ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

পর্ব- দুই

সমুদ্র দর্শন: পাঠে ও ভ্রমণে

জাগো নিউজ ডেস্ক | প্রকাশিত: ০২:০৫ পিএম, ১৭ এপ্রিল ২০২৪

আমিনুল ইসলাম

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সমুদ্রকে পৃথিবীর মেখলা বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি পৃথিবীর পানে চেয়ে বলে উঠেছেন, ‘ইচ্ছা করিয়াছে/সবলে আঁকড়ি ধরি এ বক্ষের কাছে/ সমুদ্রমেখলা-পরা তব কটিদেশ।’ রবীন্দ্রনাথের ‘সমুদ্রের প্রতি’ একটি উল্লেখেযোগ্য কবিতা। রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীকে সমুদ্রের কন্যা জ্ঞান করেছেন এবং একইসাথে সমুদ্রকে প্রাণীর ও প্রাণের মাতামহী বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি সমুদ্রের প্রতি সেই ‘আঁতুড়-আত্মীয়তা’ অনুভব করছেন গভীরভাবে-নিবিড়ভাবে। তিনি সমুদ্রের সেই ‘স্নেহময়ী’ রূপ তুলে ধরেছেন একইসাথে তুলে ধরেছেন তার চিত্ত বিক্ষুব্ধ হলে যে-ভয়ংকর-উন্মাতাল চেহারা সে ধারণ করে জোয়ারে-তরঙ্গে-জলোচ্ছ্বাসে, সেই রূপ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট এই যে পার্থিব সমুদ্রের সমান্তরালে মানবহৃদয়সমুদ্র কল্পনা করেছেন। মানুষের হৃদয় সংকীর্ণ ভাবনায় সীমায়িত হয়ে গেলে সৃষ্টি হয় নানা অনর্থ-ঝগড়া-বিবাদ-যুদ্ধ-সাম্প্রদায়িক হানাহানি ইত্যাদি। আবার মানুষের হৃদয়টা বড় হলে সেখানে বিশ্বের সব সৃষ্টির মহামিলন ক্ষেত্র গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বমানবতার কবি হিসেবে মানব হৃদয়ের সমুদ্র সমান প্রসার কল্পনা ও কামনা করেছেন।
‘আমার চিত্তের মাঝে তেমনি অজ্ঞাতব্যথা-ভরে
তেমনি অচেনা প্রত্যাশায়, অলক্ষ্য-সূদুর তরে
উঠিছে মর্মরস্বর। মানবহৃদয়সিন্ধুতলে
যেন নবমহাদেশ সৃজন হতেছে পলে পলে,
আপনি সে নাহি জানে। শুধু অর্ধ-অনুভব তারি
ব্যাকুল করেছে তারে; মনে তার দিয়াছে সঞ্চারি
আকারপ্রকারহীন তৃপ্তিহীন এক মহা আশা
প্রমাণের অগোচর, প্রত্যক্ষের বাহিরেতে আসা।’

জীবনানন্দ দাশ জীবনের শুরুতেই সমুদ্রকে নিয়ে ‘সিন্ধু’ নামে কবিতা লিখেছেন। সেটি হচ্ছে সমুদ্রের সঙ্গে বেদনা বিনিময়, যা অনেকটাই নজরুলের ‘সিন্ধু হিন্দোল’ কবিতার ভাবানুসারী। ফররুখ আহমদের ‘সাতসাগরের মাঝি’ একটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ, যেখানে তিনি জাতির অপরিমেয় দুরাবস্থা ও পরাধীনতাকে অকূল সাগরে প্রতীকায়িত করে নেতৃত্ব মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন জাতির বিপদ এবং সেটা থেকে উদ্ধার পেতে কর্ণধারের কর্তব্যের কথা। ফররুখ আহমদের ওজস্বী ভাষার গুণে এবং অভূতপূর্ব সুন্দর চিত্রকল্প-কল্পচিত্রের সমাহারে তা হয়ে উঠেছে শৈল্পিক সৌন্দর্যে এবং রোমাঞ্চে পরিপূর্ণ নান্দনিক সৃষ্টির সমুদ্র। এই কাব্যগ্রন্থের ‘পাঞ্জেরী’ নামের কবিতায় প্রতীকী সমুদ্রের ভয়াহ ছবি বর্ণিত হয়েছে, যা বাস্তব সমুদ্রের অনুরূপ।
‘দীঘল রাতের শ্রান্ত সফর শেষে
কোন্ দরিয়ার কালো দিগন্তে আমরা পড়েছি এসে?
এ কি ঘন-সিয়া জিন্দেগানির বাব
তোলে মর্সিয়া ব্যথিত দিলের তুফান-শ্রান্ত খাব?
অস্ফুট হয়ে ক্রমে ডুবে যায় জীবনের জয়ভেরী।
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
সম্মুখে শুধু অসীম কুয়াশা হেরি।’

উপন্যাসে-কবিতায়-ছোটগল্পে অতঃপর আমরা আরও অনেক ছবি দেখেছি সমুদ্রের। আমরা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে জলোচ্ছ্বাসে উন্মত্ত সমুদ্রের সেই রূপের চাক্ষুস অবস্থার বর্ণনা শুনেছি। অসাধারণ সমুদ্রের সেই ছবি। তেমনই ভাবে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সী’ সমুদ্র-প্রচ্ছদনির্ভর একটি বিশ্বখ্যাত উপন্যাস। এটি সিনেমা হিসেবেও দেখেছি। এটি অসাধারণ একটি সৃষ্টি। কিন্তু সেখানে সমুদ্র মুখ্য চরিত্র নয়। স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের ‘বুড়ো নাবিকের উপকথা’ নামক দীর্ঘায়তন কবিতার প্রচ্ছদ-ভূগোল সমুদ্র। পার্সি বিসী শেলীর ‘সিন্ধুর তীরে বিষণ্ন হৃদয়ের গান’ এবং ম্যাথু আর্নল্ডের ‘ডোভার সমুদ্রসৈকত’ সমুদ্রকেন্দ্রিক উল্লেখযোগ্য কবিতা। ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সী’ উপন্যাসে এবং ‘দি রাইম অব দি অ্যানসিয়েন্ট ম্যারিনার’ কবিতায় সমুদ্র-অভিযান এবং সমুদ্রের জীবন্ত বর্ণনা ফুটে উঠেছে। ‘সিন্ধুর তীরে বিষণ্ন হৃদয়ের গান’ কবিতায় সমুদ্রের সাধারণ বাহ্যিক বর্ণনার সাথে মানুষের মনোবেদনার ছবি চিত্রিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতাটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। সেখানে সমুদ্রের ছবিটি এরকম:
‘আমি দেখিতেছি চেয়ে সমুদ্রের জলে
শৈবাল বিচিত্রবর্ণ ভাসে দলেদলে।
আমি দেখিতেছি চেয়ে,
উপকূল-পানে ধেয়ে
মুঠিমুঠি তারাবৃষ্টি করে ঢেউগুলি।
বিরলে বালুকাতীরে
একা বসে রয়েছি রে
চারিদিকে চমকিছে জলের বিজুলি।
তালে তালে ঢেউগুলি করিছে উত্থান-
তাই হতে উঠিতেছে কী একটি তান।’

কোলরিজের বিখ্যাত ‘দি রাইম অব দি অ্যানসিয়েন্ট ম্যারিনার’ কবিতার সমুদ্রে জাহাজ বাওয়া এবং সকল প্রকার ঝড়ঝঞ্ঝা ও সামুদ্রিক বিপদ-আপদে পতিত হওয়ার কাহিনিতে ভরপুর, যদিও কবিতাটিতে কবি সমুদ্রের ও সমুদ্র-অভিযানের রূপকের আড়ালে মানবজীবনে প্রেম-ভালোবাসা-জীবে দয়া-ধর্মবিশ্বাস এসব বিষয়কে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। তবে এটাও সত্য যে, কবিতাটি সমুদ্রের মতো বিশাল ব্যাপ্তি, গভীরতা ও ভয়ংকর রোমাঞ্চে পরিপূর্ণ। আমরা জানি, সমুদ্রের নানা রূপ আছে। সমুদ্র বর্ষায় দুরন্ত যৌবনা, ঝড়ে বা সাইক্লোনে বিধ্বংসী ও ভয়ংকরী, চাঁদনী রাতে মাতাল নৃত্যে উন্মাতাল। জোয়ারের সময় মাতালের ক্ষুধার মতো সর্বগ্রাসী তার চাহিদা আর ভাটার সময় কিছুটা উজাড়, কিছুটা পরিশ্রান্ত। সমুদ্রের আরেকটি রূপ আছে-তুষারাচ্ছন্ন বরফাবৃত সমুদ্র। এটির সাথে আমরা এশিয়াবাসী খুব বেশি পরিচিত নই; কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য গোলার্ধে বছরের একটা সময় সমুদ্র থাকে বরফে আবৃত। এটি রাত্রে যেমন ভয়ংকর, তেমনই দিনের বেলা এর ওপর সূর্যের আলো পড়লে তা মনোহর রূপ ধারণ করে। স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের ‘দি রাইম অব দি অ্যানসিয়েন্ট ম্যারিনার’ কবিতায় সমুদ্রের বরফাচ্ছন্ন রূপটি দেখতে পাওয়া যায়। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত কবিতাটির চমৎকার অনুবাদ করেছেন।
‘আর এইবারে ঘনাল কুহেলি, তুয়ারসম্প্রপাত,
হিমানীর নিভাননী
মাস্তুল-ঊঁচু পুঞ্জ বরফ ধেয়ে এলো ভেসে, আর তার সব
সবুজ সবুজ, বুঝি মরকত-মণি।
আর সেই মতো ঝঞ্ঝা-তাড়িত তুষার সঞ্চারিত
আভাহীন আভা, পাংশু, বিধুর, ফিকে—
না কোনো মানুষ দেখি, পরন্তু, পরিচিতি কোনো একটা জন্তু
দেখতে পাই না, বরফ চতুর্দিকে।’

আরও পড়ুন

সমুদ্রের আরেকটি ভয়ংকর বৈশিষ্ট্য এই যে, সে অনিঃশেষ জলের অতল অথচ পিপাসার পানি প্রদানে অক্ষম। সমুদ্রের পানি অত্যন্ত লোনা হওয়ায় তা পানের অযোগ্য হেতু সমুদ্রে পিপাসা পেলে এবং সঙ্গে সুপেয় পানি না থাকলে অকালমৃত্যু অবধারিত। কোলরিজের এই কবিতায় তেমন ভয়ংকর অবস্থায় পতিত হওয়ার ছবিও রয়েছে।
‘জল শুধু যেদিকে তাকাও জল
পাটাতন কেঁপে জড়োসড়ো হয়ে ওঠে,
জল ধূ-ধূ জল যেদিকে তাকাও জল,
যদি এক ফোঁটা তৃষ্ণার জল ফোটে!’

এ সময়ের কবি কামাল চৌধুরী সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে তার প্রাকৃতিক রূপ-সৌন্দর্য দেখেছেন এবং একইসাথে বিশাল সমুদ্রের উঠোনে খুঁজে পেয়েছেন মনের মুক্তি। সমুদ্রের ক্ষুব্ধ গর্জন, বিশাল সৈকত, জেলে বালকের মাছধরার দৃশ্য, কাঁকড়ার ছোটাছুটি, নারকেল বীথির শোভা, জেলে নৌকা, ইতস্তত ছড়ানো মানুষের দল, সূর্যাস্তের শোভা ইত্যাদি দেখে মুগ্ধ হয়েছেন তিনি। তাঁর সবচেয়ে ভালো লেগেছে সমুদ্রসৈকতে পাওয়া একধরনের মুক্তির স্বাদ।
‘এই দৃশ্যে নিজেকে লুকাতে আসে ঝাউ
আর সুপারির সারি
নৈঃসঙ্গ ছাপিয়ে ওঠে ভেতরের তীব্র কোলাহল
সমুদ্রে বেড়ানো সব মানুষের খিস্তি থেকে দূরে
হৈ হুল্লোড়হীন এক শান্ত অনুভব
মিশে যায় ভেজা বালি, নগ্ন পদতলে...
(ইনানী/ কামাল চৌধুরী)

আমি নিজেও ইনানী বীচ দেখেছি; সেই অনন্যসুন্দর দৃশ্য উপভোগ করেছি এবং তা নিয়ে ‘ইনানী বীচ’ শিরোনামে একটি ছোট আকৃতির কবিতা লিখেছি। ইনানী বীচে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছে, সেটা প্রাণের রিফুয়েলিং স্টেশন।
‘শূন্য হতে থাকা ট্যাংকি নিয়ে যাই
কী দিন কী রাত
দেখি—
খোলা আছে ফিলিং স্টেশন
পদ্মা কিংবা মেঘনা নয়,
মেরিন ড্রাইভ রোড ঘেঁষে
রিফুয়েলিং পাম্প;’

আমি নিজে দেশ-বিদেশে কয়েকটি সমুদ্র দেখেছি। কিন্তু যাকে বলে গভীর সমুদ্রযাত্রা, সেটি আজও হয়ে ওঠেনি। আমি মূলত সৈকতে দাঁড়িয়ে সমুদ্রকে দেখেছি চেয়ে চেয়ে; তার জলে নেমে ভয়ে ভয়ে গা ভিজিয়েছি লোনাজলে। জীবনসঙ্গী লীনাকে সঙ্গে নিয়ে আমি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের জলে নেমেছি, তার ঢেউয়ের দোলা উপভোগ করেছি, তার সাদা ফেনার শরীর ধুয়েছি, গভীরচারী গর্জনে প্রাণের ভেতরে আলোড়ন অনুভব করেছি, তার মুক্ত বাতাসে স্বাধীনতার সংজ্ঞা পাঠ করেছি। সমুদ্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তার সাথে নৃত্য করে, তার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে, তার লোনা শরীরে নিজের লোনা শরীর মিশিয়ে মনে হয়েছে প্রাণের উৎস সমুদ্র, প্রাণের ঐশ্বর্য সমুদ্র, প্রাণের ভান্ডার সমুদ্র, প্রাণের শুশ্রূষা সমুদ্র, প্রাণ গাড়ির অন্তিম স্টেশন সমুদ্র। এত আনন্দ, এত উন্মাদনা, এত ক্ষোভ, এত শান্তি, এত হাহাকার, এত তৃপ্তি, এত পাওয়া, এত শূন্যতা, এত জল, জলাভাব আর কোথাও নেই। সমুদ্রের কাছে গেলে খুলে যায় সব বাঁধন ও শৃঙ্খল, ঘুচে যায় যত ব্যবধান ও বৈরিতা, দূর হয়ে যায় যত ক্ষুদ্রতা ও তুচ্ছতা। সমুদ্র মানে শুধু প্রাণ, শুধু নৃত্য, শুধু সংগীত, শুধু জেগে থাকা। আমি সমুদ্রকে গভীরভাবে দেখে, তার সাথে পথ চলে এবং তার সাথে কথা বলে জীবনের সবচেয়ে গভীর আনন্দের সন্ধান ও স্বাদ পেয়েছি। আমার সেই অনন্য অনুভব ও অভিজ্ঞতা ভাষা পেতে চেয়েছে দীর্ঘ কবিতায়। ‘ভালোবাসার শুটিং স্পট’ নামক সেই দীর্ঘ কবিতার শেষাংশ পাঠ করা যায়:
‘আমার আনারকলি অভিসার দেখে
হাততালি দেয় হাঙর কুমির
ডিগবাজি দেয় ডলফিন
নেচে নেচে ধামাইল গায়—
সারিবদ্ধ সখি সখি ঢেউ;
আর মাঝে মাঝে মন ধুয়ে দেয়—
প্রকৃতির লরা মার্সিয়ার—
হাওয়ার ঘ্রাণ ঢেউয়ের ফেনা।
আহা! উপচে উঠেছে প্রাণ!
আমি উচ্ছলিত! আমি নবায়িত!’

চলবে...

প্রথম পর্ব পড়ুন

এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন