নীল চশমা
হঠাৎ বেজে উঠল মোবাইল ফোন। আমিনুল সাহেব ভীষণ বিরক্ত হয়ে দেখলেন, তার মা মিসড কল দিয়েছেন। বিরক্ত হয়ে বৃদ্ধা মাকে বকা দিলেন সব সহকর্মীর সামনে। চিৎকার করে বললেন, ‘তুমি ব্রিটিশ আমলের মানুষ। তুমি যখন-তখন ফোন করে ফেলো। জানোই না যে, মিটিংয়ের সময় ফোন করতে হয় না।’
ছেলের চিৎকার শুনে ভয় পেয়ে গেলেন মা, ‘বাবা, আমি তো জানি না রে কখন তোর মিটিং থাকে। তাই ভুল করে ফোন করে ফেলেছি।’
ছেলের বকা খেয়ে দু’চোখ ভিজে উঠল মায়ের। ছানিপড়া চোখটি আরও ঝাপসা হয়ে উঠল।
দরজায় কে যেন ধাক্কা দিচ্ছে। দরজা খুলতেই উপমা প্রশ্ন করল, ‘দিদা, তুমি দরজা বন্ধ করে কেন ফোন করো? তোমার এত গোপন কী কথা থাকে?’
‘না রে দাদু ভাই, তোর বাবার সাথে আমার কোনো গোপন কথা নাই। কারো সাথে আমার কোনো গোপন কথা থাকে না।
‘তাহলে এভাবে চুরি করে ফোন করো কেন?’ প্রশ্ন করলো উপমা।
‘তোর বাবাকে ফোন করতে দেখলে তোর মা খুব বিরক্ত হবে।’
‘আমার বাবা তোমার ছেলে, তুমি তাকে ফোন করতেই পারো।’
‘ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে গেলে সবাই বাবা-মার আপন থাকে না।’
‘তাহলে বড় হয়ে কি আমিও বাবা-মায়ের পর হয়ে যাবো?’
‘না দাদু ভাই, তুই খুব ভালো মেয়ে। ভালো মেয়েরা সবার আপন থাকে। তোর বাবা আমাকে যেভাবে কষ্ট দিচ্ছে, তুই কখনো তোর বাবা-মাকে কষ্ট দিবি না।’
‘তুমি কাঁদছো কেন?’
‘কই, কাঁদছি না তো।’
দিদার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো উপমা। দিদা হাত বোলাতে লাগলেন উপমার মাথায়। মনোযোগ দিয়ে উপমা শুনতে লাগলো পুরোনো দিনের গল্প।
আরও পড়ুন: ভরদুপুরের ভূত
হঠাৎ ঘরের বাইরে প্রচণ্ড চিৎকার-চেঁচামেচি। উপমা লাফ দিয়ে উঠলো বিছানা থেকে। এক চোখ দিয়ে মালতি বেগম দেখলেন, তার ছেলের বউ চিৎকার করে বলছেন, ‘কেন, মা তোমাকে জমির ওই ভাগ দেবে? মা আমার বাসায় থাকে, তার একটা খরচ আছে না, ওই জমির ভাগ আমাদের। মা ওই জমি কাউকে দিতে পারবে না। আমি দিতে দেবো না। জমির ভাগ আমাকে দিয়ে তারপর এই বাসা থেকে জাহান্নামে যাক। তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।’
ছেলের বউয়ের কথা শুনে মালতি বেগমের বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব হলো। তিনি বসে থাকতে পারলেন না। বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
উপমা বলল, ‘দিদা, আমি সোনারগাঁ হোটেলে চলে যাচ্ছি। সাঁতার কাটতে। এসব টাকা পয়সার ঝগড়া আমার ভালো লাগছে না। আর শোনো, তোমার মোবাইলে পাঁচশ টাকা দিয়েছি। তুমি যার সাথে ইচ্ছা মন খুলে কথা বলো। তুমি ৫০ টাকার জন্য বাবা আর ফুফুদের কাছে হাত পাতো, আমার খুব খারাপ লাগে। তুমি আমার কাছ থেকে নিবা।’
‘তুই টাকা পাবি কোথায়?’
‘আমি প্রতি মাসে এক হাজার টাকা স্কলারশিপ পাই।’
‘এই টাকা থেকে পাঁচশ টাকা তোমার।’
আবেগ আর আনন্দে মালতি বেগম বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন নাতনিকে।
‘তুই ছাড়া আমার কেউ নাই রে। তুই আমার খুব ভালো বন্ধু।’
আরও পড়ুন: একজন শাহানারা বেগম
এক মাস পরের ঘটনা।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো মালতি বেগমের। বাসার মধ্যে উকিল, পুলিশ, কোর্টের লোকজন। কী ভয়ংকর কথা। এত মানুষ কেন? বিছানা থেকে নামতে পারছিলেন না তিনি। দৌড়ে এসে এক নারী পুলিশ তাকে বিছানা থেকে নামালেন। পাঁচ মেয়ে, চার ছেলে, নাতি, নাতনি, মেয়ের জামাই, ছেলের বউরা চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করলো মালতি বেগমের নামে বরাদ্দ থাকা পাঁচ কাঠা জমির ভাগ নেওয়ার জন্য।
মালতি বেগম বললেন, ‘বাবা, তোরা আমার সাথে এইভাবে গণ্ডগোল করিস না, আমার খুব শরীর খারাপ।’
মেয়ে মীনা বেগম বললেন, ‘দেখো মা, এসব নাটক করবা না। ভালো মানুষের মতো জমিটা আমাদের লিখে দাও। তা না হলে তোমার বিরুদ্ধে কেস করবো। আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবো।’
মালতি বেগম বলেন, ‘মা, তুই আমার সন্তান হয়ে এ কথা বলতে পারলি! ওই জমিটা আমি রেখেছি কাব্যর জন্য। কাব্যকে আমি রাস্তা থেকে তুলে এনে মানুষ করেছি। তোরা এত বড় বড় চাকরি করিস, আমি বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি, এইটা জানার সময় তোদের নাই।’
একটু থেমে তিনি বলেন, ‘আজ কত বছর পরে তোদের একসাথে দেখলাম। আমি এত দুর্ভাগা মা, ঈদের দিনেও তোদের সবাইকে দেখতে পাই না। আজ জমির ভাগ নিতে তোরা সবাই উপস্থিত। আমাকে জেলখানায় পাঠানোর জন্য এসেছিস। তবুও ভালো তোদের দীর্ঘ বছর পর অন্তত একসাথে তো দেখতে পেলাম।’
মেজ ছেলে রাকিব খান বলে উঠলো, ‘মা, তাড়াতাড়ি দলিলে স্বাক্ষর দাও। তোমার সাথে এত কথা বলার সময় আমাদের নাই। তুমি বেকার মানুষ। তোমার কাজ নাই। কিন্তু আমাদের অনেক কাজ আছে। তাড়াতাড়ি স্বাক্ষর দাও। নইলে সত্যিই আমরা তোমায় আদালতে নিয়ে যাবো। কাব্যকে আমাদের টাকায় মানুষ করেছো, এটাই তো যথেষ্ট। ওকে জমি দিবা কেন?’
মালতি বেগম বললেন, ‘তোদের সবাইকে আমি বাড়ি, গাড়ি, ব্যাংকের টাকা ভাগ করে দিয়েছি। আমার ভাগের ৯০ ভাগ তোদের দিয়েছি। কাব্যকে আমি মাতৃস্নেহে বড় করেছি। ওর বাবা-মার কোনো পরিচয় নাই ঠিকই কিন্তু মানুষ হিসাবে সে বড় ভালো। আমি এই জমি ওকেই দেবো। এটা আমার দীর্ঘ বছরের ইচ্ছা।’
ঝগড়া, চিৎকার-চেঁচামেচি আর ছেলে-মেয়েদের লালসার কাছে হার মানলেন মালতি বেগম। পাঁচ কাঠা জমি দিয়ে দিলেন নয় ছেলে-মেয়েকে। এবার ৫ কাঠাকে ৯ ভাগ করার জন্য বেঁধে গেলো মহাযুদ্ধ। প্রচণ্ড বুকে ব্যথার জন্য মালতি বেগম ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন।
আরও পড়ুন: চাঁন-পরীর সংসার
পরদিন সকাল। আকাশ ভরা মেঘ। সরকারি ছুটির দিন। আমিনুল সাহেবের বাসার বুয়া, মালি, ড্রাইভার, উপমা দরজা ভেঙে বের করল মালতি বেগমকে।
নিথর দেহে পড়ে আছেন মেঝেতে। দু’চোখ থেকে গড়িয়ে যাওয়া পানিগুলো মিশে গেছে গালের সাথে। ডানহাতে ধরে ছিলেন একটি চিঠি। তাতে লেখা,
‘উপমা, দাদুভাই, আমায় ক্ষমা করে দিস। তোকে ছেড়ে চলে গেলাম ওইপারে। দীর্ঘ বছর ধরে সবার এই অপমান আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না রে।
আমাকে আর কষ্ট করে ওল্ড হোমে পাঠাতে হবে না। দাদু ভাই, তোর জন্য আমার একটি কিডনি দিয়ে গেলাম। এইবার তোর কিডনি ট্রান্সপ্ল্যানটেশনটা হবে। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। তুই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবি। বিদায় দাদু ভাই। আমাকে ক্ষমা করে দিস।’
উপমা কাঁদতে পারছে না। বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে দিদার এক পা ভাঙা টেবিলের দিকে। শূন্য আর নিথর হয়ে পড়ে থাকা দিদার কালো চশমাটি বেদনায় হয়ে গেছে নীল।
এসইউ/জেআইএম