বাংলা সাহিত্যের একাল-সেকাল: প্রবন্ধগ্রন্থের আনন্দপঠন
আমিনুল ইসলাম
এবারের বইমেলায় প্রকাশ হয়েছে কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদের প্রথম প্রবন্ধের বই ‘বাংলা সাহিত্যের একাল-সেকাল’। প্রকাশিত হয়েছে কিংবদন্তী পাবলিকেশন নামক প্রকাশনী থেকে। হাতে নিয়েই সূচিপত্রে চোখ। মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। গ্রন্থভুক্ত ১০টি প্রবন্ধের ১টি আমার কবিতা নিয়ে। মেলার মাঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রবন্ধটি পড়ে নিলাম।প্রবন্ধটি এই বইয়ের সবচেয়ে বড় প্রবন্ধ।
বইটিতে স্থান পেয়েছে দশটি প্রবন্ধ। সূচিপত্র নিম্নরূপ:
১. রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ জগৎ ও জীবনেরই প্রতিরূপ
২. জীবনানন্দ দাশ হেমন্তপ্রেমীর প্রিয়মুখ
৩. ‘সাম্যবাদী’ কবি নজরুলের সমকালীন ভাবনা
৪. বঙ্গবন্ধুর লেখা বই বাংলা সাহিত্যে অসামান্য সংযোজন
৫. জীবনজয়ী কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন
৬. হুমায়ূন আহমেদের নাটকে মুসলিম রীতি-নীতি
৭. ফারুক মাহমুদের কবিতার বিষয়-বৈচিত্র্য
৮. কামাল চৌধুরীর ‘বত্রিশ নম্বর’ ইতিহাসের নির্মম সাক্ষী
৯. আমিনুল ইসলামের কাব্যভাষায় নদী-প্রকৃতির স্বরূপ
১০. ড. তপন বাগচী বাংলা সাহিত্যের বর্ণিল অধ্যায়।
আরও পড়ুন: উত্তর-ঔপনিবেশিক নিসর্গতত্ত্ব ও আমিনুল ইসলামের কবিতা: শেষ পর্ব
তিনি প্রতিটি বিষয় তার নিজের মতো করে বোঝার চেষ্টা করেছেন এবং সেই অভিজ্ঞান উপস্থাপন করেছেন প্রবন্ধগুলোয়। তার দেখার চোখটি নিজস্ব, এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে বইটি পাঠ করে। যে দশজন কবি-কথাসাহিত্যিককে নিয়ে তিনি লিখেছেন, তাঁরা সবাই তার অগ্রজজন। শিল্প-সাহিত্যে অগ্রজদের বাঁচতে হয় তাদের পরবর্তী প্রজন্মের অনুজ লেখক-সমালোচক-পাঠকদের মাধ্যমে। সে কারণে অনুজদের মূল্যায়ন ও অভিমত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনুজদের সব মতামতই পক্ষে যাবে অথবা তাদের সব মতামত সঠিক বলে মেনে নিতে হবে, এমনটা নয়। কিন্তু তাদের মতামত সম্পর্কে অবহিত হতে হবে, এটাই প্রায় বাধ্যতামূলক। যে দশজনকে নিয়ে সালাহ উদ্দিন লিখেছেন, তাঁদের পাঁচজন প্রয়াত এবং পাঁচজন জীবিত ও সক্রিয়। জীবিত পাঁচজন তো বইটি সংগ্রহ করবেন এবং পড়বেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অন্য জীবিত অগ্রজ-অনুজ কবি-কথাসাহিত্যিক-গবেষকদেরও বইটি কাজে লাগবে বলে আমার বিশ্বাস।
নিজের ঢোল নিজেকেই পেটাতে হয়। তাই বলতে হচ্ছে, আমিনুল ইসলামের কবিতা নিয়ে লেখা প্রবন্ধটিতে তিনি তার কবিতার একটি বিশেষ দিক (নদী-প্রকৃতি) নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে প্রবন্ধটিতে অনেকের অভিমত সংযোজন করেছেন। কেন করেছেন তার ব্যাখ্যাও এক স্থানে দিয়েছেন তিনি। প্রবন্ধের শুরুটা আমার জন্য গভীর আনন্দের, প্রত্যাশার এবং আবার তা একইসঙ্গে ভেবে দেখারও। তিনি বলেছেন, “কবি আমিনুল ইসলাম (২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৩) কোন্ দশকের কবি, তা বিবেচ্য নয়। দশকচিন্তা এখানে মুখ্যও নয়। তার কবিতাই তাকে সর্বজনগ্রাহ্য করে রাখবে। দশকের পর দশক তিনি পঠিত হবেন। পাঠকের অন্তরে গেঁথে থাকবে তার কবিতার অমর পঙক্তিমালা। তার কবিতায় শব্দের যে খেলা, তা আলোড়িত করে পাঠকের মন। কেননা, তার কবিতায় মানুষ, প্রেম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রকৃতি, প্রত্নতত্ত্ব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।” (পৃষ্ঠা ৬৩)
আরও পড়ুন: একাত্তরের ডায়েরী: কাব্য ও ভাষাশৈলীর সমতল ভূমি
হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে ‘হুমায়ূন আহমেদের নাটকে মুসলিম রীতি-নীতি’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি এক স্থানে অভিমত প্রদান করেছেন, “ধর্মকে আঘাত না করেও অধর্ম বা গোড়ামিকে (গোঁড়ামিকে) তুলে এনেছেন হাস্যরসে। জীবনকে পরিমাপ করেছেন বিজ্ঞ জহুরির দৃষ্টিতে। অন্যায়কে পরিহাস করেছেন উপমাচ্ছলে। অসঙ্গতিকে আঘাত করেছেন কোমল অথচ উদ্ধত ভঙ্গিতে। এত গুণের সমাবেশ কেবল হুমায়ূন আহমেদের রচনা কিংবা নির্মাণেই সম্ভব হয়েছে। ‘জনপ্রিয়’ শব্দটিকে তিনিই বহুল আলোচনায় নিয়ে এসেছেন। সাহিত্য সমাবেশে কিংবা চায়ের কাপে ঝড় তুলেছে তাঁরই নাম। অথচ কখনোই জনপ্রিয় শব্দের পেছনে ছোটেননি তিনি। নীরবে নিভৃতে কাজ করে গেছেন।” (পৃষ্ঠা ৪৫)
সেলিনা হোসেনকে নিয়ে আলোচনায় তিনি যুক্তিসঙ্গতভাবেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, তাঁর সৃষ্টিকর্মে নারী চরিত্রগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে এবং তিনি সব সময়ই রাজনীতি সচেতন ও সময়সচেতন লেখক। সালাহ উদ্দিন তার প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী সৃষ্টির অনন্যতাকে চিহ্নিত করে বলেছেন, ‘‘যেহেতু সাম্যবাদ বাংলা সাহিত্যে নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে কাজী নজরুল ইসলাম যে মমতায় মানবতা মিশ্রিত এ বিষয়গুলোর প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন, তা একান্তই অভিনব। এখানেই নজরুলের কবি চেতনার নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে।” (পৃষ্ঠা ২৮) তিনি কবি ফারুক মাহমুদের কবিতার বিশিষ্টতা নিয়ে নিজের অভিমত প্রদান করেছেন এবং অন্য দু’একজনের মতামত উদ্ধৃতও করেছেন যা প্রবন্ধটির গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে। এভাবেই তিনি অন্য প্রবন্ধগুলোতেও তার নিজস্ব ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন বইটিতে।
আরও পড়ুন: এখানে কয়েকটি জীবন: গল্পজুড়ে জীবনের বিস্তার
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ একাধারে কবি-কথাসাহিত্যিক-সাংবাদিক-প্রাবন্ধিক। এ যাবত প্রকাশিত তার গল্পের বইগুলো হচ্ছে- ‘সার্কাসসুন্দরী’, ‘নিশিসুন্দরী’, ‘সুন্দরী সমগ্র’, ‘এখানে কয়েকটি জীবন’। তার কবিতার বই হচ্ছে- ‘মিথিলার জন্য কাব্য’ ও ‘তুমি চাইলে’। উপন্যাস ‘মমতা’। একমাত্র প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বাংলা সাহিত্যের একাল-সেকাল’।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদের গদ্যের ভাষা সাবলীল, পরিষ্কার এবং সহজবোধ্য। পাণ্ডিত্যের কচকচানি নেই তার কোনো বাক্যে অথবা অভিমতে। তিনি একইসঙ্গে কবি-কথাসাহিত্যিক বলে তার গদ্যের ভাষা সচ্ছল ও উপভোগ্য। ‘বাংলা সাহিত্যের একাল-সেকাল’ সালাহ উদ্দিন মাহমুদের প্রথম গদ্যগ্রন্থ। প্রথম গদ্যগ্রন্থে তিনি যথেষ্ট প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন বিষয় নির্বাচন এবং উপস্থাপনায়। তবে প্রাবন্ধিক হিসেবে এটা তার পথচলার শুরুমাত্র। তিনি সামনের দিনগুলোয় সাহিত্যের বিচার-বিশ্লেষণে আরও গভীরচারী, আরও নিবিড়তাগামী এবং আরও সূক্ষ্ণতাস্পর্শী হবেন, এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা। তেমন সম্ভাবনা তার প্রবন্ধগুলোর ভাঁজেও উঁকিঝুঁকি মারছে।
আরেকটি কথা বলতেই হয়, প্রকাশনার মান অত্যন্ত উন্নত। দামি অফসেট কাগজ, ঝকঝকে নির্ভুল মুদ্রণ, আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ, সুন্দর পুস্তানি, উন্নতমানের হার্ডবোর্ডের মলাট---সব মিলিয়ে সুরুচিসম্মত অনন্যসুন্দর কাজ। প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থের জন্য সালাহ উদ্দিন মাহমুদকে আন্তরিক অভিনন্দন।
লেখক: কবি, কথাশিল্পী ও প্রাবন্ধিক।
এসইউ/এমএস