বনফুলের ছোটগল্পে মানবজীবন
রত্না মাহমুদা
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭৯) বাংলা সাহিত্যের অভিনব কথাশিল্পী। কথাসাহিত্যে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। সাহিত্যের চতুরঙ্গ কলা-কৌশলের জীবনশিল্পী। যিনি শৈল্পিক কারুকাজ ফুটিয়ে তুলেছেন কথাসাহিত্যে। শিল্প রূপায়নে এনে দিয়েছেন নতুনধারা। রচনায়-পরিকল্পনায় মৌলিকতা-আখ্যানবস্তুর সমাবেশে বিচিত্র উদ্ভাবনীর মাধ্যমে তাঁর শক্তিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। স্বল্প কথার গল্পগুলোয় মানবজীবনের করুণ অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। গল্প অবলম্বনে তাঁর জীবনদৃষ্টির শিল্প চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। কারণ তিনি ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। তার জীবন সম্পর্কে অতীন্দ্রিয় মোহ ছিল না। যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা যতটুকু জেনেছেন; ততটুকুই লিখে গেছেন। বনফুলের ব্যক্তিত্ব ও সুষ্ঠু বলিষ্ঠ জীবন থেকে উদ্ভুত হয়েছে নতুন নতুন মানুষের জীবনকথা। জীবনমূলে কল্পনায় ভরিয়ে দিয়েছেন বাস্তব রূঢ় জীবনবোধের অপরিকল্পিত কাহিনি। মানুষের চলনে-বলনে, আচার-আচরণে, বিবেক-আবেগ, চিন্তার প্রসারতার অভিনব ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিতে চেয়েছেন তাঁর গল্পভাষ্য। সর্বজনগৃহীত ও সর্বজন প্রশংসিত গল্প হবে এমন তো কোনো কথা নেই। তবুও বনফুলের মৃত্যুর দুইশ বছর পরও তাঁর গল্পের ভাষা যেন বর্তমান অবস্থার সঙ্গে মিলে যায়। একজন চিকিৎসক রীতিমতো মানুষের সঙ্গে মেশেন। কারণ তিনি নানা ধরনের মানুষকে মোকাবিলা করেছেন। মানুষের জীবনের গল্প শুনেছেন। সুচিকিৎসায় তাদের সুস্থ করে তুলেছেন। সুস্থতা যেমন জরুরি, জীবনে ভালো থাকার জন্য মন ও মনন জগতের স্বাভাবিকতাও জরুরি। চিকিৎসক বিধায় তিনি তাদের সাহিত্যকর্মের পরিপূর্ণ বিজ্ঞাননিষ্ঠ বুদ্ধিবাদী লেখক হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। অভিজ্ঞতাবাদ বা Empiricism-এর ভিত্তিতেই জীবনচৈতন্য গড়ে ওঠে। যা বনফুলের জীবনেও প্রকটভাবে দেখা যায়। মানুষ সত্য, জীবন সত্য। পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য ও গ্রহের ন্যায় মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি খণ্ড খণ্ড রূপে বিরাজমান।
বনফুলের প্রকৃত নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়কে গবেষকও বলা চলে। জীবনজিজ্ঞাসা ও অন্তহীন জীবনের বাস্তব প্রয়োগ করেছেন তিনি তাঁর গল্পে ও কথাসাহিত্যে। বনফুলের বলিষ্ঠ ও সুস্থ জীবনবোধ থেকেই রচনা করেছেন ছোট ছোট গল্প।তাঁর অন্তহীন দৃষ্টি সংস্কারের বিরুদ্ধে এবং সংস্কার অবমুক্ত করতে চেয়েছে। বাস্তব ও বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা-ভাবনাকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করতে চেয়েছেন তাঁর ছোটগল্পে। মানবজীবনে আচার-আচরণ ও ধ্যান-ধারণার স্বরূপসন্ধানী দৃষ্টি জীবনের আরও গভীরে পৌঁছে দিয়েছে। অন্যায় ও পাপাচারের প্রায়শ্চিত্ত ন্যায়দণ্ড, দুর্নীতি ও অনাচারের বিরুদ্ধে বিবেককে গল্পের ভাষায় বিস্তার করেছেন। তাঁর ‘সমাধান’ গল্পে যথার্থভাবে ফুটে উঠেছে কুৎসিত মেয়ের জীবনের চালচিত্র। কালো কুৎসিত মেয়েরা সমাজে অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত। সমাধান গল্পে ‘মেয়েটা কুৎসিতই ছিল। রক্ত কালোই, একটা চোখ ছোট আরেকটা চোখ বড়, তাছাড়া কি রকম যেন বোকা হাবা ধরনের, মুখে সর্বদাই লালা ঝরে। পুষ্পমঞ্জরি নাম দেওয়া চলে না তা ঠিক।’ (বনফুলের শ্রেষ্ঠ গল্প, পৃ-২২) বর্ণবাদ নিয়ে আজীবন সংগ্রাম করেছেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তৎকালীন বর্ণবাদ আর বর্তমান সময়ের বর্ণবাদে বিবর্তন এলেও বর্ণবাদ এখনো প্রকটভাবে দেখা যায়। সবাই সুন্দরের পূজা করে। সুন্দরী মেয়ে বউ হবে। পুত্রবধূ হবে। এ কামনা করে। সুন্দরের পূজা করতে গিয়ে অসুন্দরকে হেলায় ভাসিয়ে দেয়। মোটা অঙ্কের যৌতুকের বিনিময়ে কুৎসিত কন্যার জন্য পিতার পাত্র কিনে আনতে হয়! ‘কালো কুৎসিত মেয়েগুলো এভাবেই সমাজে লাঞ্ছিত অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত! শ্যাম বোস বলিলেন, আবার বলতে। বিয়ে দেবার সময় নাকের জল চোখের জলে চোখের জল হতে হবে আর কি! টাকা চাই প্রচুর!’
সমাজে প্রচুর মানুষ আছে, যারা কুৎসিত মানুষদের অবহেলা করে! তাঁরা কোনোদিন স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না। মোটা টাকা যৌতুকের বিনিময়ে কিছুদিন স্বামীর ঘর করতে পারে। রুচি বিরুদ্ধ, মত বিরুদ্ধ সংসারে বেশিদিন সুখ থাকে না, টেকেও না। সুন্দরের পূজারি কে না! সুন্দরী পাত্রীর খোঁজে সবাই থাকে! প্রতিষ্ঠিত পুরুষ চাইলেই দরিদ্র ঘরের সুন্দরী কন্যাকে বউ করে আনতে পারে। সমাজ বাস্তবতায় অসহায়ত্বে দুর্দিন যাপন করে কালো কুৎসিত মেয়েগুলো। স্বামীর মনমতো সঙ্গ দিতে অপরাগ। বনফুলের ‘মানুষের মন’ গল্পে নরেশ ও পরেশ সহোদর। আকৃতি গঠনগত দিক থেকে দুই ভাইয়ের মধ্যে মিল-অমিল বেশি। বিবেক বিচার বুদ্ধির দিক থেকেও তারা ভিন্ন। বনফুল যথার্থ বলেছেন তাদের সম্পর্কে: ‘মনের দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায় যে, দুজনেই গোঁড়া। একজন গোঁড়া বৈজ্ঞানিক এবং আরেকজন গোঁড়া বৈষ্ণব। অত্যন্ত নিষ্ঠা সহকারে নরেশ জ্ঞানমার্গ এবং পরেশ ভক্তিমার্গ অবলম্বন করিয়াছেন।’ দুজনের মতের পার্থক্য রয়েছে। নরেশ পরেশ ভিন্ন স্বভাবের ভিন্ন প্রকৃতির ভিন্ন আকৃতির হওয়া সত্ত্বেও শান্তিতে বাড়িতে বসবাস করতেন। ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের সম্পর্ক সম্মানের আত্মিক। পারিবারিক সুখ সমৃদ্ধি এনে দিতে সক্ষম।
আরও পড়ুন: জীবনানন্দের কবিতায় উপমা এবং বনলতা সেন
বনফুলের আরেক গল্প ‘তর্ক ও স্বপ্ন’। যেখানে মাংস রান্না নিয়ে বাবুর্চির সাথে তর্ক হয়। জাপান প্রসঙ্গে জানে না। জাপানে বোমা হামলার অস্থির পরিস্থিতির কথা গল্পকথক দারুণভাবে এ গল্পে তুলে ধরেছেন। স্বপ্ন ভেঙে গেলে তর্কও বন্ধ হয়ে যায়। কল্পনায় গল্পকার বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি বর্বতার করুণ অবস্থা তুলে ধরেন। ‘চট করে আমার ঘুমটা ভাঙিয়া গেল। স্বপ্নটাও। যে দুইজন উগ্র প্রকৃতির যুবক জাপান-জার্মানি সংবাদ, হিটলার মুসোলিনি প্রভৃতি লইয়া তর্ক মুখর হইয়া উঠিয়া ছিলেন। তাহারা দেখিলাম নামিয়া গিয়াছেন ট্রেন থামিয়ে নাচ নগরে।’ ‘সনাতনপুর আদিবাসিবৃন্দ’ গল্পে তিনি পুরুষ মানুষকে নিজের আয়ত্তে রাখার মোক্ষম উপায়গুলো সাজিয়ে তুলেছেন এভাবে, ‘পুরুষ মানুষদের বশে রাখার একমাত্র উপায় হচ্ছে নজর বন্দি করে রাখা, চোখে চোখে রাখা। যা বলেন আমাদের গাঙ্গুলী। দুটি চোখের আড়াল হয়েছে তো কী, বাস’। আদিবাসীদের জীবনব্যবস্থায় নারী-পুরুষের জীবনযাত্রায় পুরুষকে নারীর চোখে চোখে রাখতে হয়। গাঙ্গুলী দিদির কথা বাস্তব। শৈলেশ্বরবাবুর চালাকির ফান্দে পড়লে যে কোনো মানুষ বিপদে পড়তে পারে। শেষে শৈলেশ্বরবাবু মারা যান। কারোর প্রেমে পড়ে নয়। গভীর কুয়ার মধ্যে পড়ে মারা যান। যদিও এই কুয়া কেউ ব্যবহার করত না। মল্লিক আবিষ্কার করলেন মারা যাওয়ার কিছুদিন পর। এ কুয়ায় শৈলেশ্বরের দেহ পচে-গলে আছে। ‘দুজনে গাধার পিঠে মোট চাপাইয়া বেশ স্বচ্ছন্দ ঘরে ফেরা করিতে লাগিল যেন কিছুই হয় নাই। প্রবীণের দল কতকটা হতভম্ব হইয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িলেন। তাহার পর অবশ্য তাহারা ব্যাপারটা বুঝিয়ে ফেলিলেন ভূতের কাছে মামদোবাজি’। স্বামীর মৃত্যু স্ত্রীর অসহায়ত্বকে আরও বেশি আঁকড়ে রাখে। আদিবাসী নারী জীবনের করুণ ট্র্যাজেডিকে গল্পের থিমে দাঁড় করিয়েছেন।
‘সুলেখার ক্রন্দন’ গল্পে সুলেখার প্রথম সন্তান ডিপথেরিয়ায় মারা যায়। দুইদিন অজ্ঞান অবস্থায় বিছানায় পড়ে ছিল। মাতৃত্বের শোক সুলেখার জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। বনফুল নারীর মন ও মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারাকে অদ্ভুত বলে আখ্যা দিয়েছেন। ‘নারীর মন বিচিত্র তাহাদের মনস্তত্ত্ব ও অদ্ভুত। সে সম্বন্ধে চকোরিয়া কোনো মন্তব্য করা উচিত মনে করি না। বস্তুত স্ত্রীজাতির সম্বন্ধে কোন কিছু মন্তব্য করাই দুঃসাহসের কার্য। মনিকে দেখিয়া মনে হয় বয়স বোধহয় উনিশ কুড়ির। অনুসন্ধান করে জানা গিয়েছে তাহার বয়স পঁয়ত্রিশ।’
চিরকালের জন্য সব হারিয়ে সুলেখা পাগল প্রায়। পুত্রশোকে সে উন্মাদ। হয়তো সময়ের সাথে সাথে সন্তান হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারবে। মানবজীবনের অত্যাধিক বাসযোগ্য সমাজে পরিবার ও সন্তান মায়ার বাঁধনে বাঁচিয়ে রাখে! সন্তান হারানোর শোক সবার ভেতর কম-বেশি থাকে। সুলেখা আবেগী তাই তাঁর পুত্রশোক কাটানো কষ্টসাধ্য!
বনফুলের ‘অমলা’ গল্পে অবিবাহিত কন্যাকে নিয়ে পিতা-মাতার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। জীবনের বাস্তবতায় শিকলবন্দি থাকে ঘরে থাকা মেয়েটি। বিয়ে দিতে পারলেই দায়সারা। বাবা-মায়ের চিন্তা কতক্ষণে মেয়েকে সুপাত্রে সোপর্দ করবে। মোটা অঙ্কের যৌতুক ছাড়া কোনো রূপসীকেই বিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। অমলা গল্পে যৌতুক ও পাত্রীর যোজন-বিয়োজনে বিয়ের সজ্জায় জীবনসঙ্গীর মোহ যেন অতলে তলিয়ে যায়। অমলা চরিত্রে ভারতীয় উপমহাদেশের অবিবাহিত কন্যাদের মনের অনুরণন চিন্তা স্বপ্ন চেতনাকে বারবার দোলা দেয়। আবার দরদামের বনিবনায় হারিয়ে যায় স্বামী সংসার করার বাসনা। ‘অমলাকে আজ দেখতে আসবে। পাত্রের নাম অরুণ। নাম শুনেই অমলার বুকটিতে যেন অরুণ আভা ছড়িয়ে গেল। কল্পনায় সে কত ছবিই না আঁকলে। সুন্দর, সুশ্রী, যুবা, বলিষ্ঠ, মাথায় টেরি, গায়ে পাঞ্জাবি, সুন্দর সুপুরুষ। অরণের ভাই বরুণ তাকে দেখতে এল। সে তাকে আড়াল থেকে দেখে ভাবলে-আমার ঠাকুরপো। মেয়ে দেখা হয়ে গেলো। পছন্দ হয়েছে। একথা শুনে অমলার আর আনন্দের সীমা নেই। সে রাত্রে স্বপ্নই দেখলে। বিয়ে কিন্তু হল না-দরে বনল না।’ পাত্রী পছন্দ হলেই হয় না। পাত্রীর সাথে মোটা অঙ্কের যৌতুক লাগবে। বাবা যেন কন্যার জন্য বর কিনে এনে দেবে। হেমচন্দ্র নামে আরেক পাত্র এলো। দাবি-দাওয়া বনলো ঠিকই কিন্তু পাত্রী পছন্দ হয়নি। এবার দরে বনল; কিন্তু মেয়ে পছন্দ হলো না।
সবশেষে মেয়েও পছন্দ হলো। দাবি-দাওয়াও বনলো। অমলার প্রত্যাশিত স্বপ্নপূরণ হলো। তবে অমলার পছন্দমতো পাত্র পেলো না।বিয়ে হয় না, বিয়ে তো হয়েছে। শুভদৃষ্টির সময় অমলা একটা মায়ার বাঁধনে আটকে গেলো। এই শান্ত শিষ্ট নিরীহ স্বামী পেয়ে অমলা মুগ্ধ হলো। অমলা সুখেই আছে।
আরও পড়ুন: আবু আফজাল সালেহের শিল্পপ্রকরণ
বনফুলের ছোটগল্পের বিষয়ের বিভিন্নতা-প্রকাশভঙ্গির নতুনত্ব-সাবলীল জীবনচর্চা আমাদের মানবজীবনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। ধনী-দরিদ্র, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা সবই বিরাজমান। সহজ জীবনকথার সাথে রয়েছে ভণ্ড, পাপী, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন অন্তঃসারশূন্য মানুষের জীবনকথা। বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের আর্থিক অবস্থায় নিমজ্জিত মানবজীবনের পরাকাষ্ঠা জীবনের চিত্র। তাঁর যুক্তি ও বুদ্ধির মাধ্যমে আবেগকে বিসর্জন দিয়ে বাস্তবতার নিরীখে জীবন পরিচালনার প্রয়াস পাওয়া যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মানুষকে বাস্তবমুখী করে তোলে। সেই সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমগ্র দেশ-জাতির টনক নড়বড়ে করে দেয়। বিজ্ঞানের যুগ শুরু হয়। আধুনিক চিন্তা সবার নজরে আসে। নতুনভাবে বাঁচার পথ খুঁজে নেয়। বস্তুবাদী ভাবনা মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে বিজ্ঞাননির্ভর জীবনদর্শনকে সবাই বেছে নেয়। গল্পগুলোর চরিত্র যেন সে পথের কাণ্ডারি। তাঁর গল্প তিন রকমের- ছোট, বড় ও মাঝারি আকৃতির। গল্প যে আকৃতিরই হোক না কেন, প্রত্যেকটি গল্পে অনিষ্ট জীবনদৃষ্টির পরিচয় রেখেছেন। অতি কথার অবকাশ তাঁর গল্পে রাখেননি। স্বচ্ছ ও পরিকল্পনায় অল্পকথায় জীবনচিত্র পাঠকমহলে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছেন। বাস্তববাদী লেখকের প্রকৃত গুণ হলো অল্পকথায় সমগ্রসত্তাকে জাগ্রত করা। বনফুলের ছোট আকৃতির গল্প হলো (নিমগাছ, ছোটলোক, জোৎস্না), মাঝারি আকৃতির গল্প (জৈবিক নিয়ম, মুহূর্তের মহিমা), বড় আকৃতির গল্প (ঐরাবত, অর্জুন মণ্ডল)-এ তিন আয়তনের গল্পই তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে। বনফুলের গল্পে Single Impression কিংবা একক প্রতীতী বিদ্যমান। ঘটনার বিস্তৃতিকে উপেক্ষা করে তিনি একক প্রতীতীর কৌশল অবলম্বন করেছেন। গল্পের ভাষাশৈলীর বিশেষত্ব হলো হ্রস্ব বাক্য ব্যবহারের প্রবণতা দীর্ঘবাক্য পরিত্যাগ করা। বর্ণনা অংশে সাধুভাষা, প্রত্যক্ষ উক্তির ক্ষেত্রে চলিত ভাষার ব্যবহার। ছোট ছোট সরল বাক্যের ব্যবহার। কর্তাহীন ক্রিয়াহীনতায় গল্প সৃষ্ট। লেখক ব্যক্তিত্বের ছায়াপাত। যা লেখকের অভিনব শিল্পকৌশল। গল্পের ফ্ল্যাশব্যাক। শব্দ বিচ্যুতি, ইংরেজি শব্দ, বাগধারা প্রয়োগ, বহুভাষিকতার প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। গল্পের মধ্যে গল্প বলার রীতি, শব্দচৌম্বক, গল্পের নাটকীয় সূচনা ও তির্যক ভাষায় গল্প হয়ে উঠেছে নান্দনিক।
সমকালের বিষয়বস্তু বর্তমানেও উপস্থিত। তৎকালীন সমাজ আর বর্তমান সমাজের মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটলেও কিছু কিছু দিক ধ্রুব সত্যের ন্যায় বিরাজমান। ছোট, বড়, মাঝারি সব ধরনের গল্পে তিনি শিল্প সার্থকতা ও মানবজীবনের অন্তর্নিহিত দিকগুলো নিপুণ কারুকার্য শোভিত করেছেন। মানবমনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, জয়-পরাজয়, লীলাবৈচিত্র্যে রহস্য উদঘাটন বনফুলের শিল্পদৃষ্টির অভিনব কৌশল।
লেখক: কবি ও গবেষক।
এসইউ/জেআইএম