জীবনানন্দের কবিতায় উপমা এবং বনলতা সেন
মো. আশরাফুল আলম
‘উপমাই কবিতা’—জীবনানন্দ দাশ মনে-প্রাণে এ কথা বিশ্বাস করতেন। সে কারণেই রবীন্দ্রনাথ বলয়ের বাইরে এসে তিনি শুরু করলেন বাংলা সাহিত্যের এক নতুন ধারা। অনেকেই জীবনানন্দ দাশের এ কাব্যধারার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। তাই হয়তো তার কবিতার সমালোচনা হয়েছে বিস্তর। তার কবিতা অভিযুক্ত হয়েছিল অশ্লীলতার দায়ে অথবা দুর্বোধ্যতার দায়ে। জীবদ্দশায় এ কারণেই কবি হিসেবে যথেষ্ট সম্মান পাননি তিনি। তার একেকটি কবিতা প্রকাশিত হচ্ছিল আর সেগুলোকে তুলোধুনো করে সমালোচনা করছিলেন তার সাহিত্যিক প্রতিপক্ষরা। অবশ্য তার কারণও আছে।
তিনি কবিতায় যেসব শব্দ আর উপমা ব্যবহার করছিলেন, সেগুলোর সঙ্গে বাঙালি পাঠক অথবা তার সমসাময়িক কবিরা কেউই পরিচিত ছিলেন না। যেমন তিনি লিখলেন—
একটি তারা এখনো আকাশে রয়েছে, পাড়াগাঁয়ের বাসরঘরে সবচেয়ে গোধূলি মদির মেয়েটির মতো।
কিংবা মিশরের মানুষী তার বুকের থেকে যে মুক্তো
আমার নীল মদের গেলাসে রেখেছিলো
হাজার বছর আগে তেমনি
তেমনি আকাশে একটি তারা জ্বলছে এখনো।
এখানে স্পষ্টত একটি ভোরের বর্ণনা করা হয়েছে। ভোর হয়ে গেলেও আকাশে একটি তারা এখনো রয়ে গেছে। পাড়া গাঁয়ের কোনো মদিরা মেয়ে সারারাত বাসরঘরে থেকে রাত্রি শেষে ঘুমে যেরকম ঢুলুঢুলু থাকে; তারাটিও ঠিক সারারাত জাগার পরে সেরকম ঘুমে ঢুলুঢুলু করছে। মিশরের রানি ক্লিওপেট্রা এন্টানিওর সঙ্গে একবার বাজি ধরে বলেছিলেন, তিনি সবচেয়ে দামি নৈশভোজ দেবেন। খাবার শেষে ক্লিওপেট্রা এন্টানিওকে জিজ্ঞাসা করলেন, নৈশভোজ কেমন হলো? এন্টানিও উত্তরে বললেন, ভালো কিন্তু সবচেয়ে দামি নয়। তখন ক্লিওপেট্রা তার কানের দামি মুক্তাগুলো মদের গ্লাসে নিক্ষেপ করেন। মুক্তাগুলো গলে গিয়ে উজ্জ্বল রঙের হয়। কবি এখানে কল্পনা করেছেন মুক্তাগুলো গলে যাওয়ার পরে যেরকম উজ্জ্বল হয়েছিল; আকাশের তারাটিও ঠিক তেমনই উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে।
বাংলা সাহিত্যের অনেক কবিতায় ভোরের বর্ণনা আছে কিন্তু জীবনানন্দ দাশের মতো এতটা উপমা নির্ভর নয়। সে কারণেই সমালোচকরা তার কবিতাকে দুর্বোধ্য বলতেন। তিনি আরও লিখলেন—
হাইড্রান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল,
অথবা সে হাইড্রান্ট হয়তো বা গিয়েছিল ফেসে
যখন দুপুর রাত নগরীতে দল বেঁধে নামে,
একটা মোটর কার গাড়লের মতো গেলো কেশে।
হাইড্রান্ট দিয়ে উপচে জল পড়ছিল। তিনি সেটিকে লিখলেন হাইড্রান্ট গেল ফেসে। গাড়ির হর্ণকে তিনি লিখলেন কাশির শব্দের সঙ্গে। প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা ফুটে উঠেছে তার কবিতায় অসাধারণভাবে। বাংলার প্রকৃতি ফুল, ফল, পাখি তার কবিতায় এমনভাবে ফুটে উঠতো—মনে হতো জীবন্ত ক্যানভাস। যেমন-
চারিদিকে নুয়ে পড়েছে ফসল, তাদের স্তনের থেকে ফোটা ফোটা পড়িতেছে শিশিরের জল।
তার প্রথমদিকের কবিতাগুলোয় দেখা গেছে অদ্ভুত সব ভাষা আর উপমার প্রয়োগ—
ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল
ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার,
রাঙা আপেলের মতো গাল।
এই কবিতার শেষে লিখলেন—
মোর জানালার পাশে তারে দেখিয়াছি
রাতের দুপুরে,
তখন শকুন বধু যেতেছিলো শ্মশানের পানে উড়ে।
আরও পড়ুন: ছোটগল্প ও শিশুসাহিত্যের জাদুকর
এ এক অদ্ভুত ভাষা। শকুনের কথা অনেক কবিতায় আছে কিন্তু শকুন বধুর কথা তিনি আশ্চর্য সুন্দরভাবে তুলে আনলেন। তুলে আনলেন ডালিম ফুলের মতো গালের কথা। কবি আবুল হোসেন একবার কাজী নজরুল ইসলামকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, জীবনানন্দ দাশ নামে একজন কবি বলেছেন উপমাই কবিতা। উত্তরে নজরুল বলেছিলেন, তোমাদের আর ‘মা’তে হচ্ছে না, ‘উপমা’ দরকার। এ থেকে বোঝা যায়, জীবনানন্দ দাশের ওপর তাচ্ছিল্য নজরুলেরও ছিল। অথচ জীবনানন্দ দাশ তার প্রথমদিকের কবিতায় নজরুলকে অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। এমন অন্ধভাবে অনুসরণ করেছিলেন, সে কবিতাগুলোকে নজরুলের কবিতা বললেও ভুল হবে না। যেমন-
একাকী রয়েছি বসি,
নিরালা গগণে কখন নিভেছে শশী।
পাইনি যাহা টের,
দূর দিগন্তে চলে গেছে কোথা খুশরেজী মূসাফের।
তাচ্ছিল্য তাকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও করেছিলেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’ রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পড়ে উত্তর দিয়েছিলেন—
কল্যাণীয়েষু,
তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এতো জবরদস্তি কেন বুঝতে পারি নে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদিতে পরিহাসিত করে। বড় জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে, যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সমন্ধে সন্দেহ জাগে। জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরং উল্টো।
ইতি
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আরও একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। ১৯৩২ সালে পরিচয় পত্রিকায় জীবনানন্দ দাশের বহুল আলোচিত ক্যাম্পে কবিতাটা ছাপা হয়। একই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাঘের আশ্বাস কবিতাটাও ছাপা হয়েছিল। সে কারণেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনানন্দ দাশের ক্যাম্পে কবিতাটি পড়েছিলেন। মন্তব্য করেছিলেন জীবনানন্দ দাশের ওই ক্যাম্পে কবিতার ‘ঘাই হরিণী’—ওটা কিচ্ছু হয়নি। উল্লেখ্য, ক্যাম্পে কবিতার দুইটি শব্দ ছিলো ঘাই হরিণী; যেটি নিয়ে তখন ব্যাপক আলোচনা হচ্ছিলো। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নতুন কবির আগমনকে হয়তো ভালোভাবেই নিয়েছিলেন। সে কারণেই হয়তো লিখেছিলেন—
ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কাল বোশেখীর ঝড়।
আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বলয়ের বাইরে এসে জীবনানন্দ দাশ নিজেও ঘোষণা দিলেন—
কেউ যাহা জানে নাই, কোন এক বাণী
আমি বহে আনি।
জীবনানন্দ তার কবিতায় ব্যবহার করলেন অসাধারণ সব উপমা, সে উপমার ভাষা যারা বুঝতে পারতেন; তারা তার কবিতায় বুদ হয়ে থাকতেন। তিনি লিখলেন—সোনার ডিমের মতো ফাল্গুনের চাঁদ, পাখির নীড়ের মতো চোখ, বেতের ফলের মতো ব্যথিত নীলাভ দু চোখ, বেবিলনের রানির ঘাড়ের উপর উজ্জ্বল চামড়ার শালের মতো জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ, শিশিরের মতো সন্ধ্যা—এরকম আরও অসাধারণ তাক লাগানো মুগ্ধ হয়ে থাকার মতো শত শত উপমা।
জীবনানন্দ দাশের উপমামণ্ডিত একটি বিখ্যাত কবিতা হলো ‘বনলতা সেন’। অনেক সাহিত্যিকের মতে, এটি শুধু বাংলা ভাষায় নয়; বিশ্বসাহিত্যের সেরা কয়েকটি কবিতার মধ্যে একটি। কবিতাটির মধ্য দিয়ে জীবনানন্দ দাশ জীবদ্দশায় সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছিলেন। কবিতাটি প্রকাশের পর থেকে আজ অবধি আলোচনা হচ্ছে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মোনালিসা যেরকম রহস্য, বনলতা সেনও ঠিক একই রকম রহস্যে ঢাকা। বনলতা সেন কবিতা জীবনানন্দ দাশের নিজেরও অনেক প্রিয় ছিল বোধহয়। ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হয়ে তিনি যখন অচেতন অবস্থায় দিনের পর দিন অজ্ঞান থাকতেন। মাঝেমধ্যে তার জ্ঞান ফিরলে তিনি বলতেন, আমি এখন দেখতে পাচ্ছি বনলতা সেনের পাণ্ডুলিপির রং। জীবনানন্দ দাশের একনিষ্ঠ ভক্ত মেডিকেলের ছাত্র ভূমেন্দ্র গুহ হাসপাতালে যারা কবিকে দেখাশোনা করতেন, তাদের উৎসাহ অথবা পারিশ্রমিক যা-ই বলা হোক না কেন, সবাইকে একটা করে বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: অসমাপ্ত আত্মজীবনী: একটি জীবন্ত দলিল
কবিতা পত্রিকায় ১৯৩৫ সালের ডিসেম্বরে বনলতা সেন কবিতাটি প্রকাশিত হয়। বনলতা সেন নামটি জীবনানন্দ দাশ কীভাবে বেছে নিয়েছেন, সেটি নিয়ে নানা ব্যাখ্যা আছে। তার এক মাসির নাম ছিল স্নেহলতা। জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন সম্ভবত প্রথম বাঙালি নারী ঔপন্যাসিক। তার প্রথম উপন্যাসের নাম ছিল ‘স্নেহলতা’। তার আরও দুটি উপন্যাসের নাম ‘শান্তিলতা’ ও ‘প্রেমলতা’। এছাড়া ১৮৭৩ সালে তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্বর্ণলতা অত্যন্ত জনপ্রিয় উপন্যাস ছিল। নামগুলো থেকে জীবনানন্দ দাশ ‘বনলতা’ নামটি বেছে নিতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প নষ্টনীড়ের বৌদির ভূমিকায় মূল চরিত্রের নাম ‘চারুলতা’। এ নাম থেকে প্রভাবিত হয়েও জীবনানন্দ দাশ বনলতা নামটি বেছে নিতে পারেন। তবে জীবনানন্দ দাশ অশোক মিত্রকে একবার বলেছিলেন, রাজশাহীর জেলে বনলতা নামে এক রাজবন্দির নাম থেকে তিনি নামটি বেছে নিয়েছিলেন। তিনটি স্তবকে রচিত কবিতাটি ধাবিত হয়েছে ক্রমশ বড় থেকে ছোটর দিকে। প্রথম স্তবকে বিশ্ব থেকে, সমুদ্র, রাজা, রাজ্য নগর হয়ে চলে যায় এক রমণী বনলতা সেনের দিকে।
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে।
অনেক ঘুরেছি আমি, বিম্বিশার অশোকের ধুসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি, আর দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে।
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন
আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
এখানে হাজার বছর ধরে পথ হাঁটা মানে প্রেমিকার জন্য পথ হাঁটা নয়। জীবনানন্দ বৌদ্ধ দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন আর বৌদ্ধ দর্শন যেহেতু জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করে, তাই এই হাজার বছর হাঁটা মানে জন্ম জন্মান্তরের হাঁটা বা পথ বুঝানো হয়েছে। সে কারণেই তিনি বলেছেন, আমি ক্লান্ত প্রাণ এক। দীর্ঘ হাঁটা বোঝাতে সিংহল অর্থাৎ শ্রীলঙ্কা আর মালয় বলতে ভারতের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূল বোঝায় যা মালাবার উপকূল নামে পরিচিত। সিংহল থেকে মালাবার উপকূল সমুদ্র পথে বেশি দূরত্বের নয় কিন্তু তটরেখা ধরে হাঁটলে তা অনেক দীর্ঘ পথ। আবার এই দুটি স্থান গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই দীর্ঘ পথ বোঝাতে জীবনানন্দ দাশ এ দুটি স্থানকেই বেছে নিয়েছেন।
বনলতা সেন কবিতায় অন্ধকার শব্দটি পাঁচবার এসেছে। অন্ধকার বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি, এ অন্ধকার তা নয়। বৌদ্ধ দর্শনে অন্ধকার হলো বোধির বিপরীত শব্দ। এ অন্ধকার হলো সত্যকে দেখতে না পারা। বোধিপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এ অন্ধকার হতে মুক্তি নেই। তাই জন্ম জন্মান্তর থেকে কবি অন্ধকার পথে চলছেন। এরপর কবি বলেছেন, বিম্বিশার অশোকের ধূসর জগতে। বিম্বিশার ছিলেন মগধের অধিপতি (খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫৮-৪৯২) তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তার পুত্র অজাতশত্রু ছিলেন প্রচণ্ড বৌদ্ধ ধর্ম বিদ্বেষী। তাই পিতাকে তিনি বন্দি করে অনাহারে হত্যা করেন। পিতাকে হত্যা করার জন্য অজাতশত্রু কোনো অনুশোচনা করেননি। এমনকি তার কোনো শাস্তিও হয়নি। আবার সম্রাট অশোক ছিলেন মৌর্য সম্রাট। যার আদিনাম চণ্ড অশোক। সাম্রাজ্যের লোভে কলিঙ্গের যুদ্ধে সম্রাট অশোক অসংখ্য নিরীহ মানুষকে হত্যা করেন। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সম্রাট অশোক পরে অনুশোচনায় ভোগেন। এ হত্যাকাণ্ড তার মনকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। ফলশ্রুতিতে তিনি রাজ্য রাজত্ব সবকিছু ছেড়ে দিয়ে সাধু মানুষে পরিণত হন। সুতরাং বলা যেতে পারে, হাজার বছরের পথ চলায় কবি দুই ধরনের পাপীকেই দেখেছেন।
প্রথম স্তবকে যে নগরীর কথা বলা হয়েছে, তার নাম বিদর্ভ নগর। বিদর্ভ নগরী ছিল মহাভারতে বর্ণিত নায়িকা দময়ন্তীর পিতৃভূমি। অসামান্য রূপবতী রাজকন্যা দময়ন্তী ভালোবাসতেন নলকে। পতি হিসেবে নলকেই বেছে নিতে ছিলেন। কামের দেবতা কলি দময়ন্তীকে বিয়ে করতে চাইলেন। দময়ন্তী রাজী না হয়ে নলকে বিয়ে করেন। কলির ক্রোধে দময়ন্তীর সুখের সংসার ছাই হয়ে গেল। পৃথিবীতে অশান্তি কেবল মানুষেরাই করেনি, দেবতারাও করেছে। কিন্তু হাজার বছরের এ পথচলায় দেবতাদের কোনো অনুশোচনা বা শাস্তি হয়নি।
সমুদ্রের জলে জোয়ার ভাটা থাকলেও মানুষের জীবন সমুদ্রে কোনো ভাটা নেই। আছে কেবল জোয়ার। সেগুলো হলো লোভ, লালসা, কাম, হিংসা, অহংকার—এ সমস্ত খারাপ প্রবৃত্তিকেই বলা হয়েছে চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন। প্রথম স্তবক শেষ হয়েছে বনলতা সেন নামক এক নারীর মধ্য দিয়ে। কবি তার নামের পূর্বে নাটোর শব্দটি ব্যবহার করে কবিতাটিকে আরও রহস্যময় করে তুলেছেন। কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য বলেন, জীবনানন্দ বনলতা সেনকে রূপসী বাংলার সৌন্দর্যের রূপক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তবে বনলতা সেনের পরিচয়ের সবচেয়ে চমকপ্রদ বর্ণনা দেন ড. আকবর আলী খান। চাকরিসূত্রে তিনি নাটোরে ছিলেন। সেখানকার ইতিহাস ঘেটে তিনি জানতে পারেন, নাটোর ছিল সেই সময়কার বারবণিতার জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত জায়গা। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ নিজে কখনো নাটোরে যাননি। তাহলে নাটোর শব্দটি তিনি লিখলেন কেন?
আরও পড়ুন: মজিদ মাহমুদের কবিতা: মহাভাষ্যের বলয় থেকে
জীবনানন্দ চাকরিসূত্রে কিছুদিন দিল্লিতে গিয়েছিলেন। সে সময় নাটোরের কোনো নারী দিল্লিতে গিয়েছিলেন। সেখানে জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে তার পরিচয়। বারবণিতা হলেও বনলতা সেনের মধ্যে সরলতা খুঁজে পেয়েছিলেন জীবনানন্দ। দিল্লিতে কিছুদিন থাকাকালীন প্রচণ্ড মানসিক টানাপোড়েনে ছিলেন তিনি। তার এক সহকর্মীর সঙ্গে দিল্লির পতিতা পল্লিতে গিয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ। ওই নিষিদ্ধ পল্লিতে যাওয়ার কথা তিনি তার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লিখেছিলেন—Girls first impression of brothels women-here, ideas about them everything.
দ্বিতীয় স্তবকের লাইনগুলো পড়লে এ বিষয়ে কৌতূহল আরও বেড়ে যায়—
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা
মুখ তার শ্রাবস্তির কারুকার্য, অতি দূর সমুদ্রের পর
হালভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা।
সবুজ ঘাসের দেশে যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে, বলেছে সে এতদিন কোথায় ছিলেন?
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
দ্বিতীয় স্তবকের শুরুতেই বিদিশা নগরীর কথা বলা হয়েছে। বিদিশা একটি প্রাচীন নগর। যা অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আর বনলতা সেনের চুল সেই অন্ধকার নগরীর মতো কালো। কালিদাসের মেঘদূতে বিদিশা নগরীর কথা উল্লেখ আছে। জীবনানন্দ সম্ভবত সেখান থেকেই এ নগরীর কথা তার বনলতা সেন কবিতায় উল্লেখ করেছেন। জীবনানন্দ অনেক ছোটবেলা থেকেই কালিদাসের মেঘদূত পড়তেন। যা তার ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকে জানা যায়।মেঘদূতে কালিদাস লিখেছেন, বিদিশা নগরী স্বাচীর নিকটে একটা পাপাচারী শহর। এখানে থাকতো কামুক নারীরা। তাদের শরীর থেকে আসতো সুগন্ধ। যা পুরুষকে আকৃষ্ট করতো। ঠিক তেমনই বনলতা সেনের চুল বিদিশা নগরীর মতো অন্ধকার। আর তার শরীরের গন্ধও সেই নগরীর নারীদের মতো। এ উপমা দ্বারা কবি জীবনানন্দ দাশ দ্বিতীয় স্তবকের শুরুতেই কি বনলতা সেনের পরিচয়ের দিকে ইঙ্গিত দিলেন?
গৌতম বুদ্ধ তার জীবনের শেষ ২৫ বছর শ্রাবস্তী নগরে বাস করেছেন। এ নগরে গৌতম বুদ্ধ ও তার সাথে আরও অনেক সুন্দরী নারী, যারা বুদ্ধকে তার ধ্যান থেকে বিচ্যুত করতে চাইতো। তাদের অপরূপ শিল্পকর্ম শ্রাবস্তী নগরে খোদাই করা আছে। যা চোখে দেখলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। বনলতা সেনের মুখকে জীবনানন্দ দাশ শ্রাবস্তী নগরের সেই শিল্পের মতো সুন্দর বর্ণনা করলেন। দারুচিনি দ্বীপের খোঁজে যে নাবিক অথৈ সমুদ্রে হাল ভেঙে দিশা হারিয়েছে, সমুদ্রের অকুল দরিয়ায় যে নাবিক হাবুডুবু খেতে খেতেও বাঁচার জন্য সবুজ ঘাসের দেশ কল্পনা করে। ঠিক তেমনই জীবনানন্দ দাশ হাল ভেঙে দিশা হারিয়ে বনলতা সেনের কাছে যখন পৌঁছলেন; তখন তাকে তার সবুজ ঘাসের মতো নিষ্পাপ মনে হয়েছে।
পুরো কবিতা পরে অন্তত একটি বিষয় পরিষ্কার যে, বনলতা সেনের সাথে কবির দেখা হয়েছে একবার এবং সেটা অন্ধকারে। সেখানে কবিকে উল্লেখ করে বনলতা সেনের একটা সরল স্বীকারোক্তি ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ এ কথা দ্বারা কবির প্রেম প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। সবুজ ঘাসের মতো নিষ্পাপ মেয়েটিকে প্রেম নিবেদন করা হলে অভিমান নিয়েই হয়তো বলেছিলেন, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
বাংলা সাহিত্যে প্রিয়তমার চোখের বর্ণনা নানা উপমা দিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু বনলতা সেন কবিতায় জীবনানন্দ ব্যবহার করলেন পাখির নীড়ের মতো চোখ। চোখের ভাষা দ্বারা মানুষ অনেক কিছু বুঝে নেয়। বনলতা সেনের পাখির নীড়ের মতো চোখ দ্বারা আশ্রয় বোঝানো হয়েছে। যে চোখে আছে আশ্রয়ের শপথ আর ভালোবাসা।
তৃতীয় স্তবকে জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন—
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল।
সবপাখি ঘরে আসে সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন,
থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
আরও পড়ুন: বাংলা সাহিত্যের একাল-সেকাল: প্রবন্ধগ্রন্থের আনন্দপঠন
শিশিরের শব্দের মতো নিঃশব্দে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসা উপমাটি দ্বারা আমাদের জীবন সায়াহ্ন বোঝানো হয়েছে। দেখতে দেখতে কীভাবে আমাদের জীবনের শেষ চলে এসেছে সন্ধ্যার মতো। আর সন্ধ্যায় চিল তার পাখা থেকে রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলতে পারলেও মানুষ তো আর সব স্মৃতি মুছতে পারে না। মানুষ তার স্মৃতি থেকে পাণ্ডুলিপি সাজায়, জোনাকির রঙের মতো রূপকথা সাজায়।
সব পাখি ঘরে ফেরে অর্থাৎ সবাইকে চলে যেতে হবে। অনেক কবি-সাধকই আমাদের জীবনকে তো পাখির সাথে তুলনা করেছেন। এই ফিরে যাওয়ার আগে মানুষ নিজেকে ভাবে জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিতে। কবিও ঠিক তেমনটাই ভাবছেন। জন্ম জন্মান্তরের এ হাঁটায় এই ক্লান্ত প্রাণ বনলতা সেনের কথা ভাবছেন। হয়তো ভালোবাসার অথবা অপরাধ বোধের জন্য কারণ তার সাথে দেখা অন্ধকারে দু’দণ্ড সময়ে খুবই অল্প সময়ের।
বনলতা সেনের পরিচয় যা-ই হোক না কেন—এ কবিতা জীবনানন্দ দাশের চাইতেও জনপ্রিয়। বাংলা, নাটক, গান অথবা সাহিত্যে বনলতা সেন একটি অতি পরিচিত শব্দ। পূর্বেই বলা হয়েছে, বনলতা সেন শুধু বাংলা ভাষায় নয়; সারা পৃথিবীর সেরা কবিতাগুলোর মধ্যে একটি। যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, প্রেম থাকবে; ততদিন প্রত্যেক প্রেমিক তার প্রেমিকার মধ্যে বনলতা সেনের ছাঁয়া খুঁজবে, পাখির নীড়ের মতো প্রেমিকার চোখে আশ্রয় খুঁজবে।
লেখক: শিক্ষক ও কথাশিল্পী।
এসইউ/এমএস