দামি খাবার খেতে আসছি না।’
‘ফাস্টফুডে?’
‘তা-ও না।’
‘তাহলে তুমিই বলো।’
‘রবীন্দ্র সরোবর।’
‘ওকে।’
কথা শেষ করে পাখি ফোনটা রাখে নিজের সাইড ব্যাগে।
পাখি একটি রিকশা ডেকে উঠে বসে। রিকশাওয়ালাকে বলে,
‘মামা যান।’
‘মামণি কই যাইবেন?’
‘রবীন্দ্র সরোবর।’
‘রবীন্দ্রনাথ তো বাঁইচা নাই। তারে পামু কই? যটটুক জানি হের বাড়ি কলকাতায়।’
‘উফ। ধানমন্ডি লেক।’
‘ওহ। চলেন।’
রিকশাওয়ালার ওপর কিছুটা বিরক্ত হয় পাখি। রবীন্দ্রনাথকে চেনে অথচ রবীন্দ্র সরোবর চেনে না। ধানমন্ডি লেক আবার ঠিকই চেনে। একা একাই বলতে থাকে কথাগুলো।
একটু এগিয়ে গিয়ে রিকশাওয়ালা আবার জানতে চায়,
‘মামণি, ওই লেকটা কি তার বাপ-দাদার?’
‘কার?’
‘একটু আগে যার নাম কইলেন।’
‘অসহ্য। এত কথা বলেন কেন? আপনার কাজ আপনি করেন।’
‘ওহ। সরি। বুঝছি। আদার ব্যাপারির কাজ কি জাহাজের খোঁজ নেওয়ার।’
অন্য সময় হলে হয়তো রিকশাওয়ালার সঙ্গে গল্প করতো পাখি। বরাবর সেটাই করে। আজ গল্পটা জমেও উঠতো। মজার কথাই বলছিল রিকশাওয়ালা। কিন্তু আজ গল্পের মুড নেই পাখির। মেজাজ খারাপ হয়ে আছে নানা কারণে।
পাখির ফোনে রিং বেজে ওঠে। স্ক্রিনে তাকিয়ে ভ্রূ কোচকায়। এ সময় আবার সালুর ফোন কেন?
‘হ্যাঁ, বলো।’
‘তুমি কোথায়?’
‘যাচ্ছি।’
‘কোথায় যাচ্ছ?’
‘জাহান্নামে।’
‘আমিও যাবো।’
‘সালু, সব সময় ফাজলামি ভালো লাগে না।’
‘জানি তো। কী করবো বলো?’
‘এখন ফোন রাখো, এসে সব বলবো।’
সালু ফোন রেখে দেয়। পাখি আনমনা হয়ে ওঠে। তার দৃষ্টি উদাস। মনে মনে ভাবে, ফেসবুকের কল্যাণে পরিচয় সালুর সাথে। ক্যাম্পাসের মাঠে বসে প্রথম চ্যাটিং হয়। তখন সালুর একটি স্ট্যাটাস ভালো লাগে পাখির।
সেই থেকে স্ট্যাটাসের কমেন্টসে দু’জনের চরম ঝগড়া চলতে থাকে। তবে ঝগড়া চললেও সালুকে দেখতে ইচ্ছে হয় পাখির। তাই একদিন ইনবক্সে গিয়ে ফোন নাম্বার চায়। সালুও দিয়ে দেয়।
‘হ্যালো, কে বলছেন?’
‘শুকতারা।’
‘ওহ। কেবল যে ফোন নাম্বার নিলেন?’
‘হুম। আপনি কী করেন?’
‘কিছু না। তবে এখন বাইরে। দুপুর হয়েছে। এক কাপ দুধ চায়ের সঙ্গে একটা বাটারবন খাবো বলে বের হয়েছি।’
‘ইন্টারেস্টিং। লাঞ্চ করবেন না?’
‘লাঞ্চ বলতে আপনি কী বোঝেন?’
‘মানে?’
‘আমি এখন যা খাবো, তা-ই আমার লাঞ্চ।’
‘সরি।’
‘না না, সরি বলার কিছু নেই। আমি শিক্ষিত বেকার। চাকরির জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি। মাসেরও শেষের দিক। ফলে পকেটটা গড়ের মাঠ।’
‘আপনার অকপট স্বীকারোক্তি আমাকে মুগ্ধ করেছে।’
‘ধন্যবাদ। এবার তাহলে রাখি? দুধ চা ঠান্ডা হয়ে যাবে।’
ভাবতে ভাবতে পাখির পথ ফুরিয়ে যায়। রিকশা এসে পার্কের গেটে থামে। রিকশাওয়ালা বলে,
‘মামণি নামেন।’
‘ও হ্যাঁ। এই নিন ভাড়া।’
ভাড়া দিয়ে সামনে এগিয়ে যায় পাখি।
পার্কের গেট দিয়ে ঢুকে রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাবার কথা মনে পড়ে। পাখির বিয়ের প্রস্তাব যখন আসে; বাবা ডাকেন তার রুমে। মা-ও পাশে বসা ছিলেন।
বাবা বলেন, ‘তুমি কি কাউকে পছন্দ করো?’
‘এ কথা বলছ কেন বাবা?’ পাখি বলে বাবাকে উদ্দেশ্য করে।
লোপার মা এর মধ্যে বলে উঠলেন, ‘তোমার জন্য একটা প্রস্তাব আসছে।’
‘আমার?’ অবাক বিস্ময়ে জানতে চায় পাখি।
এবার কিছুটা ক্রুদ্ধস্বর বাবার, ‘তো কি এ বয়সে তোমার মায়ের জন্য আসবে?’
পাখিও অবাক, ‘বাবা, তুমি না!’
মা খুব সিরিয়াসলি বললেন, ‘রাখো তো তোমার ইয়ার্কি। একটা সিরিয়াস কথার মধ্যেও মজা করো।’
পাখি বলল, ‘শোন তোমরা, পছন্দ আছে কি নেই এ মুহূর্তে বলতে পারছি না। আমাকে সময় দিতে হবে।’
বাবাও জানিয়ে দিলেন, ‘সময় নষ্ট করার মতো সময় নেই হাতে। ছেলেপক্ষ কাল দেখতে আসবে।’
পাখি বলল, ‘বললেই হলো? আমাকেও তো বুঝতে হবে। তার ফোন নাম্বার দাও। আমি আগে কথা বলে দেখি।’
মা পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘তোমার অন্য কোনো পছন্দ থাকলে বলো। আমরা ভেবে দেখি।’
পাখি ইতস্তত করতে করতে বলল, ‘বলার মতো সময় হয়নি এখনো। আগে ওনার সঙ্গে কথা বলি।’
বাবা বললেন, ‘তোমার মায়ের কাছে নাম্বার আছে, নিয়ে নিয়ো। কথা বলে দেখ।’
নীল রঙের শার্ট এবং কালো প্যান্ট পরা একজনকে বেঞ্চে বসা দেখে থমকে দাঁড়ায় পাখি। ফোন করে সাবিতকে।
‘হ্যালো।’
‘হ্যাঁ, বলো।’
‘এসেছেন আপনি?’
‘হ্যাঁ, তুমি?’
‘হুম। কোথায় আছেন?’
‘কর্নারের একটি বেঞ্চে। রাতে যে পোশাকের কথা বলেছিলাম।’
‘হ্যাঁ, মনে আছে।’
বিবরণ অনুযায়ী সাবিতকে কোনার একটি বেঞ্চে বসা দেখে এগিয়ে যায় পাখি।
‘আপনি সাবিত?’
‘হুম। তুমি পাখি? তোমার ছবি আমি আগেই দেখেছি।’
‘তাই নাকি। গুড জব।’
‘হঠাৎ এখানে তলব কেন? রাতে তো কিছুই বললে না।’
‘সেজন্যই এখানে ডেকেছি। আপনি কাউকে ভালোবাসেন?’
‘না, বাসলে তো তাকেই বিয়ে করতাম। তাহলে আর তোমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতাম না।’
‘কেন?’
‘যাকে ভালোবাসবো তাকেই তো বিয়ে করা উচিত।’
‘ঠিক বলেছেন। কিন্তু আমি তো একজনকে ভালোবসি। তো আমার কী করা উচিত?’
‘তাকেই বিয়ে করা উচিত।’
‘সেটা বলার জন্যই ডেকেছি।’
‘বাবা-মাকে বলেছো?’
‘কীভাবে বলবো? ও তো এখনো বেকার।’
‘ওহ, তোমার তাহলে সকার দেখে একজনকে পছন্দ করা উচিত ছিল।’
‘দেখুন, আপনি বিজনেসম্যান। সারাজীবন টাকার পেছনে ছুটেছেন। ভালোবাসার সময়ও হয়তো পাননি। তাই একটা মেয়েকে দেখে পছন্দ হলো। প্রস্তাব পাঠালেন। মেয়ের বাবা-মা জোর করে আপনার হাতে তুলে দিলো। ফলশ্রুতিতে কী হলো? মেয়েটাকে সারাজীবন ভালোবাসা হারানোর কষ্ট বুকে নিয়ে অন্যের সংসারে সুখী হওয়ার অভিনয় করতে হলো।’
‘দেখো, এখানে আমার কী করার আছে? ঠিক আছে, তুমি যখন নিজে এসে বললে, আমি আর আগাবো না। তবে একটা অনুরোধ।’
‘কী? বলেন।’
‘আমি কি তোমার ভালোবাসার মানুষটাকে কোনোভাবে হেল্প করতে পারি?’
‘সেটা ওর সঙ্গে কথা না বলে জানাতে পারছি না।’
‘সে যাকগে। চলো একটু কফি-টফি খাই।’
‘না, কোনো কফিশপে বসবো না। (এদিক-ওদিক তাকিয়ে) ওই যে এক চাওয়ালা যাচ্ছে। ডাক দিন তাকে।’
‘কী বলো? ওই পার্কের চা খাবো আমরা?’
‘কেন নয়? কী সমস্যা? উনি তো জীবিকা নির্বাহের জন্যই বিক্রি করছেন, নাকি?’
‘ঠিক আছে। (ঘাড়টা একটু ঘুরিয়ে) এই চাওয়ালা। এদিকে আসেন।’
চাওয়ালা ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। মুখের অর্ধেকটা গামছা দিয়ে আড়াল করা। এসে ফ্লাস্কটা রেখে কাপ ধুয়ে চা দিতে গেলে মুখের গামছাটা সরে যায়।
পাখি ও সাবিত সমস্বরে বলে ওঠে, ‘সালু, তুমি...’
‘হ্যাঁ, আমি। অবাক হয়েছো তোমরা?’ বলে সালু।
সাবিত বলে, ‘এসবের মানে কী?’
‘মানে আবার কী? আমি চাওয়ালা। দেখতেই পাচ্ছো।’
‘মজা করো না সালু। অন্তত আমার সঙ্গে।’
ওদের দু’জনের কথার মাঝে এবার পাখি বলে, ‘কী, হচ্ছে কি এসব? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনারা একে অপরকে চেনেন?’
সাবিত বলে, ‘আমি বলছি শোনো...’
সালু অনুনয় করে, ‘প্লিজ সাবিত।’
পাখি রেগে যায়, ‘সালু, তুমি কোনো কথা বলবে না।’
সাবিত বলতে থাকে, ‘সালু বাবা-মার একমাত্র সন্তান। ছোটবেলা থেকেই একরোখা, বাউণ্ডুলে। লেখালেখি করতে ভালোবাসে। চারুকলা থেকে পড়াশোনা শেষ করে আঁকাআঁকি নিয়েই আছে। টাকা-পয়সার অভাব না থাকলেও সাদাসিধা জীবনযাপন করে।’
পাখি অবাক হয়, ‘তা-ই বলে চাওয়ালা?’
সালু বলে, ‘তুমি কৃষ্ণ সারথির ‘যুবতী ও চাওয়ালা’ গল্পটি পড়েছো?’
পাখি বলে, ‘হুম। পড়েছি তো। কী হয়েছে?’
সালু বলে, ‘আমিই কৃষ্ণ সারথি। আমি বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে গল্পের প্লট খুঁজি। তুমি আমাকে যতদিন যেভাবে দেখেছো, সবই আমার গল্পের চরিত্র। তবে তোমাকে ভালোবাসি এটা সত্য। কিন্তু সাবিত তোমাকে বিয়ে করতে চায়?’
পাখি বলে, ‘হ্যাঁ, উনিই তো প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। আমি তোমাকে ওনার কথাই বলেছি।’
সালু হাসতে হাসতে বলে, ‘সাবিত আমার ছোটবেলার বন্ধু। বিভিন্ন পেক্ষাপটের কারণে আমরা আপাতত বিচ্ছিন্ন। এখন সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত।’
সাবিত এবার মুখ খোলে, ‘পাখিকে ধন্যবাদ। আজকের এই মহামিলনের জন্য।’
সালু বলে, ‘বন্ধু বিচ্ছেদের সুর তো বাজতে শুরু করলো।’
সাবিত বলে, ‘মানে?’
সালু বলে, ‘আমি কি আমার বন্ধুর জন্য ভালোবাসা বিসর্জন দিতে পারি না?’
সাবিত রেগে যায়, ‘আর কোনো নাটক নয়। আর কোনো কাল্পনিক গল্প নয়। এবার বাস্তব জীবনের গল্প লেখ।’
পাখি অভিমানের সুরে বলে, ‘না, ওকে আমি বিয়ে করতে পারবো না। ও আমাকে ঠকিয়েছে। গরিব সেজে আমার ভালোবাসা পরীক্ষা করেছে। ও একটা প্রতারক।’
সালু বলে, ‘সরি, আর হবে না। তবে মাঝে মাঝে পাগল সাজতে পারি। ওই চরিত্রটা বিয়ের পরে করবো ভাবছি।’
পাখি বলে, ‘ইয়েস, গুড বয়। তুমি আগেও যেমন ছিলে, তেমনই থাকবে। কারণ আমি ওই সালুকেই ভালোবেসেছি। কোনো বিখ্যাত লেখক বা চিত্রশিল্পীকে নয়।’
সাবিত বলে, ‘জয় ভালোবাসার জয়, আমি তবে চোখের জলে নেই বিদায়। ভালো থাকিস বন্ধু। সুখে থাকিস তোরা।’
সালু বলে, ‘আমরা কি হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছে দেব?’
সাবিত বলে, ‘মানে? আমি কি রোগী?’
পাখি বলে, ‘না, মানে সিনেমার শেষ দৃশ্যে এমনটা হয় না?’
সাবিত বলে, ‘এটা বাংলা সিনেমা নয়? সুতরাং এমন দৃশ্যের অবতারণা হওয়ারও সম্ভাবনা আপাতত নেই।’
সমস্বরে হেসে উঠলো সবাই। পাখি আর সালু আরও একটু কাছে, শরীরে শরীর ঘেঁষে। নীরবে বয়ে যায় উষ্ণতার বাতাস। সাবিত হেঁটে চলে আপন পথে।
এসইউ/এমএস