শহীদের মা অথবা ফোরকান আলীর বাম পা
এক সন্ধ্যায় কোনো কারণ ছাড়াই মনটা খুব উচাটন করতে থাকে। সব কেমন শূন্য লাগে। সীমাহীন হাহাকারে ছেয়ে যায় মন। কিছুতেই মন বসে না। কিছুই ভালো লাগে না। শুধু মনে হয় অনেক কিছু করার ছিল আমার। অনেক কিছু দেখার ছিল। অনেক কিছু লেখার ছিল। অনেক কিছু বলার ছিল। হলো না কিছুই! এমন মাঝে মাঝেই হয়। তখন বের হয়ে যাই ঘর থেকে। ঘোরগ্রস্তের মতো হাঁটতে থাকি পথ ধরে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে কখনো বসে পড়ি নির্জন কোনো ফুটপাতে। যদিও এই শহরে নির্জনতার বড় অভাব। কখনো কখনো ঢুকে যাই রমনা পার্কে। সন্ধ্যা মেলানোর পর আজকাল বন্ধ হয়ে যায় রমনা পার্কের সবগুলো ফটক। তবে ফটক বন্ধ থাকলেও পার্কে ঢোকার কায়দা আমার জানা আছে। কোথায় কোন দেওয়াল টপকে ঢোকা যায়, অথবা কোন নিরাপত্তা কর্মীকে কীভাবে ম্যানেজ করতে হবে—সবই আমার জানা। আর যেদিন এসব হুজ্জত করতে ইচ্ছা করে না, সেদিন সোজা ঢুকে যাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ি সটান। কখনো কখনো আকাশ ভরা থৈ থৈ জোছনা। কখনো থাকে আকাশজুড়ে অসংখ্য তারার ফুল। কখনো নির্মেঘ আকাশে আমার মনের মতো একই রকম শূন্যতা বিরাজ করে। ফুটপাতের হকার, আলো আঁধারি রাস্তার ছিনতাইকারী কিংবা চোর ছ্যাঁচর পার্কের বাদামওয়ালা সবাই আমার একান্ত স্বজন। সবাইকে আমি ভালোবাসি। এমনকি রাতের বয়স একটু বাড়লে অথবা নবীন রাতে—পার্কের রহস্যছায়ায় কড়া লিপস্টিক, ঠোঁটে গালে সস্তার রোজ পাউডার মেখে দাঁড়াতে বাধ্য হয় যে মেয়েটা সেও আমাকে ভালোবাসে। সেও মনের আগল খোলে আমার সামনে। পরম মমতায় কখনো এগিয়ে দেয় ছোট্ট একটা চকলেট কিংবা একদানা সুপুরি। আগের জনমে হয়তো আমি তার ভাই ছিলাম। হয়তো আমি তার সন্তান ছিলাম। হয়তো আমি তার প্রতিবেশী ছিলাম। হয়তো তার একান্ত ছিলাম। হয়তো তার প্রেমিক ছিলাম। হয়তো আমি তার কিছুই ছিলাম না। হয়তো এখনো আমি তার কিছুই না। তবুও এই শহরের পথের মানুষ, ভাসমান মানুষ, নিত্যদিন মার খাওয়া মানুষ, পোড়খাওয়া মানুষ, চোর মানুষ, বাটপার মানুষ, বদমাশ মানুষ, অপরাধী মানুষ—সবাই আমাকে ভালোবাসে। কেন বাসে! জানি না আমি। উত্তর জানার চেষ্টাও করিনি কখনো। সব প্রশ্নের উত্তর হয় না—অনেক বছর আগের এক গোধূলিবেলায়—সিঁদুর রঙের আলোয় মেখে সূর্যটা যখন ডুবে যাচ্ছিলো ধীরে ধীরে পশ্চিমের আকাশে—কাঁচাপাকা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে আমাকে বলেছিলেন মফিজুর রহমান। তিনি ছিলেন আমার স্কুল শিক্ষক। কিশোরবেলার আদর্শ। ঠিক ওই সময়টাতেই মসজিদ থেকে ভেসে এসেছিল মাগরিবের আজান। আর সেই সুমধুর আহ্বানে মসজিদের দিকে পা বাড়িয়েছিলেন মফিজুর রহমান। ফলে তাকে আমার আর জিজ্ঞেস করা হয়নি, কেন সব প্রশ্নের উত্তর হয় না!
আজকের সন্ধ্যাটাও এমন অজানা বেদনায় পোড়াতে থাকে আমাকে। সীমাহীন অস্থিরতায় টেনে নিয়ে যায় ঘরের বাইরে। বাইরে বের হতেই চোখে পড়ে ভরা পূর্ণিমার আকাশ। শহরের নিয়ন আলো ছাপিয়ে গলে গলে পড়ছে জোছনা। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝরছে পৌষের হিম। গুটিগুটি পায়ে আমি ঢুকে যাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেই চেনা গণ্ডিতে। হিম জড়ানো এই সন্ধ্যায় উদ্যানটা একেবারেই ফাঁকা। প্রিয় শিরিষতলায় বসে থাকি আমি নির্জীব। কোথাও কেউ নেই। সবার আজ ছুটি। সবাই এই শীতের রাত উদযাপনে ব্যস্ত আপন ভুবনে। আমারই শুধু নিস্তারহীন বেদনা। হঠাৎই চোখে পড়ে ফোরকান আলীকে। ফোরকান আলী ব্যবসা করেন হাইকোর্টের সামনে। হাইকোর্ট মাজারের সামনের বটতলার এক পাশে তার চা সিগারেটের দোকান। সারাক্ষণই ভিড় লেগে থাকে তার দোকানে। তবে বাকির কাস্টমারই বেশি। দিনমান চা সিগারেট বেচেন আর পাওনাদারদের শাপ শাপান্ত করেন ফোরকান আলী। তিন নেতার মাজারের উল্টোদিকে পার্কের ভেতর একটি পরিত্যক্ত সুয়ারেজ পাইপের ভেতর তার বাস।
- এই শীতের মধ্যে কী মনে করে বের হলেন? ফোরকান আলীর উদ্দেশ্যে আমার প্রশ্ন।
- দূর থৈইক্যা দেখলাম আপনি বসে আছেন। তাই আইলাম। কৈফিয়তের মতো শোনায় ফোরকানের গলা।
- ওহ আচ্ছা।
এরপর আর কথা এগোয় না আমাদের। ফোরকান আলী বসে থাকেন চুপচাপ। আমি শুয়ে শুয়ে আকাশের তারা গুনি। অনতিদূরের রাস্তা থেকে ভেসে আসে গাড়ির হর্নের শব্দ। কালোপিচের সড়কে আচমকা গাড়ির ব্রেক কষার ঘর্ঘর শব্দ। দুয়েকটা রিকশার টুংটাং শব্দও আসে কানে। গাছগাছালির ফাঁক গলে আমাদের চোখেমুখে এসে পড়ে যানবাহনের লাইটের আলো।
- একটা কথা বলার ছিল! সন্ধ্যার নীরবতা ভেঙে বলেন ফোরকান।
- জ্বি বলেন ফোরকান আলী।
- আমার লগে যুদ্ধে শহীদ হইসিলে ওমর ফারুক। হ্যার মায় এখনো তার লাগি প্রতি রাইতে ভাত রাইন্ধ্যে রাখে। ওমর ফারুক তার মারে কইসিলো ফিরত আইসা বন্ধুগো লইয়া ভাত খাইবো। সেই ভাত খাওয়া তার আর হয় নাই। সে যে ফিরতেই পারে নাই। কিন্তু মায়ের মন তো আর মানে না। সেই থেইক্যা এখনো প্রতিদিন ছেলের জন্য ভাত রাইন্ধ্যে রাখে তার মা কুলসুম বেগম।
- কী বলছেন এসব? শোয়া থেকে তড়াক করে উঠে বসি আমি। আপনি কি মুক্তিযোদ্ধা?
- হ্যাঁ। কেমন যেন অভিমানী শোনায় ফোরকান আলীর গলা। আর আমার চোখ চলে যায় ফোরকান আলীর খোঁড়া পায়ের দিকে। এতদিন ভেবেছিলাম হয়তো জন্ম থেকেই অকেজো ফোরকান আলীর বাম পা। এখন বুঝতে পারছি—ফোরকান আলীর বাম পা বহন করছে মহান একাত্তরের অমিয় গৌরবগাঁথা।
- কোথাকার ঘটনা এইটা? ওমর ফারুক কোথায় শহীদ হয়েছিলেন?
- আমাগো পিরোজপুর। এলাকার সবাই জানে এই খবর।
মুহূর্তে কী হয়ে যায় আমার।
- ফোরকান ভাই চলেন পিরোজপুর যাই। এখনই!
- এহন? এই রাইতে? কেমনে সম্ভব?
- আরে ভাই চলেন না! সদরঘাট গিয়ে দেখি—লঞ্চ পাইলেও পাইতে পারি।
এরপর হন্তদন্ত হয়ে সদরঘাট পৌঁছে পিরোজপুরের লঞ্চে কীভাবে উঠেছিলাম সেই বর্ণনা দিতে গেলে সাতখণ্ড রামায়ণ হয়ে যাবে। শুধু এইটুকু বলি, শেষ লঞ্চটা কোনোমতে ধরতে পেরেছিলাম আমরা। ভোরসকালে পিরোজপুর শহরে লঞ্চ ভিড়লে আমাদের স্বাগত জানিয়েছিল আধসেদ্ধ ডিমের কুসুম রঙের সূর্য। শীতের সকালে কুয়াশা ভেদ করে জেগে ওঠা সূর্যটা দেখে আমার শীতভাব কমে গিয়েছিল অনেকটাই। তবে ফোরকান আলীর একেবারে জেরবার অবস্থা। শীতে কাহিল হয়ে গেছেন বয়স্ক মানুষটা। তবু উৎসাহের কোনো কমতি নেই। তার সহযোদ্ধা শহীদ ওমর ফারুকের গল্প শুনতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে এক দৌড়ে চলে এসেছি পিরোজপুর—এটা ফোরকান আলীর কাছে অপার বিস্ময়ের বিষয়।
লঞ্চঘাটেই সকালের নাশতা সেরে রওয়ানা দিই আমরা ওমর ফারুকের বাড়ির উদ্দেশে। শীত পড়েছে জাঁকিয়ে। বাতাসে কুয়াশার ভেজা গন্ধ। চেনা পথঘাট ফোরকান আলীকে ডাকে পরম মায়ায়। অচেনা জনপদ আমায় টানে না। আমার মনের মধ্যে উথালিপাথালি চঞ্চলতা এক মায়ের জন্য। যে মায়ের একটি সন্তান হারিয়ে গেছে মুক্তির মন্দির সোপান তলে। যে মা গত পঞ্চাশটি বছর এক ছেলের অপেক্ষায়। কিছুদূর হাঁটার পরে আমরা এসে থামি একটি একতলা বাড়ির সামনে। চারপাশে ইটের দেওয়াল উপরে টিনের ছাউনি দেওয়া ছায়াময় শান্ত একটি বাড়ি। দুপুর রোদের মতো নিস্তব্ধ। পিরোজপুর নগরীর সরকারি মহিলা কলেজের পাশের এই বাড়িটি এলাকার সবাই চেনে শহীদ ওমর ফারুকের বাড়ি হিসেবে। ফোরকান আলী হাতের মৃদু ধাক্কা দিলে ধ্রুম ধরনের ছোট্ট একটি শব্দ করে খুলে যায় বাড়ির লোহার গেট। গেট ঠেলে ঢুকতেই শান বাঁধানো উঠোন। উঠোনের তিনপাশ জুড়ে ঘর। বাড়িতে ঢুকে বোঝা যায় ফোরকান আলী এই বাড়ির সবার খুব চেনা। একান্ত স্বজন যেন।
- আম্মা কোথায়? ঢাকা থেকে মেহমান নিয়ে আসছি।
- ভেতরের ঘরেই আছে।
ফোরকান আলীর কথার উত্তরে জানায় মাঝবয়সী এক নারী। অপরিচিত আমাকে দেখেও জড়তা নেই নারীর মধ্যে। বুঝতে পারি, আমার মতো এমন অচেনা মানুষ হয়তো প্রায়ই আসেন একাত্তরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুকের বাড়িতে।
ভেতরের দিককার এক ঘরে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখি এক কঙ্কালসার বৃদ্ধাকে। পায়ের কাছের জানালার পাশ ঘেঁষে একটি অল্প বয়সী খেঁজুর গাছ। গাছের চিরল চিরল পাতায় সূর্যের আলো পড়ে বিছানাময় তৈরি করেছে সুন্দর এক আল্পনা। হালকা বাতাসে গাছের পাতাটি দুলছে মৃদুলয়ে, সেই সঙ্গে রোদছায়ার নকশাটিও। তিন বছর ধরে শয্যাশায়ী শহীদ মাতা কুলসুম বেগম। আমাদের দেখে কিছু একটা বলেন অস্পষ্ট স্বরে। গায়ে মাথায় হাত বোলানোর চেষ্টা করেন ফোরকান আলীর।
এমন সময় ঘরে ঢোকেন আগে দেখা সেই মাঝবয়সী নারী। তিনি শহীদ ওমর ফারুকের ছোটবোন সালমা রহমান হ্যাপি।
হ্যাপি আমাদের জানান, মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সময় ২১ বছর বয়সী ওমর ফারুক মা কুলসুস বেগমকে বলে গিয়েছিলেন—ফিরে এসে সহযোদ্ধাদের নিয়ে ভাত খাবেন। মা যেন বেশি করে ভাত রান্না করে রাখেন। সেই থেকে মা আজও অপেক্ষায় আছেন। দরজা বন্ধ করতে দেন না। কোনোদিন মা কোথাও বেড়াতে গেলে আমরা দরজা বন্ধ করেছি শুনলে খুব রাগ করতেন। তার ধারণা, দরজা বন্ধ দেখে যদি ওমর ফিরে যায়! আমার মায়ের বয়স এখন ৯৭ বছর। এক পা ভেঙে গেছে। গেল ২ বছর ধরে ওনার স্বাভাবিক জ্ঞানও নেই। তবুও অনেক সময় তার মুখ থেকে বের হয়ে যায় ওমরের নাম। মায়ের যতদিন জ্ঞান ছিল; ততদিন প্রধান দরজা বন্ধ করতেন না। আজও তাই ওমরের জন্য দরজা খোলা রাখা হয়।
বলেই চলেন হ্যাপি—প্রতিদিন এখনো ওমর ও তার বন্ধুদের জন্য বাড়তি ভাত রান্না করা হয়।
- ওমর ফারুক কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন?
- আমাদের আট ভাই-বোনের মধ্যে ওমর দ্বিতীয়। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফার প্রচারের জন্য পিরোজপুর এলে আমার বড়ভাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে ছাত্রলীগে যোগ দেন। পরের বছর তিনি পিরোজপুর ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
সালমা রহমান হ্যাপির চোখের কোণে এবার চিকচিক করতে দেখি জল। খানিক বাদেই মুক্তোদানার মতো ঝরে পড়ে একফোটা অশ্রু। এরপর অঝোর ধারায় ঝরতে থাকে। ঝরতেই থাকে। জলঝরা চোখে ভাঙা গলায় বলে যেতে থাকেন তবুও।
- ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে শহীদ মিনার মাঠে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন ওমর ফারুক। এই কারণে তৎকালীন সরকার তার বিরুদ্ধে মামলা করে। ২৫ মার্চ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘটিত করতে প্রশিক্ষণ শুরু করেন তিনি। ২৪ এপ্রিল তিনি মালখানা থেকে অস্ত্র লুট করার নেতৃত্ব দেন।
বাইরে তখন বাড়ছে শীতকালের দুপুর। সূর্যটা মাথার উপর উঠেই ধীরে ধীরে পশ্চিমে হেলে পড়ার পায়তারা করছে। এমন সময় ঘরে ঢোকেন এক প্রৌঢ়। তাকে দেখেই সম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ান ফোরকান আলী। সেই সঙ্গে হ্যাপিও। তাদের দেখাদেখি আমিও। তিনি মুক্তিযোদ্ধা মনিরুজ্জামান। ওমর ফারুকের সহযোদ্ধা। মনিরুজ্জামান জানান, ১৯৭১ সালের ৩ মে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী পিরোজপুর আসে। এসেই হুলারহাট, মাছিমপুর আর কৃষ্ণনগর গ্রামে গণহত্যা চালায়। হুলিয়া জারি হয় ওমর ফারুকের নামে। ওমর ফারুক সে সময় ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পথ খুঁজতে থাকেন। ২৯ জুন বরিশাল থেকে কুরিয়ানা যাওয়ার পথে লঞ্চঘাটে হানিফ রাজাকার তাকে চিহ্নিত করে এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয়। ৩০ জুন বরিশালের ওয়াপদায় বধ্যভূমিতে তাকে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
মনিরুজ্জামানের গলা থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে মিলিয়ে যায় বাতাসে।
এ পর্যায়ে আবার কথা বলতে শুরু করেন সালমা রহমান হ্যাপি, ওয়াপদার টর্চার সেল থেকে ছাড়া পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হক আমার চাচাতো ভাই মানিককে জানান ওমর ফারুকের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল। তার পকেটে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা পেয়েছিল। ওই পতাকা লোহার দণ্ডে বেঁধে তারা ওমরকে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতে বলেছিল। ওমর বলেছিলেন—জয় বাংলা। পরে সেই লোহার দণ্ড তার মাথায় ঢুকিয়ে দেয় এবং বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করে তাকে। হত্যার পর তিন দিন তার মরদেহ গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা।
সালমা রহমান হ্যাপির বক্তব্য শেষ হলে আমি খেয়াল করি ঘরজুড়ে কবরের নিস্তব্ধতা। শহীদ ওমর ফারুকের মরদেহ তারা আনতে পেরেছিলেন কি না—এরপর এই প্রশ্নটা করার সাহস হয় না আমার।
বের হয়ে আসার জন্য পা বাড়াই। এমন সময় আবারো অস্পষ্ট স্বরে কিছু একটা বলার চেষ্টা করেন কুলসুম বেগম। শীর্ণ ডানহাতটি উপরে তুলে কিছু একটা নির্দেশ করেন। মায়ের মুখের কাছে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করেন হ্যাপি।
- মা বলছেন, আপনাদের দুপুরে খেয়ে যেতে হবে!
শহীদ ওমর ফারুকের বাড়ি থেকে যখন বের হয়ে আসি, ধীরে ধীরে সন্ধ্যা মেলাচ্ছে চারপাশে। ফোরকান আলী তখনো আমার সঙ্গে।
- ফোরকান ভাই?
- হুম বলেন।
- আপনি মুক্তিযোদ্ধা বলেন নাই কেন আগে?
- বলার কী আছে? মানুষের কাছে বলে বেড়ানোর জন্য তো যুদ্ধ করি নাই।
- কিন্তু সবার তো জানা উচিত। দেশের জন্য আপনি কত ত্যাগ করেছেন। একটা পা হারিয়েছেন। ঘর-সংসারও করলেন না!
- খোঁড়া লোককে কে বিয়া করবো। তার ওপর ঘর বাড়ি জমি জিরেত কিছুই নাই। সব তো গিলে খাইসে বলেশ্বর।
- খোঁড়া বলবেন না নিজেকে। আপনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। আপনি বীর।
এরপর আর কিছুই বলেন না ফোরকান আলী। তবে তার ঠোঁটের কোণায় একটা তাচ্ছিল্যের হাসি টের পাই। এই তাচ্ছিল্য কার প্রতি! বুঝতে পারি না। বোঝার চেষ্টাও হয়তো করি না।
জাঁকালো শীত পড়েছে দক্ষিণ বাংলার এই শহরে। আজকেই ফিরে যাবো ঢাকায়? নাকি পিরোজপুরে থেকে যাবো আরও ক’টা দিন? মনস্থির করতে পারছি না। আমার মাথায় ঘুরছে একুশ বছরের এক যুবক ওমর ফারুকের মুখ। ঘুরছে প্রায় শতবর্ষী কুলসুম বেগমের মুখ। এক সময় খেয়াল করি সব ছাপিয়ে দীর্ঘদিন পর মনের গহীন কোণ থেকে জেগে উঠেছেন আসিয়া খাতুন—আমার দাদি। একাত্তরের আগুনঝরা একদিনে পাকিস্তান হানারদার বাহিনী যখন বাড়িতে ঢুকলো জনশূন্য বাড়িতে তখন একজন মাত্র মানুষ, সে আমার দাদি। আর ছিল একটি পোষা কুকুর। পাকিস্তানি হায়েনাদের নিপীড়নের সামনে সেদিন বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল সবার প্রিয় লালু। একটি বুলেটের বিনিময়ে লালু সেদিন শুধেছিল আনুগত্যের মূল্য। আর আসিয়া খাতুনের বাকি জীবনটা কেটেছিল ভয়াবহ এক ট্রমায়। আমাদের ছোটবেলায় পুলিশের পোশাকের রং ছিল খাকি। আমার দাদি এই খাকি রঙের পোশাক পরা কাউকে দেখলেই পাকিস্তানি হানাদার ভেবে ভয়ে কুকরে যেতেন। কারণ একাত্তরের মধ্য জুলাইয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছিল যে পাকিস্তানি সৈনিকরা, তাদের পোশাকও ছিল খাকি রঙের!
হাঁটতে হাঁটতে একসময় নিজেকে আবিষ্কার করি বলেশ্বর নদের সামনে। বলেশ্বরে ছায়া পড়েছে নিয়ন আলোর। চকচক করছে জল। হাজারো শহীদের রক্তেভেজা বলেশ্বরের জলকে আমার বড় পবিত্র মনে হয়। আমরা তো মনে রাখিনি একাত্তরের লাখো শহীদকে। মনে রাখিনি অজুত-নিযুত ফোরকান আলীকে। সম্মান দেইনি তাদের। হয়তো দিতে পারিনি। হয়তো দেওয়ার চেষ্টাও করিনি। তবে এই বলেশ্বর নদ, এই কুয়াশা ভেজা জোছনা রাত, এই শীতের হিম নিশ্চয়ই মনে রেখেছে তাদের! বইতে বইতে নদীর জল একসময় সাগরে গিয়ে মেশে। সাগর থেকে মহাসাগরে। সেখান থেকে বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যায় দূর আকাশে। ভেসে বেড়ায় মেঘের ভেলায়। একসময় আবারো বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে—ওমর ফারুকদের রক্তে ভেজা বাংলায়। এভাবে শহীদরা বেঁচে থাকেন যুগের পর যুগ। শতাব্দীর পর শতাব্দী। প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আমরা মনে না রাখলেও তাদের কিছু যায়-আসে না। এই শ্যামল বাংলার জল ছায়া ঠিকই হৃদয়ে ধরে রাখে তাদের।
কী মনে করে যেন হাত রাখি নদীর জলে। কী ভীষণ রকম শীতল!
এসইউ/জেআইএম