জসীম উদদীন যে কারণে পল্লীকবি
অলোক আচার্য
‘ওইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে,/ ত্রিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে’—লাইন দুটি জসীম উদদীনের বিখ্যাত ‘কবর’ কবিতার প্রথম চরণ। সুদীর্ঘ ও আবেগী এ কবিতা এত সুপরিচিত যে, নতুন করে এর পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন পরে না। জসীম উদদীন পল্লিগাঁয়ের কবি হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত। যদিও গবেষকদের মতে, তিনি অত্যন্ত আধুনিক কবি। পল্লীকবির খুব সহজ ব্যাখ্যা হলো এই যে, জসীম উদদীনের অধিকাংশ কবিতাতেই উঠে এসেছে পল্লির কথা। পল্লিমায়ের রূপ সুনিপুণ ও দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পল্লীকবির অন্তরে যেন সদা ধ্বনিত হতো পাড়াগাঁয়ের কথা।
জসীম উদদীন ছিলেন একজন বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, গীতিকার ও লেখক। তাকে বাংলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাঙালি কবিও বলা হয়ে থাকে। তিনি আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ও প্রবহমানতা তার লেখায় খুবই কৃতিত্বের সঙ্গে তুলে এনেছেন। তিনি ১ জানুয়ারি ১৯০৩ সালে ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় তার নাম রাখা হয় মোহাম্মাদ জসীম উদদীন মোল্লা। কিন্তু তিনি বেশি পরিচিত পান কবি জসীম উদদীন নামে। তার বাবা আনসার উদ্দিন মোল্লা পেশায় স্কুলশিক্ষক ছিলেন। মা আমিনা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। তিনি প্রথমে ওয়েলফেয়ার স্কুলে এবং পরে ফরিদপুর জিলা স্কুলে লেখাপড়া করেছেন।
প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১৯২১ সালে পাস করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ১৯২৯ সালে বিএ এবং ১৯৩১ সালে এমএ পাস করেন। ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ গীতিকার একজন সংগ্রাহক এবং তিনি দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে লোকসাহিত্য সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছেন। লোকসংগীত সংগ্রহ করেছেন ১০ হাজারেরও বেশি। তার প্রথম প্রকাশিত কাব্য ‘রাখালী’ ১৯২৭ সালে ‘কল্লোল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। রাখালী কাব্যে মোট ১৯টি কবিতা রয়েছে।
তিনি পল্লির রূপে যেমন মুগ্ধ ছিলেন; তেমনই কবিতার ভাষায় অন্যকেও তার গ্রামের সৌন্দর্য দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। জসীম উদদীন বাংলার গ্রামীণ জীবনের ভাষ্যকার। তিনি নিপুণভাবে গ্রাম-সমাজ ও গ্রাম-জীবন তার কবিতার ক্যানভাসে চিত্রায়িত করতে পেরেছিলেন। গ্রাম জীবনের প্রতিচিত্র নির্মাণের পাশাপাশি তিনি বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মানববোধকে লালন ও সমৃদ্ধ করেছেন। বাঙালির প্রাণ হলো গ্রামের সাদামাটা পরিবেশ, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, সহজ-সরল মানুষ, অভাব-আবেগ, গাঁয়ের মেঠোপথ, হিজলের বন। তার বিখ্যাত ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতার কয়েকটি লাইন—
‘তুমি যাবে ভাই–যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই–যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়।’
নিমন্ত্রণ কবিতায় কবির যে আকুল আমন্ত্রণ, সে আমন্ত্রণ প্রতিটি লাইনেই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। উঠে এসেছে হাজার বছর ধরে চলে আসা গাঁয়ের ভালোবাসায় ভরা রূপের কথা।
তাকে পল্লীকবি কেন বলা হয়, তা তার কবিতাগুলো একটু পড়লেই স্পষ্ট হবে। তার ‘রাখাল ছেলে’ কবিতাটি পড়লেও গ্রামবাংলার প্রকৃতির অপরূপ রূপের দেখা পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন—
‘রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! বারেক ফিরে চাও
বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও?
ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ
কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা।’
তবে তিনি যে কেবলই পল্লীকবি, তা বললে তার সাহিত্যকর্মকে গণ্ডিতে আবদ্ধ করা হয়। তিনি কবিতা লেখার পাশাপাশি গ্রামবাংলার বহু ঐতিহ্যবাহী গান রচনা করেছেন। কারণ পল্লির মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির এক অপূর্ব মিল নিয়েই তিনি কেবল কবিতা লেখেননি। এ ছাড়া বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন কবিতা লিখে গেছেন। যেসব কবিতার আবেদন চিরন্তন।
আবার একটি মেয়ের ও তার গ্রামের বর্ণনা দিয়ে তিনি ‘পূর্ণিমা’ কবিতায় লিখেছেন—
‘পূর্ণিমাদের আবাস ছিল টেপাখোলার গাঁয়
একধারে তার পদ্মানদী কলকলিয়ে যায়।
তিনধারেতে উধাও হাওয়া দুলতো মাঠের কোলে
তৃণফুলের গন্ধে কভু পড়তো ঢলে ঢলে।’
কোনো কোনো কবিতার একেকটি লাইন যেন মানব সংসারকেই সঠিক পথের দিশা দেখায়। আবেগ এবং নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার যে আকুল আকুতি তা দেখা যায় কবির ‘প্রতিদান’ কবিতায়। তিনি লিখেছেন—
‘আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
যে মোরে করিল পথের বিবাগী,
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি।
দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর;
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর।’
কবি জসীম উদদীন বাংলার বর্ষার রূপ নিয়েও চমৎকার কবিতা উপহার দিয়েছেন। তার কবিতায় বর্ষা ঋতুকে আমরা চিনেছি আরও বহু বৈশিষ্ট্যের মধ্য দিয়ে। তিনি তার ‘পল্লী বর্ষা’ কবিতায় লিখেছেন—
‘আজিকার রোদ ঘুমায়ে পড়েছে ঘোলাটে মেঘের আড়ে,
কেয়া বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে।
কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝঝুম নিরালায়,
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়।’
পল্লীকবি জসীম উদদীন পল্লি জীবনধারার সঙ্গে প্রকৃতির রং মিশিয়ে তার কবিতায় উপস্থাপন করেছেন। যা পাঠককে যুগ যুগ ধরে মুগ্ধ রাখে। তবে পল্লিধারার বাইরেও তিনি বহু কবিতা লিখে গেছেন। কখনো তা শিশুদের উপযোগী, কখনো মজার আবার কখনো ছবির মতো করে কোনো দৃশ্যপট কবিতার দ্বারা বর্ণনা। কবির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবিতার মধ্যে রয়েছে ‘আসমানী’ কবিতাটি। আসমানী একটি জীবন্ত চরিত্র। এই চরিত্র নিয়ে এত করুণ একটি কবিতা লেখা হয়েছে যে, তা রীতিমতো বিস্ময়ের। আর একজন আসমানী যেন অনেক আসমানীর প্রতিচ্ছবি হয়ে সেই সময় তার কবিতায় ফুটে উঠেছিল।
ছড়া লেখায়ও তার উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। চমৎকার সব ছড়া লিখেছেন, যা ছোট-বড় সবার মুখে মুখে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তার ‘আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা/ ফুল তুলিতে যাই/ ফুলের মালা গলায় দিয়ে/ মামার বাড়ি যাই/ মামার বাড়ি পদ্মপুকুর/ গলায় গলায় জল/ এপার হতে ওপার গিয়ে/ নাচে ঢেউয়ের দল।’ খুব ছোটবেলায় এই ছড়ার সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে। কবি জসীম উদদীনের প্রতিটি লেখায় রয়েছে গ্রামের প্রকৃতির বর্ণনা, চমৎকার রূপরেখা। গ্রামের পথ-ঘাট, গ্রামের কোনো কিশোরীর প্রতিমুখ প্রভৃতি ফুটে উঠেছে তার কবিতায়। এসব কারণেই তিনি পল্লীকবি জসীম উদদীন।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
এসইউ/এমএস