তাইজুল ইসলামের গল্প: ঋণ
প্রচণ্ড ক্লান্তি নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় পলাশ। দোকানে আজ সারাদিন বড্ড খাটুনি গেছে। শরীরটা তাই ভীষণ ক্লান্ত। তার ওপর স্ত্রী রান্না করেছে গরুর মাংস। উদরপূর্তি খেয়ে এখন চেপে ধরেছে হাই প্রেশারটাও। ঘুম আসছে না কিছুতেই। এপাশ-ওপাশ করে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করছে। রাত তখন অনেক। টিকটিক করে এগিয়ে চলছে ঘড়ির কাঁটা। ফজরের আজানের আর ঘণ্টা দেড়েক বাকি। চোখ দুটো এবার লেগে আসে। ঘুমটা ধরেছে এতক্ষণে।
ভীষণ অদ্ভুত দেখতে একটা জন্তু পলাশকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। পলাশ ছুটছে। বিস্তৃত মাঠ। কাঁটাওয়ালা ঝোপঝাড়। সেসবের তোয়াক্কা না করেই ছুটছে। লুকোবার জায়গা নেই। সামনেই জলডাঙা। বাঁচতে হলে এই জলডাঙাও পেরোতে হবে তাকে। কিন্তু এটা কি? জলের কোথাও শীতে গা কেটে আসে, আবার কোথাও পুড়ে যাচ্ছে। এ-ও হয়? এসব ভাবারও ফুরসত নেই পলাশের। তাকে ছুটতে হবে। অঙ্ক সংখ্যা ‘এক’র মতো লেজ ও মুখওয়ালা জন্তুটি তাকে তাড়া করেই চলছে। অদ্ভুত! জন্তু নয়, যেন একটা সংখ্যা তাকে তাড়া করছে। ধীরে ধীরে সংখ্যাটা বড় হয়। শঙ্কা হয়।
জলডাঙা ছাড়িয়ে আবারও মাঠ। পলাশ আর ছুটতে পারে না। হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। প্রাণ ওষ্ঠাগত তার। যেন নিশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসে। সংখ্যার মতো দেখতে জন্তুটা দানবীয় হয়ে ওঠে। বিস্তীর্ণ এক ছায়ার তলে পড়ে থাকে পলাশ৷ কপাল ঘামছে। শরীরময় অসহনীয় অস্থিরতা। ছায়াটা ক্রমশ ঝুঁকতে ঝুঁকতে চলে আসে চোখের কাছে। এই যেন পুরে নিলো তাকে!
হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে পলাশ। লাফিয়ে ওঠে তার স্ত্রী। প্রচণ্ড ঘামছে সে। ভয়ে কাঁপছে গা। তার স্ত্রী বেশ বুঝতে পারে, পলাশ দুঃস্বপ্ন দেখেছে। দুঃস্বপ্ন? পলাশ ভাবতে থাকে। স্ত্রী তাকে পানি এনে দেয়। সে পানি পান করে ভয়চাপা কণ্ঠে বলতে শুরু করে স্বপ্নের কথা। স্ত্রী তাকে বোঝায়, এসব কিছু না। নেহায়েত দুঃস্বপ্নই হবে। হয়তো তাই-ই হবে। কিন্তু পলাশের মন মানতে চাইছে না। সে স্পষ্ট দেখেছে, একটা সংখ্যাই তাকে জন্তু সেজে ভয়ংকরভাবে তাড়া করেছে।
মসজিদ থেকে ভেসে আসছে মুয়াজ্জিনের সুমধুর সুর—‘হাইয়্যা আ’লাস সালাহ, হাইয়্যা আ’লাল ফালাহ’। পলাশের হঠাৎ মনে হলো নামাজ পড়ে এলে মনটা ভালো লাগবে। বিছানা ছেড়ে তৈরি হয় নামাজের জন্য। মসজিদে যেতেই একটা প্রশান্তি ভর করে মনে। শান্ত কোমল বাতাসে শীতল হয় শরীর-মন। ফরজ নামাজ শেষে অন্যদের মতো বসে থাকে পলাশও। প্রতিদিনের মতো ইমাম সাহেব আজও মিম্বরে উঠে বসলেন। ‘ন্যূনতম ঋণও পরিশোধ না করার ভয়াবহতা’ সম্পর্কে বলতে বলতে হঠাৎই তুললেন ব্যবসায়ীদের প্রসঙ্গ।
‘ঊনিশ টাকা রিচার্জ করে বিশ টাকা রেখে দেওয়া, নিরানব্বই টাকা রিচার্জ করে একশ টাকা রাখা, খুচরোর অজুহাতে এক টাকা নেই বলে ফিরিয়ে দেওয়াটাও অনেক বড় ঋণ। প্রতিদিন এমন অগুনতি এক টাকার সমষ্টি কত হয়? এক মাস, দুই মাস, এক বছর, দুই বছর। কয়েক বছর পর সামান্য এক টাকাই কততে গিয়ে পৌঁছায়? কত বড় ঋণে পরিণত হয় সেই খেয়াল কি রাখি? পরিচিতের ঋণ তবু শোধ করা যায়, অপরিচিতের?’
ইমাম সাহেবের কথা শুনে পলাশের গায়ে কাঁটা দেয়। বুকের ভেতর ভর করে অনুশোচনা। সেই অনুশোচনা জল হয়ে গড়িয়ে পড়ে চোখের কোণ বেয়ে।
লেখক: শিক্ষার্থী, সম্মান ৪র্থ বর্ষ, ইংরেজি সাহিত্য বিভাগ, সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ, গোপালগঞ্জ।
এসইউ/এমএস