আবার জীবন্ত হলো ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’
হুমায়রা রহমান সেতু
‘আজিকে রুপার কোন কাজ নাই, ঘুম হতে যেন জাগি,
শিয়রে দেখিছে রাজার কুমারী তাহারই ব্যথার ভাগী।
সাজুও দেখিছে কোথাকার যেন রাজার কুমার আজি,
ঘুম হতে তারে সবে জাগায়েছে অরুণ-আলোয় সাজি।’
বাংলা ভাষার অমর আখ্যানকাব্য ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’কে ৩২ একরের বুকে পুনরায় জীবন্ত করে তুললো একঝাঁক সাহিত্যপিপাসু। শব্দপ্রীতির ছকে বাঁধা পড়ে ১৯২৯ সালের কাব্যোপন্যাসটিকে প্রায় ১ শতাব্দী পরে আবারও জাগিয়ে তোলেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২৭তম ব্যাচের পঞ্চম সেমিস্টারের শিক্ষার্থীরা।
যান্ত্রিকতাময় শহুরে জীবনকে পাশ কাটিয়ে সবুজ বৃক্ষরাজির গবি প্রাঙ্গণ যেন বাহারি বাতায়নকে ভেদ করে ফিরে যায় সেই পল্লীকবি জসীম উদদীনের ‘নক্সী কাঁথার মাঠে’। যার পরতে পরতে ভালোবাসার সুতোয় বোনা লোকজ জীবনগাথা। গত ২৯ ডিসেম্বর আয়োজন করা হয় এ উপস্থাপনা পর্বের।
নির্ধারিত সময়ে সেমিস্টারটিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা নিজেদের টেনে নিয়ে যান শত-সহস্র দিন পিছিয়ে; যেখানে তাদের দেখা মেলে সাজু ও রুপাইয়ের বেশে। হাতে ও পায়ে আলতা, চিকন পাড়ের সুতোর শাড়ি। হাতভর্তি কাচের চুড়ি। গ্রাম্যবালার চিকন বিনুনি যেন পল্লীকবির নিজের হাতে লেখা।
উপস্থাপনা যদিও নম্বরভিত্তিক ছিল। সেই নম্বরের দিকে ছিল না কারো ঘোর। সবাই যেন হারিয়ে গিয়েছিল পল্লির সেই পরতে পরতে। যেন এক অন্যরকম উৎসবের আমেজে মেতে উঠলো পুরো বিভাগ। শিক্ষকরা এসে শামিল হলেন সেই আনন্দে।
আরও পড়ুন: ২০২৩ সালে জাতীয়-আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন যারা
শুরু হলো উপস্থাপনা পর্ব। নিজেদের যেন সবাই আবিষ্কার করতে লাগল মুর্শিদী গানের তালে। গায়ের লোমগুলোতে শিহরণ উঠে গেল যখন পল্লীকবির বিদ্রোহের আহ্বান জেগে উঠলো—
‘মাটির সাথে মুখ লাগায়ে, মাটির সাথে বুক লাগায়ে
‘‘আলী! আলী!!’’ শব্দ করি মাটি বুঝি দ্যায় ফাটায়ে’
পরক্ষণেই আবার প্রিয়কে হারানোর ব্যথায় বুক দুমড়ে ওঠে—
‘কেন বিধি তারে এত দুখ দিলে, কেন, কেন, হায় কেন,
মনের-মতন কাঁদায় তাহারে ‘পথের কাঙ্গালী’ হেন?’
গ্রাম্যজীবনের অবুঝ নিটল ভালোবাসা দোলা দিয়ে যায় সবার মনে। উপস্থাপনা শেষে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে শিক্ষার্থী সাদিয়া রহমান লাবণ্য জানান, ‘বিখ্যাত কাব্যকাহিনির সেই চরিত্র সাজু ও রুপাই সাজার মাধ্যমে আমরা সকলেই যেন সেই গ্রামীণ জীবনের কিশোরী আবেগ-অনুভূতি ব্যতিক্রম উপায়ে অনুভব করতে পেরেছি। যান্ত্রিক জীবন থেকে বের হয়ে ক্ষণিকের জন্য অনুভব করেছি গ্রামীণ সাধারণ জীবনের বাস্তবতা। এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ।’
শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাণ ফিরতে দেখে উপস্থাপনাটির তত্ত্বাবধায়ক বাংলা বিভাগের সহকারী প্রভাষক শামসুন নাহার সেতু জানান, ‘ইট কাঠ দালানের শহরে যখন হাঁপিয়ে উঠি আমরা; তখন আমাদের মনের শ্রান্তি দেয় ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’। রুপাই-সাজুর প্রেম লোকজ জীবন আমাদের হাত ধরে টেনে নিয়ে বলে, কেন বিশ্ব দরবারের দ্বারস্থ হওয়া? স্বয়ংসম্পূর্ণ আমাদের যে সংস্কৃতি; সেটা নিয়েই মাথা উঁচু করে বাঁচি না কেন আমরা? নকশি কাঁথার মাঠে বিছানো যে শীতলপাটি, তার চেয়ে উপভোগ্য আর কী হতে পারে বাঙালির জন্য? আজ তোমাদের সাজু ও রুপাই রূপে দেখে ভীষণ ভালো লাগলো।’
আরও পড়ুন: ২০২৩ সালে বাংলা সাহিত্য যাদের হারালো
পল্লীকবির অতি যত্নে ভাবাবেগে রচিত এই ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’, যার পরতে পরতে রয়েছে গ্রামীণ জীবনচিত্র, লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। যার হালকা বাতাস ছড়িয়ে গিয়েছিল গণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেও।
লেখক: শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার।
এসইউ/এএসএম