আব্দুলরাজাক গুরনাহ: কেন্দ্র ছাড়া একটি বিশ্ব
শেষ হলো চার দিনব্যাপী দশম ঢাকা লিট ফেস্ট-২০২৩। ৫-৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ভালো-মন্দ দিকগুলোর আলোচনা শুরু হবে শিগগিরই। ফাঁক-ফোঁকর চিহ্নিত করে তার সমাধান করে পরবর্তীতে আরও উন্নত আয়োজন করা সম্ভব হবে বলে আশা করি। কোনো বৃহৎ বা ভালো অভিযাত্রায় বিতর্ক থাকবেই। আর শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এ সম্ভাবনা অনেক বেশি। বিতর্কের মধ্যে ভালো বিষয় নেহায়েতই কম নয় বলে মনে করি।
আমি আলোচনা করব তৃতীয় দিনের (৭ জানুয়ারি) একটি সেশন নিয়ে। বিষয়টি ছিল: এ ওয়ার্ল্ড উইথআউট এ সেন্টার (কেন্দ্র ছাড়া একটি বিশ্ব)। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রীক এ সেশনে অংশ নেন নোবেলজয়ী তানজানিয়ান বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ লেখক আব্দুলরাজাক গুরনাহ, আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় হিন্দি ভাষার দুজন ব্যক্তিত্ব অমিতাভ ঘোষ এবং পঙ্কজ মিশ্র। সঞ্চালক ছিলেন আরেক ভারতীয় সাহিত্যিক-সম্পাদক নীলাঞ্জনা এস রায়। তার কৌশলী প্রশ্ন বা উপস্থাপনা সেশনটি প্রাণবন্ত করতে ক্যাটালিস্টের ভূমিকা পালন করেছে।
কানায়-কানায় ভর্তি হওয়া দর্শক ছিল বাংলা একাডেমির ড. শহিদুল্লাহ ভবনের আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ হলরুমে। সৌভাগ্য হয়েছে সে আলোচনার দর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকার। নোবেলজয়ী আব্দুলরাজাক গুরনাহর আলোচনার সঙ্গে অন্যের, আমার উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে আজকের আলোচনাটি করতে চাই। এখানে লেখা, কীভাবে লেখক হয়েছেন, লেখার উপাদান, প্রথম প্রকাশের অনুভূতি-প্রত্যাখ্যান ইত্যাদি দিকগুলো আলোচনায় প্রাণবন্ত করেছে। আমরা যারা দর্শক ছিলাম, তাদের জন্য সমৃদ্ধ ও আকর্ষক একটি আয়োজন ছিল। দর্শক-আলোচক বিভিন্ন মিথস্ক্রিয়ায় ইতিবাচক কিছু আউটকাম এসেছে বলেই আমার মনে হয়। সেখান থেকে চম্বুক অংশ আজকের আলোচনায় উল্লেখ করে আলোচনাটি এগিয়ে নেব।
হিন্দি ভাষার অমিতাভ ঘোষের উপস্থাপনাগুলো (বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে) বেশ ভালো। সুন্দরবন গেঁথে গেছে তার হৃদয়ে। এই সুন্দরবনই অনেক উপাদান দিতে পারে। আলোচকের উপলব্ধি হলো, আশেপাশের উপাদান নিয়েই উৎকৃষ্ট সাহিত্য হয়ে থাকে। পাঠকের কথা ভেবে এ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। বিশ্বায়নের বিভিন্ন উপাদান থাকবে। বিশ্বযুদ্ধ যেমন সাহিত্যের অনেক উপাদান দিয়েছে। করোনা মহামারি বা বর্তমান রাজনীতির বিভিন্ন দিকও লেখার উন্নত খোরাক হতে পারে। আমেরিকান লেখক-কবিরা এখন লেখায় অনেক রাজনৈতিক উপাদান নিয়ে আসছেন বলে আলোচনায় উঠে আসে।
সঞ্চালক নীলাঞ্জনা এস রায়ের প্রশ্নে নোবেলজয়ী আব্দুলরাজাক গুরনাহ প্রথমত নিজের জন্যই লেখেন বলে জানান। আর ইংরেজিতে লেখেন, কারণ এ ভাষায় তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ‘ইংরেজিই আসলেই সাহিত্যের কেন্দ্রভাষা কি না’—এমন ধারণা নিয়ে তিনি এ কথা বলেছেন। ‘স্বচ্ছন্দ্য’ হচ্ছে লেখার সফলতার মূলমন্ত্র। ‘জোর করে’ লেখা যায় না। গুরনাহও তাই মনে করেন। আলোচনায় একাধিকবার এ-কথা বলতে চেয়েছেন। ‘স্বচ্ছন্দ্য’-এ লেখার মাধ্যমেই প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে। আমরা জানি, সাহিত্য হচ্ছে সময়ের দর্পণ। সাহিত্য বর্তমানকে পৌঁছে দেয় পরবর্তী প্রজন্মের নিকট—প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
আলোচনা থেকে উঠে আসে, সাহিত্যের উপাদান পেতে বিশ্বের কাছে যেতে হবে, মানুষের কাছে যেতে হবে। পারস্পারিক সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ইত্যাদির গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে ‘ভ্রমণ’ একটি দারুণ বিষয় হতে পারে। লেখার অবলম্বনের খোঁজ নিতে চাওয়া এবং নতুন বা তরুণ লেখকের ‘কর্তব্য কী হতে পারে’ এক দর্শকের এ রকম প্রশ্নের জবাবে গুরনাহ নতুন সৃষ্টির জন্য বাবল তত্ত্ব সৃষ্টির ওপর গুরুত্ব দেন। পরে এ কথায় সায় দিয়ে অমিতাভ ঘোষ বলেন, ‘গো টু ওয়ার্ল্ড, গো টু পিপল’। তাই একটা বাবল (বুদবুদ) সৃষ্টি করতে হবে নতুন লেখকদের। বৃত্তের বাইরে গিয়ে সৃষ্টিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে বলে মত দেন গুরনাহ। অর্থনৈতক ক্ষেত্রে বা মার্কেটে বাবল থিউরি একটি পরিচিত বিষয়। তরুণ লেখকদের জন্য বিষয়টি কাজে লাগতে পারে। স্বীকৃতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে ‘বাবল থিউরি’।
বাজারের দাম—বিশেষ করে পণ্য, রিয়েল এস্টেট এবং আর্থিক সম্পদের দাম—মাঝে মাঝে দ্রুত দাম বেড়ে যায়। এই ধারণা মতে, তখন এটি দ্রুত ক্রাশ হতে পারে। কারণ বিনিয়োগকারীরা ইভেন্টের সময়ের জন্য খুব কম বা কোন স্পষ্ট সূচকসহ অতিমূল্যায়িত সম্পদের বাইরে চলে যায়। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও (অনেক সময়) এখন তা-ই হচ্ছে। এদিকে তরুণ সাহিত্যিকদের নজর দিতে হবে। আমার ধারণা, এ দিকটাই মাথায় রেখে বাবল সৃষ্টি হবে কিন্তু পুরোপুরি ধারণা থাকতে হবে। নিজের পায়েই দাঁড়িয়ে বাবল (বুদবুদ) সৃষ্টি করতে হবে। এ মতই দিতে চেয়েছেন গুরনাহ। পরে অমিতাভ ঘোষও এ নিয়ে কথা বলে গুরনাহর সঙ্গে একমত হন।
প্রথমত নিজের আনন্দের জন্য পরে পাঠকের তৃপ্তির জন্যই লেখা উচিত। আশেপাশের বিভিন্ন বিষয় যেমন হতে পারে লেখার প্রধান উপাদান, তেমনই সুন্দরবন হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আবার আমেরিকার গণতন্ত্র, স্বাধীনতা হতে পারে লেখার বিষয়। তাই লেখক যা ভাবেন, যা করতে চান কিংবা যা দেখেন, উপলব্ধি করেন—তা-ই হতে পারে লেখার প্রাণ, গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। সাহিত্যের কেন্দ্র বলে কিছু নেই, সব স্থানই সাহিত্যের কেন্দ্র। পাঠককে ছুঁতে পারলেই সে সাহিত্যই হতে পারে মূল্যবান—বিশ্বসাহিত্যের পাঠকের আগ্রহের বিষয় হতে পারে তা। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যেতে পারে সে সাহিত্য। ডিজিটালের যুগে তা পৌঁছে যাবে বিশ্বপাঠকের কাছে।
গুরনাহ লেখার ক্ষেত্রে কোনো চালাকি করেননি। প্রথম লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনিও প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, অবহেলিত হয়েছেন। তারপরও লেখা প্রকাশের পর উল্লসিত হয়েছেন। প্রত্যাখান হওয়ার এ ইতিহাস অনেক পুরাতন। জীবনানন্দ দাশও প্রথম জীবনে প্রত্যাখ্যাত হতেন। রবার্ট ফ্রস্টরা প্রত্যাখ্যাত হতেন। এ অনুপ্রেরণা আমাদের কাজে লাগবে বলে মনে করি। মায়ের কাছে চিঠি লেখা ছাড়া গুরনাহ সবকিছু ইংরেজিতেই লিখতে স্বচ্ছন্দ্য হতেন বলে আলোচনায় উঠে আসে।
গুরনাহ বৃত্তের মধ্যে থাকতে চান না। তিনি মঞ্চের তারকা হতে চান না। সাধারণ মানুষের প্রতি আগ্রটাই বেশি। এটা তিনি বারবার বলেছেন। তিনি নিজের জন্যই লেখেন। পাঠকরা আনন্দ পেলে সার্থকতা বেড়ে যায়। প্রথম জীবনে ‘কীভাবে লেখা ছাপাতে হয়, সেটাও জানতেন না’ বলে উল্লেখ করেছেন। চারপাশে যা দেখেন, তা-ই নিয়েই লেখেন তিনি। এসব ‘বাস্তব অভিজ্ঞতা ও ধারণা’ নতুন লেখকদের অনুপ্রেরণা হবে বলে আমি মনে করি।
দর্শকদের বারবার করতালি ও প্রাণবন্ত উপস্থিতি আমার এ বিশ্বাসে পাল জুড়ে দিয়েছে। ফলে, দশম লিট ফেস্টের ‘এ ওয়ার্ল্ড উইথআউট এ সেন্টার’ শিরোনামের আলোচনাটি আমাদের জন্য খুবই কাজে দেবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
এসইউ/এমএস