ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

বিশ্বজিৎ চৌধুরীর গল্প

যুদ্ধোত্তর ইতিহাসের জীবন্ত দলিল

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০২:২৯ পিএম, ১৩ জুন ২০২৩

বঙ্গ রাখাল

কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেছেন, ‘ইতিহাস আর উপন্যাস এক জিনিস নয়। এই দুয়ের মাঝে এক রসায়ন থাকতে হবে। একটা কেমিস্ট্রি থাকতে হবে। এই সংমিশ্রণকে আলাদা আলাদা করা যাবে না। এই রসায়নকর্মটা যে করতে পারে না, তার লেখক হওয়া চলে না। যে বাস্তবকে অবাস্তবের সাথে মেলাতে পারে না, সে বাস্তবের পেছনে পরাবাস্তব দেখতে পায় না। বাস্তবের পেছনে, গভীরে আরো কত বাস্তব আছে এটা যে দেখতে পায় না, সে বাস্তববাদী লেখক নয়। তার মানে কি এই যে, বাস্তববাদী লেখক হলে আমরা সবাই প্রতিদিন যা দেখছি তা-ই লিখব? তা লিখলেই হয়। কিন্তু তাতে কি ঔপন্যাসিক হওয়া যায়? সবাই ঔপন্যাসিক হয় না কেন? এজন্য যে, সবাই জীবনের গভীরে বাস্তবতা-অবাস্তবতার সংমিশ্রণ দেখতে পায় না। চোখের আকৃতি ছোট-বড় দিয়ে সুন্দর বিবেচনা হতে পারে। কিন্তু সাহিত্য বিবেচনা হয় না।’ বিশ্বজিৎ চৌধুরীর দেখার চোখ অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। তিনি সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেন। এ কারণেই বোধহয় তার কথাসাহিত্য নিয়ে মানুষ আজ চারিদিকে কথা বলতে শুরু করেছেন। এই অতি সূক্ষ্ম কিংবা নিপুণভাবে নানা অ্যাঙ্গেল থেকে সমাজকে দেখে তিনি অতি সহজ এবং সাবলীল ভাষায় তা বর্ণনা করেন আমাদের পরিচিত চরিত্রের মধ্য দিয়ে। এভাবেই বিশ্লেষিত হয়েছেন রজত, মোজাম্মেল, মোমিনুল, জয়নাল, দীপালী সাহা, রমা চৌধুরী কিংবা বঙ্গবন্ধুর মতো চরিত্রটি।

২০১৪ সাল। একটি বইয়ের নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। যাকে আমরা বলি, বইটি খুব নাম করেছে। বইটির নাম ‘নার্গিস’। এটি নজরুল এবং নার্গিসের জীবনকে অবলম্বন করে লেখা। বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা। লেখক কে? লেখক একজন কবি-সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক। পূর্বে তার নামের সাথে পরিচিত থাকলেও মূলত তাকে ভালোভাবে চেনা-জানার সুযোগ হয় ‘নার্গিস’ উপন্যাস পড়ার মাধ্যমে। বইটির লেখক বিশ্বজিৎ চৌধুরী। তিনি ১৯৬০ সালের ১ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষ করে ১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ১৯৮৬ সালে লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তার প্রথম শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ ‘লিন্ডা জনসনের রাজহাঁস’ ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয়। এছাড়া তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা ও নাটকসহ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অবদান রেখেছেন। তার অন্য রচনার মধ্যে ছোটগল্প বিবাহবার্ষিকী ও অন্যান্য গল্প, সম্ভ্রমহানির আগে ও পরে, স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রেমের গল্প, দুধারি তলোয়ার, সেরা দশ গল্প এবং নির্বাচিত গল্প। কাব্যগ্রন্থ তোমার প্রাণের জল শ্যাওলা শরীরে ও বন্যাপ্রবণ, মাঠের ওপারে যাবে, লীলা? নির্বাচিত কবিতা। উপন্যাস তুমি কি ভালোবেসে ছিলে? একটি নিঃসঙ্গ তালগাছ, নার্গিস, বাসন্তী তোমার পুরুষ কোথায়? হে চন্দনা পাখি, দূর-সম্পর্ক, ফুটো, খুন ও আনন্দকুসুম, কবি ও রহস্যময়ী প্রভৃতি। প্রবন্ধ মুক্তিযুদ্ধ যুদ্ধাপরাধ ও অন্যান্য, সমকালীন চট্টগ্রামের চালচিত্র, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, গবেষণা কবি আহসান হাবীব: পরিণতির পরম্পরা।

কিছুদিন আগে পড়লাম বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ছোটগল্পের বই ‘পাথরের মূর্তির মতো’। বইয়ে এগারোটি গল্প। যেখানে উঠে এসেছে মন ও মানুষের দশদিগন্ত। গল্পের চেনা মানুষকেই যেন চোখের পলকে মনে হচ্ছে অচেনা। এই হৃদয়ের গহন অন্দর হতে আলো ফেলে তুলে আনা হয়েছে চরিত্র। এ আবিষ্কৃত চরিত্রই পাঠককে দিয়েছে এক অন্যরকম প্রাপ্তি। এখানেই একজন কথাকারের সার্থকতা। রক্ত, নায়িকার প্রবেশ ও প্রস্থান, সেন্ট জোনাথনের ছেলে, রাজহাঁস নিয়ে আমার বিভ্রম, কোকিল ডাকিয়াছিল, সাপ না দড়ি? সুন্দর রহস্যময়, মৃত্যু যেভাবে বাঁচায়, তোমার মন নাই কুসুম? পাথরের মূর্তির মতো, পাহাড়ের ওপারে পাহাড় গল্পগুলো ভীষণভাবে আমাকে আলোড়িত করেছে। কেননা লেখক এমন কিছু অপ্রত্যাশিত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন সেখানে; যেটি পাঠকমনে নাড়া দেবে পরিমিতিবোধ, মমতা এবং অন্তর্দৃষ্টিতে। লেখক পূর্বে কিংবা চলমান সব ঘটনা থেকেই সূক্ষ্মতায় ছেঁকে অনুরণিত হওয়ার মতো বিষয়গুলোকে গল্পে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ফেরদৌস আরা আলীমের ভাষায়, ‘গল্পকার বিশ্বজিৎ চৌধুরী জানেন গল্পের হাতটা কী ভাবে ধরতে হয়, কখন কী ভাবে গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিতে হয়, পাঠককে কোন ভাবের ঘোরে ফেলে গল্পের কোন চরিত্রকে কোন কাজটা কখন করিয়ে নিতে হয়। গল্প যে শুধু ঘটনার নয়, চরিত্রের ভাব-ভঙ্গি, ভাষা-ভঙ্গি, চালচলন—সবকিছুতে গল্প চারিয়ে দেবার যে কৌশলটা চাই সেটি তাঁর করায়ত্ত। সংলাপে-সংলাপে গল্প গড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। তাঁর চরিত্রদের যাপিত-জীবনের কোষে কোষে গল্প থাকে। সত্যিকারের সাপ হয়ে ছোবল দিতে সক্ষম তাঁর গল্প। আবার সর্পভ্রমে রজ্জুতে প্রাণসংশয়ের মতো ঘটনাও ঘটাতে পারে বিশ্বজিতের গল্প। চৈতন্য টান টান করা গল্পগুলো আমাদের সাহিত্যের বড় সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে।’ ‘পাথরের মূর্তির মতো’ বইয়ের নাম ভূমিকায় রয়েছে একটি গল্প। গল্পটি লেখা হয়েছে বাংলার বীর জননী রমা চৌধুরীকে নিয়ে। গল্পটি নিয়ে বিস্তৃত বলতে চাই। তার আগে প্রয়োজন রমা চৌধুরী সম্পর্কে কিছু বলা।

আরও পড়ুন: ছোটগল্প ও শিশুসাহিত্যের জাদুকর

রমা চৌধুরী ১৪ অক্টোবর ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালাখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। রমা চৌধুরীই দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী, যিনি প্রথম স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে তিনি সর্বপ্রথম ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। এ বীরাঙ্গনা নারী মুক্তিযুদ্ধের পর কখনো পায়ে স্যান্ডেল পরেননি, স্যান্ডেল পায়ে দিলে তাঁর মাটিতে ঘুমিয়ে থাকা সন্তানদের অসম্মান করা হবে এ আদর্শকে তিনি অন্তরে ধারণ করেই খালি পায়ে হাঁটতেন। এ থেকেই বোঝা যায়, তিনি দেশমাতৃকাকে কতটাই ভালোবাসতেন। শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন। এ নারীর ওপর মুক্তিযুদ্ধের সময় চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি তিন পুত্রসন্তানের জননী। এ সময় তাঁর স্বামী ভারতে চলে যান। ১৩ মে তাঁর ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চড়াও হয়। তাঁকে পাশের ঘরে নিয়ে সম্ভ্রম কেড়ে নেওয়া হয়। সম্ভ্রম হারিয়ে তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য যখন পাশের পুকুরে লুকিয়ে থাকেন; তখন তাঁর ঘর-বাড়ি গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এমতাবস্থায় ঘর-বাড়িহীন রমা চৌধুরী তিন সন্তান ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে জলে-জঙ্গলে লুকিয়ে বেরিয়েছেন। এ সময় তাঁরা মানবেতর জীবনযাপন করেছেন। কোনো সাহায্য সহযোগিতা করা হয়নি বরং তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত। তাঁর ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থে এ সময়ের বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়।

বিজয়ের আগের দিন অর্থাৎ ১৫ ডিসেম্বর থেকে তাঁর সন্তান সাগরের শ্বাসকষ্ট শুরু হয় এবং ২০ ডিসেম্বর মারা যায় সাগর। ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থের ২১১ পৃষ্ঠায় রমা চৌধুরী লিখেছেন, ‘ঘরে আলো জ্বলছিল হ্যারিকেনের। সেই আলোয় সাগরকে দেখে ছটফট করে উঠি। দেখি তাঁর নড়াচড়া নেই, সোজা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সে, নড়াচড়া নেই। মা ছটফট করে ওঠে বিলাপ করে কাঁদতে থাকেন, আর ভাই নাই, ভাই গ্যাছে গো।’ একই অসুখে আক্রান্ত দ্বিতীয় সন্তানও। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অর্ধউন্মাদিনী রমা চৌধুরী নিজের ছেলে টগরকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে অসাবধানতাবশত তাঁরও শ্বাসরোগ হয় এবং টগর মারা যায়। প্রথম সংসারের পর দ্বিতীয় সংসার বাঁধতে গিয়ে সেখান থেকেও প্রতারিত হন। দ্বিতীয় সংসারের ছেলে টুনু ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর বোয়ালখালীর কানুনগোপায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তিনি পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, পুরুষ ছাড়াও সমাজে টিকে থাকা সম্ভব। তিনি নিজের সন্তানদেরও নিজের পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার শিক্ষা দিয়েছিলেন। কেউ তাঁর সন্তানদের বাবার কথা জানতে চাইলে তিনি তাদের ভগবানের সন্তান বলে পরিচয় দিতেন।

রমা চৌধুরী ১৯৭১ সালের বীরমাতা। তিনি নিজের জীবনের মূল্যবান সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়েছেন, যে কারণে স্বামী ও সমাজ তাঁকে গ্রহণ করেনি। তবুও তিনি মাথা নত করেননি। নিজের ইচ্ছাশক্তির বলেই হাতে তুলে নিয়েছেন কলম। এ কলমের মাধ্যমেই তুলে ধরেছেন নিজের কথাগুলো। তাঁর চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অসংগতিগুলোকে লেখার উপকরণ বানিয়ে রচনা করেছেন কবিতা ও প্রবন্ধ। স্বাধীন দেশ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই তিনি পরিচিত হন একজন ধর্ষিতা নারী হিসেবে। তিনি তবুও এই লাঞ্ছনাকে মাথা পেতে নিয়ে নিজেকে ধ্বংস না করে টিকে থাকার শক্তি হিসেবে গ্রহণ করেন। রমা চৌধুরী সমাজের প্রতি বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে সন্তানদের শবদেহ হিন্দুরীতি অনুযায়ী না পুড়িয়ে মাটিচাপা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

আরও পড়ুন: অসমাপ্ত আত্মজীবনী: একটি জীবন্ত দলিল

রমা চৌধুরীর যেন জন্মই হয়েছে দুঃখকে বরণ করে নিয়ে চলার জন্য। তিনি সন্তানদের দুঃখকে ভোলার জন্য বিড়াল পুষতেন এবং তাদের আদরের মধ্যেই যেন নিজের হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের খুঁজে পান। বিড়াল নিয়েই সন্তানহারা এ মায়ের সংসার। তাঁর লিখিত ৮টি গ্রন্থ তিনি এ বিড়ালের নামেই উৎসর্গ করেছেন। শরীর ভালো থাকলে কাঁধে ঝোলা নিয়ে নিজের লেখা বই বিক্রির জন্য বের হয়ে যান। তবুও নিজের সাহায্যের জন্য কারো কাছে হাত পাতেননি। তিনি বলেন, ‘আমার সন্তানদের শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়নি কিন্তু তারা আমার কাছে শহীদ। কারণ একাত্তর আমাকে দিয়েছে পোড়াভিটে, কাঁধের ঝোলা, ছেলের শোক আর খালি পা।’ স্বাধীনতার পরে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘আজ থেকে প্রত্যেক বীরাঙ্গনার পিতার নামের জায়গায় আমার নাম আর ঠিকানার জায়গায় ৩২ নম্বর ধানমন্ডি লিখে দাও।’ বঙ্গবন্ধুর জীবিতকালে অনেকেই পুনর্বাসিত হয়েছেন। জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ইতিহাস পাল্টে যায়। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে যায়। তখন থেকেই লাঞ্ছিত হন বীরাঙ্গনারা। তাদের পুনর্বাসিত করা হয়নি। এ দেশে এ সময় তাদের কোনো খোঁজ রাখা হয়নি।

রমা চৌধুরী সর্বস্ব হারিয়ে দেশের কাছ থেকে পেয়েছেন বীরাঙ্গনা উপাধি। তিনি অনেক অভিমানী; দেশের কাছে বেশি চাওয়াও ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ তাঁর পুরো জীবনকেই লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। তবুও তিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন। ‘পাথরের মূর্তির মতো’ বইয়ে একটি গল্পের চরিত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে। কিন্তু শেখ হাসিনা বা শেখ রেহানা নন। অন্য একটি মেয়ে, ভিন্নতর প্রেক্ষাপট। ‘পাথরের মূর্তির মতো’ গল্পে রমা চৌধুরী প্রফেসরকে বলছেন, ‘প্রফেসর সাহেব, যুদ্ধের পর আমার যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। পাকিস্তানি সেনারা আমাকে ধর্ষণ করেছিল এটা যেন আমারই অপরাধ। অন্য লোকের কথা কী বলব, আমার এক কাকা, আমার মরা বাপের আপন ভাই আমার সম্পর্কে যেসব কথা বলে বেরিয়েছে... ভাবতে পারবেন না। কোথাও লজ্জায় ঘৃণায় নিজের পিতা-মাতার পরিচয় দিতে পারতাম না। এ রকম দুঃসময়ে একদিন শুনলাম শেখ সাহেব বলেছেন ‘ধর্ষিত মেয়েরা বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দাও, আর ঠিকানা লেখ ধানমন্ডি বত্রিশ’। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না স্যার, সেদিন থেকে আমি শেখ মুজিবের মেয়ে। এটি আমি অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করেছি। আমার আর কোনো গ্লানি নেই, আমার একটা পরিচয় আছে। আমি শেখ মুজিবের মেয়ে।’

কী এক বাস্তবতার বয়ানে লেখক গল্প লিখেছেন। যে গল্প পড়লে একদিকে যেমন চোখে জল গড়িয়ে পড়ে, অন্যদিকে ঘৃণা আর ক্ষোভের জন্ম দেয়। এ সমাজের মানুষের প্রতি যারা আমাদের জন্য তাদের জীবনের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে তাদের জায়গা হয় না। তারা না খেয়ে পথে পথে ঘোরেন। এরই নাম বুঝি প্রতিদান। রমা চৌধুরী দেশের জন্য কী করেননি? দেশের জন্য তার অবদান দেখলে যে কোনো মানুষ পাথর হয়ে যাবেন। একবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে খবর পঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কী লাগবে আপনার? রমা চৌধুরী জবাবে বলেছিলেন, কিছু লাগবে না। তিনি বীরদর্পে গল্পে খালিদের কাছে বলছেন, আমি শেখ মুজিবের মেয়ে, আমি কারো কাছে হাত পাততে পারি? এই হলো রমা চৌধুরী। তাকে কেন্দ্র করেই ‘পাথরের মূর্তির মতো’ গল্পটি রচিত হয়েছে। সামান্য বিষয়কে অসামান্য করে গল্পে রূপদান করার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে গল্পকার বিশ্বজিৎ চৌধুরীর।

আরও পড়ুন: মজিদ মাহমুদের কবিতা: মহাভাষ্যের বলয় থেকে

বইটির প্রথম গল্প ‘রক্ত’। গল্পটি আমাদের ক্ষয়িত সময়ের গল্প। সদ্য স্বাধীন দেশ চারিদিকে নিজেকে সাজিয়ে তুলতে শুরু করেছে। এর কয়েক বছরের মধ্যেই ঘটে এক ভয়াবহ ঘটনা। যুদ্ধোত্তর মূল্যবোধের অবক্ষয়, আস্থা বা বিশ্বাসহীনতায় পাল্টে যায় দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। দেশের রাজনৈতিক এই যে বাঁক-বদলের খেলা সত্যকেও হার মানাচ্ছে। এ গল্পের নারী চরিত্র জাহানারা মাহমুদ। তিনি বলেছেন, আশির দশকের দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জারুলতলায়, চাকসু ক্যাফেটেরিয়ার সামনে, শহীদ মিনারের পাদদেশে কামরুল নামের এক তরুণের কণ্ঠে অনর্গল প্রবাহের মতো উচ্চারিত হতো প্রতিবাদের ভাষা, সেই ভাষা শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। চশমার কাচের আড়ালে থেকে দীপ্ত, বাঙ্ময় দুটি চোখ আমাকে যেন ঘুমের মধ্যেও জাগিয়ে রাখত। জাহানারার পিতা মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন আবু মাহমুদ। এই আবু মাহমুদ পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিরোধ যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রও দখল করতে চেয়েছিলেন। মৌলভী সৈয়দ, এস এম ইউসুফ, মহিউদ্দিন চৌধুরী মিলে খুনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। এটাকেই তখনকার সরকার ‘চট্টগ্রামের ষড়যন্ত্র মামলা’ নাম দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা ভেস্তে গিয়েছিল। মৌলভী সৈয়দ ধরা পড়েছিলেন আর্মিদের হাতে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয় লোকটাকে। পিঠে হাত রেখে বিশ্বাসে তুমি বলেছিলে, আপনার বাবার মৃত্যু বৃথা যাবে না, এদেশে একদিন বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হবেই। ডাক্তার মিলন মারা গেছে পুলিশের গুলিতে। ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ খোলা বুকে-পিঠে লিখে পথে নেমেছিল নূর হোসেন। পুলিশের গুলি এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছিল সেই তরুণের বুক ও পিঠ।

‘তুমি সারাদিন পড়ে আছো পথে, মিছিলে-আন্দোলনে-সংগ্রামে। আমরা পরস্পরকে ভালোবেসেছি। কিন্তু একান্তে প্রেম করার সুযোগ আমাদের হয়নি।’ এভাবেই জাহানারা ও রজতের সম্পর্ক ঘনিভূত হয় এবং বিবাহ করেন তারা। ওই বছরই ছেলে জন্ম নিল, তার নাম রাখা হলো ঋজু। একদিন গল্পের নায়ক রজত গিয়েছিল গ্রামের বাড়ি সাতকানিয়ায় এক রাজনৈতিক সভায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। সভায় জামাত-শিবিরের লোকজন আক্রমণ করেছিল। রজতের রাজনৈতিক সহকর্মী মারা গেলেও সে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসে। বাসায় এলে জাহানারা বলেন, তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও। রজত কোনো জবাব দেয়নি। এ ঘটনার দুদিন পরেই মধ্যরাতে হঠাৎ পুলিশ ঘিরে ফেলেছিল তাদের ঘর। নিজের চোখে জাহানারা দেখল পুলিশ তাদের শোবার ঘরে বালিশের নিচে একটা রিভলবার রেখে রজতের অস্ত্র বলে তুলে নিয়ে গেল। পরের দিন জাহানারা থানায় গেলেও সেখানকার লোকজন বলছে রজত নামে তারা কাউকে তুলে আনেনি। এসবি, ডিবি, পিআইবি, পুলিশের নানা সংস্থায় দিনের পর দিন ঘুরেও রজতের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। প্রায় আটদিন পর ভোরবেলা একটি গাড়ি এসে নামিয়ে দিয়ে যায় রজতকে। হাত-পায়ে ব্যান্ডেজ, ক্রাচে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে ঘরে ঢোকে রজত। পরে কানাডা যাওয়ার জন্য বললেও রজত দেশ ছেড়ে যেতে চায় না। সে এ মাটিতে বঙ্গবন্ধুর হত্যা ও রাজাকারদের বিচার দেখতে চায়। জাহানারা একমাত্র সন্তানকে বুকে করে দেশ ছাড়েন, সবকিছু থেকে দূরে রাখতে চায় ছেলেকে। রজত-জাহানারা বিচ্ছিন্ন জীবন-যাপন করে। সব ধরনের সামাজিক-জাগতিক যোগাযোগও ছিন্ন হয়ে গেল।

১৫ আগস্ট ২০১৬ সাল। টরন্টো কনভেনশন সেন্টারে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীকে স্মরণ করে মঞ্চস্থ হয় ‘শেখ মুজিব: দ্য ট্র্যাজিক হিরো’। এটি মীর সালেখ খানের লেখা ও নির্দেশনা। মীর সালেক খান এক সময় ঢাকা থিয়েটার করতেন, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু এবং রাইসুল ইসলাম আসাদের বন্ধু। নাটকটি ছিল বিয়োগান্ত। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতে ফারুক, রশিদ, ডালিমের মতো একদল বুনো শুয়োর কেমন করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ভীতি-সঞ্চারী আবহসংগীত আর আলো-ছায়ার কারুকাজে তা চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন নির্দেশক। বঙ্গবন্ধু মরে নাই। সালেক খানের চোখে বিস্ময় ও মুগ্ধতা, ‘কী করল ছেলেটা? এতো আগুন সে কোথায় পেল? ঋজুতো আবু মাহমুদের নাতি, কামরুল হাসান রজতের ছেলে... সাহসের উত্তরাধিকার, রক্তের উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করবে কে?’ এভাবেই ‘রক্ত’ গল্পটিতে চমৎকারভাবে বাস্তবতাকে লেখক তুলে ধরেছেন। আমাদের জীবন্ত ইতিহাসই যেন আমাদের চোখের সামনে উপস্থিত। আমাদের ইতিহাস আজ বদলে পড়তে হয়। প্রতিদিন কত ধর্ষণ, ইয়াবা, বন্দুকযুদ্ধ, গণজাগরণ, শাপলা চত্বর, টেকনাফ, রোহিঙ্গা-বিষয় তো ছুটে আসছে যমুনার বানের লাহান। একাত্তরে দেশটা স্বাধীন হলো, তারপর থেকে কত রকমভাবে বদলে গেল রাজনীতি। অস্থির সমাজ কত রকমভাবে বাঁক নিচ্ছে—সত্য ঘটনা তো গল্পকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা পদক-সনদ টাঙিয়ে রাখে দেওয়ালে। এগুলো গলার কাটা হয়ে থাকে। সত্যিকার মূল্যায়ন কী পেয়েছে মোমিনুল বা মোজাম্মেল। এদের তো মনে কোনো স্বার্থ ছিল না। তারা দেশকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছিল। এমনই ভাবে নানা ক্ষোভ-অভিমান-বদলে যাওয়া রাজনৈতিক ইতিহাস কিংবা বাস্তবতার করুণ আখ্যানের ডালি সাজিয়েছেন কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী। এটি আমাদের একাত্তর পরবর্তী মানুষের সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক ইতিহাস বললেও অত্যুক্তি হয় না।

আরও পড়ুন: ওবায়েদ আকাশের কবিতা: উজ্জ্বল ও প্রোজ্জ্বল ভাষা

প্রকৃত জীবন কখনো গল্পের চেয়েও চমকপ্রদ। সেই জীবনের গল্পই লিখেছেন বিশ্বজিৎ চৌধুরী। এ যেন যথার্থই এক ‘বিস্তৃত, ব্যাপক ও বিচিত্রগামী গল্পবিশ্ব’। নানা শ্রেণিপেশার মানুষ তাঁর গল্পের চরিত্র। একইভাবে বিষয়-বৈচিত্র্য ও চেনা-অচেনা নানা চরিত্র পাঠককে দাঁড় করাবে অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি। বিশ্বজিৎ চৌধুরীর গল্পগুলো যেন এ সময় ও পরিপার্শ্বেরই বিশ্বস্ত দলিল এবং তিনি এ চিত্রকে ধারণ করেছেন এমন এক স্বাদু ও সপ্রতিভ গদ্যে যে, তার যাবতীয় মাত্রা ও ব্যঞ্জনা, ডিটেল ও ডিলেমা, অনন্ত জীবন ও বাঙ্ময় হয়ে ধরা দেয়।

গল্পকার অধিকাংশ গল্পই নিজ বয়ানে বলে যাচ্ছেন কিংবা অন্যের মধ্যে প্রতিফলন ঘটাচ্ছেন বা ক্ষণিকেই বদল ঘটছে নিজের দেখা রাজনৈতিক উত্থান-পতনের দৃশ্যপটে। বর্ণনা করে যাচ্ছেন আমাদের সামাজিক, মানসিক, রাজনৈতিক বিষয়গুলো—যা পাঠককে ঠিকঠাক লেখক নিজের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। চরিত্র চিত্রণ এবং কাল বিশ্লেষণের দক্ষ কারিগর কথাকার বিশ্বজিৎ চৌধুরী। প্রতিটি গল্পই বয়ানের দিক থেকে সরল। তার গল্প বলার ভঙ্গিটাও নিজস্ব। কাহিনি নির্মাণের ক্ষেত্রেও তিনি অতি সচেতন। ঘাত-প্রতিঘাতে কিংবা বাক্য বিন্যাসেও সচেতন বটে। কিছু আলাপ অতি চেনা হলেও আত্মমগ্ন, কোমল কিন্তু অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন গদ্যের কারণে পড়তে গিয়ে হৃদয়ে কম্পন অনুভব করতে হয়। এ সহজ-সরল ভাষার ছন্দই পাঠককে গল্পকার ও লেখার প্রতি আকৃষ্ট করে। এভাবেই পরিচয় মেলে একজন দক্ষ সাহিত্যিকের। নিঃসন্দেহে বিশ্বজিৎ চৌধুরী একজন দক্ষ সাহিত্যিক—এ কথা বলতেই হবে।

লেখক: কবি ও কথাশিল্পী।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন