ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

সমরেশ চলে গেলেও রয়ে যায় রেশ

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:০৯ পিএম, ১২ মে ২০২৩

অরিত্র দাস

‘মৃত্যু কী সহজ, কী নিঃশব্দে আসে অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে যায়’—সমরেশ মজুমদারের উক্তিটি এখন বাংলা ভাষাভাষি পাঠকের মুখে মুখে। পারতপক্ষে সমরেশ কখনো জীবন নিয়ে গর্ববোধ করেননি। তিনি যা করেছেন, তা হলো—একটি স্থির মনোবৃত্তি নিয়ে লিখে গেছেন এক জীবন। তাঁর এই এক জীবনের লেখা তাকে বাঁচিয়ে রাখবেন আরও অনেকগুলো জীবনের ন্যায়। ১৯৬৭ সালে দেশ পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয় তাঁর লেখা গল্প—অন্য মাত্রা, বিনিময়ে পেয়েছিল পনেরো টাকা। এরপর ১৯৭৬ সালে দেশ পত্রিকায় প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ প্রকাশিত হওয়ার পর ক্রমাগত লিখেই গেছেন। লেখার জন্যই যেন তাঁর জন্ম। তারপর তাঁর লেখার দৌড় এসে থামলো ২০২৩ সালের মে মাসের ৮ তারিখ সন্ধ্যায়।

তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় কৈশোরে। পরিচয়ের সূত্রপাত অবশ্য ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে। তার লেখা ‘শাপ মোচন’ উপন্যাস পড়তে গিয়ে আমি প্রেমে পড়ি প্রেমের, আমি প্রেমে পড়ি সাহিত্যের, আমি প্রেমে পড়ি উপন্যাসের। আমার কাছে মনে হতে থাকে—এ এক আলদা জগৎ, যেখানে আর্থিক স্বচ্ছলতা-অস্বচ্ছলতা নেই, প্রতিক্রিয়াশীলতা নেই, লাভ-ক্ষতির দর কষাকষি নেই, প্রতিযোগিতা নেই, সংকীর্ণতা নেই, প্রতিষ্ঠা-অপ্রতিষ্ঠার ভাবনা নেই। আছে কেবল মননশীলতার তৃপ্তি। এই তৃপ্তির ঢেঁকুর প্রমথ চৌধুরী তুলেছিলেন বলেই হয়তো লিখেছিলেন এক প্রবন্ধ—‘সাহিত্যে খেলা’। কৈশোর বয়সে ‘শাপ মোচন’ আমাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেছিল ঠিক কিন্তু সেই প্রেম পরবর্তীকালে আমাকে নিয়ে যায় জলপাইগুড়ির ডুয়ার্সের চা বাগানে। যেখানে ১৯৪২ সালের ১০ মার্চ সুদর্শন মিতভাষী দীর্ঘকায় এক সুঠাম দেহের অধিকারী পৌরুষের জন্ম হয়। নাম তাঁর সমরেশ মজুমদার। জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলের ছাত্র। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে করেছেন স্নাতকোত্তর।

একে একে পড়ে ফেলি তাঁর লেখা উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ উপন্যাস। পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করি—একটা মানুষের মগজপ্রদেশে কয় সমুদ্র বাক্যসম্ভার থাকলে এমন শব্দবহুল উপন্যাস লেখা সহজ! যেন তাঁর কলমের উত্তাপে খইয়ের মতো ফুটতে থাকে শব্দ। মানুষকে পড়তে পারার ক্ষমতাও রপ্ত করেছিলেন বিস্ময়করভাবে, তিনি যা লিখতেন তা উপলব্ধি করে লিখতেন। উপলব্ধির অতলস্পর্শী গভীরতা থেকে তিনি তাঁর লেখায় বলেছিলেন—‘ঈশ্বর যদি মানুষকে অন্তত একদিনের জন্যে অন্যের মনের কথা পড়ার ক্ষমতা দিতেন, তাহলে নব্বই ভাগ মানুষ কেউ কারো সঙ্গে থাকতে পারত না।’

আরও পড়ুন: প্রথম গল্প লিখে ১৫ টাকা পেয়েছিলেন সমরেশ মজুমদার

বাস্তবিক অর্থে তা-ই। যা-ই হোক, তাঁর বিখ্যাত ত্রয়ী সিরিজের মধ্যে প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরাধিকার’, সিরিজটি শেষ হয় ‘কালপুরুষ’ দিয়ে। মাঝের উপন্যাস ‘কালবেলা’। যা ধারাবাহিকভাবে ‘দেশ পত্রিকা’য় প্রকাশ হয় ১৯৮১-১৯৮২ সালের দিকে। ১৯৮৪ সালে এ বই তাকে এনে দেয় সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। আমি আন্দোলিত হই, যখন দেখি আশির দশকে বাঙালি সমাজ ব্যবস্থায় তিনি অনিমেষ ও মাধবীলতার মাধ্যমে দেখিয়েছেন—যদি ভালোবাসা থাকে, তবে বিয়ের মতো এক সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা তথা চুক্তির মধ্যে না গিয়েও পাশাপাশি বসবাস করা যায়। বিয়ের অনুপস্থিতিতে স্বামী ও স্ত্রীর ন্যায় মনুষ্য জীবন পার করে দেওয়া যায় ভালোবাসা এবং বিশ্বাসের উপস্থিতিতে। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি স্বয়ং ঢাকায় আয়োজিত এক লেখক গল্প আড্ডায় স্বীকার করেছিলেন—‘লেখার সময় মনে হতো তৎকালীন রক্ষণশীল বাঙালি সমাজ অনিমেষ এবং মাধবীলতাকে মেনে নেবে না। ভেবেছিলাম আমাকে খিস্তি দিয়ে আমার বই বাজেয়াপ্তের হাঁক তুলবে, কিন্তু নাহ, মানুষ গ্রহণ করেছে।’

সেই সঙ্গে উপন্যাস ঘিরে আবর্তিত নকশালবাড়ির আন্দোলন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক তো ছিলই। এমন এক রাজনৈতিক তালমাতালের প্রেক্ষাপটে ‘কালবেলা’ উপন্যাস রচনা করেছেন, যখন ভরা বামফ্রন্ট এবং সিপিএমের ভাবমূর্তি চতুর্দিকে ঘোলাটে অবস্থা। লেখককে নজরদারিতে রাখা হতো, যে কোনো সময় আসতে পারে জীবনের প্রতি হুমকি। তথাপি তিনি রাজনৈতিক ঈর্ষা ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লিখেছেন, তুলে ধরেছেন পাঠকের কাছে। গর্ভধারিণী উপন্যাসে তাই লিখেছেন—‘অভাব থেকেই তো অক্ষমতা, ঈর্ষা আসে। আর সেটাকে ঢাকতে বেশীর ভাগ মানুষই গলা চড়িয়ে মেজাজ দেখানো ছাড়া অন্য কোন পথ পায় না।’

jagonews24

বস্তুত দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের অনুপ্রেরণায় তিনি কথাসাহিত্যিক হয়ে ওঠেন। কেননা জীবনের শুরুতে তিনি থিয়েটারে যোগ দেন। সেখানে নাটক লিখতে গিয়ে লিখে ফেলেন গল্প। গল্পের সূত্র ধরেই একদিন সাগরময় ঘোষ ডেকে বললেন, এবার তুমি একটা ধারাবাহিক উপন্যাস লেখো বরং। প্রথমে একটু ইতস্তত করেছিলেন কিন্তু লিখলেন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। একে একে সৃষ্টি করেছেন—দৌড়, সাতকাহন, তেরো পার্বণ, গর্ভধারিণী, স্বপ্নের বাজার, উজান গঙ্গা, মৌষলকাল, মনের মতো মন, ভিক্টোরিয়ার বাগান, অনুরাগসহ অর্ধশতের বেশি উপন্যাস। তাঁর লেখা বিপুল সংখ্যক উপন্যাসের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক একটি উক্তি পাওয়া যায় তাঁরই মৌষলকাল উপন্যাসে। তিনি লিখেছেন—‘বিখ্যাত লেখকরা বোধহয় এভাবেই উপন্যাসে লিখে থাকেন যা পাঠক আগে আন্দাজ করতে পারে না।’

ঢাকায় অনুষ্ঠিত সেই লেখক গল্প আড্ডায় আমার থাকার সুযোগ হয়েছিল। আমার তখন স্নাতকের পাঠ চুকায়নি। পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করি, উপসম্পাদকীয় লিখি। মলাট আকারে উপন্যাস বের হতে শুরু করেছে সবেমাত্র। তরুণ লেখক শুনে উনি বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে জানতে চাইলেন, ‘লিখ কেন?’ আমি স্মিত হেসে প্রসন্ন দৃষ্টিতে উত্তর দিলাম, ‘লিখতে না পারলে অস্বস্তি হয়, তাই লিখি।’ তিনি বেশ বাহবা দিলেন। খুশিও হলেন বোঝা গেল। প্রকাশ করলেন বাংলাদেশের তরুণ লেখকদের নিয়ে তাঁর সম্ভাবনার কথা। বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর আলাদা কৌতূহল ছিল। ছিল এখানকার কবি ও কথাসাহিত্যিকদের সঙ্গে দারুণ সখ্য। যাদের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ অন্যতম। বাংলাদেশে এলে লেখক হুমায়ূনের কাছে থাকতেন, হূমায়নকে কলকাতার মানুষের কাছে পরিচিত করে তুলতে তাঁর এক প্রকার তাড়না ছিল এ কথা সর্বজন বিধৃত।

আরও পড়ুন: কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার আর নেই

এ ছাড়া শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ শামসুল হকসহ অনেকের লেখা তিনি পছন্দ করতেন, পড়তেন। অধিকন্তু বাংলাদেশের ঘটনাবহুল পটভূমি নিয়ে লিখতে চেয়েছিলেন বই। এ বইয়ে মূলত পরাধীন ব্রিটিশ ভারতের ৪৬-এর দাঙ্গা থেকে শুরু করে একাধিকক্রমে ৪৭-এর দেশভাগ, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুথান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ৭৫-এর সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ স্বাধীন বাংলাদেশের ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে স্পর্শ করতে চেয়েছিলেন। কবিতার প্রতি তাঁর ছিল তীব্র ঝোঁক। তবে সবার যে কবি হতে হবে, তা তিনি মানতে পারতেন না। তিনি অপছন্দ করতেন সবার কবি হওয়ার প্রবণতা। বেশ কিছু কবিতা সমরেশ মজুমদার লিখলেও প্রকাশ্যে আনতে সর্বত্রই তাঁর মধ্যে অনীহা দেখা যেত। তাঁর কবিতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
‘এই যে আমি তোমাকে দেখছি,
দেখে মন ভরে যাচ্ছে,
না দেখতে পেলে বুক টনটন করে,
বেঁচে থাকাটা বিবর্ণ হয়ে যায়,
এই অনুভূতি কি
ভালোবাসা নয়?’

তবে তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে সমাদৃত হয়েছেন। এ বিবেচনায় জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে সাদৃশ্য পাওয়া যায় কিছুটা। জীবনানন্দ দাশ কবিতার পাশাপাশি উপন্যাসও লিখেছেন: যেমন কল্যাণী, সতীর্থ, মাল্যদানসহ বেশ কিছু উপন্যাস। কিন্তু জীবনভর তিনি নির্জনতার কবি হিসেবেই সমাদৃত হয়েছেন। সমরেশ বাবু একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, জীবনানন্দের কবিতায় তিনি উদ্বেলিত হন। ঢাকায় সমরেশ বিগত এক দশকে যতবার এসেছেন, তার অধিকাংশই হয়তো বাতিঘরের আমন্ত্রণে। বাংলাদেশের প্রতি, বাংলা ভাষার প্রতি এবং বাঙালির প্রতি এক প্রগাঢ় টান থেকেই তিনি বাংলাদেশে বারবার ছুটে এসেছেন। ব্যক্তি হিসেবে আমি সমরেশ বাবুকে দেখেছি নির্মীলিত মানুষ হিসেবে। বেশ গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। হিসেব করে কথা খরচ করেন তবে আন্তরিক। হাসেন খুব ছোট করে। দূর থেকে দেখলে যা বোঝা যায় না। কলকাতা ফিরে যাওয়ার আগে দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর লেখা ছোট্ট একটি বই ‘অপরিচিত জীবনযাপন’। বইটিতে দেওয়া তাঁর অটোগ্রাফ আজও স্বচ্ছ জলের মতো টলমল।

তাঁর সঙ্গে সরাসরি আলাপ হওয়ার আগেও আছে একটি স্মৃতি, যদিও তিনি তা জানেন না। আমার একটা নেশা আছে, বইয়ের নেশা। পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি মানুষ কোনো না কোনো নেশার দ্বারা আবদ্ধ। আমি এর ব্যতিক্রম নই। আমার নেশা বইয়ের নেশা। একবার হলো কী—নীলক্ষেত গেছি বই কিনতে। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠেছি। ক্যাম্পাসও ঠিকমতো পরিচিত হয়ে ওঠেনি। একাডেমিক এবং নন-একাডেমিক বই মিলিয়ে প্রায় হাজার খানেক টাকার বই কিনলাম। দোকানি টাকা পরিশোধ করার পর খেয়াল করলাম—বইয়ের মূল্য মিটিয়ে অবশিষ্ট কোনো টাকা নেই। যা দিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরবো। এখন কী করি, আমার এই নাজেহাল অবস্থা অনুমান করে বইসমূহের মধ্যে একটা বই, যার মূল্য তুলনামূলক কম—দোকানি তা রেখে দিতে চাইলেন। যাতে আমার জাহাঙ্গীরনগর পৌঁছানোর যাতায়াত খরচ উঠে যায়। আমি লক্ষ্য করলাম বইটি—সমরেশ মজুমদারের লেখা ‘আট কুঠরি নয় দরজা’। তাৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের জন্য নীলক্ষেত থেকে সায়েন্সল্যাব হেঁটে এসে দাঁড়িয়ে রইলাম ঘণ্টাখানেক। বই কিনে দেউলিয়া হয়ে শূন্য পকেটে ফিরেছি ক্যাম্পাসে, তবু রেখে আসিনি সমরেশকে। সমরেশের রেশ যাকে একবার ছোঁয়, তাকে উপেক্ষা করার সাহস কারো পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। আপনার আট দশকের এই দীর্ঘ জার্নির প্রতি শ্রদ্ধা সমরেশ মজুমদার। প্রণতি সমরেশ বাবু।

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন