শফিক নহোরের গল্প: মনের দরজা
রাসেল ভাই আমার প্রাইভেট মাস্টার। সন্ধ্যার পরে বাসায় পড়াতে আসতেন। বাড়িতে মা একা পাশের ঘরে জি-বাংলা দেখছিলেন। বাংলা সিনেমার সংলাপ আমার কানেও আসছিল। রাসেল ভাই সেদিনই প্রথম আমাকে পড়াতে এসেছিলেন। মা কিছুক্ষণ পর এসে নাস্তা দিয়ে গেলেন। মাস্টার মশাই একাই ইঁদুরের মতো কুটকুট করে নাস্তা খেতে লাগলেন। মা কিছুক্ষণ পরে চা দিয়ে গেলেন। রাসেল ভাইকে খুব খাদক টাইপের লোক মনে হলো আমার কাছে। খাবার সময় আমাকে কিছুই বললেন না। পুরোটাই খেয়ে শেষ করলেন মাশাআল্লাহ। নাস্তা শেষে আমাকে বললেন, ‘বুঝতে না পারলে আমাকে জিজ্ঞেস করবে, কেমন? আমাকে বেশি লজ্জা পাবার কিছু নেই। আমি তোমাদের গ্রামের ছেলে। আজ তাহলে উঠি। আমি যে পড়াগুলো দিয়েছি সেগুলো দেখবে। বিশেষ কোনো অসুবিধা হলে তা পরের দিন আলোচনা করবো।’
রাসেল ভাই মাঝে মাঝেই আমার দিকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকতেন; আমি সেটা বুঝতে পারতাম। একুশ দিনের মাথায় আমি নিজেই রাসেল ভাইকে প্রশ্ন করলাম, ‘রাসেল ভাই, আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন?’
‘হঠাৎ তোমার এমন মনে হলো কেন, বলো তো?’
‘না, মানে, আপনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন তো? তাই ভেবেছি, আপনি হয়তো কিছু একটা বলতে চান।’
মিচকে শয়তানের মতো হালকা একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘না তেমন কিছু না। পরের অধ্যায়ের অঙ্কগুলো কিন্তু আমাকে নিজে করে দেখাতে হবে। আজ আমার একটু তাড়া আছে...’ বলেই বিদায় নিলেন।
রাসেল ভাই এ ঘটনার তিনদিন পরে আমার অঙ্ক খাতায় লিখলেন, ‘কিছু একটা বলতে চাই।’ আমি বেশ খানিকটা সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম! মুখের ভঙ্গি আর চোখের ভাষায় তাকে বেশ এলোমেলো দেখাচ্ছে। তিনি আমাকে কেমন যেন একটা জাদুকরী মোহের ভেতরে ফেলে দিলেন। এভাবেই রাসেল ভাইয়ের সঙ্গে আমার রোমান্টিকতার শুরু। আমি তার কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে পরাজিত হই। আমি তখন অনেকটা আনাড়ি। নিজের শরীরের প্রতি ছিলাম বড্ড অনাগ্রহী। অনাগ্রহ নাকি রাসেল ভাইয়ের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতাই ছিল, তা ভাবতে ভাবতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে আসে।
আমি সকালে বিশেষ কাজে বাবার সাথে রাজশাহী যাবো বলে বেরিয়েছি। পথে রাসেল ভাইয়ের সাথে দেখা। আমাকে দেখে কেমন যেন না দেখার ভান করলেন তিনি। আমি খুব সহজে বিষয়টা মেনে নিতে পারলাম না। তার দু’দিন পরের ঘটনাটা আমাকে আরও অবাক করেছে। রাতে রাসেল ভাইয়ের সাথে জানালা খুলে কথা বলতে চাইলে অজুহাত দেখিয়ে কেটে পড়েন। তার অজুহাতটা ছিল এরকম, ‘রাস্তা দিয়ে লোকজন যাওয়া-আসা করছে। লোকে দেখলে মন্দ ভাববে। নানা কথা হবে। আমি পরে একসময় তোমার সঙ্গে কথা বলবো।’ কোনোরকমে কথা শেষ করেই তিনি আমাকে বেকুবের মতো বুঝ মানিয়ে চলে গেলেন!
কলেজে ভর্তি হওয়ার পর রাজশাহীর সাহেব বাজারে চলে আসি। সাহেব বাজার থেকে হেতেম খাঁর ছোট মসজিদ এলাকা হয়ে একা একা আসা আমার পক্ষে খুব কঠিন হয়ে যেত। তবুও জীবনের নতুন মোড় ঘোরাতে কষ্টকে কখনো কষ্ট মনে হয়নি। অপ্রত্যাশিত ভাবে রিকশাচালকের সাথে ভাড়া নিয়ে দু’কথা হতেই এক ভদ্রলোক বিষয়টা বুঝতে পেরে রিকশাচালককে সাবধান করে দিলেন। দেখলাম তার ভেতরে একটা চমৎকার পুরুষালি ভাব কাজ করছে। পরিচয় পর্ব শেষে ভদ্রতার খাতিরে ছেলেটা মোবাইল নম্বর চেয়ে বসলো। চোখের দিকে তাকাতেই মনে হলো তাকে বিশ্বাস করা যায়।
রাসেল ভাইয়ের সাথে আমার একেবারেই যোগাযোগ নেই। বাড়ি থেকে শুনেছি চট্টগ্রাম শহরে তার নতুন চাকরি হয়েছে। তখন খুব কম মানুষের হাতে মোবাইল ফোন। এখনকার মতো না। ঠিকানা জানি না, অন্য কোনো মাধ্যমও ছিল না। তবুও বহুবার যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। স্মৃতিগুলো আজও বেশ নাড়া দেয়। জীবনের দরজায় আসা প্রথম মানুষের স্মৃতি সত্যিই আমরা কেউ ভুলি না; চাইলেও ভুলতেও পারি না। নিজের সাথেই একটা মিথ্যে অভিনয় করি।
সুমন নামের সেই ছেলের সাথে ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব জমে ওঠে। তারপর প্রেম! বলে রাখা ভালো, উপরের কাহিনিটা আমার দরজায় টোকা দিয়ে যাওয়া অপূর্ণ প্রেমের গল্প। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ভাগ্যক্রমে সুমনও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তখন আমি আমার বন্ধু সুমনকে অকপটে এই কাহিনি শুনিয়েছিলাম। সুমন শুধু বলেছিল, ‘একটা মেয়েমানুষ এমন সত্যি কথাও অকপটে বলতে পারে? আমি অবাক!’ তাই আমার প্রতি খুব সহজেই সুমনের একটা বিশ্বাসও জন্মেছিল। এরপর তাকে আমি আরও অনেক কথা বলেছি।
আমাদের দুজনের মাঝে বেশিরভাগ কথা হতো রাতের বেলায়। জোনাকি পোকার মৃদু আলোয় আর ঝিঁ-ঝিঁর শব্দে। কখনো কখনো আমার মনে হতো রাতের গভীরতায় আমাদের এই কথোপকথন একটি পুরোনো পাপের দরজায় এনে দাঁড় করিয়েছে। আমি নিজেকে তখন শুধুই পাপী ও বোকা মনে করতাম। তাই কারণে বা অকারণেই নিজের সুখের কথা ভুলে যেতাম। তখন চোখের সামনে শুধু রাসেলের মুখ ভেসে উঠতো। একজন মানুষ এতটা প্রতারক হতে পারে! তার কাছে প্রেমের কোনো কদর ছিল না। তার দৃষ্টি ছিল কামুক। সে তার প্রাপ্য লাভ ঠিকই বুঝে নিয়েছে। নিঃস্ব হয়েছি আমি। তাকে এখন ঘৃণা করতেও ঘৃণা হয়। তবে আমি আজ সুমনের কথাও আনমনেই খুব করে ভাবি।
সংসারের টানাপোড়েনের কারণে নিজের শখ, আহ্লাদ জলে ডুবে গিয়েছিল। শরীর অবশ হয়ে সে সময়ে বাবা ঘরে পড়ে আছেন। মা প্রতিদিন শতবার বলতেন, ‘এত মানুষ মরে, আল্লাহ্ তোমারে চোখে দেখে না।’ মা যখন মাধ্যমিকে পড়তেন, তখন প্রেম করে বিয়ে। সেই থেকে তার সংসারের ঘানি টানা শুরু। ছেলেমেয়ে মানুষ করা থেকে শুরু করে এতদিন পর্যন্ত কীসের মায়ায় মা এ সংসারে, তা মা ছাড়া কেউ জানে না। মাকে বলতাম, মা তুমি সুন্দরী, লেখাপড়া জানো; বাবার মতো একজন মানুষের জীবনে ঝুলে পড়ে আছো কেন? মা আমাকে খুব জোরে থাপ্পড় দিয়ে বলেছিলেন, ‘স্বামীর সংসার। দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা, পাওয়া-না পাওয়ায় মানুষের চেষ্টাও লাগে, আবার তকদিরও লাগে। জীবনে তোর বাজান কম চেষ্টা করেন নাই! ভাগ্যে সুখ নাই, জোর করে কি সুখী হওয়া যায়? তোদের মানুষের মতো মানুষ করতে তার চেষ্টার কমতি ছিল না রে, পোড়ামুখী। জীবন-যৌবন দামি জিনিস। হেফাজতের জিনিস অবহেলায় ছেলেমানুষি করলে মেয়ে মানুষের কী থাকে, বল? লেখাপড়া করছিস অথচ মাথার ভেতরে গোবর! সংসারের মায়া কি তোর বাপের চেয়ে তোর বেশি? আজ বাদে কাল তোর বিয়ে দিলে স্বামীর সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবি। তখন আমাদের কথা মনে থাকবে? সংসার জীবনে কেউ আপন না রে, মৌ। তোকে পেটে ধরি নাই ঠিকই, কিন্তু তোর জন্য বড্ড মায়া হয়। মানুষটা সারাদিন ঘরের বারান্দায় একটার পর একটা বিড়ি টানবে আর খুকখুক করে কাশবে। বারান্দার সামনে মানুষের থোকা থোকা কাশ ফেলানো কি ভালো জিনিস? ডাক্তার বারণ করেছে; আমিও তো আল্লাহর ত্রিশ দিনই বলি ধূমপান ছাড়তে। আমার কথার কি তোর বাবার কাছে দাম আছে? একআনাও নাই! রাসেল আর তোরে নিয়ে মানুষ কানাঘুষা করে। আমাদের সামনে কেউ কিছু বলে না। আমি মা, আমার কাছে অন্ততপক্ষে খুলে বলতে পারতি! বেটা মানুষ কি ভালো মানুষ গো, সব হারামির জাত! সুমন পোলাডা কে গো? তোর কি শুধুই বন্ধু? তোরে ভালোবাসার কথা বলে না? ছেলেটার মুখের দিকে তাকালে মায়া হয়। মনে হয় কত জনমের আপন মানুষ। মুখের দিকে তাকালে কেমন মুখখানা শুকনা শুকনা লাগে। তুই না বলছিস, আমার সাথে নাকি ছেলেটা দেখা করতে চায়? একদিন আমাদের বাড়িতে আসতে বল।’
মায়ের সেদিন সুমনের কথা বলা শেষ না হতেই সে এসে হাজির। এ যেন মেঘ না চাইতেই ভারী বর্ষণ।
আচার ব্যবহার দেখে মায়ের কাছে ওকে ভালো মানুষ মনে হয়। সে পরিচয় পর্ব শেষ করেই বলল, ‘কাকি, মৌয়ের সঙ্গে আমার ফোনে অনেক কথাই হয়েছে। তারপর দেখাও হয়েছে অনেকবার। মৌ খুব সহজ-সরল মেয়ে। আমি মৌকে বউ হিসেবে ঘরে নিতে চাই, যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে। ওর লেখাপড়ায় আমার কোনো আপত্তি নেই। হয়তো ভাবছেন, বিয়ের কথা বলছি কেন? আমার পরিবারে আমি আর আমার মা। মা অসুস্থ। ঘরের বাইরে বের হওয়াও তার জন্য কঠিন। আমার ছোট খালাই মায়ের দেখাশোনা করেন। খালারও আমরা ছাড়া কেউ নেই। জনমদুঃখী মানুষ। তাই সাত-পাঁচ না ভেবে সরাসরি বলা। যদিও আপনাদের গ্রামের অনেক মানুষই মৌয়ের সম্পর্কে আমাকে অনেক বাজে কথা বলেছে। আমার বিশ্বাস, যে সত্য বলে, সে খারাপ মানুষ হতে পারে না। আমি একজন ভালো ও সত্যাশ্রয়ী মানুষ খুঁজছি। আমার কাছে মনে হয়েছে মৌ আমার সেই যোগ্যতম মানবী। ওর প্রতি আমার বিশ্বাস ও ভালোবাসা থেকেই বলছি, মৌয়ের মতামত জেনেই আমি চলে যাবো।’
ঘরের ভেতর থেকে আমি বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। চোখ দুটো জলে ভেজা। সুমন আমাকে দেখেই বলল, ‘তোমার চোখ দুটো কানাকুয়ো পাখির মতো লাল কেন?’ উদাস কণ্ঠে সুমনের হাত ধরে বলতে লাগলাম, তোমার কাছে ভালো থাকতে পারবো হয়তো, কিন্তু সুখী হতে পারবো না সুমন। মনের ভেতরে এতটা দুঃখ আর পাপবোধ নিয়ে কখনই সুখী হওয়া যায় না। সুমন তুমি ফিরে যাও!’ এক দৌড়ে আমি ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম।
এসইউ/এমএস