ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণুর গল্প

স্বপ্নের জমিন

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু | প্রকাশিত: ০৩:৫৭ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২৪

তখন অনেক রাত। কিছুতেই ঘুম আসছিল না শুভরাংশুর। এপাশ-ওপাশ করতে করতে বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত বিছানা ছেড়ে সামনে বসার ঘরে বইয়ের তাকের মধ্যে আশ্রয় খুঁজল। না, তাকগুলো তাকে নিরাশ করেনি। পাবলো নেরুদা তার নজর কাড়ল। নেরুদার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইটি সে হাত বাড়িয়ে নিয়ে শরীরটা সোফায় ছেড়ে দিল। নেরুদা শুভরাংশুর প্রিয় কবিদের একজন। নির্দিষ্ট করে নয়, এমনিই বইটির মধ্যভাগ মেলে চোখে পড়ে নেরুদার সেই ‘আমার পেছনে হিংস্রতার ছায়ায়’ তার প্রিয় কবিতার একটি। এ কবিতাটি শুভরাংশুর বহুলপঠিত।

আমার পেছনে হিংস্রতার ছায়ায় কবিতার ‘ঈর্ষাকে ক্লান্ত, পরাস্ত করে আমার তাবৎ গান,/হিংসার নাবিকেরা একে একে ঢলে পড়ে নিদারুণ বেদনায়।/আমি যখন উচ্চারণ করি ভালোবাসার নাম, আকাশ জুড়ে পারাবত ওড়ে,/প্রতিটি স্তবক আমার, জাগায় বসন্তের কলি।/আর তুমি উন্মীল হও আমার হৃদয়ে/স্বর্গীয় পাতার মতো তোমাকে দেখি,/কেমন করে তুমি শুয়ে থাকো মৃত্তিকায়…’ মধ্যাংশের এ পঙ্ক্তিগুলো শুভরাংশুকে নতুন করে টেনে নিল।

পাবলো নেরুদার শ্রেষ্ঠ কবিতার পাতায় পাতায় চোখ বোলাতে বোলাতে শুভরাংশু কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে। অনিন্দিতার হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। পাশে শুভরাংশুকে দেখতে না পেয়ে অনুমান করে নেয় শুভরাংশুর বিনিদ্ররাতের ঠিকানা। নিজেই নিজেকে আশ্বস্ত করল এই ভেবে, বইয়ের কাছে আছে শুভরাংশু। তার স্বামীকে সে জানে-চেনে। শুভরাংশু তার কাছে বহুলপঠিত বইয়ের মতো। সে এগিয়ে যায় সামনের ঘরের দিকে। অনেক দিনের মতো একই অবস্থায় শুভরাংশুকে সোফায় দেখে ঘুম না ভাঙিয়ে ওর গায়ে একটি চাদর জড়িয়ে দিয়ে পাশের সোফায় বসে তাকে অপলক দেখতে থেকে। হঠাৎ শুভরাংশু জেগে যায় বারান্দায় তাদের পোষা বেড়ালটার লাফ দিয়ে পড়ার শব্দে। শুভরাংশু চোখ মেলেই বলে, ‘ওমা! তুমি বসে আছো; ডাকলে না কেন?’

অনিন্দিতা বলল, ‘কতদিন তোমার ঘুম দেখি না, তাই তোমার ঘুম দেখছিলাম। একসময় তোমার ঘুম দেখার জন্যই তো জেগে থেকেছি। তুমি শিশুর মতো বেঘোরে ঘুমাতে, আজ ওরকমই ঘুমাচ্ছিলে। খুব মায়া হচ্ছিল। কত রাত তোমার এভাবে কেটেছে আমি তো দেখেছি। কিন্তু আজকের মতো এত কাতর হয়ে এর আগে কখনও দেখিনি। তোমার দুঃখের ভেতর আনন্দের অনর্গল কথা বলাও তো অতিক্রান্ত দুই যুগে কম অনুভব করিনি। কখনও কখনও আমার মনে হয় তোমার মতো যদি সর্বংসহা হতে পারতাম!’ একটানে কথাগুলো বলে অনিন্দিতা থেমে যায়। মধ্যম গতিতে দেয়ালপাখাটি ঘুরছিল। পাখাটির ঘূর্ণন দুজনেরই নজর কাড়ে এবং তাদের যুগলভাবনার দিগন্ত খুলে দেয়।
বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা ভেঙে শুভরাংশু অনিন্দিতার একটি হাত টেনে নিয়ে তার মুঠোবন্দি করে। অনিন্দিতা ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে। রাত্রিকালীন অবিন্যস্ত মেহেদি রঙের অনিন্দিতার চুলগুলো দেয়ালপাখার বাতাসের ঝাপটায় শুভরাংশুর মুখে যেন তুলির মতো আঁচড় কাটতে থাকে। অনিন্দিতাও খুব উপভোগ করে। মাঝে মাঝে আঙুলের আলতো স্পর্শে সে নিজেই তার চুলগুলো সরালেও এর স্থায়িত্ব মেলে না।
শুভরাংশু অনিন্দিতার চুলের ফাঁকে ফাঁকে চোখে চোখ রেখে বলে, ‘আচ্ছা, তুমি কি সময়কে জন্মাতে দেখেছো?’
বিলম্ব না করে অনিন্দিতার ঝটপট উত্তর, ‘কতবার, এর হিসাব মেলানো ভার। যতবার তোমাকে আবিষ্কার করি ততবারই সময়কে জন্মাতে দেখি। বহুবার আমার এও মনে হয়েছে, এ যেন অসীমের মাঝে সীমানা খুঁজতে যাওয়া। আমি ভাবিনি এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হব। এ যে ছিল আমার একান্ত গোপন আনন্দ। এ আনন্দের মহাসমুদ্র দর্শন আমার সঞ্চিত সুখভান্ডার, যা ক্রমাগত স্ফীত হয়েছে; আর আমাকে করেছে মুকুটহীন রানী।’
কথা লুফে নেয় শুভরাংশু। থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘থাক অনিন্দিতা, থাক। এ তোমার নিজস্ব সঞ্চয় হয়েই থাক। কিছু কিছু বিষয় আছে কাউকে এর অংশীদার করা একেবারেই ঠিক নয়। তাতে আনন্দ বা সুখানুভূতির ঔজ্জ্বল্য হারায় কিংবা ক্ষয়ে যায়। জানো অনিন্দিতা, আমার কখনও কখনও এও মনে হয় জীবনে কোনো না কোনোভাবে টাকা জমানো যায় কিন্তু সুখানুভূতির ভান্ডার ইচ্ছা করলেই কারও জীবনে গড়ে ওঠে না। তুমি তো আমার ডাক্তার বন্ধু আফসানকে দেখেছ।

অবশ্য তখনও তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক সেভাবে গড়ে ওঠেনি। আমাদের বিয়ের আগেই সে সিডনি চলে গেল। সুহানার সঙ্গে তার সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত পরিণতির দিকে না যাওয়ায় আফসান জীবনের বাঁক বদলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমি তো বটেই আমাদের অন্তপ্রাণ বন্ধু সানন্দ, জায়ানও আফসানের সিদ্ধান্ত বদলের চেষ্টা কম করেনি। কিন্তু আমরা পারিনি ওকে দেশে রাখতে।

আমরা যাতে তার যাওয়ার পথে বাধা না হই এজন্য সব প্রক্রিয়া আফসান বলতে গেলে গোপনে চালিয়েছিল। আফসানের সঙ্গে সুহানার সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত স্থায়ী না হওয়ার একমাত্র কারণ সুহানার সামনে বাধার দেয়াল ডিঙানোর সক্ষমতার অভাবই নয়; পিতৃহীন সুহানাকে মা ফিরোজা বেগম প্রচণ্ড প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে লেখাপড়া করিয়ে স্বাবলম্বিতার পথ দেখিয়েছেন।

সুহানা তার মায়ের জীবনসংগ্রাম আর ত্যাগ দেখেছে। ফিরোজা খালা আফসানকে কেন জানি মানতেই পারেননি। সম্পর্কে আফসান ফিরোজা খালার খুব কাছের আত্মীয়। সুহানা তো বটেই, আমরাও খালাকে বোঝানোর কম চেষ্টা করিনি। কিন্তু পারিনি। শেষ পর্যন্ত সুহানা একা থাকার সিদ্ধান্ত নেয় এবং আফসানকে সে তার সিদ্ধান্তের কথা জানায়। আমাদের সবার মনেই আফসান-সুহানার সম্পর্কচ্ছেদের কষ্টগাথা এখনও জিইয়ে আছে।’

অনিন্দিতা আফসান-সুহানার জীবনকথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। ভাবছিল জীবনের বাঁকে বাঁকে মানুষের স্বপ্ন কতভাবে হোঁচট খায়। তবে অনিন্দিতা বিশ্বাস করে, জীবনের সব গল্প জয় দিয়ে শুরু হয় না আবার সব গল্পে মানুষ হেরেও যায় না। বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক খ্যাতিমান রুশ লেখক লিও তলস্তয়কে তার মনে পড়ে গেল। অনিন্দিতা জানে তলস্তয় কেবল বিখ্যাতই ছিলেন না, ছিলেন কিংবদন্তিও। তার অনেক উপন্যাস অনিন্দিতার পড়া। তলস্তয়ের মহৎ উপন্যাস ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ ও ‘আনা কারেনিনা’ আলাদা আঙ্গিক তৈরি করে দিয়েছিল এটা অনিন্দিতার বিশ্বাস। তলস্তয়ের কিছু প্রেরণামূলক বাণীও তাকে খুব উদ্বুদ্ধ করে।

অনিন্দিতা বলল, ‘কতদিন তোমার ঘুম দেখি না, তাই তোমার ঘুম দেখছিলাম। একসময় তোমার ঘুম দেখার জন্যই তো জেগে থেকেছি। তুমি শিশুর মতো বেঘোরে ঘুমাতে, আজ ওরকমই ঘুমাচ্ছিলে। খুব মায়া হচ্ছিল। কত রাত তোমার এভাবে কেটেছে আমি তো দেখেছি। কিন্তু আজকের মতো এত কাতর হয়ে এর আগে কখনও দেখিনি।

অনিন্দিতা তলস্তয়ের কিছু বাণী শুভরাংশুকে শোনানোর আগ্রহ দেখায়। সে মাথা হেলিয়ে শুভরাংশুর ঝাঁকড়া চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলতে থাকে, ‘তুমি অনেক বই পড়া একজন মানুষ। তুমি শুধু পড়ার পিপাসা মেটানোর জন্যই পড়োনি তা আমি খুব করে জানি। তবু তোমাকে আমার প্রিয় ঔপন্যাসিক তলস্তয়ের কিছু অসাধারণ উক্তি শোনাতে চাই যদি তুমি শুনতে চাও।’
শুভরাংশু উঠে বসে। নুতুন কিছু শুনতে-জানতে ওর খুব আগ্রহ। শুভরাংশু বলে, ‘তুমি তো জানো আমার আগ্রহ-অনাগ্রহের বিষয়গুলো। তুমি যা বলতে চাচ্ছ আমার শুনতে কিংবা জানতে আগ্রহের কোনো কমতি থাকবে না। তবে কেন অনুমতি চাওয়া?’
অনিন্দিতা বাঁ হাতের আঙুলগুলো দিয়ে তার চোখ-মুখে পাটের সুতায় বোনা পর্দার মতো ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে বলে, ‘আমি জানি তোমার ভাবনার জমিনজুড়ে কী রয়েছে কিংবা থাকতে পারে। আমি এমনিই বলেছি যদি শুনতে চাও। কারণ মনের জানালা তো পারিপার্শ্বিক নানা করণে সব সময় উন্মুক্ত থাকে না। শোনো, তলস্তয় বলেছেনÑছোট্ট পরিবর্তনেও জীবন সত্যি করে জীবন্ত হয়ে ওঠে। আফসান-সুহানার জীবনের ঘটনা নিশ্চয় অনেক বড় কিন্তু একটা ছোট উপলক্ষ তাদের জীবনটা দুই ভাগ করে দিল। এ ছোট্ট উপলক্ষ অনেক বড় সৃজনের পথ রুদ্ধ করে দিল তা অসত্য নয়, কিন্তু জীবনই তো জীবনের শিক্ষক।’ এটুকু বলে অনিন্দিতা থেমে যায়।
শুভরাংশু ওর কথার গভীরতা বুঝতে পারে। ও জানে অনিন্দিতার প্রকাশ খুব কম। সে নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে রাখতেই পছন্দ করে। শুভরাংশু তাদের পরিচয়ের কিছুদিন পরই স্পষ্ট বুঝে নিয়েছিল অনিন্দিতা কিছুটা ভিন্ন ধরনের। একদিন বৈকালিক আড্ডায় শাহবাগে পাবলিক লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসে দেয়ালে পিঠ রেখে শুনিয়েছিল, কাউকে ভালোবাসলে আপনার প্রত্যাশা অনুযায়ী কেমন হতে পারত তা ভেবে নয়, বরং তারা যেমন আছে সে অবস্থায়ই ভালোবাসুন। সেদিনই শুভরাংশু অনিন্দিতার গভীরতা খুব করে টের পেয়েছিল। তার মনে হয়েছিল যে কোনো মানুষ অনেকটাই সেই ভাগফলের মতো যার লব সে নিজে আর হর হলো নিজের ব্যাপারে সে যা ভাবে।

অনিন্দিতা হয়তো সে রকম কিছুই সেদিন বুঝিয়েছিল। তারপর ক্রমে ক্রমে তারা অনেক পথ হেঁটেছে, জীবনধ্যায়ে কত কিছুর সংযোজন হয়েছে। যোগ-বিয়োগ-ভাগ-গুণও হয়েছে গাণিতিক নিয়মে এবং একপর্যায়ে সংসার জীবনে জড়িয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে। ওরা দুজনই নিজেকে অন্যের জন্য বিলিয়ে দিয়ে জীবনের পথে শিউলি ফুলের মতো স্মৃতি কুড়াতে পছন্দ করে, ভালোবাসে। এ জন্য তাদের কষ্টও কম মেলেনি; কিন্তু তাতে তাদের কোনো অনুতাপ নেই বরং এ পথেই তারা তাদের সৃজনের রেখা টেনে চলেছে।

দুজন কথা বলেই যাচ্ছে তো যাচ্ছে। এ যেন পরমানন্দের বিস্তৃত আখ্যান। শোবার ঘরে একমাত্র সন্তান শখ ঘুমাচ্ছে। রাত গড়িয়ে যাচ্ছে। সকালে শখকে নিয়ে স্কুলে যেতে হবে শুভরাংশুর; তারপর অফিসÑএসব কিছুই মনে নেই। এমনকি এই যে বিনিদ্ররাত কেটে যাচ্ছে তাতেও খেয়াল নেই। ভাবনার বিশ্লেষণের আচ্ছাদিত এমন জীবনের সংজ্ঞাই কি সুখ! নীরবতার মাঝে এমন প্রশ্নই জাগল শুভরাংশুর মনে।
অনেকক্ষণ দুজন দুজনার দিকে মৌনতায় ডুব দিয়ে নিবিড়ভাবে তাকিয়ে থাকে। অনিন্দিতার দুই চোখ জুড়ে শুভরাংশু অনাবিল সারিবদ্ধ স্বপ্ন দেখতে পায়। তার ভাবনার নতুন দরজা খুলে যায়। তার মনে পড়ে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদক। তিনি বলেছেন, ‘সবাই তোমাকে কষ্ট দেবে, তোমাকে শুধু এমন একজনকে খুঁজে নিতে হবে যার দেওয়া কষ্ট তুমি সহ্য করতে পারবে।’ আফসান-সুহানার জীবনপঞ্জির সঙ্গে বহুমাত্রিক হুমায়ূন আহমেদের এ মন্তব্যের কত মিল! কিছুতেই আফসান-সুহানা আজ শুভরাংশুর মন থেকে বিস্মৃত হচ্ছে না।
এরই মধ্যে মসজিদ থেকে ভেসে আসে আজানের ধ্বনি। যে আচ্ছন্নতা-তন্দ্রার মধ্যে শুভরাংশু-অনিন্দিতা ডুবে ছিল ফজরের আজান তা কাটাল। দুজনের দৃষ্টি দুই জোড়া চোখের গভীরে মিশে ছিল। কখন কেটে গেল সারাটা রাত কেউ বুঝতেই পারল না! শুভরাংশু অনিন্দিতার বাঁ হাতের তালুতে হাত রেখে বলল, ‘একসময় ভাবতাম কষ্ট শুধু নষ্টই করে। কিন্তু এখন দেখছি কষ্ট শুধু নষ্টই করে না, কখনও কখনও নতুন পথের সন্ধানও দেয়।’
অনিন্দিতা মাথা নুইয়ে শুভরাংশুর হাত দুটি তার ডান হাত দিয়ে আলতো করে বোলাতে থাকে। ওর বাঁ হাতটিও শুভরাংশুর হাত থেকে সরিয়ে নিজের চিবুকে বোলাতে থাকে। শুভরাংশুকে বারবার কী বলতে গিয়েও থেমে যাচ্ছে। শুভরাংশু এমনটি ধারণা করেই বলল, ‘তুমি মনে হয় কিছু বলতে চাচ্ছ?’
অনিন্দিতা গ্রীবা বাঁকিয়ে বলে, ‘তুমি আমার অন্তর্যামী। তুমি আমার জগতের মধ্যে ভিন্ন জগৎ। এই জগৎ শুধু আমার; একান্তই যেন আমার বিচরণ। আমার ভাবনার জমিনজুড়ে তোমার অস্তিত্ব। বাকিটা না হয় অনুচ্চারিতই থাক।’
অনিন্দিতার কথা শেষ হতে না হতেই ভোরের মৌনতাভেদী শুভরাংশুর অট্টহাসি। হাসতে হাসতেই সে বলে, ‘তোমার অনুচ্চারিত অভিব্যক্তি যদি সামান্যও বুঝতে না পারি তাহলে তোমার সঙ্গে দীর্ঘ যে যুগলজীবন ইতোমধ্যে অতিক্রম করলাম, তাতে কি শুধু সময়ই কাটালাম? তুমি আমার বহুলপঠিত বইয়ের চেয়েও অনেক বেশি কিছু। নিজেকে অপ্রকাশের যে শক্তি তুমি ধারণ করে আছো তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই তা পারে না। তোমার অন্তর্জগতের সৌন্দর্য তাতে আরও বেশি অদৃশ্যভাবে বিকশিত, যা হয়তো শুধু আমিই দেখি।

থাক, এ আমার একান্ত নিজস্ব সম্পদ হয়েই থাক। চলো বারান্দায় যাই। যে বিনিদ্র নিশি আমরা যাপন করলাম এবং ভালোবাসা-ভালোলাগার যেটুকু স্পর্শ অন্যরকমভাবে পেলাম তা বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে যাপন করি।’ কথা বলতে বলতেই শুভরাংশু দাঁড়িয়ে অনিন্দিতাকে পেছন থেকে বুকে জড়িয়ে মৃদু পদক্ষেপে পদক্ষেপে নিয়ে যায় বারান্দায়। অনিন্দিতা যেন সুখানুভূতির ভিন্নমাত্রার স্পর্শ টের পাচ্ছিল।
ততক্ষণে ভোরের আলো ছড়াতে শুরু করে। পাখির প্রভাতি কুঞ্জন। বসন্তের শিরশির হাওয়ায় শিহরিত দুজনই। দুজনই তন্ময় হয়ে দৃষ্টি রাখে দক্ষিণের উন্মুক্ত প্রান্তরে। ঢাকায় ঘর থেকে এমন অপরূপের রূপ উপভোগ করা দুষ্কর। বারান্দার গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়ানো দুজনের যুগলদৃষ্টি মিলিয়ে গেল খোলা প্রান্তে স্বপ্নের মায়াজালের বুননে বুননে।

এইচআর/জেআইএম