হুমায়ূন আহমেদ
যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো
অলোক আচার্য
পাঠকের সঙ্গে লেখকের সম্পর্ক সৃষ্টি হয় তার লেখনীর মাধ্যমে। লেখনী হলো একটি সেতু এবং একজন লেখকের আয়না, যা তাকে পাঠকের কাছে প্রকাশ করে। তা হোক নেতিবাচক বা ইতিবাচক। সাহিত্যকর্ম কেন সৃষ্টি হয় এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো পাঠকের জন্য। পাঠক পাঠ করে আনন্দ পান। আত্মার ক্ষুধা মেটান। সাহিত্য সৃষ্টির বিচারে কে জনপ্রিয় লেখক এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। জনপ্রিয়তার ধরনেও রয়েছে পার্থক্য। তবে একটি কথা মেনে নিতে হয়, যে লেখকের লেখা পাঠকের অন্তরে স্থান করে নেয় তিনিই লেখক হিসেবে স্বার্থকতা পান। পাঠক মজে থাকেন লেখকের লেখার জাদুতে। মঞ্চের জাদুকর কিছুক্ষণ জাদু দেখিয়ে দর্শকদের বাহবা পান। একজন লেখক তার লেখার জাদুতে মুগ্ধ রাখেন বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। এই যেমন দেবদাস বা শেষের কবিতার অমিত বা এরকম কোনো চরিত্র নিয়ে আজও মানুষ আবেগপ্রবণ হন সত্যি মনে করে, অনেকটা সেরকম। তাই লেখকের চেয়ে বড় কোনো জাদুকর আর নেই। যেমন জাদুকর ছিলেন আমাদের প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।
যদিও ইদানিং লক্ষ্য করেছি যে, এই জাদুকর লেখকটির লেখা নিয়ে অকারণেই এবং শিশুসুলভ সমালোচনা কেউ কেউ করছেন, তারা কি লক্ষ্য করেছেন যে, হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর (১৯ জুলাই ২০১২) এতগুলো বছর পরেও তার ধারে কাছের জনপ্রিয়তা একজনও পাননি অথবা এমন দু’চারটি সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেননি যে পাঠক মহলে রীতিমতো হইচই পড়ে যায়। উল্টো সাহিত্যাঙ্গণ আজ নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত। কে যে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারছেন আর কে পারছেন না, সে একমাত্র সময়ই বলতে পারবে। যেমনটা পেরেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি বেঁচে থাকতে পাঠককে নিজের লেখার জাদুতে মুগ্ধ রেখেছেন আবার পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েও পাঠককে তাঁর সৃষ্টির জাদুতে মুগ্ধ রেখেছেন। তাই এদেশের সবচেয়ে বড় জাদুকর মনে হয় তিনিই।
আরও পড়ুন: উপলব্ধ জীবনের প্রতিবাদলিপি
বাংলাদেশের সাহিত্যে প্রবাদপুরুষ হুমায়ূন আহমেদ। যার সাহিত্য রচনায় পাঠক মুগ্ধ থেকেছেন যুগের পর যুগ। বেঁচে থাকতে হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গস্পর্শী এবং তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর জনপ্রিয়তা এতটুকুও কমেনি। বরং তাকে জানার আগ্রহ আরও বেড়েছে। সহজ, সরল আর সাবলীল গতিতে সৃষ্টি হওয়া একেকটি সাহিত্যকর্ম যেন পাঠকের প্রাণ। লেখকের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো তার লেখায় পাঠককে ধরে রাখার ক্ষমতা। কোনো একটি বই পড়তে গিয়ে অর্ধেক পড়ার পর যদি বিরক্তির জন্ম হয়, তখন বুঝতে হবে লেখায় পাঠককে টানার ক্ষমতা কম ছিল। একটি বইয়ের যত গভীরে যাওয়া যাবে; তত বইটি শেষ করার ইচ্ছা জাগতে হবে। উপন্যাস বা ছোট গল্পের চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে কল্পনা করেও অনেক পাঠক তৃপ্তি বোধ করেন। যেমন কেউ হুমায়ূন আহমেদের হিমু সেজে রাস্তায় ঘুরে বেড়ান।
আজকের যুগে লেখালেখি করার ক্ষেত্র বা সুযোগ অনেক বেশি। দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্যপাতা ছাড়াও প্রতি বছর বাংলা একাডেমির বইমেলায় গাদা গাদা বই প্রকাশিত হয়। প্রচুর নতুন লেখক, কবিদের আগমন ঘটে। আবার বইমেলা শেষ হলে সেসব লেখকের বেশিরভাগেরই আর দেখা পাওয়া যায় না। একজন লেখক তার লেখা চালিয়ে যান সারাবছর। পাঠকই লেখকের লেখা খুঁজে বের করেন। হুমায়ূন আহমেদের চলে যাওয়ার পর আজও সেই পাঠক তৈরি করার মতো লেখকের দেখা পাইনি। যারা লিখে এসেছেন; তারাই লিখে যাচ্ছেন নিয়মিত। হুমায়ুন আহমেদ চলে যাওয়ার পরও প্রতিটি বইমেলায় তাঁর বই কিনতে পাঠকদের আগ্রহ দেখেছি। তাঁর পাঠকশ্রেণি আজ তাঁর বইয়েই মশগুল হয়ে আছেন। নতুন করে আর কোনো পাঠকশ্রেণি তৈরি হয়নি। তাঁর সৃষ্টি মিসির আলী, তাঁর হিমু বা রুপা চরিত্রগুলো আজও বইয়ের পাতা থেকে রাস্তায় দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যে এত তুমুল জনপ্রিয় লেখকের দেখা খুব কমই পেয়েছে সাহিত্যনুরাগীরা। কোনো লেখকের শূন্যতাই পূরণ হওয়ার নয়। তিনি ছিলেন পাঠকনন্দিত লেখক। পাঠকের অন্তরে জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন বলেই এমন বলা হয়।
আরও পড়ুন: জিল দল্যুজ: দুর্বোধ্যতার আড়ালে অনন্য যাযাবর- শেষ পর্ব
১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হয়; তখনই বোঝা গিয়েছিল কথাসাহিত্যের বিশাল জগতে তিনি অল্প সময়ের জন্য আসেননি, তিনি এসেছেন রাজত্ব করতে। তিনি সহিত্যের ভুবনে ছিলেন সম্রাট। তাঁর পাঠকশ্রেণি ছিল আলাদা। যারা গোগ্রাসে তাঁর লেখা পড়তো। মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনযাত্রা অসাধারণ দক্ষতায় তুলে এনেছেন। অবশ্য তার সমালোচক শ্রেণিরও অভাব ছিল না। সমালোচনা তাঁর ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। তিনি তাঁর লেখার ধরন নিজের মতো ঠিক রেখেছেন। সে সমালোচনা তাঁকে আরও উঁচুতে পৌঁছে দিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের লজিক ও আ্যান্টিলজিক চরিত্র হিমু ও মিসির আলী চরিত্র দুটি আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয়। এ চরিত্র নিয়েই দেশে বহু আলোচনা হয়েছে। বাস্তবতার সঙ্গে মেলানোর প্রচেষ্টাও করা হয়েছে। অনেক সময় চরিত্র দুটির স্রষ্টাকেই এই চরিত্রের সত্যিকারের মানুষ বলে মনে হয়েছে। কোনো কোনো লেখকের বই পাঠক গোগ্রাসে গেলেন আবার কোনো কোনো বই পাঠক গোগ্রাসে না গিললেও তার গভীরতা পাঠককূলকে আকৃষ্ট করে। হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশে যে এক তুমুল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ছিলেন সে কথা দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায়। তিনি কতটা জনপ্রিয় ছিলেন তা জানতে হলে তাঁর কর্ম এবং সৃষ্টির দিকে তাকাতে হবে। রবীন্দ্রনাথের পর যেমন বাংলা সাহিত্য বহু বছর তার ধারার স্রোতে প্রবাহিত হয়েছে; তেমনই হুমায়ূন আহমেদের লেখনীর ধারায় আজকের লেখনী চলে। সেই স্রোতে কত বছর চলবে তা ভবিষ্যতই বলবে। তাঁর উপন্যাসের স্বকীয়তা, সহজ স্বাভাবিক ভাবে জটিল ত্ত্ত্বগুলোর বর্ণনা দিয়ে যাওয়া, চরিত্রের তুমুল জনপ্রিয়তা কেবল তাঁর লেখনীতেই সাজে।
হুমায়ূন আহমেদের স্পর্শ যেন সফলতার অন্য নাম। সহজ, সরল ও সাবলীল ভাষায় পাঠককে গল্পের ভেতর টেনে নেওয়ার ক্ষমতা তাঁর ছিল। তিনি যেখানেই হাত দিয়েছেন; সেখানেই সফল হয়েছেন। প্রকৃতির প্রতি বিশেষ টান তাঁর চরিত্রের একটি বড় বৈশিষ্ট্য। ছোটবেলায় হুমায়ূন আহমেদ ভালোবাসতেন সবুজ অরণ্য, বৃষ্টি আর টিনের চালে সেই ছন্দ, বৃষ্টির পানিতে ভেজা। ঘুরেফিরেই শ্রাবণ আসে প্রতি বছর। বৃষ্টি হয়। এই শ্রাবণেই পৃথিবী ছেড়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর তৈরি নূহাশ পল্লীতে তিনি সেভাবেই সাজিয়েছিলেন প্রকৃতিকে। তার লেখার বহু বর্ণনায় সেসব পাওয়া যায়। বিংশ শতাব্দির জনপ্রিয় বাঙালি ঔপন্যাসিকদের তিনি অন্যতম। তাঁর এই লেখার জাদুতে আরও বহু যুগ পাঠক মুগ্ধ থাকবে। বহু যুগ পার হয়ে গেলেও পাঠক হুমায়ূন আহমেদে মশগুল থাকবে, এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
এসইউ/এএসএম