মোহাম্মদ রায়হানের গল্প: উদ্যানে শেষ পলক
বয়স হয়েছে। তবুও সাদিয়াকে সবাই ‘বাচ্চা বাচ্চা’ বলে ক্ষ্যাপালে একটা জায়গায় সে ঠিক। ফোনকলের ওপাশ থেকে যখন শোনে, অনিক সিগারেট ধরিয়ে বিড়বিড় করে কথা বলছে, চোখ-মুখ আগুন করে কথা বন্ধ করে দেয়। এ নিয়ে কয়েকশ বার অনিক সিগারেট খাবে না, ছুঁবে না বলে কথা দিলেও পুনরায় নতুন উদ্যমেই সিগারেট ধরায়।
আজ রিকশায় চড়তে অনিক কোনো সিগারেট ধরায়নি দেখে সাদিয়া বিস্মিত। আশ্চর্য, আজ মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! রিকশায় চেপে বসে দুজন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে চললো। মাস ছয়েক ধরে অনিক সাদিয়াকে একটাই অনুরোধের স্বরে বায়না ধরে বসে আছে। কবিতার লাইনে সাদিয়ার কাছ থেকে একটি নিরস-কর্কষ দুপুর চেয়েছে। প্রায়ই চারটে লাইন অনিকের মাথায় ভনভন করে, ‘এখানকার দুপুরগুলো বড়ই নিরস/ কারণ এখানকার প্রেমিকের খালি পেটে কথার ঝুলি পূর্ণ একটি দুপুর ভিক্ষে চাওয়ার আহ্লাদ এখানে পূর্ণ হয় না/ পূর্ণ হয় তৃতীয় মানুষকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। আজ সেই আশা পূর্ণ হওয়ার দিন।’
সাদিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থী, অনিক পড়ে শেকৃবিতে। ঢাকা শহরের কষ্টকর জ্যাম ঠেলে শেষে সাদিয়াকে নিয়ে রিকশায় চারুকলা থেকে দোয়েল চত্বর ঘুরে আবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসার সময়টাই সবচেয়ে সুখের।
আজকের এই সময়টা শত বসন্তের অসীম সুখের চেয়েও সুখকর, বুঝলে সাদিয়া?
থাক, বলতে হবে না। আমার সময় নেই। কী বলবেন তাড়াতাড়ি শেষ করবেন কিন্তু।
চলো, আগে বুনোফুল খুঁজি। মনে আছে, সেই প্রথম দেখার দিন লালবাগ কেল্লার ফুলগুলোর কথা। সাতরঙা সাতটা ফুল। একটা ফুল তোমার কানের পাশের চুলে গুঁজে দেওয়ার পর যেটা আমি পেয়েছি, তা কখনোই ভুলতে পারবো না।
কথা বলতে বলতে অনিক ঠিকই ঘাসফুল খুঁজে নিয়েছে। সাদিয়ার কপালে একটা টিপ আর কানে একটি ফুল অনিকের ভীষণ প্রিয়। প্রথম যেদিন দেখা, জোরপূর্বক কপালে টিপ পরিয়েছে আর কানে ফুল তো সে নিজেই গুঁজে দিয়েছে। চারুকলার সামনে যে কাঠের গহনাগুলো বিক্রি হয়; সেখান থেকে একটি কাঠগোলাপের ছবি খচিত লকেট গলায়, বেলি ফুলের আকৃতির কাঠের কানের দুল আর অনিকের পছন্দের কালো শাড়িতে এসেছে সাদিয়া। অবশ্য এতসব এই অনিকের জোরাজুরিতেই।
দুজন মুখোমুখি বসেছে, যেমন চাওয়া ছিল। অনিকের দৃষ্টি সাদিয়ার কালো টিপে। না বললেও চোখে কাজল দিয়ে এসেছে সাদিয়া। আশ্চর্যরকম সুন্দর লাগছে। কাজল দেওয়ার বিষয়টি অনিক ভাবেনি আগে। তবে অনিকের শারীরিক ভঙ্গি সাদিয়ার বাহ্যিক সৌন্দর্যের পূজা করলেও তার মনে শত কথা ঢেউ খেলছে। অল্প বয়সী মেয়েটিকে প্রতিনিয়ত সে এটা-ওটা উপদেশ দেয়, ভালো-খারাপ সব দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু এ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে তো, স্বভাবতই ভুল করবে ভেবে সব সহজ ভাবেই নেয় অনিক।
মোবাইলের নোটপ্যাডে আগ থেকে লিখে রেখেছে কী বলবে। যতটা সাহসের সাথে আবদার করেছে, ততটাই ভয়ে বুক কাঁপছে অনিকের। সাদিয়া স্পষ্ট দেখছে, নোটপ্যাডে থাকা লেখাগুলো স্ক্রল করতে বারবার আঙুল ভুল জায়গায় পড়ে যাচ্ছে। অনিকের তীর্যক দৃষ্টি ফোনে। দীর্ঘক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে ছিল। যেন পরীক্ষা তার মিনিট পাঁচেক পরেই। সাদিয়া কিছুটা বিরক্তও হচ্ছে। অনিকের সাদা পাঞ্জাবির কুঁচকে যাওয়া দেখতে দেখতে সাদিয়া সময় পার করছে। ইস, কেমন অযত্ন করে নিজের। পরীক্ষার সময় অন্য মানুষ ঘুম থেকে জাগিয়ে দেওয়া, ফোনকলে ডুবে পরীক্ষায় ভরাডুবি, রাত জেগে কথার ঝুলি সব কিছুতেই নিজের প্রতি অযত্নের চাপ স্পষ্ট দেখতে পায় সাদিয়া। হঠাৎ ফোনকলের টুংটাং শব্দে অনিক নড়েচড়ে বসলো। এতক্ষণে হয়তো হুঁশ হয়েছে তার সামনে কেউ একজন বসা। ফোনের কল কেটেই কেমন মুখ গোল করে অন্যমনস্ক হয়ে যায় সাদিয়া। ভ্রূ কুচকে অনিক জিজ্ঞেস করে,
কী হয়েছে?
কিছু না।
আবির কল দিয়েছে?
আপনাকে কেন বলবো?
বলো বলছি। সব সময় সব কথা লুকাও কেন? বলতে বলছি না।
শোনেন ভাইয়া, আজ উঠি।
আশ্চর্য, হয়েছে কি তোমার? কষ্ট নিজের মধ্যে লুকোতে নেই। নিজের কষ্ট যদি বিশ্বস্ত কাউকে শেয়ার করো, কষ্ট অনেক হালকা হয়।
আমি কষ্ট নিয়েই বাঁচতে চাই। প্লিজ, আমি চলে যাচ্ছি।
বলেই হনহন করে সাদিয়া উঠে গেল। আবিরকে বড্ড পছন্দ করে সাদিয়া। তার সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা। বছর দেড়েক আগে সাদিয়ার সাথে অনিকের পরিচয়। এর ঠিক সপ্তাহ ছয়েকের মাথায় আবার আবিরের সাথে পরিচয়ে নতুন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পারিবারিক বিয়ে নয়, দুজন দুজনের পছন্দের ওপর নির্ভর করেই বিয়ের কথা পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। আবির ঢাকা শহরের বাইরে চাকরি করে।
অনিক নির্বিকার চিত্তে উদ্যানের ঘাসের ওপর চেপে বসেই আছে। একদিকে অভিমান, আরেক দিকে কষ্ট। নিজেই অভিমান করে সারাদিন কাটাবে, তবুও সাদিয়ার পিছে পিছে ছুটবে না। একলাই মেয়েটা ছুটলো। উদ্যানের যে গেট দিয়ে টিএসসি, সেখানকার মুখে সর্বশেষ সাদিয়ার কাপড়ের আঁচল অনিক লক্ষ্য করলো। এক ঝলক কালো আভা চোখের পলকেই নিভে গেল। অনিক ভাবে, এ কালো কেবল সাদিয়ার শাড়ির রং নয়, তার হৃদয়ের রং। সুখের নয়, অভিমানের রং কালো। ছেলেদের অভিমান মানায়, অতিরিক্ত রাগ তো সবারই থাকে। অনিক সব সময় রাগ চেপে ধরার অনুশীলন করে। এদিক দিয়ে বাকি পুরুষের থেকে আলাদা। রাগ আর অভিমানের মাঝে মানুষ পার্থক্য খুঁজে পায় না। অথচ রাগ মানুষের অত্যন্ত খারাপ গুণগুলোর একটি। ভাবতে ভাবতেই অনিক পাঞ্জাবির পকেট থেকে আরেকটি সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে অভিমানগুলো উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ছেলেটার ভেতর কবি কবি একটা ভাব আছে। দিন নেই, রাত নেই, সুযোগ পেলেই দুটো লাইন লিখে ফেলে। সিগারেট ধরিয়েই ফোনের নোটপ্যাডে আরও দুটি বিরহের লাইন লিখে ফেললো, ‘এই উদ্যানে আমাদের গল্পগুলো পাঁখা মেলতে গিয়েও কাকেদের ডানা ঝাপটানি তোমাকে আমার হতেই দিলো না!’
প্রতিবারের মতো এবার আর সাদিয়া অনিকের সাথে যোগাযোগ করেনি কোনো রকম। বিয়ে-শাদিতে মানসিক শান্তিকে প্রথম গুরুত্ব দিতে হয়। যেখানে মানসিক শান্তি মেলে না; সেখানে কোনো সম্পর্কই টেকে না। মানসিক শান্তি বিয়ে কিংবা সম্পর্ক যে কোনো ক্ষেত্রেই প্রধান বিবেচনার বিষয়। কথাটি রোজ সাদিয়াকে বলতো অনিক। আবিরের সাথে একটা নিশ্চিত অশান্তির সম্পর্কে জড়িয়ে আছে সাদিয়া। দুদিন পর রাগ, দুদিন পর ঝগড়া, আবার দুজনের মাঝে অদৃশ্য বোঝাপড়া, এই ভালো এই ঝগড়া। অনিক দম বন্ধ করে তাদের গল্প শোনে। সাদিয়াকে সান্ত্বনা দেয় আর অন্যরকম চাপা কষ্টে নিজেই জড়িয়ে যায়। সব কিছুর পরও রাত জেগে সাদিয়ার ফোনকল অনিকের সব কষ্ট আর অভিমানকে ভুলিয়ে দেয়। কে জানে, কী টানে সে এখানেই পড়ে আছে।
তিনদিন পরও সাদিয়ার সাথে অনিকের যোগাযোগ নেই। সেদিন সারপ্রাইজ দেবে বলে সব কথা জমিয়ে রেখেছে অনিক। বিকেলে মেসে যখন কেউ থাকে না, অনিক তার বেলকনির হাসনাহেনা ফুলের সুবাস নিতে বসে। পাশে থাকা নয়নতারাকে অনিক স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না আজ। বারবার কান্না পাচ্ছে। ফুল তার ভীষণ প্রিয়, তাই এর সুবাস নিতে বেলকনিতে বসেছে। কিন্তু অতি দ্রুতই আজ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।
আগামীকাল অনিকের ফ্লাইট। সেদিন ভিসার কাগজপত্র ব্যাগে করে নিয়ে গিয়েছিল অনিক। জমানো সব কথার সাথে তার স্কলারশিপের সুখবরটাও দেবে ভেবে। কে জানে, সেদিন অনিকের দেশ ছাড়ার খবর শুনে সাদিয়া হয়তো খুশিতে ভেসে যেত। অনিক ভাবে, সাদিয়া এবার হয়তো মুক্তি পাবে। প্রায়শই শুনতো অনিককে নিয়ে তাদের মাঝে অসংখ্যবার ঝগড়াও হয়েছে। সেদিন দুপুরে কি এমন কিছুই হয়েছে? অনিক তবুও অপেক্ষা করে, ভাবতে থাকে। হঠাৎ করেই রুমমেট এসে টি-শার্টের এক কোণা টান দিয়ে বলল, ‘দ্রুত আয়, ব্যাগ এখনই না গোছালে কাল সময় পাবি?’
এসইউ/এমএস