নিষিদ্ধশয্যা: অন্ধকার জগতের খতিয়ান
সাফি উল্লাহ্
তরুণ সমসাময়িক ঔপন্যাসিকের দীর্ঘ তালিকার মাঝেও নিজের স্বতন্ত্র অবস্থান নিশ্চিত করেছেন জব্বার আল নাঈম। উপন্যাসের অনুষঙ্গ, বিষয়বস্তু ও প্রকরণ হিসেবে নির্বাচন করেছেন সমাজের মূল প্রবাহ থেকে বিচ্যুত এক জনগোষ্ঠীকে। যাদের এই অবস্থানের জন্য সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণি বিশেষভাবে দায়ী। তিনি লেখনীর মাধ্যমে সমাজের অভ্যন্তরে, অনেক গভীরে লুকিয়ে থাকা শেকড়ের রূপ উন্মোচন করেছেন সাবলীল ভাষায়। জব্বার আল নাঈম তার উপন্যাস ‘নিষিদ্ধশয্যা’য় সমাজের নিষিদ্ধ মানুষকে নিয়ে সভ্য মানুষদের অসভ্য ও নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ডের পাঁপড়ি উন্মোচন করেছেন। একজন নারী, যিনি কিছুটা বাধ্য হয়ে, কিছুটা বোকামি করে, পতিতাবৃত্তি শুরু করেছিলেন, এমন এক চরিত্রের বয়ানে পুরো সমাজের সুস্পষ্ট চরিত্র প্রকাশ করেছেন। যাদের কারণে নারী পতিতা হয়ে ওঠে, সেইসব তথাকথিত সভ্য মানুষের অভ্যন্তরীণ জগতকে নির্লিপ্তভাবে সামনে টেনে এনেছেন উপন্যাসে। প্রাথমিকভাবে পাঠক উপন্যাসটিকে রগরগে প্রেমের কাহিনি কিংবা যৌনতার সুড়সুড়ে বয়ান বলে সরলীকরণ করতে পারেন। তবে উপন্যাসের আদ্যোপান্ত না পড়ে থমকে দাঁড়ানো যেমন মুশকিল, তেমনই থমকে দাঁড়িয়ে পূর্ণাঙ্গ অর্থ উদ্ধার আরও দুরূহ। শিরোনামকে নানা আঙ্গিক থেকে ব্যাখ্যা করা গেলেও এ উপন্যাসকে মানুষের নিষিদ্ধ জগতের খেড়োখাতা বললে অত্যুক্তি হবে না। কথাসাহিত্যিক নাঈম পুরুষ সমাজের পাশবিক পৌরুষত্বের দিকে আঙুল উঁচু করেছেন। শেষাংশে নারীর জন্য নিরাপদ পৃথিবী নির্মাণ করতে না পারলেও নারীর কণ্ঠস্বরকে উচ্চকিত করেছেন দারুণভাবে, যা সহজেই পাঠকের হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করবে।
স্বপ্না শুধু পেশাগত দিক থেকেই পতিতা নন বরং অধিকার ও সামাজিকতা থেকেও সমাজের মূলস্রোত থেকে পতিত। স্বপ্নাকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ আবর্তিত হয়েছে। তার মা আলেয়াও একজন পতিতা ছিলেন। সমাজের তথাকথিত উঁচু স্তরের মানুষ কীভাবে আলেয়ার সর্বস্ব কেড়ে সমাজ থেকে ছুড়ে ফেলেছে, মরণকালে দাফন পর্যন্ত করতে দেয়নি, তার চিত্রায়ন ঘটেছে উপন্যাসে। শুধু তা-ই নয়, এ নষ্ট সমাজের মূল হোতাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করায় স্বপ্নাকেও ছুড়ে ফেলা হয়েছে সমাজের মূলধারা থেকে।
‘নিষিদ্ধশয্যা’ উপন্যাসটির শিরোনাম শুনলেই মনে হতে পারে যৌনতার রোমাঞ্চকর রগরগে বর্ণনায় সমৃদ্ধ থাকবে বইয়ের সবটুকু অংশ। কিন্তু বইটি পড়া শুরু করলেই সে ভুল সহজেই ভাঙবে। উপন্যাসে যৌনতার রোমান্স নিয়ে কোনো আলাপ নেই বরং বিবাহবহির্ভুত যৌনতা কীভাবে পুরুষকে সাময়িক সুখ দিতে পারে এবং পুরুষের পৌরুষ কীভাবে প্রকাশিত হয় তার বর্ণনা রয়েছে। এতে রয়েছে নারীর নষ্ট হয়ে যাওয়া জীবনের আখ্যান, এ অন্ধকার-জীবনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ, এমনকি বারবার পরাস্ত হয়েও নিজের অধিকারের কথা বলার সাহসের বয়ান।
উপন্যাসে দেখা যায়, হাস্নার স্বামী মখলেসকে দীর্ঘদিন হোম সার্ভিস দিয়েছে স্বপ্না—উপপত্নি কিংবা পতিতা হিসেবে। হোম সার্ভিস দেওয়ার বিনিময়ে সে টাকা পেয়েছে এবং পেয়েছে একটি ফ্ল্যাট, যদিও এর বিনিময়ে তার জীবনের স্বপ্ন ও মূলপ্রবাহকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। স্বপ্নার বিক্রি করতে চাওয়া ফ্ল্যাটটি কিনতে চায় হাস্না। কিন্তু ঘটনাক্রমে ফ্ল্যাট কেনার ইস্যুকে কেন্দ্র করে হাস্না, মখলেস ও স্বপ্নার মুখোমুখি দেখা হয়। স্বপ্না যদি সবকিছু হাস্নাকে বলে দেয়, এই ভেবে মখলেস ভয় পায়। ফ্ল্যাট দেখে ফিরে গেলেও পরে মখলেস একা স্বপ্নার সাথে দেখা করতে আসে, তখন স্বপ্না তাকে বলে, “...পাপ করার পরও পুরুষেরা সাধু আর নারীরা পতিতা। তাই না? এ কেমন জাস্টিস? ওই পুরুষ, এটা কেমন জাস্টিস?” একই ধরনের গর্হিত কাজ করার পরেও লিঙ্গভেদে নারীরা পতিতা স্বীকৃতি পায় আর পুরুষরা তখনো বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়। এ উপন্যাসের মূল বক্তব্য যদি এক উক্তির মধ্য দিয়ে বলতে বলা হয়, আমি নিঃসঙ্কোচে বলব, “ওই পুরুষ, এটা কেমন জাস্টিস?” পুরুষ জাতির ভণিতাকে এক নিমিষে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে পুরো সামাজিক বাস্তবতাকে প্রকাশ করা হয়েছে।
একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য মরিয়া ব্যক্তি হলেন সেলিম ঠাকুর; সাবেক এমপি হাসমত; মখলেস চেয়ারম্যান, আলাদ্দিন মিজি, রাজিব কমিশনার কিংবা পুষ্পশয্যা প্রোপার্টির ম্যানেজার মোস্তাফিজ—সবাইকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে নিপাট ভদ্রলোক, সমাজদরদী, এমনকি ধার্মিকও বটে। কিন্তু এদের সবার মনোরঞ্জনের বস্তুতে পরিণত হতে হয়েছে স্বপ্নাকে। শুধু তা-ই নয়, আলেয়ার সাথেও ছিল সেলিম ঠাকুরের যৌনসম্পর্ক, তারই ঔরসজাত অবৈধ সন্তান স্বপ্না, হোক বিবাহবহির্ভুত, তবু তো নিজ রক্তের। নিজের মেয়ের সাথে শুধু নিজে নয়, আয়োজন করে নিজের বন্ধু এমনকি রাজনৈতিক কর্মীদের মনোরঞ্জনে স্বপ্নাকে বাধ্য করেছে। স্বপ্না যখনই কণ্ঠস্বর উঁচু করতে চেষ্টা করেছে, তখনই বাঁধার সম্মুখীন হয়েছে। স্বপ্না এ পেশা ছেড়ে দিতে চাইলেও নানাভাবে তাকে বাধ্য করা হয়েছে। সব পুরুষই যে এমন নারীখাদক, বিকৃত যৌনকাতর, তা নয়। মুগদা থানার ওসি, মুগদা হাসপাতালের চিকিৎসকসহ বেশ কিছু চরিত্রের অবতারণা করা হয়েছে যারা শুধু পুরুষ নয়, মানুষও।
সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্ধকার দিক তুলে ধরতে গিয়ে লেখককে রাষ্ট্রের নানা প্রতিষ্ঠানের প্রসঙ্গ আনতে হয়েছে। খুবই দক্ষতার সাথে কোনো প্রতিষ্ঠানকে সার্বিকভাবে এবং সরলীকরণের মাধ্যমে দোষারোপ তিনি করেননি বরং ব্যক্তিবিশেষের বিচ্যুতি ও অপরাধগুলো উপস্থাপন করেছেন। পুলিশ প্রশাসনে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের নিয়ে মন্তব্য করেছেন, একইসাথে সৎ ও রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত পুলিশ কর্মকর্তার কথাও বলেছেন। অসৎ রাজনীতিবিদের কথা যেমন বলেছেন, সৎ রাজনীতিবিদ কেমন হন, তার রূপরেখাও দিয়েছেন। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, পতিতা ও তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের নাম সরাসরি উল্লেখ করেছেন; কারণ উপন্যাসের মাধ্যমে নারীদের যে অধিকারের কথা লেখক বলতে চান, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নকারী বাস্তবিক সংগঠন হলো সেটা। এ উল্লেখের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া ও অন্ধকার জগতের নারীদের পক্ষে কাজ করা মানুষগুলোকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করা হয়েছে।
উপন্যাসে পুরুষ সমাজের বেশ কিছু কপটতাকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। উপন্যাসে সমাজের বিত্তশালী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ কবরস্থানের আয়োজন দেখা যায়। পুষ্পশয্যা প্রোপার্টিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান কবরের প্লট বরাদ্দ দেয় যেখানে শুধু বিত্তশালী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গ বা তাদের পরিবারের সদস্যগণের কবর বরাদ্দ দেয়া যাবে। এ প্রতিষ্ঠানের একজন এজেন্ট স্বপ্নার নিকট প্লটের অফার নিয়ে বারবার আসে। স্বপ্নার মা যেহেতু দাফনের মাটিটুকুও পায়নি, নারীখেকো মানুষগুলোই দাফনের ব্যবস্থা করতে দেয়নি, তাই সে নিজের জন্য দাফনের মাটিটুকু খরিদ করে যেতে প্লট বরাদ্দের ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছিলো। আর প্লটের দাম পরিশোধের জন্যই বিক্রি করে দিতে হয় তার ফ্ল্যাট। উপন্যাসের শেষাংশে পুষ্পশয্যা প্রোপার্টিজের ম্যানেজার স্বপ্নাকে জানায়, তার জন্য প্লট বরাদ্দ দেয়া যাবে না কারণ সে একজন পতিতা, এখানে পতিতাদের কোন স্থান নেই। মখলেস তো এর আগে তাচ্ছিল্য করে বলেইছে, স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি কবরে শুয়ে থাকবে, এমতবস্থায় কোন পতিতার কবর যদি তাদের পাশে হয়, তাহলে মৃত্যুর পরেও পতিতার দিকে বদনজর যেতে পারে যা মৃত্যুপরবর্তী দাম্পত্য জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। উল্লেখ্য, এই ম্যানেজারও স্বপ্নাকে এক সময় ভোগ করেছে। ম্যানেজার মতামত জানানোর পরে উপন্যাসে বর্ণিত পাশবিক পুরুষ অর্থাৎ সেলিম ঠাকুর, আলাদ্দিন মিজি, মখলেস বা অন্যান্যরা আরো একবার স্বপ্নাকে ভোগ করতে জোর করে এবং স্বপ্না সেখান থেকে পালিয়ে আসে। পাশবিক যৌনকাতর পুরুষের কপটতার নানান স্তরকে নানান উপায়ে উন্মোচিত করে ব্যঙ্গ করা হয়েছে।
উপন্যাসের শিরোনাম ‘নিষিদ্ধশয্যা’ কেন, এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেওয়া যেমন লেখকের কাজ নয়, আবার একটি উত্তর বের করে সেটাকেই সঠিক বলে দাবি করাও পাঠকের জন্য শোভনীয় নয়। সম্ভাব্য কিছু অর্থ নিশ্চয়ই উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, নিষিদ্ধশয্যা বলতে একজন পতিতার শয্যাকে বোঝায়। সামাজিকভাবে বিবাহবহির্ভুত যৌনশয্যা মূলত নিষিদ্ধ আর যেহেতু উপন্যাসে এ ধরনের যৌনতার সাথে জড়িত মানুষদের জীবনযাপন এবং জীবনসংগ্রামের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে, নারীদের পতিতা বানানো পুরুষদের চরিত্রের ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে, তাই উপন্যাসের এ নামকরণ করা হতে পারে। দ্বিতীয়ত, নষ্ট সমাজের কারিগরগণ যে শয্যা পেতে বসেছেন সমাজে, যে শয্যার কারণে সমাজের পরতে পরতে দুর্নীতি, অন্যায়, অনাচারের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যে শয্যার কারণে ক্ষমতার বলি হতে হয় সাধারণ মানুষকে, সে প্রতীকী শয্যাকে ইঙ্গিত দিতে পারে এ ‘নিষিদ্ধশয্যা’। আরও গভীরভাবে উপন্যাসটি অধ্যয়ন করলে আরও আঙ্গিক থেকে নিষিদ্ধশয্যাকে ব্যাখ্যা করা সহজ হবে।
পরিশেষে বলা যায়, প্রতিশ্রুতিশীল কথাসাহিত্যিক জব্বার আল নাঈম ‘নিষিদ্ধশয্যা’ উপন্যাসে সমাজের না-বলা অন্ধকারকে চিত্রিত করেই ক্ষান্ত হননি বরং এ অন্ধকার থেকে উত্তরণের যে আকাঙ্ক্ষা এবং প্রয়াস, সেই ক্ষীণ আলোকবর্তিকারও অবতারণা করেছেন। ক্ষমতার দর্পে চুরমার হয়ে যাওয়া স্বপ্ন ও জীবনকে ভিন্ন জানালা দিয়ে পাঠককে দেখিয়েছেন। উপন্যাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায় যেমন অন্ধকার জগতের খতিয়ান বর্ণিত হয়েছে তেমনই নিভৃত ও ক্ষীণ আলোর আগমনবার্তাও রয়েছে চোখে পড়ার মতো।
আলোচক: কথাসাহিত্যিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
এসইউ/এমএস