দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণুর গুচ্ছ কবিতা
কষ্টের নিবিড় চাষবাস ও অন্যান্য
এক.
তুমি যেও না
যেও না, বারণ করছি; যেও না
স্থির জানি, গেলেই তুমি হারিয়ে যাবে।
তোমার নিয়তি হতে পারে না নিরুদ্দেশযাত্রা
তুমি সাগরের ক্ষুব্ধ তরঙ্গে আছড়ে পড়া ঢেউ
তুমি মিছিলে মিছিলে বজ্রমুষ্টির স্মারক
তোমাকে এভাবে প্রস্থান মানায় না, কখনও না
তুমি কালের যোগ্য উত্তরাধিকার।
লোডশেডিংয়ে অসহায় ল্যাম্পপোস্টের মাথা ছুঁইয়ে
অন্ধকার তাড়িয়ে তুমিই দেখাও আলো
আমাদের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জানুক
তাদের সরবরাহ বিদ্যুৎ না পেলেও আমরা আলোহীন নই
বহুমাত্রিক বিশ্লেষণে ও বহুরৈখিক বিবেচনায়
তোমাকে প্রয়োজন, খুব প্রয়োজন।
রাষ্ট্র-সমাজ শব্দ দুটি উচ্চারণমাত্র তুমি আরও বেশি
অপরিহার্য হয়ে ওঠো
মনে পড়ে বিদ্রোহ-বিপ্লবের স্বপ্নধ্যানে
তোমাকে স্তবের মতো উচ্চারণ করি
যেও না, বারণ করছি; যেও না
স্থির জানি, তুমি গেলেই অঙ্গীকারগুলো হারিয়ে যাবে।
তুমি প্রাত্যহিক জীবনের খুব জরুরি অনুষঙ্গ
তুমি তাবৎ নির্মাণের রূপকার, অনিন্দ্যসুন্দর
তুমি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের অববাহিকায় চরিত্রায়ণ
এত ক্লেদের মাঝেও তুমি দহনবেলার উচ্চারণ
তুমি হৃদয়ের গভীরে অন্তর্গত বোধ ও সৌন্দর্য
তুমি স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও নিঃসংশয়
পর্যবেক্ষণ তীক্ষ্ণ, সূক্ষ্ম, তোমার প্রকাশ অনবদ্য।
যেও না, বারণ করছি; যেও না
তুমি চলে গেলে রূপগত পরিচর্যার পরিচয়
মিশে যাবে ধুলোয়।
দুই.
জয়শ্রীর ক্ষয়
জয়শ্রীর মাথাভর্তি ঘন চুলের সৌন্দর্যের কাছে
অরণ্যের গভীরতার সৌন্দর্যও হার মেনেছিল।
জয়শ্রী না বলা বেদনায় ফোটাতে চেয়েছিল ফুল
কিন্তু বালিকা থেকে নারী হয়ে উঠতে গিয়ে ক্রমেই ভাঙছিল তার ভুল।
জয়শ্রী মানুষ হওয়ার পণ করেছিল
কিন্তু দুঃসময় তার স্বপ্নে হুল ফোটাতে শুরু করল।
জয়শ্রী মুক্তাঙ্গনে দাঁড়িয়ে প্রত্যয়গুলো ওড়াতে চেয়েছিল
কিন্তু বৈরী বাতাস ঝড় হয়ে সব তছনছ করে দিল।
জয়শ্রী ভালোবাসার আঙুল ছুঁয়ে ব্রহ্মাণ্ড জয় করতে চেয়েছিল
কিন্তু ইচ্ছার কপাটগুলো ঠাস ঠাস করে বন্ধ হয়ে গেল।
জয়শ্রী বহ্নিতাপে মুছে দিতে চেয়েছিল শঙ্কার চিহ্নগুলো
কিন্তু হায়, নারী হয়ে ওঠাই যে তার কাল হয়ে দাঁড়াল!
তিন.
কষ্টের নিবিড় চাষবাস
সময়ের পাঁজরের ভাঁজে ভাঁজে যখনই চোখ আটকে যায়
কষ্টের সঙ্গে কষ্টগুলো কাতারে কাতারে দেখি শুয়ে আছে
যেন এক একখানি অন্তহীন খরায় দগ্ধ অঞ্চল!
মানুষ এত কষ্ট বয়ে বেড়ায় কী করে!
কষ্ট কি কখনও হয়ে ওঠে না বিদ্রোহী?
পরিতাপের বর্ণমালা ছড়িয়ে যায় না জমিনজুড়ে?
এমন প্রশ্নে বহুবার তিরবিদ্ধ হয়ে এও দেখেছি
সময়ের তরঙ্গায়িত বুকে দীর্ঘশ্বাসের ঢেউয়ে ঢেউয়ে
ওদের কি উথালপাথাল দাপাদাপি
অসংখ্য কষ্ট একসঙ্গে কেঁদে ওঠে
অথচ কি বিস্ময়, তবু জীবনের চোখের পাতা গলে
চিবুক বেয়ে জল পড়ে না অনেকেরই!
কোনো কোনো মানুষ কীভাবে নিজের ভেতর নিজেই শেষনিঃশ্বাস ছাড়ে
কেউ দেখে না, জীবন্মৃতের ভেতর প্রাণের আর্তনাদ
মর্মস্পর্শী, খুব মর্মস্পর্শী কষ্টগুলো কীভাবে হয় ব্যথিত ব্যাকুল
তবে এও তো জানি, সব বেদনার ছায়া দৃশ্যমান নয় ।
কারও কারও অপার অবধি কষ্টের ভেতর আনন্দ অনর্গল কথা বলে
হিসাব মেলানো ভার, কতজন কষ্টে দগ্ধ হয়ে বেঁচে থাকে
নিজেকে নিঃশেষ করে অন্যকে অশেষ করতে
কারও কারও অজন্তামূর্তি যেন কষ্ট-শিল্পের গাঢ় সৃজনের সম্ভাষণ
কষ্টগুলো ফসল ফলায় অনেকের বুকের উর্বর জমিনে।
কি সুন্দর অন্ধ কষ্টগুলো দুঃসময়ের সঙ্গে
হেঁটে চলে ভূদৃশ্যের বর্ণনা হয়ে
ওই পথের দিকে তাকিয়ে ফিরে ফিরে অন্ধ হয়ে যাই
মানুষের হৃদয়ে শ্রেষ্ঠ আশ্রয়ে হাতড়াই, শুধুই হাতড়াই
এও তো জানি, কষ্টও কখনও কখনও
কীভাবে সোনার পাথরবাটি হয়ে যায়।
এইচআর/এএসএম