স্বপ্ন দেখি গল্পটি বলবো বলে
রাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা আমার খুবই অদ্ভুত। এমনও হয় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তার সঙ্গে আমার কোনো কথা হয় না। দেখা হয় না। আবার যখন কথা হয়, তখনো যে খুব বেশি হয় এমনটা নয়। রাইকে আমি ভালোবাসি। খুব করে বাসি। কিন্তু ও কি আমাকে বাসে? কখনো মনে হয় বাসে। আবার কখনো মনে হয় একেবারেই বাসে না। তবুও আমি তার জন্য প্রবল টান অনুভব করি। বর্ষার উতলা নদী যেমন টেনে নেয় পাড়ের জমি বসতবাড়ি স্থাপনা গাছপালা। আমার তেমন প্রবল টানে রাইকে বুকের ভেতর নিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু নেবো কিভাবে? রাই তো জোছনার মতো। চারপাশ জুড়ে বিছিয়ে থাকে। শরীর ও মনজুড়ে লেগে থাকে নরম আলো হয়ে। তাকে অনুভব করা যায়। কিন্তু ছোঁয়া যায় না। সে পাশে থাকে। তবে অবয়বহীন। তাকে শুধুই অনুভবে পাওয়া যায়। রক্তে মাংসে পাওয়া যায় না। বাস্তবে পাওয়া যায় না।
তাকে আমি তীব্রভাবে অনুভব করি বলেই হয়তো প্রায় রাতেই স্বপ্নে দেখি। যেমন দেখলাম গতকাল রাতেও। রাতে না ঠিক, রাই আমার স্বপ্নে এসেছে আজ ভোরের একটু পরে। এমনিতে অনেক রাত করে ঘুমাই বলে ঘুম ভাঙতে দশটা সাড়ে দশটা বেজে যায়। তার ওপর আজ ভোরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছিল। খোলা জানালা দিয়ে আসছিল বৃষ্টির ঝাঁট। হাত বাড়িয়ে জানালাটা বন্ধ করতে ইচ্ছে করেনি আমার। তারচেয়ে বালিশের পাশ থেকে কাঁথাটা টেনে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে অতল ঘুমে হারিয়ে যাই। এর পরপরই রাই এসে হাজির হয় আমার স্বপ্নে। স্বপ্নটা দেখার ঠিক পরপরই ঘুম ভেঙে যায় আমার। ঘুম ভেঙে যাওয়াতে ভীষণ রকম মন খারাপ লাগে। রাইকে খুঁজি আশপাশে। কিন্তু তার তো থাকার কথা নয়—এখন এখানে। স্বপ্নটা এত বাস্তব ছিল, মনে হচ্ছিল রাই কাছাকাছি কোথাও আছে। এমনকি রাইয়ের শরীরের মোহন গন্ধটাও টের পাচ্ছিলাম আমি। আর এ কারণেই আরও বেশি মন খারাপ লাগে। ঘুমটা যদি না ভাঙতো, আরও দীর্ঘক্ষণ দেখতে পারতাম যদি স্বপ্নটা? স্বপ্নে হলেও রাই আর আমি পাশাপাশি থাকতাম!
ইচ্ছে করে রাইকে তখনই ফোন দিই। কিন্তু বুকের ভেতর কোথায় জানি একটা অচেনা অভিমান জমে। মনে হয় কী হবে ফোন দিয়ে? তারচেয়ে বরং স্বপ্নটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি। তবে দুপুরবেলা তাকে টেক্সট করি—রাই কাল রাতে তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি।
কী দেখেছো?
দেখলাম আমি তোমার বাসায় গেছি। একটা পাঞ্জাবি পরেছি। সাইজে অনেক বড়। এই দেখে তুমি খুব হাসাহাসি করছো। আর আমি বলছি, হাসছো কেন? তুমি আরও বেশি করে হাসছো। একেবারে বাচ্চাদের মতো খিলখিল হাসি। তোমার হাসির শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম ভাঙার পরও অনেকক্ষণ ধরে শুনছিলাম হাসির শব্দটা। মনে হচ্ছিল পাশের ঘরে বসে হাসছো তুমি।
বাহ, খুব মজার স্বপ্ন তো!
এই সময় আমি একটু ফিলোসফি করার চেষ্টা করি। বলি, আসলে কি জানো রাই। যেসব ইচ্ছে মানুষের মনে খুব প্রবলভাবে থাকে; সেগুলোই স্বপ্নে দেখে!
ওহ!
এটুকু বলেই চুপ করে যায় রাই। মেয়েটা আসলে এমনই। হয়তো অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছে, বলতে বলতে এক পর্যায়ে হুট করে চুপ করে যাবে। হাজারটা কথা জিজ্ঞেস করলেও তখন আর কোনো উত্তর দেবে না। সেই সময়গুলো আমার খুব অস্থির লাগে। অসহনীয় অভিমান হয় মনের ভেতর। ভাবি, ধুর ছাই আর কথাই বলবো না তার সঙ্গে। যে আমার সঙ্গে এত ভাব দেখায় তার সঙ্গে যেচে আলাপ করার কী এত ঠেকা পড়েছে আমার। কিন্তু ওই ভাবা পর্যন্তই! কয়েকঘণ্টা গেলেই আবার তাকে নক দিই—কী করো রাই? অথবা লিখি—একটু ফোন দেওয়া যাবে রাই? বেশিরভাগ সময় এসব কথার কোনো উত্তর দেয় না সে। সিন করে ফেলে রাখে। আবার কখনো কখনো লেখে—খু্ব বেশি ইচ্ছে করছে? এই লাইনটা যখন লেখে, আনন্দে বান ডেকে যায় ভেতরে আমার! সঙ্গে সঙ্গেই ফোন দিই তাকে। এসব সময়ে অনর্গল কথা বলে যায় রাই আমার সঙ্গে। আমি যতক্ষণ পর্যন্ত নিজে থেকে ফোন রাখার কথা না বলি, রাই কথা বলতেই থাকে। আমার কথা শুনতেই থাকে।
আচ্ছা, কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে যাচ্ছি। আজকাল এমন হয়েছে খুব গুছিয়ে সুন্দর করে কিছু বলতে পারি না। রাই বলে—এটা বয়সের দোষ। বয়স হলে মানুষ এমন হয়ে যায়! তুমি দিন দিন বুড়ো হয়ে যাচ্ছো তো! তাই কথার খেই হারিয়ে ফেলো! বলেই তার সেই বিখ্যাত খিলখিল হাসিতে মাতিয়ে তোলে চারপাশ। আর আমার কাছে মনে হয় একসঙ্গে জ্বলে উঠেছে লক্ষ তারার বাতি! মনে হয় একসঙ্গে কোথাও ভাঙলো একশ কাচের চুড়ি। আচ্ছা থাক এসব প্রসঙ্গ। রাইকে নিয়ে দেখা আরেকটা স্বপ্নের কথা বলি।
একদিন স্বপ্নে দেখলাম—রাই আর আমি রিকশা করে কোথায় যেন যাচ্ছি। শাঁ শাঁ করে এগিয়ে চলছে রিকশা। রাইয়ের মাথার চুল উড়ছে নদীর ধারের বাবলা গাছের মতো ভীষণ বেগে। একটু পর পর হাত দিয়ে একগুচ্ছ চুল কানের কাছে গুঁজে রাখছে সে। মুহূর্তেই চুলগুচ্ছ বাঁধনহারা হয়ে ঊর্ধ্বমুখ আকাশের দিকে ছুটতে চাইছে। আমি তখন বলেছিলাম—তোমার চুল আজ পাখির ডানা পেয়েছে। আকাশ ছুঁতে চাইছে। রাই একটা মিষ্টি হাসি দিলো। পরক্ষণেই বললো—কী সব ছাইপাশ কবিতা লেখো আজকাল! কিছুই হয় না! আমি যেন মিনমিন করে কি কৈফিয়ত দিচ্ছিলাম তাকে। ঘুম ভাঙার পর আর মনে করতে পারিনি। সকালে ঘুম থেকে জেগে রাইকে স্বপ্নের কথা বলতেই স্বভাবমতো কিছুক্ষণ হাসলো। তারপর বললো—কী কৈফিয়ত দিচ্ছিলে?
মনে নেই তো!
ধুর, মনে রাখবে না সব! তুমি হলে কবি। কবিদের এইসব খুঁটিনাটি বিষয় মনে রাখা উচিত।
ওহ আচ্ছা!
আচ্ছা শোনো না। তোমার কোনো কবিতা কিন্তু আমার কাছে ছাইপাশ মনে হয় না। খুব ভালো লেখো তুমি। আমি কবিতা তেমন বুঝি না। তবে তোমার কবিতা আমার খুব পছন্দের।
রাইয়ের কথা শুনে ধীরে ধীরে মন ভালো হতে থাকে আমার। আচমকা বলে বসি—রিকশা করে আমার সঙ্গে ঘুরবে রাই?
তোমার সেই স্বপ্নের মতো?
হুম!
ধুর পাগল, তাই কি হয়? জানো না আমার পক্ষে এটা সম্ভব নয়?
কেন সম্ভব নয়?
সেটা তুমিও জানো, আমিও জানি।
এরপর আর কোনো কথা বলি না আমি। নীরবতা ভাঙে রাই।
লেখালেখি বাড়াও।
বাড়ালে কী হবে?
উচিত বাড়ানো!
পারি না যে। তোমার সঙ্গে রিকশায় ঘুরতে পারলে বাড়াতে পারতাম।
থাক তোমার লেখা লাগবে না!
বলেই রাই হাসে সেই মোহন হাসি। আমিও হাসি।
এতক্ষণ ধরে যারা ধৈর্য নিয়ে শুনছেন এই গল্প, তাদের জন্য আরেকটা ঘটনা বলি। একবার শীতের রাতে হঠাৎ ফোন দেয় আমাদের বন্ধু রফিক। জাঁকিয়ে শীত পড়েছিল সেবার।
দোস্ত চল উত্তরবঙ্গ যাই। শীত দেখে আসি।
কখন যাবি?
এই তো এখনই। মহিম একটা মাইক্রোবাস জোগাড় করেছে। আমরা এখন রওয়ানা দিলে ভোরবেলা পঞ্চগড় পৌঁছাবো। পঞ্চগড়ে শীতের ভোর কী যে অপরূপ, তুই না দেখলে বুঝবি না দোস্ত।
এতো কথার দরকার নাই। কখন রওয়ানা দিবি বল?
এই তো অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই। তুই রেডি হয়ে থাক। মহিম গেন্ডারিয়া থেকে গাড়ি নিয়ে তোর বাসার কাছে আসবে। তোকে তুলে নিয়ে সোজা মিরপুর। সেখান থেকে আমি উঠবো। গাবতলী আমিনবাজার হয়ে সাভার দিয়ে সোজা পঞ্চগড়।
আচ্ছা।
রফিকের ফোন কেটে দিয়ে সেলফোনের ঘড়িতে দেখি রাত পৌনে একটা বাজে। মহিমকে ফোন দিলে বলে কাছাকাছি আছে। আমি ছোট্ট একটা ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এসে বাইরে দাঁড়াই। শরীরে আঘাত করে হিমশীতল বাতাস। তীব্র কুয়াশায় এক হাত সামনেও কিছু দেখা যায় না। মনে মনে ভাবি ঢাকার যদি এই অবস্থা হয়, পঞ্চগড়ে তাহলে কী হবে? পথে একটা মানুষও চোখে পড়ে না। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বড় রাস্তার মুখে এসে দাঁড়াই। ফোন দিই মহিমকে। বলে দুই মিনিট লাগবে। রাস্তার মোড়ে চা সিগারেটের দোকান নিয়ে বসে আছে বাবুল মিয়া। অন্যদিন সারারাত তার দোকানে ভিড় লেগে থাকে নানা কিসিমের মানুষে। কিন্তু আজকে এই শীতের রাতে খুব বেশি মানুষ দেখি না। দু’তিনজন রিকশাওয়ালা যাত্রীর আসনে বসে পা তুলে দিয়েছে সামনের সিটে। আরামসে চা খাচ্ছে আর শীতে কাঁপছে থরথর। একজনকে দেখি বিশাল বড় বাঁশের ঝাঁকা বাবুল মিয়ার ভ্যানে হেলান দিয়ে রেখে তার সামনের বেঞ্চে বসে সিগারেট টানছে। আর বাবুল মিয়া বসে আছে বিরস মুখে। এত শীতেও তার গায়ে শুধু একটা ফুলহাতা শার্ট। গলায় ঝোলানো একটা মাফলার। এগিয়ে যাই আমি বাবুল মিয়ার দোকানের দিকে।
কী বাবুল মিয়া, শীত লাগে না।
এত রাইতে আপনি এইহানে কী করেন পাভেল ভাই?
করি না কিছু। বাতাস বোঝার চেষ্টা করি।
কী যে কন না আপনে! আগামাথা বুঝি না কিছু।
বেশি বোঝার দরকার নাই বাবুল মিয়া। এক কাপ চা বানাও। চিনি কম দিবা।
বাবুল মিয়া আর কোনো কথা না বলে গরম পানি দিয়ে কাপ ধুতে থাকে। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে পকেট থেকে সেল ফোন বের করে দেখি একটা পঁচিশ বাজে! এখানে দাঁড়ানোর পর কেটে গেছে প্রায় বিশ মিনিট। কিন্তু মহিমের দুই মিনিট এখনো শেষ হয়নি। প্রচণ্ড রাগ লাগতে থাকে। ইচ্ছে করে তাকে ফোন দিয়ে কঠিন ঝাড়ি লাগাই। কিন্তু বলি না কিছুই। চুপচাপ চা খেতে থাকি। উপরে তাকাই। চোখে পড়ে কুয়াশার আবরণ ভেদ করে অনেক দূরে ঝুলে আছে বিশাল চাঁদ। বাবুল মিয়ার চায়ের ভ্যানের একটু দূরে একটি দোকানের বন্ধ শাটারের সামনে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে একটি কুকুর, তিনটি বয়সী মানুষ এবং এক কিশোর। কাঁথার ফাঁক গলে বের হয়ে আছে কিশোরের রোগা একটি পা। ময়লা জমে জমে পা-টা কেমন কালচে রং ধারণ করেছে। শীতে ফেটে যাওয়া গোঁড়ালির কাছে ভনভন করছে একটি মাছি। কাঁথায় মুড়িয়ে রাখা মাথার দিকটাতেও ভনভন করছে অনেকগুলো মাছি। তাদের পাশে জ্বলছে একটি কয়েল। কিন্তু তাতে মশা কিংবা মাছির কোনো বিকার নেই। হঠাৎ গাড়ির হর্নে চমকে উঠি। রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি ক্রিম কালারের মাইক্রোবাস থেকে বের হয়ে আসছে মহিম। গায়ে মোটা জ্যাকেট, পরনে উলের মোটা ট্রাউজার, নাক এবং ঠোঁটজোড়া ছাড়া আর সবই কানটুপিতে ঢাকা। গাড়ি থেকে নামতে নামতে সশব্দে হাসে মহিম। তার হাসি দেখে গা জ্বলে যায় আমার। কিন্তু আমাকে কিছু বলার সুযোগ দেয় না সে। তার আগেই হরবর করে কথা বলতে থাকে।
দোস্ত আর বলিস না। চলে আসছিলাম খুব তাড়াতাড়ি। কিন্তু বকশী বাজারের কাছে আসতেই পড়ে গেলাম উটকো জ্যামে। রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ একটা ট্রাক নষ্ট হয়ে গেলো। এরপর কোত্থেকে জানি একের পর এক গাড়ি এসে পুরো রাস্তা জ্যাম বানিয়ে বানিয়ে দিলো!
চাপা মারার আর জায়গা পাস না, নাহ? এই মাঝরাতে বকশী বাজারে জ্যাম। শালা ফাজিল!
দোস্ত আমার কথা বিশ্বাস না করলে ফজলুকে জিজ্ঞেস কর।
রাখ তোর ফজলু্। চোরের সাক্ষী হবে মাতাল! তুই যেমন তোর ড্রাইভারও তেমন। চল রওয়ানা দিই। রফিক অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
দোস্ত একটু চা খেয়ে নিই।
আরও মিনিট দশেক পরে আমরা গাড়ি স্টার্ট দিই। মিরপুর দুই নম্বরে রফিকের বাসার নিচে আসতে লাগে দশ-বারো মিনিট। এসেই রফিককে ফোন দিই।
নেমে আয়। তোর বাসার নিচে আছি।
দোস্ত পাঁচ মিনিট লাগবে।
দশ মিনিট পর রফিক আসে। বাসা থেকে নয়। রিশাদের সঙ্গে বাইকে করে কোত্থেকে যেন আসে সে।
কি রে তুই আমাদের সবাইকে আসতে বলে নিজে কই চলে গেসিলি?
রফিকের প্রতি ক্ষোভ ঝাড়ে মহিম। আমার কিছুই বলতে হয় না। রফিক কোনো উত্তর না দিয়ে দ্রুত বাসায় ঢুকে যায়। মিনিট কয়েকের মধ্যেই বের হয়ে আসে দ্রুত। এবার আমাদের গাড়ি চলতে থাকে। গাবতলী পার হতেই গাড়ির স্পিড বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে কুয়াশা। আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে।
ফজলু ভাই এতো জোরে চালানোর দরকার নেই। দেখছেন তো কেমন কুয়াশা। সামনে কিছু দেখা যায় না।
আপনে কোনো চিন্তা কইরেন না পাভেল ভাই। আমি সাবধানেই চালাইতেসি।
পঞ্চগড় পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগতে পারে?
পেছন থেকে বলে রফিক।
তা ধরেন ছয়-সাড়ে ছয় ঘণ্টার মধ্যেই চইলা যামু। ড্রাইভার ফজলুর চটপট উত্তর।
এরপর গাড়ির মধ্যে চলতে থাকে আমাদের এলোমেলো আড্ডা। এক ফাঁকে রাইকে টেক্সট করি আমি—পঞ্চগড় যাই শীত দেখতে।
আর কে যায় সঙ্গে?
মহিম আর রফিক!
ইশ, আমিও যেতে পারলে খুব ভালো হতো!
চলো!
সাবধানে যেয়ো।
গাড়ি চলতে চলতে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ে মহিম আর রফিক। আমি জেগে জেগে ফজলু মিয়ার সঙ্গে গল্প জমানোর চেষ্টা করি। আর একটার পর একটা সিগারেট খাই। এক পর্যায়ে আমিও ঘুমিয়ে পড়ি। সে কি গভীর ঘুম। ঘুমের মধ্যে আবারও স্বপ্নে হানা দেয় রাই। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। কিন্তু সকালের আলো এসে চোখে লাগলে আমার ঘুম ভেঙে যায়। গাড়ি দেখি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ঠাঁয়। চারপাশে ঘন গভীর কুয়াশা। মোটা চাদরের মতো চারপাশ জুড়ে ছড়ানো কুয়াশায় কেমন যেন ভৌতিক লাগে সব। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে আশপাশে তাকিয়ে কোনো কিছু ঠাহর করতে পারি না। মাথার মধ্যে রাইয়ের তাণ্ডব চলতে থাকে উথাল পাথাল। ফজলু মিয়া পাথরের মতো স্থির চোখে তাকিয়ে আছে সামনে। পেছনের সিটে তাকিয়ে দেখি অঘোরে ঘুমাচ্ছে মহিম আর রফিক।
কোথায় আছি আমরা ফজলু?
বঙ্গবন্ধু সেতুর আগে আছি! সেতুতে উঠি নাই এখনো।
কী বলেন ফজলু ভাই? বললেন ছয়-সাত ঘণ্টায় চলে যাবেন পঞ্চগড়।
কী জ্যাম দেখসেন ভাই? কেমনে যামু বলেন!
আমি আর কোনো কথা বলি না। আসলেই তো ফজলু মিয়ার কী করার আছে? পানির বোতলটা হাতে নিয়ে এক ঢোক পানি খেয়ে সিগারেট জ্বালাই। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে একটু আগে দেখা স্বপ্নটা। কী অদ্ভুত ব্যাপার! এমন শীতের রাতে চলন্ত গাড়ির মধ্যেও স্বপ্নে চলে আসে রাই! স্বপ্ন দেখছিলাম—ঢাকা থেকে গাড়িতে যাত্রা করেছি আমি আর রাই। গাড়ি চলছে ধীরভাবে। রাই পরেছে তীব্র শাদা রঙের একটা জামা। কানে শাদা পাথরের ছোট্ট দুল। গাড়ির গ্লাসের ফাঁক গলে জোছনা অথবা সোডিয়াম লাইটের আলোয় চিকমিক করছিল রাইয়ের কানের দুল। গলায় একটা শাদা মুক্তার মালা। হাতে কিছু নেই। সব মিলিয়ে রাইকে মনে হচ্ছিল একটা শুভ্র রাজহাঁস। আমি আর রাই কী নিয়ে যেন গল্প করছিলাম। কথা বলতে বলতে এক সময় দেখি রাই আর আমি দুজনেই উড়ে যাচ্ছি। পৃথিবীর আকাশ গ্রহ তারা ছাড়িয়ে আমরা কোথায় যেন উড়ে উড়ে যাচ্ছি। রাই হাসছে খিলখিল করে। আর আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে। তৃষ্ণায় আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আমি যতই বলছি রাই এবার থামো। চলো আমরা নিচে যাই। সে কোনো কথাই বলছে না। শুধু আমার দিকে একবার চোখ রাখে। কী অদ্ভুত মাদকতা সেই চোখে। আমি আর কোনো কথা বলতে পারি না। রাই আরও তীব্র বেগে উড়ে চলেছে। আমিও আছি তার সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু কোনোভাবেই আমার ভয়টা কমছে না। এমন সময় আমার ঘুম ভেঙে যায়। আর দেখি আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গায়। এমন অদ্ভুত স্বপ্ন কেন দেখলাম আমার মাথায় ঢোকে না। একে তো ভীষণ জ্যামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকা, তার ওপর রাইকে নিয়ে এমন অদ্ভুত স্বপ্ন সব মিলিয়ে মন কেমন করতে থাকে আমার। ইচ্ছে করে পঞ্চগড় যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ঢাকা ফিরে যাই।
রফিককে ঘুম থেকে ডেকে তুলি।
অ্যাই রফিক, আর কত ঘুমাবি?
অ্যাঁ, দোস্ত পঞ্চগড় এসে গেছি।
ঘোড়ার ডিম আসছি! চল ঢাকা ফেরত যাই।
ক্যান? কী হইসে?
দেখছিস না, কেমন আন্ধাগিট্টু লেগে আছে! কখন যাবো পঞ্চগড়? সূর্যোদয় তো এখানেই হয়ে গেছে।
আমাদের কথা শুনে ঘুম ভাঙে মহিমের। চোখ ডলতে ডলতে সে জানতে চায় কী হয়েছে। কোথায় আছি আমরা?
পুরা ঘটনা এখন তোরে বুঝাইয়া বলার টাইম নাই। আমি চাইতাসি ঢাকায় চইলা যাই।
রাগ এবং বিরক্তি নিয়ে বলি আমি। মহিম কিছু বুঝতে না পেরে একবার আমার দিকে আরেকবার রফিকের দিকে তাকায়।
শেষ পর্যন্ত আমরা ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্ত বাতিল করে পঞ্চগড়ে যাবো বলেই ঠিক করি। গাড়ি আস্তে আস্তে চলতে শুরু করে। শীত সকালে সূর্যের দেখা মেলেনি এখনো। কুয়াশার কারণে গাড়ির গতি একেবারেই কম। রাস্তায় কোনো জন মানুষের দেখা মেলে না। বঙ্গবন্ধু সেতু পার হলে রাস্তা ফাঁকা মেলে। ফজলু মিয়া সাবধানে গাড়ি চালায়। একটার পর একটা গ্রাম জনপদ পেরিয়ে চলি আমরা। দ্রুত সরে সরে যায় আশপাশের বাড়িঘর গাছপালা দোকান বাজার। মহিম কোথাও গাড়ি থামিয়ে নাস্তা করতে চায়। তার কথায় আমরা কেউ উত্তর করি না। আমার মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে রাই নামের এক রাজহংসীর ছবি।
অবশেষে পঞ্চগড় পৌঁছি আমরা দুপুর পেরিয়ে যাওয়া সময়ে। সূর্যটা হেলে গেছে পশ্চিম আকাশে। রোদের আলোর রং সোনালি। গায়ে মাখতে খুব ভালো লাগে। আমরা এদিক সেদিক ঘুরি।
হঠাৎ রাইয়ের টেক্সট।
পৌছেঁছো ঠিকঠাক?
হুম, এসেছি।
সারাদিনে আর কোনো খোঁজ নেই?
সরি।
শেষ হয়ে যায় আমাদের কথা।
সন্ধ্যা মেলানোর পর আমরা ঠিক করি ঢাকায় চলে যাবো। সকালের সূর্য দেখার ইচ্ছে সবার মন থেকেই কেন জানি দূর হয়ে গেছে। ঢাকায় ফেরার কথাটা প্রথম বলেছিল মহিম। আমরা বাকি দুজনও তার সঙ্গে মুহূর্তেই একমত হয়ে যাই। সন্ধ্যা মেলানোর পর আমরা রওয়ানা দিই ঢাকার দিকে। ভোর সকালে ঢাকায় এসে চলে যাই যার যার বাসায়। জীবন চলতে থাকে জীবনের মতো। মহিম ব্যস্ত তার দুলাভাইয়ের ট্যানারির ব্যবসায়। প্রথমদিকে তার দুলাভাই যখন বলেছিল, ব্যবসায় সময় দিতে, সে খুব গাঁইগুঁই করেছিল। তারপর ধীরে ধীরে মানিয়ে নেয় এক সময়। রফিক একটা মফস্বল কলেজে মাস্টারির চাকরি নিয়ে ঢাকা ছাড়ে। আমার কোনো হিল্লে হয় না। বাঁধন ছেঁড়া গরুর মতো এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই। কোনো কোনো ভরদুপুরে রাইয়ের অফিসের নিচে গিয়ে দাঁড়াই। রাইকে টেক্সট করি চলো—কোথাও লাঞ্চ করি। বেশিরভাগ সময় রাই কোনো উত্তর দেয় না। তবে কখনো কখনো হাজার বারোশ টাকা বিকাশ করে দেয় আমার মোবাইলে। নিজেকে খুব ছোট মনে হয় তখন। তবুও না নিয়ে কোনো উপায় থাকে না। কারণ পকেট যে একবারেই ফাঁকা! সময় চলে যায়। শীত পেরিয়ে গ্রীষ্ম আসে। আসে বর্ষা।
শ্রাবণের দিন। একদিন মাঝরাতের থেকেই শুরু হয়েছে অঝোর বর্ষণ। বিরামহীন বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। সকালে দশটার দিকে ঘুম থেকে উঠেছি সবে। এমন সময় রাইয়ের টেক্সট।
বাসা থেকে বের হবে কখন?
এই তো এগারোটার দিকে।
বের হলে টেক্সট দিয়ো।
আচ্ছা।
রাই এ সময়ে অফিসে থাকে। হঠাৎ কেন জানতে চাইলো বাসা থেকে কখন বের হবো? মাথায় ঢোকে না কিছুই। তাছাড়া আমার তো চাকরি বাকরি অফিস আদালত ব্যবসা বাণিজ্য কিছু নেই। এই বৃষ্টিতে বাসা থেকে বের হতেই হবে এমন তো নয়!
তারপরেও সাড়ে এগারোটার দিকে বাসা থেকে বের হই ছাতা মাথায়। ইচ্ছে আছে আফজাল ভাইয়ের ওখানে যাবো। পকেট একেবারেই ফাঁকা। আফজাল ভাই যদি লেখার বিল টিল কিছু দেন।
রাস্তায় নেমে মনে পড়ে রাইয়ের কথা। টেক্সট করি।
বাসা থেকে বের হয়েছি।
সঙ্গে সঙ্গে রাইয়ের ফোন।
হ্যালো, কোথায় তুমি?
এই তো মাত্র বের হলাম।
একটু বাবুল মিয়ার চায়ের দোকানের এখানে এসো।
মানে?
আরে আসোই না!
ফোন কেটে দেয় রাই। আমি হন্তদন্ত হয়ে বাবুল মিয়ার চায়ের দোকানের দিকে এগোই। ইট রঙের একটা ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে রাই। গায়ে একটা গাঢ় নীল রঙের ফতুয়া। স্বপ্ন নয়, একেবারে বাস্তবে দাঁড়িয়ে আছে। এও কি সম্ভব? রাইকে হঠাৎ এখানে এভাবে দেখে বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করতে থাকে আমার।
অ্যাই, তুমি এখানে কী করো?
আসলাম, তোমার সঙ্গে এক কাপ চা খেতে!
আমি কী করবো, কী বলবো বুঝতে পারি না। সব কেমন এলোমেলো লাগতে শুরু করে। দুই কাপ চায়ের কথা বলে রাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি চুপচাপ। দোকানের কাঠের বেঞ্চে লোকজন নেই খুব বেশি। তবে মুষলধারায় বৃষ্টিতে বেঞ্চগুলো ভেজা। দোকানের ওপরের নীল রঙের প্ল্যাস্টিক পানি ঠেকাতে পারছে না। আমরা পাশের নিচু দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়াই। বাবুল মিয়া চা দিলে দুজনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাই। অর্ধেকের বেশি চা খেয়ে রাই তার কাপটা রেখে দেয় পাশের দেওয়ালে। আমি এক হাতে ছাতা, আরেক হাতে চায়ের কাপ নিয়ে সিগারেট জ্বালাতে গেলে একটু ঝামেলায় পড়ি। রাই আমার হাত থেকে কাপটা নিয়ে রেখে দেয় পাশের দেওয়ালে। আমি সিগারেট টানি। রাই এক হাতে কায়দা করে ছাতা ধরে, অপর হাতে মোবাইল ফোনে চায়ের কাপের ছবি তোলে। ফোঁটা ফোঁটা জল জমেছে চায়ের কাপে।
সন্ধ্যার দিকে দেখি রাই ফেসবুকে ছবি দিয়ে লিখেছে—চায়ের কাপে বৃষ্টি! আমি নিচে কমেন্ট করি—চায়ের কাপে বৃষ্টি হলে কী হয়?
রাই লেখে—কচু হয়!
এসইউ/জেআইএম