সানাউল্লাহ সাগরের গল্প: ব্যালকনি
মেয়েটিকে অনেক দিন দেখি না। তাকে মনে পড়ে। দেখতে ইচ্ছে করে। কেন করে? জানি না। সে আমার বিশেষ কেউ নয়। খুব পরিচিতও নয়। তারপরও মনে পড়ে। গত দুই সপ্তাহ পারিবারিক কাজে ঢাকার বাইরে এমন ব্যস্ত ছিলাম যে, অন্য কিছু নিয়ে ভাবার সময় ছিল না। আজ হালকা বৃষ্টির এই সন্ধ্যায় মেয়েটির কথা আবার মনে পড়লো। কী সুন্দর চোখ তার। তীক্ষ্ম চাহনি। সৃষ্টিকর্তা তার সব সৌন্দর্য যেন চোখেই ঢেলে দিয়েছেন। তাই বলে অন্য অঙ্গে যে অবিচার করেছেন তা-ও নয়। কিশোরী বেলায় কি আমিও এরকম ছিলাম?
আমাকে ছোট সময় আদর করে ঠাকুমা ধলাকদু ডাকতেন। আমার মুখ এতটাই নাকি উজ্জ্বল ছিল যে, লাউয়ের ভেতরের অংশের সাথে তুলনা করেছিলেন। যদিও সে মুখ এখন অনেকটাই অনুজ্জ্বল হয়ে গেছে। আর মুখের থেকে ভেতরটা আরও ম্রিয়মান হয়ে গেছে। তবুও যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তা-ও কম কীসে! নিজের সৌন্দর্য নিয়ে সুন্দরীদের এক ধরনের অহমিকা থাকে। কিশোরী বেলায় আমারও তা ছিল। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা জানেন মানুষকে কখন কীভাবে তার আয়ত্বে নিয়ে নিতে হয়। কীভাবে তার নিজের কাছেই নত করে দিতে হয়। ঠিক তেমনই আমাকে করে রেখেছেন। সে কারণে এত সৌন্দর্য আজ ম্রিয়মান। তার প্রথম অধ্যায় শুরু হয়েছিল আমার বিয়ের মধ্য দিয়ে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পরপরই বন্ধবীরা বলতে লাগলো, তুই এই বিয়েতে রাজি হইস না। তোর মতন এমন সুন্দরীদের সাথে এই ছেলে মানাবে না।
আমার মুখে কোনো কথা নেই। আমি যেন নিজের মধ্যে ডুবে নিজেকে পরিমাপের চেষ্টা করছিলাম। আর গভীর ক্ষতের মধ্যে ডুবে যাওয়া নিজের অসহায় মুখটির প্রতি অন্তহীন করুণা নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। আমার মনে কি কোনো ছাপ পড়েছিল? হয়তো পড়েছিল। কিন্তু কিছু বলার উপায় ছিল না। দেড় বছর আগে বাবা মারা গিয়েছিলেন। সংসারে মা আমি আর ঠাকুমা। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম বাবার অবর্তমানে আমাদের সবকিছু থমকে গেছিল। তাই আমাকে পাত্রস্থ করে তারা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চাচ্ছিলেন। তার ওপর সরকারি চাকরি করা ছেলে। এই পাত্র ঠাকুমা কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাচ্ছিলেন না। আমার পছন্দ-অপছন্দের চেয়ে মা-ঠাকুমার স্বস্তিই মুখ্য তখন। কিন্তু আমার মনের অবস্থা হয়তো ঠাকুমা বুঝতে পারছিলেন। তাই আমাকে কাছে বসিয়ে আবেগমাখা চোখ নিয়ে বোঝালেন, দ্যাখ ছেলেদের গায়ের রং কোনো ব্যাপার না। তার আয়-ইনকামই বড় ব্যাপার। তার ওপর সরকারি চাকরি। আমি শেষ পর্যন্ত চুপ করে থেকে কপিবুক ভদ্র পাত্রীর মতন ‘তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ’ বলে তাদের দুশ্চিন্তা থামিয়ে দিয়েছিলাম। নিজেকেও প্রস্তুত করেছিলাম নতুন জীবনের জন্য। নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার খেলায়। যে খেলা এখনো চলমান।
ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। সামনে একটু খোলা জায়গা। তারপর কবরস্থান। শুয়ে থাকা ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় প্রকাশ হওয়ার মতন কোনো সাইনবোর্ড নেই। বেশিরভাগ কবরস্থানে যেরকম থাকে। মরার পর মানুষের পরিচয় দিয়ে কী হয়? মরার পর সবার একটিই পরিচয় লাশ। যেখানে উঁচু-নিচুর কোনো বিভেদ নেই। সব পেশা-শ্রেণির মানুষ পাশাপাশি শুয়ে থাকে। খুব আপন মানুষের মতন। নারী-পুরুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। যেন হাজার বছর ধরে তাদের চেনাজানা। বয়সেরও কোনো তারতম্য নেই। ‘মরার আবার জাত কী?’ সত্যিই মারার কোনো জাত নেই। সবারই এক পরিচয়, মৃত!
এই বাসায় আসার আগে আমার শ্মশানে, কবরস্থানে ভয় লাগতো। ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়ার সময় কবরস্থানের কাছ দিয়ে একা যেতে পারতাম না। ভয়ে কান্না পেত। মনে হতো মাটির নিচে ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলো যদি হঠাৎ করে জেগে ওঠে—আমাকে মাটির মধ্যে টেনে নিয়ে যায়! সে ভয় এই বাসায় আসার পরও ছিল। যদিও এই হাস্যকর ভাবনা মাথায় এলে নিজেই নিজেকে বুঝ দিতাম, বয়স হয়েছে। এখন এসব ভাবলে চলে না। সর্বোপরি আমার বর অনুপের পুলিশের চাকরি। যে কারণে অনেক সময় রাতেও ডিউটি করতে হয়। আর তখন এই কবরস্থান ঘেঁষা বাসায় একা থাকতে হয়। রাতে ঘুম না হলে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই। মাটির সাথে পরিচয় মিশে যাওয়া মানুষের পাশাপাশি শুয়ে থাকা দেখি। প্রথম প্রথম খুব ভয় লাগতো। এখন এই কবরস্থানে ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলো আমার আপন হয়ে গেছে। তাদের সাথে নানা রকমের কথা বলি। তারাও আমার সাথে কথা বলেন! হয়তো বলেন। হয়তো বলেন না। কিন্তু আমার ভালো লাগে। পুরো বাসার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হলো এই ব্যালকনি।
গত বৈশাখে আমার ঊনচল্লিশতম জন্মদিন গেল। আর মাত্র এক বছর পর চল্লিশ হয়ে যাবে। বাংলাদেশে মেয়েদের চল্লিশ বছর হওয়ার পর তার আর কিছু থাকে না। থাকে না বলতে চাওয়া-পাওয়ার বিষয় অবশিষ্ট থাকে না। যদিও আমার জীবনে তেমন কিছু চাওয়ার ছিল না। এখনো চাওয়ার নেই। গত উনিশ বছর ধরে একটাই চাওয়া ছিল। আমার একটি সন্তান হোক। প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত চেয়েছি। কিন্তু হয়নি। ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। অনুপ প্রথম রাজি ছিল না। আমার হাতে-পায়ে ধরার কারণে রাজি হয়েছিল। ওর মনে হয়তো এমন কোনো ভয় ছিল, যদি ওর কোনো সমস্যা ধরা পড়ে! ডাক্তার সাহেব দুজনকেই অনেকগুলো টেস্ট দিলেন। সবগুলো টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে এক সপ্তাহ পর আবার দেখা করতে বললেন। তার নির্দেশমতো থমথমে মন নিয়ে আমরা তার চেম্বারে দেখা করলাম। আমার চেয়ে অনুপের যে ভয় বেশি ছিল, সেটা তার মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম। টেস্ট করে ওর কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি। বরং ডাক্তার আমাকেই অনেক নিয়মকানুন মেনে চলতে বললেন। একগাদা ওষুধ ধরিয়ে দিলেন। আবার বললেন, উপরওয়ালার ওপর ভরসা রাখুন। ডাক্তারের ওপর ভরসা করে তার দেওয়া ওষুধ খেয়েছি সাত বছর। উপরওয়ালার ওপরও ভরসা করেছি। বিভিন্ন জায়গায় মানত করেছি। দান করেছি। কিন্তু কেউ কোনো ভরসার প্রতিদান দেয়নি। না ডাক্তার, না উপরওয়ালা। কিছুই হয়নি। অবশ্য এভাবে না বলে বলা ভালো ধরে রাখতে পারিনি।
ব্যালকনিতে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। হাসিহাসি মুখ। প্রতিদিনের মতন উচ্ছল, উজ্জ্বল। অপর ব্যালকনিতে অপেক্ষায় থাকা প্রিয় মানুষের জন্য তার এই অপেক্ষা, সাজগোজ, গুনগুন করে গান গাওয়া আমার ভালো লাগে। একা একা হাসি। কখনো-সখনো আমিও গুনগুন করি। মেয়েটিকে প্রথম দেখেছিলাম এই বাসায় আসার সপ্তাহখানেক পর। সেদিন সাপ্তাহিক ছুটি ছিল। তবুও জরুরি কী কাজ থাকায় অনুপ বাসায় ছিল না। এমনিতেই বিভিন্ন কাজে অনুপকে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে, আমাকে সময় দেওয়ার মতো সময় তার থাকে না! অথবা সে হয়তো নানা কাজের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রেখে পৃথিবীর যাবতীয় কষ্টকে ভুলতে চায়। এসব নানা কারণে আমার মন খারাপ থাকে। মন খারাপকে আরও বিষিয়ে তুলতে শ্রীকান্তের গান শুনি। ব্যালকিনেতে গিয়ে কফি খাই। দুজনের সংসারে এছাড়া আর কাজইবা কী! সেদিন শেষ বিকেলে আমি ব্যালকিনতে বসে উদাস মনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ শুনছিলাম। ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মনরে আমার...’ সাথে আমি গুনগুন করছি। দেখলাম পাশের বিল্ডিংয়ের চতুর্থ তলায় চোখ আটকে গেল। একটি ছেলে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে একা একা হাসছে। প্রথমে ভাবলাম হয়তো সেলফোনে কারো সাথে কথা বলছে আর হাসছে। পরে খেয়াল করলাম, তার হাতে কোনো সেলফোন নেই। আমার চোখ-মন তার হাসির কারণ খুঁজতে থাকলো। আশপাশের ব্যালকনিতে চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে অপর প্রান্তের একটি বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলার ব্যালকনিতে কারণ উন্মোচিত হলো। দুই বিল্ডিংয়ের দূরত্ব দেড়শ থেকে দুশ মিটার হবে হয়তো। খুব আস্তে বা স্বাভাবিকভাবে কথা বললে এক ব্যালকনি থেকে অন্য ব্যালকিনেতে পৌঁছাবে না। তবে জোরে কথা বললে সেটা পৌঁছে যাবে ঠিকঠাক। মেয়েটির বয়স কত হবে? ধারণা করি তেরো-চৌদ্দ বছর। বেশিও হতে পারে। কারণ সব সময় আমরা যা অনুমান করি তা সঠিক হয় না। তবে তার শরীরের পরিবর্তন আমাকে ধারণা করতে সহযোগিতা করে। আর ছেলেটি? যার জন্য মেয়েটি এই শেষ বিকেলে সেজেগুজে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছে, পনেরো-ষোলো। তবে কেউ যে এখনো স্কুলের গণ্ডি পার হয়নি, সেটা তখনই বুঝতে পেরেছিলাম। যেটি পরে ঠিকঠাক মিলে গেছিল। সেদিন থেকে ব্যালকনিতে বসলেই আমি দুজনকে দেখতাম। খুব গোপনে। যেন তারা টের না পায়। বিশেষ করে মেয়েটিকে। দুজনের মধ্যে মেয়েটিকেই আমার বেশি ভালো লাগতো। কেন? তা জানি না। হয়তো সব ভালো লাগার কারণ আবিষ্কার করা যায় না। কিংবা আবিষ্কার করতেও হয় না।
ব্যালকনিতে মেয়েটিকে পেয়ে আমার খুশি খুশি লাগে। উঠে গিয়ে কফি বানাই। কফি নিয়ে আবার ব্যালকনিতে বসি। দূর থেকে দেখি মেয়েটি গুনগুন করে গান গায়। কী গান গায় সেটা আমি দূর থেকে শুনতে পাই না। ছেলেটিও শুনতে পাওয়ার কথা নয়। তবুও মেয়েটি গায়। গুনগুন করে মনের আনন্দ প্রকাশ করে। এদের দুজনের কারো নাম আমি জানি না। গত সাত মাসে কথাও হয়নি কখনো। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে ওদের সাথে কথা বলি। কিন্তু নিজের এই অর্বাচীন চিন্তা চেপে রাখি। নিজের এসব উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা দেখে নিজেই হাসি। যদিও তাদের সাথে আমার কথা হয় না, তবুও ওরা পরিচিত হয়ে ওঠে। অজান্তেই খুব আপন হয়ে যায়। একদিন এই নাম না জানা দুজনকে আমি নাম দিয়ে দেই। আমার অনাগত সন্তানদের যে নাম রেখেছিলাম, সেই নাম। তারা যদি ঠিক সময় পৃথিবীতে আসতো, এখন এদের বয়সীই থাকতো। প্রথম সন্তান কনসিভ করার তিন মাস হওয়ার পরই অনুপের নামের সাথে মিল রেখে ‘অনি’ নাম রেখেছিলাম। ভালো নাম অনিমেষ। দ্বিতীয় সন্তান কনসিভ করার পাঁচ মাসে গিয়ে আমার নামের সাথে মিল রেখে নাম রেখেছিলাম ‘কথা‘। কাকলীর মেয়ে কথা! খুব সুন্দর মানাতো। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আমাদের যাবতীয় পরিকল্পনাকে কখনো কখনো ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। আর তখনকার আমাদের অসহায় অবস্থা দেখে হয়তো মিটিমিটি হাসতে থাকে। প্রথম সন্তান চার মাসে আর দ্বিতীয় সন্তান ছয় মাসে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তারা পৃথিবীর মুখ দেখতে পারেনি। আর কখনো দেখবে না। এসব নিয়ে আমার যেমন খারাপ লাগে; তেমন যে অনুপেরও লাগে সেটা আমি বেশ বুঝতে পারি। তারপর আর কনসিভ করেনি। অনুপকে কতবার আরেকটি বিয়ে করতে বলেছি। অনুপ আমার সেসব কথা কানে তোলেনি। অনেকক্ষণ বিষণ্ন থেকে পাতলা করে হেসেছে। আর সেই একই কথা, একটাই তো জীবন। এত আয়োজনের কিচ্ছু নাই। তুমি-আমি এই তো বেশ আছি।
কিন্তু আমরা যে বেশ নেই, সেটা আমিও যেমন জানি অনুপও তেমন জানে। বরের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগহীন থাকার পরও আমি কেমন যেন নিজের মধ্যে নিজে বিষিয়ে উঠতে থাকি। কিশোরী কাকলীর সব অহম নুয়ে যায়। ধুলোয় লুটোপুটি খায়। নিজেদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। যে দূরত্ব এখন পাহাড়সম। যা হয়তো আর কখনোই কমবে না। বরং সেটাকে হয়তো আরও ভারী করে অনুপের বদলির সাথে সাথে এক শহর থেকে অন্য শহরে টেনে নিয়ে যাবো।
যদিও অনুপের আমার প্রতি অবহেলা নেই। কিন্তু সে নিজের প্রতি যে অবিচার করছে, তা কি আমার প্রতিও নয়? মাঝে মাঝে মনে হয়, এমন সম্পর্ক বয়ে বেড়ানো কেন? অনুপকে না জানিয়ে কোথাও পালিয়ে যাই। কিন্তু কার কাছে যাবো? মা কিংবা ঠাকুমা কেউ যে আর বেঁচে নেই। এত না থাকার মধ্যে এই অনুপই একমাত্র ভরসার জায়গা, যেখানে অন্তত একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। আবার এটাও মনে হয়, অনুপের সাথে বিয়ে না হলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো। কখনো কখনো একজনের ভুলের খেসারত অন্যজনকে দিতে হয়। যেমন মা ও ঠাকুমার সিদ্ধান্তের খেসারত আমি দিচ্ছি। আবার কখনো ভাবি, অন্য কোথাও বিয়ে হলে হয়তো এর থেকেও খারাপ হতে পারতো। অনুপ আমাকে সম্মান দেয়। ভালোও বাসে। এত বছরে আমারও তার প্রতি একটা মায়া তৈরি হয়েছে। এমন মায়া যে এটা কাটিয়ে মরে যেতে ভয় হয়!
এভাবে দুই-তিন মাস কেটে যায়। শেষ বিকেল কিংবা সন্ধ্যায় ব্যালকনিতে বসি। গান শুনি আর আমার অনাগত সন্তানদের কল্পনায় ওদের দুজনকে দেখি। মনে মনে ওদের জন্য আমার মায়া তৈরি হয়, আহ্লাদ তৈরি হয়। ইচ্ছে করে কাছে বসিয়ে চুলগুলো আঁচড়ে দিই। যত্ন করে খাইয়ে দিই। মায়াভরা মুখ দুটির দিকে গভীর করে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু দূর থেকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করা হয় না। এমনকি তাদের কাছাকাছি যেতেও কি এক দেওয়াল আমাকে আটকে রাখে।
একদিন রাতে অনেক শোরগোলে ঘুম ভেঙে গেল। আমি হয়তো একটু আগেই ঘুমিয়েছিলাম। দীর্ঘদিন ধরে ঘুমের ওষুধ খেতে থাকলে ক্রমেই ঘুমাতে দেরি হতে থাকে। আর তার ফল হিসেবে রাত দশটায় ওষুধ খেলেও ঘুমে ঢলে পড়তে আমার দুইটা তিনটা বেজে যায়। এখন রাত পৌনে তিনটা বাজে। এত শোরগোলেও অনুপ মরার মতো ঘুমাচ্ছে। আমি অনুপকে জাগাই। সে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে?
আমি বলি, বুঝতে পারছি না। তুমি একটু দেখো তো।
কিছু হয়নি এরকম ভঙ্গিতে অনুপ বিছানায় গাড়াগড়ি দিতে থাকে। শোরগোলটি আরও বেড়ে যায়। অনুপ বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আমরা ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই। এই এলাকায় আমরা এসেছি প্রায় এক বছর। এর মধ্যে এরকম কোনো হইচই হয়নি। যেহেতু এলাকার কারো সাথে আমি কিংবা অনুপ কেউ তেমন পরিচিত নই; সেহেতু শোরগোলের কারণ জানতে আমাদের একটু সময় লেগে যায়। পাশের ফ্ল্যাটের বয়সী মাহিলার কাছ থেকে জানতে পারি, উত্তর পাশের বিল্ডিংয়ে একটি খুন হয়েছে। ছোট ভাই বড় ভাইকে খুন করেছে। তখন পাশের ফ্ল্যাটের কম বয়সী মেয়েদের কাছে অনেক ধরনের গল্প শুনতে পাই। যে ছেলেটি খুন করেছে, তার নাম কিরণ। ক্লাস টেনে পড়ে। বড় ভাই এইচএসসি পরীক্ষার্থী। তবে খুনের কোনো কারণ কেউ বলতে পারে না। কিরণের পরিবার নিয়ে নানা গল্প ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। তবে সেসব কোনো গল্পকেই খুনের কারণ হিসেবে মেলাতে পারি না। এই পরিবেশে আমার চোখে আর ঘুম অবশিষ্ট থাকে না। ঘুমের ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। খুন কিংবা তাদের সংসারের নানা রঙের গল্প শুনতে শুনতে সকাল হয়ে যায়। লোকজন আরও বাড়তে থাকে। সকাল সোয়া পাঁচটার দিকে পুলিশ আসে। আর তখন জানতে পারি, কিরণ আর কেউ নয় সে আমার অনি! অনিমেষ। আর তখনই আমার মাথা ব্যথাটা একেবারে কমে যায়। কিংবা শরীর থেকে মাথাটা উধাও হয়ে যায়।
সকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে অথবা তারও একটু পর ভাইকে খুনের দায়ে কিরণ মানে অনিকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। গলির সরু রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় আমি নির্বাক, অস্থির হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মনে হচ্ছিলো কিরণ নয়, এ যেন আমারই সন্তান অনি। যাকে আমি গত ষোলো বছর ধরে কোলে পিঠে করে বড় করেছি। কিরণ যেতে যেতে পুলিশি শাসনের চোখ তোয়াক্কা না করে বার বার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছিলো। তার ঘুমহীন বিধ্বস্ত চোখ কাউকে খুঁজতে ছিল। কিন্তু মহল্লার সবাই উপস্থিত থাকলেও বিপরীত ব্যালকনির মেয়েটি তখন পুলিশ দেখতে আসা উৎসুক মানুষের মধ্যে ছিল না। হয়তো মেয়েটি ইচ্ছে করেই আসেনি। প্রিয় মানুষের এমন বিবর্ণ, বিষিণ্ন মুখ সে দেখতে চায়নি।
কিরণকে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মেয়েটি এলো। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল দীর্ঘসময় ধরে কান্না করার ফল হিসেবে চোখ-মুখ ফুলে গেছে। চোখের নিচে লেপ্টে আছে কান্নার দাগ। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগে এলেই দেখতে পেতে বিদায়ের মুহূর্তে একজোড়া প্রেমিক চোখ তাকে কতটা প্রত্যাশা করেছে।
এসইউ/জেআইএম