প্রকাশনা জগতের একজন পথিকৃৎ মহিউদ্দীন আহমদ
পুস্তক প্রকাশনা জগতে মহিউদ্দীন আহমদের বিচরণ ছিল প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল। কবি গোলাম মোস্তফা রচিত ‘বিশ্বনবী’, আবুল মনসুর আহমদের ‘বাংলাদেশের কালচার’, মুনীর চৌধুরীর ‘তুলনামূলক সমালোচনা’, ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ প্রফেসর আলী আহসানের ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ হুমায়ূন আহমদের ‘এই সব দিনরাত্রি’ ইত্যাদি বিভিন্ন ধারার গ্রন্থ প্রকাশনার মাধ্যমে তিনি একজন রুচিশীল প্রকাশক হিসেবে নিজেকে পাঠসমাজের কাছে পরিচিত করেন। বইয়ের প্রকাশনাই ছিল তাঁর একমাত্র কর্ম। অন্য কোনো ব্যবসার কথা ভাবেননি।
দেশ বিভাগের পর ঢাকায় এসে স্কুলের পাঠ্য বই ও সহায়ক নিয়েই বেশি মনোযোগী ছিলেন। সেই সুবাদে স্কুলের অনেক শিক্ষকের সঙ্গে তাঁর একটি সুসম্পর্ক ছিল। সমাজপাঠ, গার্হস্থ্য অর্থনীতিসহ অনেক স্কুলের বইয়ের তিনি প্রকাশক ছিলেন। ঢাকা মুসলিম গভঃ হাইস্কুলের হেডমাস্টার ইব্রাহিম খলিল, ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রধান শিক্ষক সালেক স্যারের সঙ্গেও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। অনেক পাঠ্য বইয়ের সম্পাদক হিসেবেও তাঁরা জনাব মহিউদ্দীন আহমদকে সহায়তা করতেন।
প্রকাশক হিসেবে মহিউদ্দীন আহমদের সাফল্য সহজে আসেনি। জীবনের শুরুটা ছিল খুবই কষ্টের এবং সংগ্রামের। সংসারের অবস্থা ততটা সচ্ছল ছিল না। তাঁর দাদার আমলটা মোটামুটি সচ্ছল ছিল। কিন্তু বাবা আলতাফউদ্দীন ভূঁইয়ার সময়টা মামলা-মকদ্দমা ইত্যাদি নানা কারণে অভাবের সংসার ছিল। দাদার নবাবী চালচলন সবসময়ই মহিউদ্দীন আহমদকে মুগ্ধ করতো। ১৭ বছর বয়সেই তিনি দাদাকে হারান। দাদাকে হারানোর পর থেকেই ভাবতেন কিভাবে ভবিষ্যতে একজন সফল ব্যবসায়ী হবেন।
সাংসারিক দুরাবস্থা দেখে তাঁর মনে উপার্জন করার বাসনা জেগে ওঠে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১৭ বছর বয়সে ১৯৩৬ সালে তিনি হাওড়ার বাকুড়া স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত তাঁর বাবার কাছে চলে যান। তাঁর বাবা ও দাদার খুবই আপনজন কলকাতা কাস্টমস্ অফিসের সহকারী কেমিস্ট জনাব হাফিজ মিয়া মহিউদ্দীন আহমদকে কলকাতার তালতলা হাইস্কুলে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিলেন।
এভাবেই হাফিজ মিয়ার বদৌলতে মহিউদ্দীন আহমদ পড়াশুনায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন। হাফিজ মিয়া তাঁকে সকাল-বিকাল পড়াতেন। মহিউদ্দীন আহমদ পাঠ্যবই খুব একটা পড়তেন না। গল্প, ইতিহাস, মহান ব্যক্তিদের জীবনী, পত্রপত্রিকা পড়ার প্রতি তার বেশ ঝোঁক ছিল এবং এভাবেই তিনি অধিকাংশ সময় ব্যয় করতেন।
ছোটবেলা থেকেই ছিলেন জীবন সম্পর্কে খুব বেশি সচেতন। তারুণ্যের অস্থিরতা তাঁকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। সবসময়ই ভাবতেন কীভাবে পরিবারের হারানো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনবেন। পাঠ্যাবস্থায় কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা যায় কিনা সে চেষ্টাও তিনি মাঝেমধ্যে করতেন। তিনি কলেজ স্ট্রিটে বিখ্যাত ‘এন্টিকোয়ারেন্ট বুক সেলার্স’ নামে বইয়ের দোকানে সেলসম্যানের চাকরি নেন। এভাবেই বইয়ের প্রতি, লেখকের প্রতি তাঁর আকর্ষণ জন্মে। দেশ বিভাগের পর তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন ‘ঢাকা বুক ডিপো’ ১৯৪৮ সালে।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান টেক্সট বুক বোর্ড ২১টি বই পাঠ্যবই হিসেবে অনুমোদন দিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সাল থেকে দেশে বইয়ের ব্যবসায় মন্দাভাব দেখা দেয়। তখন বই প্রকাশকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং বই প্রকাশের পরিমাণও বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরিমাণের দিক থেকে বই বিক্রির হার বাড়েনি। এ অবস্থায় তিনি বিকল্প চিন্তা শুরু করলেন। তখন পূর্ববাংলায় ভূচিত্রাবলী, দেয়াল মানচিত্র, গ্লোব ইত্যাদির দারুণ অভাব ছিল। এই শিক্ষা উপকরণগুলো ভারত থেকে আমদানি হতো। এগুলোর প্রচুর চাহিদা ছিল।
মহিউদ্দীন আহমদ জিন্দাবাহারে কেনা একমাত্র বাড়িটি এক বন্ধুর কাছে বন্ধক রেখে টাকা ধার নেন এবং কলকাতা চণ্ডিচরণ অ্যান্ড সন্সের এক লোককে ঢাকায় এনে গ্লোব তৈরির মেশিনের ব্যবস্থা করলেন। উল্লেখ্য, তিনিই একমাত্র সফল পুস্তক ব্যবসায়ী যিনি মাতৃভাষায় প্রথম মানচিত্র বই, ওয়ালম্যাপ, গ্লোব ইত্যাদি তৈরি করে দেশ সেবার দায়িত্বকে কর্তব্য বলে মনে করেছেন। এই জন্য অবশ্য তিনি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং এ ত্যাগ বৃথা যায়নি। ফলে দেশের বহু বৈদেশিক মুদ্রা বেঁচে গিয়েছিল এবং শিক্ষা ব্যবস্থাও অনেক উপকৃত হয়েছিল।
মহিউদ্দীন আহমদ কেবল একজন সৎ প্রকাশক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ধার্মিক এবং উৎসর্গপ্রাণ সমাজসেবক। গ্রামের বাড়ির সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর মমত্ববোধ। যে চিনামুড়া হাইস্কুলে তিনি প্রাথমিকভাবে অধ্যয়ন করতেন তখন সেটা ছিল টিনের ঘর। সেই স্কুলে পরবর্তীতে তিনি নিজ ব্যয়ে পাকা দালান করে দিয়েছেন।
তাছাড়া তিনি নিজ বাড়িতে আলতাফ মেমোরিয়াল ফ্রি প্রাইমারি স্কুল, স্বপাড়া দাতব্য চিকিৎসালয় (স্থাপিত ১৯৫৯ সালে), মসজিদ, মাদ্রাসা এবং আরো অনেক জনহিতকর প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৯৬২ সালে থানা পরিষদের অধীনে দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর মতলবের যে রাস্তাটি তৈরি হয় তার অন্তরালেও মহিউদ্দীন আহমদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। গৌরীপুর মুন্সি ফজলুর রহমান ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠায় (১৯৬৯) তাঁর ভূমিকা ছিল। কলেজের লাইব্রেরি (মহিউদ্দীন পাঠাগার) ও ছাত্রাবাস তৈরী করে দিয়েছেন নিজ অর্থে।
তিনি প্রায়শই বলতেন প্রকাশিত বইয়ের শতকরা ৬০ ভাগ সরকার কিনে নিতে পারেন এবং ক্রয় করার পর এসব বই সরকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাঠাগারে বিক্রি ও বন্টন করতে পারেন। তাছাড়া বেতার টেলিভিশন ও পত্রিকায় কম খরচে বইয়ের প্রচারের ব্যাপারেও তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলতেন, সরকার ৬০ ভাগ বই কিনে নিলে প্রকাশকদের মূলধনের একটা বিরাট অংশ উঠে আসবে। ফলে বাকি বই ধীরে ধীরে বিক্রি হলেও খুব একটা অসুবিধা হবে না।
মহিউদ্দীন আহমদ কোন বিদেশি লেখকের বই ছাপেননি। এর কারণ হিসেবে তিনি বলতেন বিদেশি লেখকদের বই ছাপলে আমার দেশের বই ছাপবে কে? তিনি বলতেন, দেশি কবি-সাহিত্যিক ও লেখকদের উৎসাহিত করতে হবে। আর একদিন তাঁদের মধ্য থেকেই নামিদামি লেখক বের হয়ে আসবে। তিনি বলতেন সবার আগে আমার দেশ, আমার দেশের মাটি ও মানুষের সাথে সংগতি রেখেই কাব্য-সাহিত্য রচনা করতে হবে। এক সময় অনেকটা হতাশ হয়ে বলেছিলেন এ পর্যন্ত কেউ-ই প্রকাশনা শিল্পকে সহায়তা করার ব্যাপারে এগিয়ে আসেনি।
এই অনুভূতি তিনি ব্যক্ত করেছিলেন ১৯৭৯ সালে বাংলা একাডেমির বই মেলার সময়ে। ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলা উদ্বোধন করেন। এই উপলক্ষে পশ্চিমবাংলা থেকে মনোজ বসু, নিমাই ভট্টাচার্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিকরা বাংলা একাডেমিতে এসেছিলেন।
সেসময়ই বাংলা একাডেমির প্রধান গেট সংলগ্ন স্থানে মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা, আহমদ পাবলিশিং হাউজের জনাব মহিউদ্দীন আহমদ, নওরোজ কিতাবিস্তানের জনাব আবদুল কাদির, বর্ণমিছিলের জনাব তাজুল ইসলাম তাঁদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বইগুলো পথের দুপাশে চট বিছিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করেন। এখান থেকেই বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলার উৎপত্তি।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর তিনি ৩২ নম্বরে নিজে বঙ্গবন্ধুর সাহায্য তহবিলে অর্থ সাহায্য প্রদান করেন। ২৫ শে মার্চের কালো রাতের পর অনেকটা বাধ্য হয়েই তিনি জিন্দাবাহারের বাড়ি ছেড়ে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে পরিবার পরিজন নিয়ে চলে যান। গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে তিনি বেশ কঠোর ভূমিকা পালন করেছিলেন। কেউ যেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না বাঁধাতে পারে সেজন্য তিনি গ্রামে রাতে পাহারাদারের ব্যবস্থা করেছিলেন। বেশ কয়েকজনকে কঠোর ভর্ৎসনা করেছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের অত্যন্ত গোপনে সহায়তা করেছিলেন। তাঁর জামাতা তৎকালীন ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার কারণে ১৯৭১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে তাঁকে না পেয়ে গ্রামের বাড়িটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে দেয়। যুদ্ধের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য তিনি দেশ স্বাধীনের পরপরই মুক্তিযুদ্ধের ওপর সাতটি বই প্রকাশ করেছিলেন।
তন্মধ্যে মেজর [বর্তমানে মেজর জেনারেল (অবঃ)] এমএসএ ভূঁইয়ার ‘মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস’, আবদুল গণি চৌধুরীর ‘বাংলার গণহত্যা’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পাদিত ‘মুক্তিসংগ্রাম’, কাজী আবু মোহাম্মদ আবদুল্লার ‘ছোটদের শেখ মুজিব’, শামসুল হুদা চৌধুরীর ‘একাত্তরের রণাঙ্গন’, কাজী আবুল হোসেনের ‘ডাক দিয়ে যায় সংগ্রাম’ উল্লেখযোগ্য।
মহিউদ্দীন আহমদ প্রকাশনা শিল্পের অন্যতম অগ্রপথিকই শুধু নন এদেশের প্রকাশনাশিল্পকে যারা রুচিবোধ, সংস্কৃতি-চেতনা ও শৈল্পিক দৃষ্টি দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। শ্রম, সংগঠন, দক্ষতা, ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি এবং শিল্পসাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ঐতিহ্যপ্রীতি ও রুচিবোধ যে একজন একনিষ্ঠ মানুষকে যথেষ্ট সাফল্য দিতে পারে মহিউদ্দীন আহমদ তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর এই বিরল ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম এই বলে মন্তব্য করেছেন যে, মহিউদ্দীন আহমদ সমাজের সেই বিরল ব্যক্তিত্বের একজন যার সঙ্গে যেকোন বুদ্ধিজীবী সচ্ছল সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন। তিনি বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে।
লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/জেআইএম