ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

জীবনানন্দের লাশকাটা ঘরের পোস্টমর্টেম

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:৪৭ পিএম, ১২ ডিসেম্বর ২০২৩

আশরাফুল ইসলাম

‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’—উক্তিটি জীবনানন্দ দাশের। যে ক’জন কবি বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বল, তার মধ্যে জীবনানন্দ দাশ অন্যতম। বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বলয়ের বাইরে এসে তিনি সৃষ্টি করেছেন কবিতার এক নতুন ধারা, নতুন জগৎ। জীবনানন্দ দাশ তার সময়কে অতিক্রম করে যাওয়া কবি। সে কারণেই তার সময়কার খুব কম পাঠক-কবিই তার কবিতাকে বুঝতে পেরেছেন। যারা বুঝতে পারতেন না; তারা সমালোচনা করতেন। সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করতেন। তবে বর্তমানে জীবনানন্দ দাশ অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। ভবিষ্যতে সে সম্ভাবনা আরও বেশি।

জীবনানন্দ দাশের একটি অসাধারণ সৃষ্টি ‘আট বছর আগের একদিন’। শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম সেরা কবিতাগুলোর মধ্যে একটি। কবিতাটি কবি কখন লিখেছিলেন, সে সম্পর্কিত কোনো পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি। তবে কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল কবিতা পত্রিকায় ১৩৪৪ সালের চৈত্র সংখ্যায়, ইংরেজি ১৯৩৭ সালে। কবিতাটি যখনই লেখা হোক—এর প্রেরণা ছিল কমপক্ষে আট বছর আগের অর্থাৎ ১৯৩০ কিংবা তার আগের। ১৯৩০ সালের বহু আগে থেকেই বরিশালে লাশকাটা ঘরের অস্তিত্ব ছিল। অশোকানন্দ তার ভাইয়ের মৃত্যুর পরে লিখেছেন, ‘প্রায় ছোটবেলা থেকেই বরিশালের উপকণ্ঠে শ্মশান ভূমির পাশ দিয়ে আমরা দুজনে হেঁটেছি, অবাক হয়ে কখনও বা লাশকাটা ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখেছি।’

বাংলা সাহিত্যে মৃত্যুকে নিয়ে আগে কখনো এত জটিলভাবে কবিতা লেখা হয়নি। মৃত্যুর সঙ্গে জীবনবোধের এক অসাধারণ বর্ণনা ফুটে উঠেছে এই কবিতায়। জীবনানন্দ দাশ কবিতার শুরু করেছেন খুবই সাধারণভাবে। তিনি শুনেছেন এক ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন এবং লাশকাটা ঘরের মর্গে শুয়ে আছেন। তিনি এখানে কথকের ন্যায় খুবই সাধারণভাবে শুরু করলেন—
‘শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ,
মরিবার হলো তার সাধ।’

মানুষের তো কত কিছুর সাধ আছে, বড়লোক হওয়ার সাধ, গাড়ি কেনার সাধ, খাওয়ার সাধ, প্রেমিকাকে পাওয়ার সাধ কিন্তু এই ব্যক্তির ‘মরিবার’ সাধ হলো—শব্দটি দিয়ে জীবনানন্দ একটি চমৎকার ধাঁধার সৃষ্টি করলেন। জীবনানন্দ যেহেতু পরজন্মে বিশ্বাস করতেন; সে কারণেই তিনি লোকটির মরার সময় উল্লেখ করলেন, যখন ডুবে গিয়েছে পঞ্চমীর চাঁদ। নিয়ম মতো পঞ্চমীর পরই ষষ্ঠী বা ষষ্ঠীর দিন। সনাতন ধর্মমতে ষষ্ঠী শিশুদের দেবতা তিনি নবজাতক সৃষ্টি করেন। তাহলে লোকটি কি আবার পুনর্জন্মের জন্য পঞ্চমীর রাতটিকেই নিজের আত্মাহুতির জন্য বেছে নিলেন? জীবনানন্দ দাশ পরের লাইনগুলোতে আবার লিখলেন—
‘বধু শুয়ে ছিল পাশে শিশুটিও ছিল,
প্রেম ছিল আশা ছিল জোৎস্নায় তবু সে দেখিল
কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল—লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।’

দাম্পত্য জীবনে লোকটির কোনো সমস্যা ছিল না। তার পাশে স্ত্রী শুয়ে ছিল, সন্তান ছিল। তাদের ঘুমন্ত অবস্থায় রেখেই সে আত্মাহুতি দেওয়ার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। এখানে জীবনানন্দ কি গৌতম বুদ্ধকে কল্পনা করলেন? বুদ্ধও তো জীবনের দুঃখ, জরা, ব্যধি—এইগুলোতে কখনো কষ্ট পাননি। তার স্ত্রী ছিল, সন্তান ছিল কিন্তু এইগুলো থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য রাজার বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে একরাতে স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করেন। বোধিপ্রাপ্তির আশায় বেরিয়ে পড়েন। লোকটিও কি ঠিক এই কাজটিই করলেন? পরের লাইনগুলোতে জীবনানন্দ দাশ লিখলেন—
‘এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি!
রক্তফেনা-মাখামুখে মড়কের ইঁদুরের মত ঘাড় গুজি
আঁধার ঘুজির বুকে ঘুমায় এবার
কোনদিন জাগিবে না আর
কোনদিন জাগিবে না আর
জাগিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম অবিরাম ভার।’

এখানে কবি লোকটিকে খানিকটা তাচ্ছিল্য করলেন। লোকটি কি মৃত্যুর পরে এই মরা ইঁদুরের মতো ঘুম চেয়েছিল। কোনোদিন জাগিবে না আর, জাগিবার গাঢ় বেদনার। এই লাইন দুটো নিয়ে বিতর্ক আছে। ‘কবিতা’ পত্রিকায় যখন কবিতাটি প্রথম ছাপা হয়; তখন লেখা ছিল জানিবার গাঢ় বেদনার—এমনকি কবিতাটি সংকলিত হয় ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম সংস্করণে সেখানেও জাগিবার স্থলে জানিবার শব্দটি আছে। কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’র সংস্করণে ১৯৫৬ এবং ১৯৭৩ সংস্করণে জানিবার স্থলে জাগিবার শব্দটি গ্রহণ করেছেন।

এই কবিতার গড়নের মূলে রয়েছে জাগরণ আর ঘুমের বৈপরীত্য। লোকটির ঘুম ভেঙে গেলে অকস্মাৎ সে ঘুমের জন্য বেছে নিলো আত্মহননের পথ। কেন সে জাগবে না কেনই বা জাগবে? জাগা মানেই তো বেদনার অবিরাম ভারে ভারাক্রান্ত হওয়া। জেগে থাকা মানেই জানা আর জানা মানেই তো উদ্যমের ব্যথা, উৎসাহের ভার জমানো কাজ আর মাথার ভেতর চিন্তার ব্যথা জাগরণ মানেই গাঢ় বেদনা। তাই ‘জীবন’ কবিতায় তিনি লিখলেন—
‘ঘুমায়ে যা দেখি নাই জেগে উঠে তার ব্যথা সইতে হয়।’
এই জাগরণের ব্যথার হাত থেকে নিস্তার পেতে মৃত্যুর সমার্থক ঘুম চাই আমাদের। সে কারণেই ‘প্রেম’ কবিতায় তিনি লিখেছেন—
‘সকলের ঘুম আছে ঘুমের মতন মৃত্যু বুকে
সকলের—নক্ষত্র ঝরে যায় মনের অসুখে।’
জীবনানন্দ দাশ আরও বলেছিলেন—
‘ঘুমাও ঘুমে মৃত্যুর মতো শান্তি আছে।’
কোনদিন জাগিবে না আর—এই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন ‘অন্ধকার’ কবিতায়।
‘ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম
পউশের রাতে
কোনদিন জাগবো না আর জেনে
কোনদিন জাগবো না আমি—কোনদিন জাগবো না আর।’

হঠাৎ ভোরের আলোর মুর্খ উচ্ছাসে জেগে উঠে নিজেকে পৃথিবীর জীব বলে বুঝতে পেরেছে বক্তা। ভয় পেয়েছে রক্তিম আকাশে সূর্য মানসিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য আমাকে নির্দেশ দিয়েছে। আমার সমস্ত হৃদয় বেদনার আক্রোশে ভরে গিয়েছে। জাগানোর ফলে এখানেও সেই বেদনার কথা। লাশকাটা ঘরের সেই মানুষটি আর কোনোদিন বেদনা অনুভব করতে জাগবে না। তাকে আর কোনো গাঢ় বেদনা অনুভব করতেও হবে না। পরের পঙক্তিগুলোতে জীবনানন্দ আবার জীবনবাদী হয়ে উঠলেন। লোকটির আত্মহননের বিরোধিতা করলেন—
‘তবুও তো পেচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে,
আরেকটি প্রভাতের ইশারায় অনুনের উষ্ণ অনুরাগে।’
লোকটিকে উদ্দেশ্য করে কবি বলছেন, তবুও তো পেচা জাগে বেঁচে থাকার জন্য। সাপ যে ব্যাঙটিকে ধরে ফেলেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই খেয়ে ফেলবে; সে ব্যাঙটিও বেঁচে থাকার জন্য প্রাণপণ লড়াই করে। আরেকটা ভোরের সূর্য দেখার জন্য। কবি আরও লিখলেন—
‘মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থাকে জীবনের স্রোত ভালবেসে।’

একটি মশাও মশারির ভেতর বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। এভাবে জীবনানন্দ লোকটিকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করেছেন—
‘রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে উড়ে যায় মাছি;
সোনালী রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কত দেখিয়াছি।
ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন কোন বিকীর্ণ জীবন
অধিকার করে আছে ইহাদের মন;
দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িংয়ের ঘন শিহরণ
মরণের সাথে লড়িয়াছে।’
আকাশকে জীবনের আশ্রয় মেনে নিয়ে কীটপতঙ্গরাও বেঁচে থাকে। দুরন্ত শিশু খেলার ছলে যখন কোনো ফড়িংকে ধরে, সে ফড়িংটিও বাঁচার জন্য আকুতি করে। কিন্তু লোকটির বাঁচার কোনো আকুতি নেই। সে গেল আত্মহত্যা করতে।
‘চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা একা
যে জীবন ফড়িংয়ের, দোয়েলের—মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা।’
লোকটি আত্মহত্যা করার জন্য অশ্বত্থ গাছকে বেছে নিলেন। অশ্বত্থ গাছ বোধিপ্রাপ্তির প্রতীক; জ্ঞানের প্রতীক। গৌতম বুদ্ধ অশ্বত্থের নিচেই ধ্যানমগ্ন থাকতেন এবং সেখান থেকেই বোধিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। লোকটিও অশ্বত্থ গাছের নিচে গিয়েছিলেন পঞ্চমীর রাত্রে চাঁদ ডুবে যাওয়ার সময় পরের দিনই লোকটি পুনর্জন্ম লাভ করবেন। মানুষ না হয়ে ফড়িং হয়ে দোয়েল হয়ে মানুষ হয়ে নয়। মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা। জীবনানন্দ দাশ তার নানা কবিতায় পুনর্জন্মের কথা বলেছেন কিন্তু তা মানুষ হয়ে নয়। যেমন-
‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়।
হয়তো মানুষ নয়—হয়তোবা শঙ্খচিল শালিকের বেশে।’

এমনকি তিনি ঘাস হয়ে জন্মাতে চেয়েছেন। অসুস্থ রোগীর পাশে কমলালেবু হয়ে জন্মাতে চেয়েছেন। সে কারণে কমলালেবু কবিতায় লিখলেন—
‘আবার যেন ফিরে আসি
কোন এক শীতের রাতে
একটা হীম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোন এক পরিচিত মুমূর্ষের বিছনার কিনারে।’
একজন পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে কমলালেবু হয়ে জন্মানোর এই আকুতি এই অসাধারণ মেটাফোর শুধু জীবনানন্দের পক্ষেই লেখা সম্ভব।

জীবনানন্দ দাশ আত্মহননের লোকটিকে আবার প্রশ্ন করলেন—
‘অশ্বত্থের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভীড় এসে সোনালী ফুলের স্নিগ্ধ ঝাকে,
করেনি কি মাখামাখি?
থুরথুরে অন্ধ পেচা এসে,
বলেনি কি বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?
চমৎকার!
ধরা যাক দু’একটা ইঁদুর এবার!
জানায়নি পেচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?

জীবনের এই স্বাদ সুপক্ক যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের
তোমার অসহ্য বোধ হল
মর্গে কি হৃদয় জুড়ালো।
মর্গে গুমোটে
থ্যাতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে।’
অশ্বত্থ হলো জ্ঞানবৃক্ষ, অথচ সেই বৃক্ষের ডালে লোকটা আত্মহত্যা করলো কিন্তু সে কোনো প্রতিবাদ করলো না? জোনাকির দল, ফুলের গন্ধ, যবের ঘ্রাণ—এইগুলোও তাকে কোনো আকর্ষণ করলো না? এই সৌন্দর্যের চাইতেও তার কাছে মর্গের ঘুম অনেক ভালো মনে হলো? সেখানে এখন সে মরা ইঁদুরের মতো ঘুমুচ্ছে; সেটাই তার কাছে অনেক প্রিয় বলে মনে হলো?

অশ্বত্থ গাছের ডালে এক বৃদ্ধ পেচা বসেছিল, সে আবার অন্ধ। এই বৃদ্ধ অন্ধ পেচা চাঁদ ডুবে যাওয়ার পরেও বেঁচে থাকার জন্য একটা ইঁদুর ধরার জন্য অপেক্ষা করছে। এই পেচাটিকে দেখেও লোকটির বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছে করলো না। এভাবে প্রশ্নে কবি মৃত মানষটিকে জর্জরিত করেছেন। জীবনানন্দ দাশ আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া ব্যক্তিটিকে নিয়ে আবার লিখলেন—
‘শোনো
তবু এ মৃতের গল্প, কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি খাদ।
সময়ের ঊর্ধ্বতনে উঠে এসে বধু
মধু আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাড়হাভাতের গ্লানি বেদনার শীতে
এ জীবন কোনদিন কেঁপে ওঠে নাই
তাই লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।’
এই মৃত ব্যক্তি প্রেমে ব্যর্থ হয় নাই, দাম্পত্য জীবনে তার কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। স্ত্রী তাকে পরিপূর্ণ সুখ দিয়েছে। ক্ষুধা শীতে সে কোনোদিন কষ্ট পায় নাই। কিন্তু তারপরও সে আত্মহত্যা করে লাশকাটা ঘরে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে।

জীবনানন্দ দাশ এতক্ষণ লোকটির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। মৃত ব্যক্তিকে জীবনের পক্ষে নানা প্রশ্ন করছিলেন। কিন্তু এখন এসে তিনি যেন আবার পরোক্ষভাবে লোকটিকে সমর্থন করলেন। তাই তিনি লিখলেন—
‘জানি তবু জানি,
নারীর হৃদয় প্রেম শিশু গৃহ নয় সবখানি।
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়
আরও এক বিপন্ন বিস্ময়।
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;

আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত করে—ক্লান্ত করে।
লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই
তাই লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।’

নারীর হৃদয়, গৃহ, শিশু—এ সবকিছুই জীবনের প্রধান বিষয় নয়। আমাদের হৃদয়ে এক অজানা বিস্ময় কাজ করে, যা আমাদের অস্থির করে, ক্লান্ত করে। জীবনানন্দ দাশ তার নাম দিলেন বিপন্ন বিস্ময়। এই বিপন্ন বিস্ময়ের ঘোরে লোকটি চাঁদ ডুবে গেলে উটের গ্রীবার মতো দীর্ঘ রাত্রির এক নিস্তব্ধতায় নিজে এক গাছা দড়ি হাতে অশ্বত্থ গাছের শাখায় গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে গিয়েছিলেন। জীবনানন্দ দাশ এই বিপন্ন বিস্ময়কে লাশকাটা ঘর থেকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার এক কবিতায় লিখেছিলেন—
‘আবার জাগিনু আখি। রাত্রি হলো ক্ষয়
পাপড়ি মেলিল বিশ্ব, এই তো বিস্ময়।’

লাশকাটা ঘরে এই বিপন্ন বিস্ময়ের ক্লান্তি নাই। কিন্তু বিপন্ন বিস্ময় একটা রহস্যই থেকে যাবে। ক্লিনটন বি শেলির মতে, বিপন্ন বিস্ময় যাই হোক না কেন, ক্লান্তির কারণ ঘটায় এবং আত্মহননের ইন্ধন জাগায়। এই শব্দযুগলের মধ্যে ঝুলে আছে কবিতাটা। লোকটি অশ্বত্থ গাছের মুখোমুখি হয়ে কবিতাটির আবেগের চরম পরিণতি দিয়েছে কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে প্রশ্ন ওঠে, লোকটি কেন আত্মহত্যা করলো? কী এই বিপন্ন বিস্ময়? দীপ্তি ত্রিপাঠী বলেন, বিপন্ন বিস্ময় সৃষ্টিশীলতার মানসিক যন্ত্রণাকে প্রতিনিধিত্ব করে। এই বিপন্ন বিস্ময় তো সৃষ্টির বেদনা। বোধ কবিতাতেও জীবনানন্দ দাশ এই সৃষ্টির তাড়নার কথা বলছেন।
‘স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে।’
এই মহাশক্তির কাছে কবি অসহায়। রবীন্দ্রনাথ সামন্ত এই বিপন্ন বিস্ময় নিয়ে লিখেছেন—
‘কবি মৃত্যুকেই বিস্ময়ের বোধে দেখেছেন। জীবনানন্দ মূলত বিস্ময়বোধের কবি। রোমান্টিক কবির মতো এই বিস্ময়বোধ ঘাস, ফুল, নক্ষত্র, নদী, নারীর মতো মৃত্যুকেও মৃত্যুর অবারণ আকর্ষণকে বড় বিস্ময়ের চোখে দেখেছেন। ওই মানুষটির সব ছিল, এখন মৃত্যুনিস্ব, ঐ মানুষটি কাল জীবিত ছিলো আজ নেই। এই আশ্চর্য কাণ্ডের কারণ খুঁজতে গিয়ে কবি বিপন্ন এবং বিস্মিত।’

কিন্তু সব বাদ দিয়ে কবিতার শেষে জীবনানন্দ দাশ আবার জীবনবাদী হয়ে উঠলেন—
‘তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি আহা
থুরথুরে অন্ধ পেচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে
চোখ পাল্টায়ে কয়, বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?
চমৎকার!
ধরা যাক দু’একটা ইঁদুর এবার—

****
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব
জীবনের প্রচুর ভাড়ার।’

চাঁদ ডুবে গেলেও সেই থুরথুরে অন্ধ পেচা অশ্বত্থের ডালে বসে অপেক্ষা করে আরেকটা ইঁদুর ধরার জন্য। জীবনানন্দ দাশ নিজেও কি একইভাবে জীবনের শেষ পর্যন্ত দুনিয়ার অনেক বিস্ময় দেখে যেতে চেয়েছিলেন? কিন্তু সেটা কি তিনি আসলেই পেরেছিলেন? নাকি বিপন্ন বিস্ময়ের ট্রামের তলায় নিজেকে শপে দিয়েছিলেন—এ বিষয়ে আলোচনা চলবে আরও দীর্ঘদিন।

লেখক: শিক্ষক ও কথাশিল্পী।

এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন