একাত্তরের ডায়েরী: কাব্য ও ভাষাশৈলীর সমতল ভূমি
দিনলিপি বা ডায়েরি সাহিত্যের এক শক্তিশালী জনরা। যেখানে লেখক তাঁর নিজের ঘটমান জীবন এবং পারিপার্শ্বিক ঘটনাকে লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে ওই সময়কে যুগ যুগ ব্যাপী আঁকড়ে ধরে রাখেন। ডায়েরি স্পষ্টভাবেই রচনাকালের পরিচ্ছন্ন ইতিহাস বহন করে। বিশ্বসাহিত্যে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ডায়েরি পাওয়া যায়। যার মধ্যে আনা ফ্রাঙ্কের ‘দ্য ডায়েরি অব অ্যা ইয়াং গার্ল’, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং কবি সুফিয়া কামালের ‘একাত্তরের ডায়েরী’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
‘ঐ তো লক্ষ ছেলে-মেয়ে
নাতি-নাতনি দামাল
সবুজ দ্বীপের মতো মাঝখানে
সুফিয়া কামাল।’
সুফিয়া কামালকে সংজ্ঞায়িত করতে কবীর সুমনের গানের লাইন দুটিই যথেষ্ট। সুফিয়া কামাল মানেই বটবৃক্ষের ছায়া, অনুপ্রেরণা ও ভরসার আঁতুড়ঘর। বাংলার প্রত্যেকটি সন্তানই যেন তাঁর নিজের সন্তান। এর প্রমাণ তাঁর ‘একাত্তরের ডায়েরী’ পাঠ করলে পাওয়া যায়। কবি লিখেছেন—
‘শতেক জনার মা ডাকায় মোর শান্তি লভুক মন
কে আছে সৌভাগ্যবতী আমার মতন!’
‘একাত্তরের ডায়েরী’ বইটি ১৯৭১ সালে চলমান মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি, প্রভাব ও নিজ জীবনের অভিব্যক্তির লিপিবদ্ধ দলিল। ডায়েরিটা লেখা শুরু করেন ডিসেম্বর ৩০, ১৯৭০ তারিখে। শেষ করেন ডিসেম্বর ৩১, ১৯৭১ তারিখে। পুরো এক বছর সময়। তবে তিনি প্রতিদিনের ঘটনা বা অভিব্যক্তি লেখেননি। মাঝে মাঝে কিছু তারিখ বাদ দিয়ে লিখেছেন। কোনো কোনো দিন মাত্র দুই-তিন লাইন লিখেছেন। আবার কোনো কোনো দিন লিখেছেন কবিতা। গ্রন্থটি পুরোপুরি পাঠ করে তৎকালীন পাকিস্তানি বাহিনীর হিংস্রতা, লেখকের উৎকণ্ঠা ও বাঙালির অদম্য সাহসিকতার স্বরূপ চমৎকার ভাষাশৈলীতে খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ ‘একাত্তরের ডায়েরী’ কাব্য ও ভাষাশৈলীর সমতল ভূমি।
আরও পড়ুন: রাহেল রাজিবের প্রেমের কবিতা: বাস্তবতার অভিজ্ঞান
সুফিয়া কামাল পাঠক সমাজের কাছে কবি সুফিয়া কামাল হিসেবেই বেশি পরিচিত। তাঁর কাব্যের তীর অনায়াসেই বিদ্ধ করে পাঠকের হৃদয়। অন্তরে অন্তকাল লেগে থাকে কবিতার চরণ। ‘একাত্তরের ডায়েরী’ পড়া শুরু করার আগে আনুমান করিনি যে, বইটিতে চমৎকার কিছু কবিতা পড়ার সৌভাগ্য হবে। পাঠ শেষে বইটিতে মোট ছয়টি কবিতা পাওয়া গেছে। যা আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে। ২৯ ডিসেম্বর, বুধবার ১৯৭১ তারিখে তিনি লিখেছেন—
‘তাই আজ মুছি অশ্রুর ধারা সন্তানহীন মাতা
জয়ে, গৌরবে প্রার্থনা করে ওগো দাতা ওগো ত্রাতা
সুন্দর কর মহামহীয়ান কর এ বাংলাদেশ
এই মুছিলাম অশ্রুর ধারা দুঃখের হউক শেষ।’
দেশের প্রতি কবির ভালোবাসা ও প্রার্থনার নমুনা নান্দনিক ভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। একই দিনের একই কবিতার প্রথম চরণে পাওয়া যায় সন্তানহারা জননীর দুঃখগাথা। কবি লিখেছেন—
‘আমার ‘দুলু’র মুখ দেখি আজ বাংলার ঘরে ঘরে
শ্বেতবাসা, আর শূন্য দু’হাত নয়নে অশ্রু ঘরে।’
পাকিস্তানি বাহিনীর হিংস্রতা ও কাপুরুষতার নিন্দাসূচক ঢঙে একই কবিতায় লিখেছেন—
‘একবার দেখি! গোপনে যে ভীরু সরীসৃপ সম এসে
লক্ষ প্রাণের ছোবল মারিয়া বিবরে লুকাল শেষে।’
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল। কবি সুফিয়া কামাল ৩০ ডিসেম্বর পটুয়াখালীর ধানখালীতে ত্রাণ দিতে যান। ৮ জানুয়ারি ১৯৭১ শুক্রবারে নন্দীর বাজার নদীপথে, ভি এ জলকপোতে বসে সৃষ্টিকর্তার প্রতি অনুযোগের সুরে কবি লিখেছেন—
‘আবার নিঠুর করি ছিনায়েছ অকরুণ কঠোর হে তুমি
তোমার সুন্দর সৃষ্টি যে সমুদ্র, নদী, তীর ভূমি
কী আক্রোশে এ বীভৎস মৃত্যুর খেলায়
মেতেছ একান্তে, তুমি নাকি দয়াময়!’
৩০ জানুয়ারি, শনিবার কবি বিমানে বসে লিখেছেন—
‘হৃদয় আমার! সব হারানো বাঁশীর সুরে
কেন দিস তুই সাড়া?
তোর হাতে পায়ে শিকল বাঁধা
চার দিকে যে কারা।’
এই লেখার মধ্যে পাকিস্তানিদের শোষণ ও বাঙালি মুক্তিযুদ্ধের আগমনী বার্তা পাওয়া যায়।
বইটির বিভিন্ন জায়গায় চমৎকার কিছু কাব্যের হদিস পাওয়া যায়—
১.
মৃত্যুর সে বিষ পান করে হয় হৃদয় তন্দ্রাহত
কান্না যে হায় পান্না হয়ে বাজে গানের মতো।
(৩ ফেব্রুয়ারী বুধবার ১৯৭১)
২.
প্রভাতে সন্ধ্যায় রাতে দিনে
সুষমা বিথরি যায় বিপিনে বিপিনে
নিত্য আনে নব জাগরণ
সুবীরে জাগায়ে স্পন্দন—
(২১ মার্চ রবিবার ১৯৭১)
৩.
অন্তর দিয়ে অনুভব করি ধুঁকে ধুঁকে এই বাঁচা
অত্যাচারীর ছুরিকার তলে দিল প্রাণ মোর বাছা
পথের ধুলায় লুটায়ে রহিল। এখনও দেশের মাটি
রক্তে নাহিয়া হয়ে ওঠে সোনা-হীরকের চেয়ে খাঁটি।
(৩১ জুলাই শনিবার ১৯৭১)
আরও পড়ুন: পার্কবেঞ্চের কবিতা: মরণ ও প্রেমের সিংহাসন
লেখকের শব্দ চয়ন, বিষয়বস্তুর বর্ণনা, উক্তি ও ভাষাশৈলীর কারুকার্য পাঠককে দারুণভাবে বিমোহিত করবে। লেখক কখনো হয়েছেন স্মৃতিকাতর, কখনো প্রতিবাদী, সংক্ষুব্ধ ও সাহসী সত্তা। চমৎকার সব শব্দ ও উপমার মিশ্রণে লেখকের নিজস্ব ভাষাশৈলী বইটিকে বিশেষ করে তুলেছে।
নিম্নোক্ত লেখাগুলো পড়লে তা সহজেই অনুমান করা যাবে। যেমন—
>>‘চর বিশ্বাস, চর সাগস্তিতে গেলাম যখন তখন সে জায়গাকে ধোয়ামোছা একটি মাটির থালার মতো লেগেছিল—না পশুপাখি, না একটা মশা মাছি। (৫ জানুয়ারি মঙ্গলবার ১৯৭১; রাবনাবাদ নদী)
>>‘কাল গেল বসন্ত পূর্ণিমা। বড় সুন্দর রাত কিন্তু বড় যন্ত্রণায় রাতটা কাটল। মানুষের দেহ কারাগারে বন্দী, আত্মার ক্রন্দনের সীমা নেই, গুমরে গুমরে কাঁদে সে মুক্তির জন্য, সুন্দরে বিলীন হওয়ার জন্য। সংসার যে কত কঠোর! বেঁচে থাকার কত মাশুল দিতে হয়!’ (১২ মার্চ শুক্রবার ১৯৭১)
>>‘এতদিনে আজ বহু গর্জনে পর বৃষ্টি নামল। অকরুণের করুণা ধারা। বাংলার বুক শ্যামল হোক, সুশোভন হোক, পবিত্র শহীদের রক্ত গন্ধমুক্ত হয়ে শান্ত হোক, শীতল হোক, স্নিগ্ধ হোক, কাটুক বাংলার অভিশাপ।’ (২৯ মার্চ সোমবার ১৯৭১)
>>‘প্রেতনগরী ঢাকা আজাবের করাল আভাস। গ্রামীণ জীবন দুর্বিষহ, মহামারীর কবলে অসহায় কান্নায় মরছে।’ (২ মে রবিবার ১৯৭১)
>>‘বর্ণাঢ্য পৃথিবী বিবর্ণ হয়ে যায়, ক্ষুধার খাদ্য তৃষ্ণার পানীয় বিস্বাদ হয়ে ওঠে। বিষাক্ত মনে হয় নিঃশ্বাসের বায়ু। ওগো অকরুণ। আর কত! তুমিও তো সহ্যের সীমা অতিক্রম কর, কর গজব নাজেল। মায়ের বুক কি তোমার ধৈর্যের চেয়েও সহনশীল!’ (৩০ আগস্ট সোমবার ১৯৭১)
বইটি পাঠের পর পাঠক একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব চিত্রের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারবেন। তখনকার ভয়াবহ দৃশ্যের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যাবে বইটিতে। হাওলাদার প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত দশম সংস্করণের বইটির প্রচ্ছদ ও ভেতরের অলংকরণ পাঠককে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাস। আমি বইটির বহুল পাঠ ও প্রচার কামনা করছি।
বইয়ের নাম: একাত্তরের ডায়েরী
লেখক: সুফিয়া কামাল
ধরন: দিনলিপি
প্রকাশক: হাওলাদার প্রকাশনী
প্রচ্ছদ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি
অলংকরণ: ধ্রুব এষ
মুদ্রিত মূল্য: ৩৫০ টাকা।
এসইউ/জেআইএম