জান্নাতুল নাঈমের গল্প: গোপন আর্তনাদ
মেয়েটির নাম শিশির। হাসানের দেখা ব্যতিক্রম মেয়ে।
হাসান তাকে বন্ধু করে রাখতে চায়। কিন্তু মেয়েটি তাকে জীবনসঙ্গী করবে না। তাই প্রতিদিন বিদায় জানায়।
কোনো এক বিষণ্ন সন্ধ্যায় শিশির আর হাসান বিদায়ের চূড়ান্তে পৌঁছে যায়। সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে শিশির চলে যায়।
একদিন ভীষণ বৃষ্টি ও ঝড়। শিশির ফোনের নেট বন্ধ করে বসে আছে। একটি অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে। শিশির কণ্ঠ শুনেই একদম থমকে যায়। তবুও কথা বলে। হাসান বলল, ‘হোয়াটস্অ্যাপ চেক করো।’
শিশিরের ভীষণ রাগ হয়। চির বিদায়ের পর হাসান ফোন করেছে তাই। তবুও আনন্দ হয়। বহুকাল পরে হাসানের কণ্ঠ শুনলো। আনন্দ ও বেদনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।
হাসান ফোন করেছে রাতে শুকরিয়া নামাজ পড়ে। বিধাতাকে বলে, ‘আমি কিছু বুঝি না। তবে আমি তাকে পেলে সুখী হবো।’
পনেরো দিন পর শিশির মেসেজ করে হাসানকে বলে, ‘কেমন আছেন?’ হাসান প্রত্যুত্তর দেয় না। শিশির আরও শক্ত হয়।
একটি রাতের ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয়। হাসান বলে, ‘আগের নাম্বারটি বন্ধ করে দিয়েছি। এখন থেকে এই নাম্বারে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।’ মেসেজ দেখে হাসানের প্রতি রাগ হলো। যাকে ভালোবাসে না তাকে কেন নাম্বার দেবে? তাই সিন করে রেখে দেয়।
পরদিন সকালে রাগে মেসেজ করে, ‘যোগাযোগ করে কী হবে?’ হাসান সিন করে রেখে দেয়। হাসানকে অন্য নাম্বার থেকে ফোন করে ইচ্ছেমতো বকবে। বিদায় হওয়ার পর কেন নাম্বার দিলো তাই। কিন্তু ফোন দিয়ে আর খারাপভাবে কথা বলতে পারে না। শিশির শুধু বলে, ‘কেমন আছেন?’
হাসান প্রথমে কে বলে কণ্ঠ শুনেই বলে, ‘ও। হ্যাঁ ভালো। নাস্তা খাচ্ছি। খেয়ে ফোন দেবো।’
একটু পরেই হাসান ফোন দিলো। পুরোনো ক্ষত ভুলে গেল শিশির। কয়েকমাস পর সুযোগ পেয়ে অনবরত কথা বলেই যাচ্ছিল। হাসান বলে, ‘একদিনেই কি সব শেষ করে ফেলবে?’
শিশির বলে, ‘আপনার সাথে বেশি কথা বলতে আমার ভালো লাগে।’
পুরোনো সব ভুলে শিশির সব কথা ২ ঘণ্টায় শেষ করে। শিশির আবার মায়া অনুভব করলো। কথা প্রসঙ্গে হাসান বলল, ‘কাল একবার শহরে এসো।’ শিশির কথাটা শুনেই রাজী হয়ে গেল।
শিশির শহরে গেল। প্রায় ছয়মাস পর দেখা। হাসানকে দেখে একটা হাসি দিলো। যেন এ হাসিতে পৃথিবীর সব সুখ ঠিকরে পড়ছে। হাসানের চোখে তাকাতেই পারে না। লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। এর আগে কখনোই হাসানকে মন ভরে দেখেনি। আজ শিশির শুধু দেখছে। হাসান অন্য কোথাও তাকালেই শিশির নয়ন ভরে দেখে। ভাবে একে নিয়ে সংসার করলে জীবন অন্যরকম হয়ে উঠবে। গলা শুকিয়ে আসে। শরীর ঠান্ডা হয়ে হাত-পা কাঁপছে। হাত ঘেমে গেছে। পানির বোতল খুলতে পারেনি। হাত বাড়িয়ে হাসানের কাছে বোতলটি দিলো। হাসান খুলে দিচ্ছে। পাশে থাকা লোকজন আড়চোখে দেখছে। ভাবছে কে এই মেয়ে? হাসান কেন তাকে যত্ন করছে।
তারা চা পান করছে। হাসান কারো সাথে কথা বলছে। শিশির নয়ন ভরে দেখছে। চোখ, মুখ, চুল ও হাত দেখছে। এর আগে কাউকে সে এভাবে দেখেনি। শিশিরের দিকে তাকাতেই অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। শিশিরের মনে হয়, যদি হাসানকে এভাবে অনন্তকাল দেখতে পারতো।
ভালোবাসা জেগে ওঠে। শিশিরের যোগাযোগ তৃষ্ণা বেড়ে যায়। রাতে ঘুম হয় না। প্রতিদিন ভোর হতেই শিশির বলে, ‘আমি কি মিস করলে বলতে পারবো?’
হাসান বলে, ‘এত সকাল সকাল এসব কেন? তোমার রাতে ঘুম হয়েছে তো?’
শিশির শুধু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে, ‘এসব কথা বলতে না পারলে আবার উধাও হবো।’
তীব্র যোগাযোগ নেশায় শিশির প্রতিদিন হাসানকে ফোন করে। ‘শুধু কেমন আছেন’ বলে রেখে দেয়। হাসান আর কিছু বলতে চাইলে সে বলে, এমনিতেই ফোন দিয়েছি। অথচ সে প্রচণ্ড মিস করার কারণে একটু কণ্ঠ শুনতে ফোন দেয়, হাসান সেটা বোঝে না।
একদিন শিশির বলে, ‘আপনি যদি নাম্বারটা না দিতেন, তাহলে আমি আর জ্বালাতন করতাম না। সব কিছু আগের মতো ফিরিয়ে আনার জন্য আপনি দায়ী।’
হাসান বলে, ‘তুমি শহরে কবে আসবে?’
শিশির বলল, ‘কালই।’
হাসান বলে, ‘দেখা করো, একসঙ্গে চা পান করবো।’
শিশির ভেবে নেয়, হয়তো ভালো কিছু হবে। তাই সে রাজী হয়ে যায়। শিশিরকে না জানিয়ে হাসান বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আসে। শিশির বিব্রত হয়ে পড়ে। তবুও কিছু বলে না। প্রিয় মানুষের অদ্ভুত কার্যাবলিতে ভুল ধরতে ইচ্ছে করে না। শিশির এই প্রথম হাসানের মুখোমুখি বসে আছে। খাবার গলা দিয়ে নামছে না। কথার ফাঁকে ফাঁকে হাসানের হাত, মুখ, চোখ দেখে নেয়। শিশির সেখানে বসে ভেবে নেয়, এরপর হাসান তাকে গ্রহণ না করলে এটাই হবে শেষ দেখা।
হাসানের বন্ধু বলে, ‘আপনি এত শান্ত।’
শিশির মনে মনে হাসে। হাসান ছাড়া বুকে কেউ গুলি মারলেও শিশির কথা বলে না। শুধু শোনে। যে কেউ শিশিরকে ইন্ট্রোভার্ট বলে। অথচ হাসান জানে মেয়েটি তাকে পেলে অবিরত কথা বলে।
হাসানের সম্মুখে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকে শিশির। মুহূর্তেই ভাবনায় ডুবে যায়। আবার ভীষণ মায়া হয়। একটু দেখে নেয়। শিশিরের হাত ঘেমে যায়। টিস্যু দিয়ে পানির বোতল খুলতে যায়। তবুও পারে না। হাসানের বন্ধু তাকিয়ে দেখছে। মেয়েটি পানির বোতলের মুখ খুলতে পারে না। হাসান হাত বাড়িয়ে বোতল খুলে দেয়। সে জানে, হাসানের সামনে শিশিরের হাত ঘেমে লজ্জায় শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। মেয়েরা প্রিয় মানুষ কাছে পেলে শিশু হয়ে যায়। যত্ন পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। সুন্দর স্মৃতি ধারণ করতে চায়।
মুহূর্তেই বুক বিদীর্ণ হয়ে ওঠে শিশিরের। এসব যত্ন আর কোথায় পাবে? বন্ধুর সামনে হাসানকে কিছু বলতে পারে না। কান্নাকে বহু কষ্টে থামিয়ে রাখছে। অসহায় হয়ে হাসানের মুখটি প্রাণভরে দেখে।
আজ যদি কেউ না থাকতো; হয়তো শিশির বলতো, ‘আমাকে ভালোবাসলেন না কেন?’ হয়তো বলতো, ‘আপনার শাসন, বোঝানো আমাকে শান্ত করে। সবকিছু আমাকে সুন্দরভাবে বোঝাতে পারেন। তাই আপনাকে চেয়েছি। আপনার মতো কেউ আমাকে পরিবর্তন করতে পারে না।’
হয়তো বলতো, ‘আপনাকেই আমি ভীষণ ভালোবাসি।’
কত কিছু বলার ইচ্ছে করছে। কত কিছু বলার ইচ্ছে থাকলেও বলতে পারে না। শুধু বেদনা লুকিয়ে হাসছে।
কথা না বলার দীর্ঘশ্বাসে বেদনা চোখেমুখে স্পষ্ট। তবুও হেসেই যাচ্ছে। গোপন আর্তনাদ লুকিয়ে নীরব থেকে মন ভরে শেষবারের মতো অসহায় হয়ে দেখছে।
এসইউ/জেআইএম