ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

রুডইয়ার্ড কিপলিং

ছোটগল্প ও শিশুসাহিত্যের জাদুকর

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০২:৪০ পিএম, ০৬ মে ২০২৩

সাইফুর রহমান তুহিন

জোসেফ রুডইয়ার্ড কিপলিং ছিলেন উনবিংশ শতাব্দির শেষদিকের এবং বিংশ শতাব্দির শুরুর দিকের একজন ইংরেজ লেখক, সাংবাদিক ও কবি। ছোটগল্পের অন্যতম প্রধান প্রবর্তক হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকে। কিপলিংয়ের লেখা শিশুতোষ বইগুলো কিশোর সাহিত্যের জন্য চমৎকার দৃষ্টান্ত। সমালোচকরা তার কাজকে বহুমাত্রিক ও ঝলমলে কাহিনিসমূহের এক অমূল্য উপহার হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

১৮৬৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের মুম্বাই নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন রুডইয়ার্ড কিপলিং। তার জন্মের সামান্য কিছুদিন আগে তার বাবা-মা জন লকউড কিপলিং ও অ্যালিস কিপলিং ভারতে আগমন করেন। তারা এসেছিলেন অন্য স্বদেশির মতোই একটি নতুন জীবন শুরু করতে এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের ভারতবর্ষ শাসনে সহযোগিতা করতে। তারা ভালোভাবেই বসবাস করছিলেন এবং কিপলিং ছিলেন তার মায়ের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ।

রুডইয়ার্ড লেক এলাকার সৌন্দর্য লকউড ও অ্যালিস কিপলিংকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে, প্রথম সন্তানের নামের সঙ্গে তারা লেকটির নাম জুড়ে দেন। কিপলিংয়ের ভাস্কর ও মৃৎশিল্প ডিজাইনার বাবা ছিলেন মুম্বাইয়ের নবগঠিত ‘স্যার জামসেটজি জিজিভয় স্কুল অব আর্ট’র ভাস্কর্যবিদ্যা বিভাগের প্রধান। পরিচর্যাকারী নারীর সঙ্গে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইহুদিদের শহরটির ব্যস্ত বাজারগুলো অনুসন্ধানী চোখ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে কিপলিং উপলব্ধি করতে সক্ষম হন, ভারতবর্ষ একটি বিস্ময়কর জায়গা। তিনি স্থানীয় ভাষা শিখে ফেলেন এবং এই দেশ ও তার সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তিনি বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন।

আরও পড়ুন: বাংলা সাহিত্যের একাল-সেকাল: প্রবন্ধগ্রন্থের আনন্দপঠন

কিপলিংয়ের জবানবন্দিতে আত্মপরিচয় নিয়ে তার মানসিক দ্বন্দ্বের পরিচয় পাওয়া যায় এভাবে, ‘অপরাহ্নের উষ্ণতায় যখন আমরা ঘুমাতে যেতাম; তখন পর্তুগিজ আয়া কিংবা পরিচর্যাকারী ভারতীয় হিন্দু পুরুষ আমাদের গল্প কিংবা ভারতীয় শিশুতোষ গান শোনাতো। যা আমি একটুও ভুলতে পারিনি। এরপর কাপড়-চোপড় পরে ডাইনিং রুমের দিকে যাওয়ার সময় বাবা-মায়ের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলার বিষয়টি খুব ভালোভাবে মনে করিয়ে দেওয়া হতো। তখন অনেকটা ইতস্তত ভঙ্গিতেই ইংরেজি বলতে হতো।’

পাঁচ বছর বয়সে রুডইয়ার্ড কিপলিং নিজ দেশ ব্রিটেনে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হন এবং এরপর আবার ভারতবর্ষে ফিরে আসেন ১৮৮২ সালে। তখন তার বাবা ছিলেন লাহোরের মায়ো কলেজ অব আর্টের অধ্যক্ষ এবং লাহোর জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক। কিপলিং সেখানকার স্থানীয় পত্রিকা ‘সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি গেজেটে’ চাকরি পান। ১৮৮৭ সালে তিনি সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন এলাহাবাদের পত্রিকা ‘দ্য পাইওনিয়ারে’। এখানে তিনি ছিলেন ১৮৮৯ সাল পর্যন্ত। ১৮৮৬-১৮৮৭ সালে ‘সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি গেজেটে’ থাকাকালে কিপলিংয়ের মোট ৩৯টি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। এর অধিকাংশই ১৮৮৮ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘প্লেইন টেলস ফ্রম দ্য হিলসে’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

ওই দুটি পত্রিকা ছাড়াও রুডইয়ার্ড কিপলিং ১৯০০ সালের শুরুর দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার অরেঞ্জ ফ্রি স্টেটের রাজধানী ব্লুমফনটেইনের ‘দ্য ফ্রেন্ড’ পত্রিকায় সপ্তাহ দুয়েক কাজ করেছেন। ১৮৮৩ সালের গ্রীষ্মে তিনি ব্রিটিশ ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী এবং পাহাড়ি স্টেশন শিমলায় ভ্রমণ করেন। তখন থেকে তিনি ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয়ের (বড় লাট) শাসন প্রত্যক্ষভাবে অবলোকন করেন। ছয় মাসের জন্য শাসনকাল শিমলায় চলে আসাকে তিনি বর্ণনা করেন ‘শাসনকেন্দ্র এবং বিনোদন কেন্দ্র’ হিসেবে।

আরও পড়ুন: গোলাম কিবরিয়া পিনুর কবিতা: বুনোফুলের সৌরভে

কিপলিংয়ের জবানবন্দিতে শোনা যায়, ‘শিমলায় একমাস ছুটি কাটানোর সময়টাতে সেখানকার লোকজনের চলাফেরা আর নির্মল আনন্দ—প্রতিটি সোনালি মুহূর্তের হিসাব আমার কাছে আছে।’ শতাব্দীকাল অতিক্রম করে যাওয়া ‘গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড’কে কিপলিংয়ের কাছে মনে হয়েছে জীবন চলার পথে বহমান এক নদী যার অস্তিত্ব আছে বিশ্বজুড়েই। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া পর্যন্ত বিস্তৃত এ রোড এশিয়ার প্রাচীনতম ও দীর্ঘতম রাস্তাগুলোর একটি। ভারতের মুম্বাই নগরী নিয়ে কিপলিং লিখেছেন—
‘আমার কাছে সব শহরের মাতা
যেখানকার প্রবেশদ্বারে আমি জন্মেছিলাম
পাম গাছ ও সাগরের মাঝখানে
যেখানে পৃথিবীর শেষ আর অপেক্ষমান জাহাজগুলো।’

১৮৯২ সালের ১৮ জানুয়ারি রুডইয়ার্ড কিপলিং তার আমেরিকান লেখক বন্ধু ওলকট ব্যালেস্টিয়ারের বোন ক্যারোলিন ব্যালেস্টিয়ারকে (ক্যারি) বিয়ে করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্ট রাজ্যের ব্রাটলেবরোতে স্থায়ী হন। এই দম্পতির প্রথম সন্তান জোসেফাইন ১৮৯৯ সালে মাত্র ছয় বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। মেয়ের এই অকালমৃত্যুই কিপলিংকে উদ্বুদ্ধ করে ‘জাস্ট সো স্টোরিজ ফর লিটল চিলড্রেন’ গ্রন্থটি লিখতে। ‘কিম’ গ্রন্থটি প্রকাশের বছরখানেক পর ১৯০২ সালে এটি প্রকাশ হয়। কিপলিংয়ের শিশুতোষ গল্পগুলো এখনো আগের মতোই জনপ্রিয়। ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত ফিকশনধর্মী বই ‘দ্য জাঙ্গল বুক’ নিয়ে অসংখ্য চলচ্চিত্র ও কার্টুন সিরিয়াল তৈরি হয়েছে। ১৮৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কিপলিং ও ক্যারোলিন দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান এলিস জন্মগ্রহণ করে।

রুডইয়ার্ড কিপলিং তার লেখক জীবনে যেসব ফিকশনধর্মী কাজ করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে ‘দ্য ম্যান হু উড বি কিং’র মতো ছোটগল্প। তার রচিত কবিতার মধ্যে ‘ম্যান্ডালে’, ‘গুঙ্গা ডিন’, ‘দ্য গডস অব দ্য কপিবুক হেডিংস’, ‘দ্য হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন’, ‘ইফ’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ১৯০৭ সালে প্রথম ইংরেজিভাষী লেখক হিসেবে কিপলিং ‘নোবেল সাহিত্য পুরস্কার’ জয়ের কৃতিত্ব অর্জন করেন। ব্রিটিশ সরকার অনেকবার তাকে রাজকবির মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি ‘নাইটহুড’ খেতাব দিতে চেয়েছে। কিন্তু তিনি তার কোনোটিই গ্রহণ করেননি।

আরও পড়ুন: পল ফায়ারাবেন্ড: একজন এনার্কিস্টের কথকতা

অনেক লেখক যেমন—এডমুন্ড ক্যান্ডলার কিপলিংয়ের লেখা দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। কবি টি এস এলিয়ট ১৯৪১ সালে তার সম্পাদিত ‘এ চয়েস অব কিপলিং’স ভার্স’ গ্রন্থের ভূমিকায় লেখেন, রুডইয়ার্ড কিপলিং সব সময় শ্রেষ্ঠত্বের দৌড়ে নিজেকে শামিল রাখার নীতি অবলম্বন করতেন এমন কথার কোনো যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাই না।’ এলিয়টের কথার সূত্র ধরে জর্জ অরওয়েল ১৯৪২ সালে কিপলিংয়ের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দীর্ঘ মূল্যায়ন করেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে কিপলিং খুব জটিল ডিওডেনাল আলসার রোগে ভোগেন এবং এর পরিণতিতে ১৯৩৬ সালের ১৮ জানুয়ারি তার জীবনাবসান ঘটে। তার দেহভস্ম লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে কবিদের সমাধিস্থলে থমাস হার্ডি ও চার্লস ডিকেন্সের কবরের পাশে সমাধিস্থ করা হয়।

যে ভারত থেকে রুডইয়ার্ড কিপলিং তার অধিকাংশ লেখার উপাদান সংগ্রহ করেছেন, সেখানেই তার যশ ও খ্যাতি নিয়ে বিতর্কের উদ্ভব হয়েছে। বিশেষ করে আধুনিক জাতীয়তাবাদী এবং উপনিবেশ-পরবর্তী কিছু সমালোচকদের কাছে। অন্য সমসাময়িক ভারতীয় বুদ্ধিজীবী যেমন—আশীষ নন্দী কিপলিংয়ের লেখালেখির সঙ্গে পুরোপুরি ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তবে এসব সমালোচনা তার জনপ্রিয়তার পথে বাধা হতে পারেনি। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু সব সময়ই কিপলিংয়ের লেখা উপন্যাস ‘কিম’কে তার প্রিয় বই হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও লেখক খুশবন্ত সিং ২০০১ সালে লেখেন, তিনি কিপলিংয়ের কবিতা ‘ইফ’কে ‘শ্রীমৎভগবতগীতা’র ইংরেজি সংস্করণের নির্যাস বলে মনে করেন। ভারতীয় লেখক আর কে নারায়ণের মতে, ‘ভারতে বসবাসকারী লেখকদের মধ্যে সম্ভবত তুলনামূলকভাবে দক্ষ রুডইয়ার্ড কিপলিং এখানকার সাধারণ বাসিন্দাদের চেয়ে বন-জঙ্গলে বসবসকারী প্রাণীদের মন-মানসিকতা ভালো বুঝতেন।’

২০০৭ সালের নভেম্বরে ভারতের মুম্বাইয়ের ‘স্যার জামসেটজি জিজিভয় স্কুল অব আর্ট’র কাছে কিপলিংয়ের জন্মস্থানকে তার জীবন ও কর্মসংক্রান্ত জাদুঘর হিসেবে রূপান্তরের ঘোষণা দেওয়া হয়। কীর্তিমান এ সাহিত্যিক তার বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনের কারণে বিশ্বজুড়ে অগণিত পাঠকের মাঝে আজও অমর হয়ে আছেন।

লেখক: অনুবাদক ও ফিচার লেখক।

এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন