আমিনুল ইসলামের কবিতা: পরিহাসই যেখানে শিল্প
বিদ্রুপাত্মক এবং ব্যঙ্গাত্মক হচ্ছে চতুর বা যুৎসই শব্দাবলি ব্যবহার করে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সম্পর্কে ধারণার যোগাযোগের শিল্প। একটি গোষ্ঠী বা ব্যক্তির অবস্থা, অনুভূতির ব্যঙ্গাত্মক প্রকাশ করার জন্য ভাষার একটি স্টাইল হচ্ছে স্যাটায়ার। এটি একটি পরিস্থিতি বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি সিন্ডিকেট প্রকাশ করার জন্য ব্যবহার করা হয়। গদ্য-সাহিত্য (বিশেষ করে নাটক) স্যাটায়ার ব্যবহার বহুল হলেও কবিতায় ব্যবহার করতে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিতে হয়। উপহাসের অর্থকে বোঝাতে কবিকে শব্দ নির্মাণে অধিক চতুর হতে হয়। অভিজ্ঞতাও অবশ্য চতুর হতে সহয়তা করে। কবি আমিনুল ইসলাম (২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৩) প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে চাকরির সুবাদে বিভিন্ন বিষয়ে বেশ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছেন। ফলে অন্ধকার দিকের বিভিন্ন বিষয় তাঁর কণ্ঠ, ত্বক ও চোখ ইত্যাদিকে জাগিয়ে তুলেছে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা।
অন্য সাধারণ কবিতার মতোই আমিনুল ইসলাম এ-ধারায় নতুন কিছু জানালা খুলেছেন। তাঁর কাব্যিক থিম এবং বিষয়গুলো প্রধানত জনগণ ও বিভিন্ন গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের বেদনা, হতাশা, অনিরপেক্ষতা, মোড়লগিরি এবং বিভিন্ন দেশীয়-আন্তর্জাতিক সমস্যার প্রকাশ ও নেপথ্যদের চরিত্র ও চিত্র তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন অস্বাভাবিকতার সমালোচনা ও সংশোধনের সুযোগ সৃষ্টি করে সমাজ ও নাগরিকদের কৌশল ও চিন্তা করার আমন্ত্রণ করেছেন। শুধু শব্দাবলির প্রয়োগই নয়, বাক্য ও বিষয়বস্তু বাছাইয়ে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন মূল্যবোধ ইত্যাদি তুলে ধরেছেন। দাপ্তরিক, প্রযুক্তিগত ও আন্তর্জাতিক শব্দ বা পরিভাষা, ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ইত্যাদি শব্দশ্রেণি ব্যবহারে যুৎসই বাগ্মীতা ও শৈল্পিক মূল্যের পাশাপাশি পাঠকের হৃদয়ের কাছাকাছি যেতে পেরেছেন। ধর্ম-অধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে লেখা আসল চরিত্র উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে প্রাচ্যের অসুখ (শেষ চার লাইন), রাখাইন ইত্যাদি কবিতায় তুলে ধরা হয়েছে। দুর্নীতি, লুটেরা, ক্ষমতাবান ইত্যাদি চরিত্র কল্পচিত্র (সন্ত্রাসী ও হত্যাকারীরা ক্ষমতার চেয়ারে আসীন), কচুক্ষেতের হাসি (বামনদের জয়জয়কারে ছবি), শেয়ালের সিংহরোগ (অযোগ্যদের দখলবাজির ছবি), আঁধার বন্দনা (সাহিত্যে শিল্পে নেতিবাচকতা ও বিমানবকীকরণকে কটাক্ষ) ইত্যাদি কবিতায় তুলে ধরা হয়েছে। রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষমতার অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে চোরের জন্য কনসালটেন্সি (দুর্নীতি ও লুটপাটের রামরাজত্ব সম্পর্কে আলোকপাত), অডিটবিহীন দিন (লুটপাটের সংস্কৃতির জয়জয়কারকে তুলে ধরা), আমার বোন এবং আমি (নারী স্বাধীনতা বিষয়ে পুরুষের ভণ্ডামি), বেদখল হয়ে যায় পরানের পার্ক (আধুনিক মানুষের অর্থলিপ্সা ও প্রেমহীন যৌনতা), কিউপিডের মিউজিয়াম এবং (দেহবাদী প্রেম ও নগ্নতার সমর্থকদের তীব্র কষাঘাত), বোমাবাঁধা মানুষ (মরণশীল মানুষের লোভ ও লিপ্সার ছবি), স্বপ্নের কথা (রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে জোরাজুরিকে কটাক্ষ) ইত্যাদি কবিতায় তুলে ধরা হয়েছে। বাইরে ফিটফাট ও উদার মনে হলেও আধুনিক এ যুগের শিক্ষিত ও উঁচুস্থানের ব্যক্তিত্বদের আসল চরিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে পর্বতবিরোধী গান (ঈর্ষাকাতর বামন মানুষ, রাজনীতিক-কবি-শিল্পীদের ছোটমনকে তুলে ধরা), কুড়ালের হাসি (জোর যার মুলুক তার দর্শনের সমালোচনা), ভালোবেসে কী হবে? (আধুনিক সভ্যমানুষ ও আধুনিক রাষ্ট্রের প্রেমবৈরী স্বরূপ উন্মোচন), কুয়ায়ন (আধুনিক মানুষের মানসিক ক্ষুদ্রতার ছবি), আমি হতে পারিনি আকাশ (মানুষের আসল রূপ উন্মোচন), বিকিনি রাত ও ফুটো কন্ডোম (দ্বিচারী আধনিকতাকে কটাক্ষ), এইসব শেয়ালেরা (সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনের গোষ্ঠীবাদের কটাক্ষ), নিয়মের সৎপুত্র (প্রশাসনে দলবাজিতার কুফল), বিষবৃক্ষের বাগান (রাষ্টযন্ত্রে ও প্রশাসনে অবিশ্বাস, সন্দেহ, সংশয়) ইত্যাদি কবিতায় তুলে ধরা হয়েছে।
গণতন্ত্র, পুঁজিবাদসহ বিভিন্ন তন্ত্রমন্ত্র ইত্যাদির কালো অধ্যায় নিয়ে, রাষ্ট্রের ভয়ংকর রূপ, ক্ষমতার দাপট, ক্ষমতার উৎস্যদের অবজ্ঞা করা, চাপিয়ে দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে কবিতাগুলো হচ্ছে, জঙ্গলায়ন (গণতন্ত্রের ভয়ংকর রূপ উন্মোচন), আমি চেয়ার বলছি (ক্ষমতার দাপট ও অসারতা), রাজাময় (রাষ্ট্র বা ক্ষমতার সর্বগ্রাসী বিস্তার ও ক্ষতিকর প্রভাব), পুঁজিবাদ (পুঁজিবাদ বা ধনলিপ্সা বিষয়ে মানুষের স্ববিরোধী আচরণ), সভ্যতার সংঘর্ষ (সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতার মুখোশ উন্মোচন), অন্ধরাতের এক্সরে রিপোর্ট (আধুনিক রাষ্ট্রের প্রেমবৈরী অবস্থান ও কাজকাম), সত্য বলা না বলা (দূষিত রাষ্ট্র ও সমাজকে তীব্র কষাঘাত), ফোরকালার অধঃপতন (আধুনিক মানুষ ও রাষ্ট্রে অধঃপতন), বৃদ্ধ বাবা এবং সত্যের রং (রাষ্ট্র ও ক্ষমতার স্বরূপ উন্মোচন) করা হয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ:
১.
কাঁচাফলে কিল নয়, অগ্নিগর্ভ নল
দিন যায়- পচন ধরে আড়ালে আবডালে,
...জ্যেষ্ঠভ্রাতা খিস্তি পাড়ে, নষ্টভ্রাতা চতুর্মুখ;
রাষ্ট্রজ্ঞানী হতবুদ্ধি;
মুখ ঢাকে আব্রাহাম লিংকন;
লম্বোদর এ শহর চার্বাকের ঘি গিলে বেসামাল,
খুলে পড়ে পাতলুন।
নক্ষত্রখচিত গোষ্ঠীগোশালায়
পরান্নে জাবর কাটে বুদ্ধিজীবী।
এ নগরে এজমালি বৃক্ষের গোড়ায় জল দেবে কে?
...ধাবমান দিনের সন্তাপে হৃদয় আক্রাস্ত হলে
পরশ বুলিয়ে দেবে মাটিছোঁয়া সাঁঝের বাতাস।
নগরীর কুটিল দালানে জমলে জমুক যত তন্ত্রের ফ্যাসাদ
আমাদের সবুজের সংবিধান অলংঘিত-
পরিব্যপ্ত প্রাণের বর্ণমালায়।
(তন্ত্র থেকে দূরে)
২.
বটের রক্ত সুন্দরীর আঁচল রাঙিয়ে
গড়িয়ে চলেছে অর্পণগাছিয়ার জলে;
সবুজের জলসাঘরে শ্যামার আহত
কণ্ঠে বেগম আখতারের ঠুংরী...
(সংক্ষেপিত/ কল্পচিত্র)
৩.
যুবতীদের কালো হাঁড়িতে ঢুকিয়ে ঢাকনা আঁটা হচ্ছে;
তর্জন গর্জন সহযোগে তাড়ানো হচ্ছে মধুপ:
দেখছ না কত রস! কত কীট! ঢেকে দাও;
নইলে আসমান ভেঙে পড়বে রাজার মাথায়!
অন্যদিকে প্রতিপক্ষ গলা: ভারী অন্যায়! ঢাকনা কেন?
বরং নীবিবন্ধ খুলে দিয়ে অবাধ হাওয়ায় ছেড়ে দাও
তারা তো প্রকৃতিরই বোন। আর আমাদের পুরুষচন্দ্র
রাজা তো আধুনিক মানুষ-খোলামেলাই পছন্দ করেন!
...হাতাহাতিরত শব্দের ভিড়ে চাপা পড়ে যাচ্ছে যুবতীদের গলা।
(সংক্ষেপিত/ মাছিতন্ত্র)
৪.
দ্যাখো—জাতিসংঘের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে
বিকট এক অস্তিত্ব
মাথায় কেন্দ্রীয় টাক, নাভি ঘিরে মেদের বাহুল্য
হাঁটুতে বাড়তি চাপ আর
পায়ের গোড়ায় প্রবাহিত
অজস্র মানুষের রক্ত ও ঘাম...
(সংক্ষেপিত/ পুঁজিবাদ)
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অন্যায্য, ভণ্ডামি, কপটতা, ক্ষমতা ইত্যাদি নিয়ে স্বরূপ উদঘাটন করা হয়েছে বাঘ-হরিণের সংসার (বড় রাষ্ট্র ও ছোট রাষ্ট্রের সম্পর্ক), কুটুম (জাতীয় রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ ডেকে আনার ছবি), জল থেকে জাতিসংঘ (পক্ষপাতদুষ্ট বিচারব্যবস্থার সমালোচনা), শান্তিদেব (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডাভল স্টান্ডার্ড স্বরূপ উন্মোচন), ডায়গনোসিস আফটার অপারেশন (দুনিয়ার অশান্তির কারণ উদঘাটন) ইত্যাদি কবিতায়।
১.
ভালোবাসার মামলা ঠুকে হেরি গেছি হায়!
হেরি গেছি ভাই... হেরি গেছি বোন...
বৃথা গেলো অকাট্য সাক্ষী-সাবুদ
মেষশাবকের মতো ভাবছি ভাটিতে
ও জনক, ও জননী-,
এ কোন জঙ্গলে বলো তোমাদের গন্দম-বাগান!
...দ্যাখো- পন্ডিতের কালি মেখে গালে
শাহবাগে হাসছে কবিতা,
আর্ট গ্যালারিতে উৎফুল সুলতানের ভীষণ মানুষেরা!
আর তুমি! তুমি শুধু হাতে নিয়ে কাঁচি আর কড়া...!
(সংক্ষেপিত/ জল থেকে জাতিসংঘ)
২.
ও আফ্রিকার জঙ্গলের সিংহ, ও সুন্দরবনের বাঘ
ও আমাজনের কুমির,
কবে তোমরা এসে বসবে সভ্যতার সিংহাসনে আর
আধুনিক মানুষ নামের জন্তুগুলো আলোর পাঠ নেবে
তোমাদের পদতলে বসে? কবে???
(সংক্ষেপিত/ রাখাইন এবং)
৩.
রবিঠাকুরের রামকানাই নই, তবু কী করো অস্বীকার করি—
ডাল ভাঙে, পত্রপুষ্প উড়ে যায়,
তলে তলে টান পড়ে শেকড়েও!
...বিবিসি-সিএনএন-স্টার ওয়ার্ল্ড
এরা কার কথা বলে?
পাখির টক শো কানে তোলো তুমি; ঘরে নিই আমিও।
(সংক্ষেপিত/ পাখির টক শো)
এশা (সংবেদনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতাকে তুলে ধরা), প্রদীপের নিচে একটি অন্তর্বতীকালীন রিপোর্ট (সরকারি চাকরি অঙ্গনের ছবি), মেরুদণ্ড রোগ (নীতিবান মেরুদণ্ডওয়ালা মানুষের চাকরির বিপদ), থুতু (বাঙালির কপট ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতার ছবি), মাছিতন্ত্র (নারী স্বাধীনতা নিয়ে পরস্পরবিরোধী দুই গ্রুপের একই চরিত্রের ছবি), রাইসরিষার কাব্য (তৈলমর্দন সংস্কৃতির স্বরূপ উন্মোচন), পুচ্ছ সংকীর্তন (চামচামি, দালালি ও বানরামির ছবি) ইত্যাদি কবিতায় সমাজের কদাকার কিছু দিক উঠে এসেছে। কয়েকটি উদাহরণ:
১.
আমার থুতু দিই। ওয়াক থু!
দেখুন- এ আমাদের হাল আমলের অভ্যাস
...সাপের থলিতে যেমন বিষ
ঊর্ণ-অধরে যেমন লালা
সতীনের বুকে যেমন ঈর্ষা
আমাদের পেটে তেমনি থুতু।
(সংক্ষেপিত/ থুথু)
২.
এটা কোনো প্রাচ্যতত্ত্ব নয়, অপ্রিয় বাস্তবতা এই যে
প্রাচ্যের শরীরে এক কঠিন রোগের আনাগোনা আজ;
সে-রোগ সংক্রমণে দিনদিন মানব-জঙ্গল হয়ে উঠছে
শত সভ্যতার সূতিকাগার—পূবের দুনিয়া! অথচ
প্রথমদিনের সূর্য একদিন উঠেছিল...
আর বনের আকাশে ওঠা চাঁদের পিঠে চড়ে দ্যাখো-
দুর্বলদের ভেড়া জ্ঞানে নিজেদের নেকড়ে-ভূমি
রচনায় তৎপর সনখর সবলের দল!
কোনো মানবীয় ঘ্রাণ নয়,
অলৌকিক খোশবুও নয়,
তাদের শরীর থেকে বের হয়ে আসে
জিঘাংসা ব্রান্ডের বিকট গন্ধ
...এবং কোনো ধর্মগুরু নয়, চিকিৎসাবিজ্ঞানীও নয়
ধর্মের নিতম্ব থেকে—
এই রোগের জীবাণু আবিস্কার করেছেন
মহামান্য রাজনীতিবিদগণ; ছড়াচ্ছেনও তারাই।
(সংক্ষেপিত/ প্রাচ্যের অসুখ)
৩.
আছিলা বাঁশের স্কুলে জমে ওঠা প্রাকটিক্যাল
ক্লাস থেকে ডাকছি-
ও ইতিহাস, ওগো মহাকালের প্রেস সেক্রেটারি,
প্রস্তরযুগকে সঙ্গে নিয়ে একবার এসো ভাই
দেখে যাও- আলোকায়নের বিকিনি পরা রাত
ফুটো কনডম- আর ধর্ষকদের ইউনাইটেড ক্লাব!
(সংক্ষেপিত/ বিকিনি রাত এবং ফুটো কনডম)
ব্যঙ্গাত্মক হচ্ছে প্রতিশ্রুতিশীল এবং দায়িত্বের অংশের বহিঃপ্রকাশ বলা যায়। অতীতের তুলনায় এ ধারার প্রতিশ্রুতিশীল সম্প্রসারণ বলে দেয়, ক্রমান্বয়ে কবিতারা আরও অর্থবোধক, নৈতিক ও মানবিক হয়ে উঠছে। অবশ্য, কবিদের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অনেক নেতিবাচক কথা উপস্থাপন হচ্ছে। এ-দিকটি বিবেচনা করে বা বাইরে রেখেই বলছি। আমিনুল ইসলামের ব্যঙ্গাত্মক কবিতা বুদ্ধিবৃত্তিক, পেশাভিত্তিক, ধর্মীয়, আদর্শিক, রাজিনৈতিক, নারীবাদী চেতনা, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রেম-অপ্রেম, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক ইত্যাদি বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জনাথান সুইফট (১৬৬৭-১৭৪৫) হচ্ছেন স্যাটায়ার সাহিত্যের সোনালি যুগের প্রতিনিধি। তিনি স্যাটায়ারধর্মী কবিতাও লিখেছেন। সব বিখ্যাত কবিই এ ধারা এড়িয়ে যাননি। সুইফট স্যাটায়ার ধারাকে আয়না হিসাবে দেখেছেন। আয়নায় যেমন নিজেকে ছাড়া অন্যকে দেখা যায় না। ব্যক্তি গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। কবি আমিনুল ইসলামও ব্যতিক্রম নন। ব্যঙ্গাত্মক রীতিনীতি, অভ্যাস, সামাজিক বিভিন্ন সম্প্রদায় ও শ্রেণির অবনতি, অবক্ষয় ইত্যাদিকে আক্রমণ করে সংশোধন করাই এ-ধারার লক্ষ্য। রাজনীতির ক্ষেত্রে এ ধারা ক্রমবর্ধমান হচ্ছে। সম্প্রসারণের প্রবণতাই বলে দিচ্ছে রাজনীতি দিন-দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃত দুঃখ, বঞ্চনা, বৈষম্য, অসংগতি ইত্যাদির মধ্যে ভার্চুয়াল বন্ধন কিংবা সুখের মধ্যে বিরাট ফাঁক থাকায় কবিকে ব্যঙ্গাত্মক কবিতা লিখতে উৎসাহিত করে। যে কবি যত বিবেকবান ও সচেতন তিনি ততই এ কবিতা লেখার ক্ষেত্রে সার্থক। কবি আমিনুল ইসলাম কবিতায় কখনো ব্যক্তি বা দেশীয়-আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অঙ্গকে লক্ষ্য করে রচিত হয়েছে। তাঁর কবিতা পরোক্ষভাবে কখনো বা প্রত্যক্ষভাবে, নোংরামি, দুর্নীতি, অনৈতিকতা ইত্যাদি নেতিবাচক বিষয়াদি উপহাসমূলক সুরে কণ্ঠস্বর নির্মিত হয়েছে। তিনি কখনো কখনো সংকীর্ণমনা ও ঈর্ষান্বিত প্রতিদ্বন্দ্বীদের সম্পর্কে ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপন করেছেন। চেরাপেটে পাওয়া গেছে সারমেয় লেজ (ডায়াগনসিস আফটার অপারেশন), এমনকি শেয়ালশাসিত কলাকেন্দ্র (পাখি সংকলন), আমাদের মাটিবর্তী দেহ, শয্যাবর্তী মন (কচুক্ষেতের হাসি), নেকড়ীয় প্রটেকশন (কল্পচিত্র), মানুষ নেকড়ে হলে বৃহত্তম গণতন্ত্রও জঙ্গল হয়ে ওঠে (জঙ্গলায়ন) ইত্যাদি শব্দশ্রেণি তিনি ব্যবহার করেছেন। দেখিয়েছেন সংকট ও অসংগতির প্রতি তাঁর আক্রোশ ও কঠোরতা। আরও কিছু কবিতাংশ তুলে ধরতে ইচ্ছে করছে:
১.
দ্যাখো-বয়েসী পাইনের আন্তঃমহাদেশীয় চোখে বেগুনি
হলুদ বিস্ময় জাগিয়ে কেমন ছোট হয়ে আসে পৃথিবী!
...ও ভাই ব্যাং, ও বোন কুয়ো,-এই কান ধরলাম,
আর গালি দেওয়া নয়,
দ্যাখো- ইতোমধ্যেই কতখানি ছোট হয়ে এসেছি আমি!
(সংক্ষেপিত/ কুয়ায়ন)
২.
ও ভুল, ও লালসা, অতএব মেতে ওঠো উৎসবে!
পরোয়া কীসের!
তোমরা এখন প্রতিকারহীন মহাশক্তির অনুগত থাবা!
(সংক্ষেপিত/ অডিটবিহীন দিন)
৩.
সাবধান হে চোর মহোদয়, আর মুরগিচুরি নয়!
হাজতের চাবি আর হাতকড়া হাতে নিয়ে
দ্যাখো নাকি- দাঁড়িয়ে আছেন থানা মহাশয়!
জেনে রাখো-মুরগিচোরকে ঘৃণা করে-
জনতা ও জেলখানা, থানা ও দুদক,
উকিল ও আদালত-, অধিকন্তু সকলেই প্রায়।
তারচেয়ে-যদি পারো গিলে খাও দিঘি ও পুকুর
জেনে নাও হজমের হাল;
ভালো? অতএব
অতঃপর আস্ত একটি বঙ্গোপসাগর
জঙ্গলে বা জাতিসঙ্ঘে তখন আর কে তোমাকে আটকায় হে বীর!
(সংক্ষেপিত/ চোরের জন্য কনসালটেন্সি)
৪.
নজরে পড়বে
কালের কুকুরের—ঘেউ ঘেউ, ঘেউ ঘেউ!
এমনটা কতদিন ধরেই তো দেখে আসছি!
আর হ্যাঁ, সত্যি কথাটা বলতে আমার লজ্জা নেই
আমি চেয়ার খুব পিছলা স্বভাবের
জাদুবাস্তবতার তেল মেখে মাঝে মাঝে বাঁশ হয়ে উঠি।
এবং জ্ঞানীদের জন্য বহু দৃষ্টান্ত ইতিহাসে।
(সংক্ষেপিত/ আমি চেয়ার বলছি)
৫.
রাজপ্রাসাদ তো নেই, নেই রাজমুকুটও
অথচ যেখানেই হাতটি দিই,
সেখানেই রাজার শরীর;
...হে রাজামশাই, ওগো মহামাননীয়,
আমার এ ভালোবাসার উঠোন থেকে
কবে যে সরাবে তোমাদের বীভৎস নিতম্ব!
(সংক্ষেপিত/ রাজাময়)
বাংলাদেশের কবিতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হচ্ছে স্যাটায়ারধর্মী কবিতা। তবে, আন্তর্জাতিক পেক্ষাপটে বললে অনেকটাই পিছিয়ে থাকবেন বাংলাদেশের কবিরা। সঙ্গতকারণে আমিনুল ইসলামও পিছিয়ে। তবে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিনি জোরালো ভূমিকা পালন করে স্যাটায়ার কবিতায় তিনি উজ্জ্বল এক অধ্যায় রেখে যাচ্ছেন বলেই আমার মনে হচ্ছে। কবি আমিনুল ইসলাম সমাজ-রাষ্ট্রের ত্রুটি ও সংকট, পার্থক্য ইত্যাদি বড় করে পাঠকের নিকট উপস্থাপন করতে চেয়েছেন এবং পাঠকের মনোযোগ ও আকর্ষণ ভালোর দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। সমসাময়িক সফল কবিদের মধ্যে ব্যঙ্গাত্মককে মানবিক হিসাবে তুলে ধরার মধ্যে কবি আমিনুল ইসলাম শীর্ষেই থাকবেন বলে মনে করি। সংখ্যাগত দিক দিয়ে তো বটেই, মানস, বিষয় এবং শৈলীগত দিক দিয়েও তিনি সফল।
এসইউ/এমএস