গাজী আজিজুর রহমান: সাহিত্য ও শিল্পমানস
শুভ্র আহমেদ
এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর ‘অরিয়েন্টালিজম’ বইয়ে জ্ঞানের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন—জ্ঞান কীভাবে বৈধ সম্প্রসারণের জন্ম দেয়। কিন্তু ড. নিহার রঞ্জন রায় বলেন, ‘অরিয়েন্টালিজম বিশুদ্ধ জ্ঞান প্রকল্প নয়, এটি প্রাচ্যের দুর্বলতা চিহ্নিত করে প্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণের কৌশলও।’ অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমান সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত করার পূর্বে আরও একটি বিষয়, সেটি অরিয়েন্টালিজমের সঙ্গে জড়িত ‘কেন্দ্র প্রান্তের’ সম্পর্কটাকেও সামান্য বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। ‘কেন্দ্র প্রান্তের’ এই সম্পর্কটিকে ঢাকা, কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও প্রবল ও প্রধান হয়ে উঠতে দেখি, এমনকি স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পরও।
‘কেন্দ্র প্রান্তের’ এই সম্পর্কটিকে উল্টিয়ে দিয়ে, সাহিত্যের বিচিত্র বর্ণালিতে সজ্জিত হয়ে, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষাকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মার্কসীয় মানবিকতার দ্বান্দ্বিক সমন্বয় সাধন করে বহুভাষিক সমাজ সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও রাজনীতির পাঠ গ্রহণের পর আন্তঃসাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং জ্ঞানকেন্দ্রিক ক্ষমতার নিপুণ প্রয়োগে মফস্বলে চিরন্তন বসবাসী হয়েও নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলেন প্রাবন্ধিক গাজী আজিজুর রহমান।
গাজী আজিজুর রহমানের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। ভারতের দার্জিলিংয়ে। কৈশোরিক পড়াশোনা ঢাকায়। মাঝখানে কিছুদিন সাতক্ষীরা ও খুলনার স্কুল, কলেজে কাটিয়েছেন বিদ্যায়তনিক শিক্ষার অন্বেষায়। স্বাধীনতার পরবর্তী জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে পড়া ও লেখার সার্বক্ষণিক প্রতিবেশী হয়ে উঠেছিলেন কবি আবুল হাসান, কবি মাকিদ হায়দার, ঔপন্যাসিক ও সম্পাদক আরেফিন বাদল, কবি জাহাঙ্গীর হাবীবউল্লাহ, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি ও গবেষক আব্দুল মান্নান সৈয়দ, কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী, গবেষক শাহরিয়ার কবির প্রমুখ।
অধিকাংশ বাঙালি যুবক, তরুণের মতো কবিতা দিয়ে লেখালেখির ডুব সমুদ্রে গাজী আজিজুর রহমানের আবির্ভাব হলেও বিশুদ্ধ জ্ঞান ও দর্শনের অসহ্য অভিঘাতে তিনি বেশিদিন কবিতা চর্চায় নিমগ্ন থাকেননি। মাঝখানে কিছুদিন উপন্যাস ও নাটক রচনায় সার্থকতা অর্জনের প্রচেষ্টার মধ্যে শক্ত, কঠিন, বস্তুবাসিত, মনন-মেধা-জ্ঞান-মস্তিষ্কনির্ভর গদ্যের হিরকোজ্জ্বল আলোকছটায় আত্মাহুতি দিয়ে প্রায় সার্বক্ষণিক গদ্য বিশেষ করে প্রবন্ধ চর্চায় নিমগ্ন হন।
হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির বিশ্লেষণে দেখা যায়, গদ্যের চেয়ে কবিতাই মানুষকে অনেক বেশি আলোড়িত করে। তা সত্ত্বেও গাজী আজিজুর রহমান গদ্যের প্রতি অনুভব করলেন তীব্র আকর্ষণ। বিশেষ করে প্রবন্ধে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্ম-দর্শন, মনস্তত্ত্ব, সমালোচনা-তুলনা-প্রতিতুলনা, রাজনীতি-অর্থনীতি-বৈশ্বিক চেতনা ইত্যাদি চর্চা, বিচার বিশ্লেষণের যে অপার সম্ভাবনা তৈরি করা সম্ভব সেটি সাহিত্যের অন্য শাখায় সার্থকভাবে হয়ে ওঠে না। আবেগ সর্বস্বতা ও ভাবুকতার চেয়ে যেহেতু যুক্তি ও দ্বান্দ্বিকতা গাজী আজিজুর রহমানের অধিক পছন্দের বিষয়, তাই তিনি গদ্য চর্চায় সকল অশৈল্পিক ভার থেকে নিজের মুক্তি খুঁজেছেন। উপরোক্ত সত্যের দায় এড়াতে চান না বলেই তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে প্রবন্ধ সাহিত্যের প্রাধান্য সুস্পষ্ট। তাঁর অধিকাংশ প্রবন্ধই নিবিড় গবেষণাধর্মী এবং সাহিত্যনির্ভর। প্রবন্ধগুলোর একটি ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিশেষ করে মৃত্যু, আত্মহত্যা এবং কবিতাবিষয়ক লেখাগুলো পাঠককে বার বার ভাবিত করে, প্রশ্নমুখী করে তোলে। বিশ্বসাহিত্য, ইতিহাস, আধুনিকতা তাঁর লেখালেখির প্রিয় বিষয়। নিম্নে উল্লেখিত গ্রন্থ তালিকা তাই প্রমাণ করে।
প্রবন্ধ গবেষণা: ভ্রামণিক রবীন্দ্রনাথ (২০১৯), কবিদের কবি : জীবনানন্দ দাশ শামসুর রাহমান আবুল হাসান (২০১০ ও ২০১৮), বাংলার দ্বিতীয় রেনেসাঁ (২০১৮), স্বদেশ ভাবনা ও বঙ্গবন্ধু (২০১৭), সাহিত্যে সমাজবাস্তবতার ধারা (১৯৯২ ও ২০১৪), স্বেচ্ছামৃত্যুর করতলে কবি (১৯৯৬ ও ২০১৫), কালীগঞ্জের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ (২০১৪), সাহিত্য ও সিংহাসন (১৯৯৯), আধুনিক বাংলা উপন্যাসের বিষয় ও শিল্পরূপ (২০০৯), সাতক্ষীরার ভাষা ও শব্দকোষ (২০০৪), নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের শতবর্ষ (২০০১); সম্পাদনা: মরণরে তুহু মম (২০০৪) এবং খান আনসার উদ্দীন আহমেদ রচনাবলী (১৯৯৯); উপন্যাস: জায়েদামঙ্গল (২০২০), বজ্রের বাঁশি (১৯৮৯), যোদ্ধার জতুগৃহ (১৯৯১), শামুক (১৯৯৬); নাটক: সক্রেটিস (১৯৯৩), চন্দ্রাবতী (১৯৯৬), কালো সূর্যের নিচে (১৯৯১), অভাজন (১৯৯৯)। সম্পাদিত পত্রপত্রিকার মধ্যে রয়েছে—হরফ (১৯৭৮), উদিত দুঃখের দেশ (১৯৯০), একুশের সংলাপ (১৯৯১), জল পড়ে পাতা নড়ে (১৯৯৮) প্রভৃতি। অনিয়মিত এসব সম্পাদনার পাশাপাশি ১৯৯২ সাল থেকে সম্পাদনা করে যাচ্ছেন নদী নামের একটি সাহিত্যপত্র। গাজী আজিজুর রহমানের প্রকাশিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের বিচারে খুব সহজেই অনুমেয় প্রবন্ধ গবেষণা বইয়ের সংখ্যাই বেশি।
গাজী আজিজুর রহমান ভাষা ও মননে আধুনিক। এ সম্পর্কে আবুল কাশেম ফজলুল হকের অভিমত, ‘অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমানের ভাষা অত্যন্ত আধুনিক। তার লেখার সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রতি অনুরাগের প্রকাশ আছে, অনুসন্ধিৎসা ও চিন্তাশীলতার পরিচয় আছে, বিশ্বাস এবং আবেগ আছে। জনগণের প্রতি ভালোবাসা এবং যুক্তিকামী মানুষের মুক্তিচেতনা তার লেখার অন্তর্গত চালিকাশক্তি।’
গাজী আজিজুর রহমানের প্রথম প্রবন্ধের বই সাহিত্যে সমাজবাস্তবতার ধারা। মার্কসবাদী শিল্প তাত্ত্বিক প্লেখানভ, কডওয়েল, লুকাচ প্রমুখ শিল্পতাত্ত্বিক শিল্পের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে যে সমস্ত সংজ্ঞা ও প্রস্তাবনা পেশ করেছেন সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, নাটক বা চলচ্চিত্রে সে-সবের উদ্বোধন সমাজবাস্তবতা ধারার সাহিত্য বলে চিত্রিত করার চেষ্টা লক্ষিত হয় গ্রন্থটিতে। গ্রন্থটিতে সমাজ ও সাহিত্য বিকশিত হওয়ার যে সম্ভাবনা তৈরি করে তা শেষ পর্যন্ত অধরাই থেকে যায়। সাহিত্যে সমাজ বাস্তবতার ধারা গ্রন্থটি শেষ পর্যন্ত তাই টেরি ঈগলটনের ‘মার্কসবাদ ও সাহিত্য সমালোচনা’। কিংবা জর্জ টমসনের ‘মার্কসবাদ ও কবিতা’র মতো মার্কসবাদী সাহিত্যের প্রচার পুস্তিকায় রূপ নেয়।
বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে, স্বতন্ত্র গদ্যভাষার সুদক্ষ প্রয়োগে, বিপুল পঠনের সমারোহে এবং সিনথেসিস ক্ষেত্রের আত্মীকরণে গাজী আজিজুর রহমানের দ্বিতীয় প্রবন্ধের বই স্বেচ্ছামৃত্যুর করতলে কবি একই সঙ্গে লেখককে দিয়েছে প্রবন্ধ সম্রাজ্যে এক টুকরো পবিত্রভূমি ও অমরত্বের হাতছানি। পরবর্তী প্রবন্ধের বই সাহিত্য ও সিংহাসন (সহলেখক অমিতাভ চক্রবর্তী) এই প্রত্যয়কে প্রতিষ্ঠিত করতেই রচিত।
স্বেচ্ছামৃত্যুর করতলে কবি বইয়ে লেখক বলেছেন, মৃত্যুর বহু রকমফেরের মধ্যে আত্মহত্যা আমাদের নিত্য পরিচিত। আত্মহত্যা অপরাধ হলেও এর সুষ্ঠু সংঘটনের মধ্যেই রোপিত আছে এই অপরাধ থেকে নিষ্কৃতির একমাত্র পথ। বিষয়টি পার্থিব সকল বিষয়ের মধ্যে ব্যতিক্রম। আর এ বিষয়টি উপজীব্য করেই তিনি রচনা করেছেন। লেখক আরও লিখেছেন, জীবনের প্রতি দুর্জেয় ভালোবাসা মানুষের সহজাত। মানুষ শত সংকটেও বাঁচতে চায়। তবু কেউ কেউ স্বেচ্ছামৃত্যুর মায়াবী হাতছানি উপেক্ষা করতে পারে না। চলে যায়, না ফেরার এক রহস্যময় দেশে। তবে শেষ পর্যন্ত লেখকের দৃষ্টির তীর নিবদ্ধ হয়েছে আত্মঘাতী কয়েকজন কবির জটিল মনোলোক ও তাঁদের স্বেচ্ছামৃত্যুর নান্দনিক আয়োজনের পরাবাস্তব চিত্রে।
প্রতিভা ও জ্ঞান কবিদের দুই প্রধান শক্তি হওয়ার পরও প্লেটোর সময় থেকেই কবিদের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সরিয়ে রাখার প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলেও আজও অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। গাজী আজিজুর রহমানের সাহিত্য ও সিংহাসন গ্রন্থে কবিদের দেখা হয়েছে মানুষের জয়গানে মুখর, স্বপ্ন বিলাসী, স্বাধীনচেতা ‘ঈশ্বরিত প্রায় স্বয়ম্ভু শক্তি’ হিসেবে। প্রায় ৭০ জন কবি বা গদ্যশিল্পীর সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা, তাঁদের জীবন ও মনোজগতের অজ্ঞাত ধূসর অধ্যায়ের উন্মোচন, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রনেতা, ধর্মব্যবসায়ী, সামন্ত, সৈনিক, আমলা, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক, সংঘাত, সংঘাতের পরিণতি এবং ক্ষেত্র বিশেষে রাষ্ট্র বা শক্তির শীর্ষে আরোহণ ও তার অনুশীলন গ্রন্থটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। বিশ্ব সাহিত্য সম্পর্কে অগাধ জানাশোনা না থাকলে এমন গ্রন্থের রচনাতো দূরের কথা পরিকল্পনাও সম্ভব নয়। গ্রন্থটির নিবিড় পর্যবেক্ষণের পর গাজী আজিজুর রহমান যে এ বিষয়ে প্রকৃতই পারদর্শী একজন ঋদ্ধ ব্যক্তি সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না।
সমাজ-সভ্যতা, সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি, পরিবর্তন-জাগরণ, মানব মুক্তির সংগ্রাম নিয়ে যারা ভাবেন বা চিন্তা করেন তাঁদের কাছে রেনেসাঁ একটা আবশ্যিক বিষয়, তাৎপর্যময় বিষয়ও বটে। কারণ রেনেসাঁর শক্তিই পারে মানুষের অধীত চিন্তা-ভাবনা-দর্শনকে আমূল বদলে দিয়ে একটা নতুন সমাজ, নতুন সংস্কৃতি, নতুন মানবমণ্ডলী গড়ে তুলতে। যে সমাজ হবে বৈচিত্র্যময়, মানবতাবাদী, জ্ঞান-বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিনির্ভর, প্রগতিপন্থী ও আধুনিক। আর সেই সমাজের মানুষেরা হবে সক্রেটিস-প্লেটো-দ্য ভিঞ্চি-মিকেলাঞ্জেলো-রাফায়েল-আলবের্তি-পের্ত্রাকা-গ্যেটে-ভলতেয়ার-টমাস পেইন-মার্কস-রামমোহন-রবীন্দ্রনাথ-মধুসূদন-বিদ্যাসাগর-নজরুল-কাজী ওদুদ বা আহমদ শরীফ, আহমদ ছফার মতো দ্রোহী, শুভার্থী, কৃতবিদ্য মানুষ। রেনেসাঁর সন্তানেরাই যুগে যুগে ছড়িয়েছে আলো-আশা-ভালোবাসা। গেয়েছে জীবনের জয়গান। তাঁদের হাতেই মানুষ ও সমাজের আলোক-অভিসার।
বঙ্গীয় রেনেসাঁর সমাপ্তি ঘটে মূলত বিশ শতকের প্রথমার্ধে। এর মধ্যে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রুশ বিপ্লব, স্বদেশী আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন, আজাদী আন্দোলন, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, প্রগতি আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার এক আশ্চর্য বিকাশ ঘটে। এই বিকাশের মধ্য দিয়ে বাঙালি অর্জন করে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সেক্যুলারিজম, সমাজ প্রগতি, শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-সংস্কৃতির নতুন প্রগতিশীলতা, আধুনিকতা, বিজ্ঞান-দর্শন-জ্ঞান চিন্তার উৎকর্ষতা, পাশ্চত্যের ভাব বিপ্লবের উত্তরঙ্গও। এই বিশাল পরিবর্তন ও অর্জন তো রেনেসাঁরই শিক্ষা। যদিও এই অর্জনে পদে পদে বাধা ছিল, নিপীড়ন-নিগ্রহ ছিল, কিন্তু বাঙালি পিউরিটানিজম শত্রুকে পরাজিত করে জেগে ওঠে দশ দিগন্তে। তাঁরা একে একে পরাজিত করে ধর্মাশ্রয়ী সমাজ, সাম্প্রদায়িক সমাজ পশ্চাৎপদ সমাজ, সংস্কাচ্ছন্ন সমাজ এবং অন্ধ ও বদ্ধ বিশ্বাসী সমাজকে। সেই আলোকমুখি সমাজ ইতিহাসকে গবেষক গাজী আজিজুর রহমান বাংলার দ্বিতীয় রেনেসাঁ হিসেবে অভিহিত করেই বাংলার দ্বিতীয় রেনেসাঁ বইয়ের অবতারণা করেছেন।
আমাদের সাধারণ উপলব্ধি—বাঙালি জাতি হিসেবে সাধারণত ভ্রমণ বিমুখ। মূলত বৈরাগ্য বিলাসেই তাঁর মুক্তি। গৃহ তাঁর কাছে বিশ্ব, বিশ্ব তাঁর কাছে গৃহকোণ। নতুনে তাঁর বিরাগ, পুরাতনে অনুরাগ। গতিতে সে নিস্পৃহ, স্থিতিতে সে স্পৃহ। বাঙালির এই স্বভাব প্রবণতা থেকে আরও অনেক কিছুর মতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালিকে প্রবুদ্ধ করেছিলেন ভ্রমণের মুক্তধারায়।
রবীন্দ্রনাথই বাঙালির সবচেয়ে বড় ভ্রামণিকের উদাহরণ। তিনি আজও আমাদের ভ্রমণ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা। তাঁর মতো ভ্রমণ বিষয় এত গ্রন্থ আর কোনো বাঙালি আজও লেখেননি। তিনি জীবনে কত হাজার মাইল ভ্রমণ করেছেন সেটি গবেষণার বিষয়, কিন্তু লিখেছেন হাজার পৃষ্ঠার মতো। এর মধ্যেই বিধৃত রয়েছে প্রায় গোটা বিশ্বের ইতিহাস, ভূগোল, মানবসমাজের শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতি-ঐতিহ্যসহ মানব চৈতন্যের দীপ্তি। তাঁর দেখা ও উপলব্ধির উজ্জ্বল ভুবনও অনেকাংশে আয়ত্তীকৃত এই ভ্রমণ কথার চরণে চরণে। কবির সেই বিশ্ব লোককে পাঠক সমাজের সামনে তুলে ধরা এবং পরিচয় করিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যেই গাজী আজিজুর রহমান রচনা করেছেন ভ্রামণিক রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থটি। শুধু তাই না, তাঁর ভ্রমণ সাহিত্য রচনার নব রীতি, ভ্রমণকলা ও তুলনামূলক আলোচনার প্রয়াসও রয়েছে এই গ্রন্থে। সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের অতি মূল্যবান অথচ সবচেয়ে অমূল্যায়িত ও অনালোচিত তাঁর ভ্রমণ সহিত্য। সেই প্রেক্ষিতটি বিবেচনায় রেখে রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ সাহিত্যকে পাদ প্রদীপের আলোয় এনে দীপ্ত করা ও উদ্ভাসিত করার উদ্যতিতে এই গ্রন্থের উন্মীলন। বলা যায় রবীন্দ্রবিশ্বে অনুপ্রবেশের এক অন্যতম সিংহদ্বার তাঁর ভ্রমণ সাহিত্য। যতটুকু জানি, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বইটি পাঠ্যসহায়ক বই হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের শতবর্ষ এই লেখকের উল্লেখযোগ্য আরেকটি গ্রন্থ। এই গ্রন্থে গাজী আজিজুর রহমান ১০০ বছরের নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করেছেন। গ্রন্থটি দুটি পর্বে বিভক্ত। গ্রন্থটির ১ম পর্ব গ্রন্থটির ভূমিকায় উল্লেখিত লক্ষ্য উদ্দেশ্যের সঙ্গে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ। নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ও একটি পর্যালোচনা শিরোনামের আলোচ্য অংশটি ৮টি স্বতন্ত্র উপশিরোনামে বিভক্ত। মানবজাতির কল্যাণে আলফ্রেড নোবেলের চিন্তা-কর্মের প্রকৃত স্বরূপটি কেমন ছিল, সে সম্পর্কে যেমন লেখক আমাদের জানাতে প্রাণিত হয়েছেন তেমনি তাঁর (নোবেলের) চিন্তাকর্মের সঙ্গে বর্তমানের নোবেল পুরস্কার প্রদান কমিটির চিন্তাকর্মের অসঙ্গতির দিকটি জোর দিয়ে দেখিয়েছেন।
গাজী আজিজুর রহমানের শিল্পমানস আধুনিক এবং সংগ্রামী মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল। বৃত্তকে অতিক্রমের চেষ্টা তার প্রতিটি লেখায় সহজে শনাক্তযোগ্য। আধুনিক বাংলা উপন্যাসের বিষয় ও শিল্পরূপ তাঁর সৃজনশীলতার অনন্য একটি উদাহরণ। আধুনিক কথাটি এখানে কিছুটা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। মূলত গ্রন্থটি একটি বিশেষ সময়াধারে রচিত ১০ জন ঔপন্যাসিকের নির্বাচিত ১০টি উপন্যাসের শিল্পিত আলোচনা। আলোচ্য ১০টি উপন্যাস বাংলা উপন্যাসের প্রতিনিধিত্ব না করলেও সেগুলো বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্যকে দায়বদ্ধভাবে ধারণ করে। শাস্ত্রশাসিত সমালোচনার পদ্ধতি অনুসরণ না করেও যে সৃজনশীল সমালোচনা সম্ভব সেটি গাজী আজিজুর রহমানের আলোচ্য গ্রন্থ পাঠে অনুধাবন করা যায়। ‘উপন্যাস হলো মানুষকে এনলাইটেড করা, আবিষ্কার করা, আমাদের জানার পেছনে অজানাকে জানা, দেখার পেছনে অদেখাকে দেখা, বাস্তবতার অতিরিক্ত বাস্তবকে অবলোকন করা’। স্বোপার্জিত এই শিল্পসূত্রে গাজী আজিজুর রহমান আলোচ্য উপন্যাসগুলো দেখার চেষ্টা করেছেন। আর এই কারণে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, অতীন বন্দোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, মহাশ্বেতা দেবীর ‘অরণ্যের অধিকার’, আবুল বাশারের ‘ফুলবউ’, হোসেনউদ্দীন হোসেনের ‘সাধু হাটির লোকজন’, হুমায়ূন আহমেদের ‘শঙ্খনীল কারাগার’ প্রভৃতি সম্পর্কে লেখকের মতামত নতুনত্বে লালিত।
বাঙালির প্রাত্যাহিক জীবনের সব সংকট, সংগ্রাম, আনন্দ-বেদনায় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য আমাদের অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করলেও আমরা আমাদের সাহিত্য রচনায় রবীন্দ্র ভাষা ব্যবহার করি না। অন্যদিকে আমাদের মানস গঠন ও জাতীয় জীবনে জীবনানন্দ দাশের প্রভাব ততখানি না হলেও গত সত্তর বছর জীবনানন্দের ভাষাই আমাদের সাহিত্যের প্রধান শকট। আন্দোলন, সংগ্রামে জেগে ওঠা সাহসী মানুষের আত্মাকে ধারণ করেই শামসুর রাহমানের সাহিত্যিক সাফল্য। আবুল হাসান অসামান্য প্রতিভাধর, সাহসী, সময়ের চেয়ে অগ্রসর ঝিনুকে মুক্তা ফলাতে আগ্রহী। প্রথমত তিনজন পরিণত বয়স পেলেও আবুল হাসান অকালপ্রয়াত। গাজী আজিজুর রহমানের কবিতা বিষয়ক আরেকটি গ্রন্থ কবিদের কবি। এই বইয়ে লেখক কবি জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান ও আবুল হাসানের কবিতা এবং কবিত্রয়ের মননবিশ্ব অসামান্য দক্ষতায় আলোচিত হয়েছে। তিন ফুলে তিলোত্তমা এই তিন কবি আধুনিক বাংলা কবিতার জন্য যে ঐশ্বর্য, ভূষণ, চিন্তন ও পরিভাষা রেখে গেছেন তার প্রয়োজনীয়তা বা প্রাসঙ্গিকতা কখনোই ফুরাবার নয়। কবিতা যে শুধু বিবরণ নয়, স্ফুট-স্ফটিক নয়—প্রচ্ছন্ন, বঙ্কিম, গভীরতম দ্যোতনার নির্যাস; চিহ্ন, প্রতীক, রূপক, উপমার অরণ্য; শব্দ দিয়ে গড়া নৈঃশব্দের প্রতিমা, তারই বোধন ও উদ্ভাসন ঘটেছে উল্লেখিত তিন কবির কবিতায়। কবিদের কবি গ্রন্থে এই তিন কবির কবিতায় যে কাব্যসুষমা, শিল্পরূপ ও রীতি প্রকরণ রয়েছে তা সুবিস্তারে ব্যখ্যা করা হয়েছে।
ইতিহাসের ইতিহাস যে সাহিত্যেরও ইতিহাস সেসব বিষয় নিয়ে প্রাবন্ধিক গবেষক গাজী আজিজুর রহমান লিখেছেন স্বদেশ ভাবনা ও বঙ্গবন্ধু বইটি। এই বইয়ের ষোলোটি প্রবন্ধে মিলবে বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তন, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভাবন যা আমাদের দেশের লেখক-কবিদের একটি অতি দুর্মূল্য অনুষঙ্গ।
সাতক্ষীরা নিজস্ব কোনো একক উপভাষা নেই। কিন্তু স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, লৌকিক ও ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে সাতক্ষীরার একটি নিজস্ব উপভাষা তৈরি হয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে গাজী আজিজুর রহমান (সহলেখক এস. এম. হারুন-উর-রশীদ) রচনা করেছেন সাতক্ষীরার ভাষা ও শব্দকোষ শিরোনামের বইটি। বইটিতে সাতক্ষীরার ভাষা, ভাষা বৈচিত্র্য, বৈশিষ্ট্য, সমাজ ভাষাতত্ত্ব, বাক্য, বাক্য গঠন ও বিশ্লেষণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বাড়তি পাওনা হিসেবে আছে সাতক্ষীরার শব্দকোষ।
দেশের সর্বদক্ষিণাংশের সুন্দরবনের উপকণ্ঠে সাতক্ষীরা জেলার শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতি-আন্দোলনের সূতিকাগার কালীগঞ্জ থানার ইতিহাস আজও লেখা হয়নি। আঞ্চলিক ইতিহাস ছাড়া ইতিহাস কখনোই সম্পূর্ণ নয়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে গাজী আজিজুর রহমান লিখেছেন গবেষণাধর্মী আরেকটি উল্লেখযোগ্য বই কালীগঞ্জের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ। বইটিতে কালীগঞ্জের ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের অজানা ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে। সঙ্গত কারণের সহজেই অনুমেয় এই লেখকের প্রতিটি বইয়ের বিষয় এবং উপস্থাপনা অত্যন্ত আধুনিক এবং নতুনতর।
পঁচাত্তর পেরুনো ‘চিরতরুণ’ মননশীল এই গবেষক দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন কিন্তু এখনো পর্যন্ত তাঁর কাজের কোনো সরকারি বা সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাননি। আংশিক প্রথা ও প্রতিষ্ঠান বিরোধী এই লেখকের পক্ষে সেটি অবশ্য অগৌরবের নয় বরং গৌরবের। গাজী আজিজুর রহমানের সাহিত্য ও শিল্পমানস আজও আমাদের কাছে সম্পূর্ণভাবে আবিষ্কৃত হয়নি। ‘প্রান্তজনের সখা’ অত্যন্ত শক্তিশালী এই গবেষকের জ্ঞানকেন্দ্রিক ক্ষমতার নিপুণ প্রয়োগ আরও হীরকোজ্জ্বল জ্যোতি ছড়াক এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: অধ্যাপক, ডে-নাইট কলেজ, সাতক্ষীরা।
এসইউ/এমএস