ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

আনি আরনক্স: আত্মজীবনীর নতুন রূপকার

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ১২:৫০ পিএম, ১৩ অক্টোবর ২০২২

রত্না মাহমুদা

গত ৭ অক্টোবর ঘোষিত এ বছরের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী আনি আরনক্স। তিনি একজন ফরাসি লেখক ও সাহিত্যের অধ্যাপক। ১৯৬৬-১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্যারিসে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে গড়ে ওঠে কর্মজীবন। লেখালেখিতে মনোনিবেশ করার জন্য শিক্ষকতা ছেড়ে দেন। আনি আরনক্সের জন্ম ১ সেপ্টেম্বর ১৯৪০ সালে ফ্রান্সের নরম্যান্ডির লিলিবোন শহরে। লিলিবোনের কাছাকাছি ইভেটোতে বেড়ে ওঠা। বাবা-মা শহরে একটি মুদিখানা ও একটি ক্যাফে চালাতেন। ফলে শ্রমিক-শ্রেণির জীবন সংগ্রাম খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তার আলমা ম্যাটার ফ্রান্সের রুয়েন বিশ্ববিদ্যালয় ও বোর্দো বিশ্বদ্যিালয়। তিনি মূলত ‘আধুনিক ফরাসি সাহিত্য’ পড়েছেন।

ঔপন্যাসিক আনি আরনক্স আত্মজীবনীমূলক রচনায় সিদ্ধহস্ত। যা সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বিরাশি বছরের এ লেখক শিল্প-সাহিত্যকে পুঁজি করেই সমগ্র ফরাসি জাতিসত্ত্বার মূল্যবোধকে জাগিয়ে তোলার প্রত্যয়ে অনবরত লিখছেন। জীবনের চরম সত্যকে স্বীকার করা ও পাঠকমহলে উপস্থাপন করা আপোসহীন লেখক পরিচয় বহন করে। মানুষ সমাজে বসবাস করে, মানুষই সমাজের নিয়ম-নীতি প্রবর্তন করে। মানুষ-শিল্প-সমাজ-সাহিত্য প্রত্যেকটির সঙ্গে রয়েছে সামগ্রিক যোগসূত্র। যাপিত জীবনের ঘটনাগুলো জনসম্মুখে আনার মত দুঃসাহস একমাত্র লেখকেরই থাকে। যা আনি আরনক্স করে দেখিয়েছেন।

নোবেল বিজয়ী এ লেখকের সাহসিকতা হয়ে উঠেছে বর্তমান অধিকার সচতেন নারীদের প্রতিচিত্র—বিশেষ করে যে নারীরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, পারিবারিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, দাম্পত্য-কলহ, প্রেম-ভালোবাসার ভাঙা-গড়ার কাহিনি ব্যক্তিজীবনে কতটা প্রভাব পড়ে। মানুষের জীবন পথের বাধা হয়ে মানুষকে বিষণ্নতায় ডুবিয়ে মারে। ‘ক্লিনড আউট’ তার প্রথম বই। যা ১৯৭৪ সালে প্রথম প্রকাশিত। এ ছাড়া দ্য ইর্য়াস (২০০৮), লে প্লেইজ (১৯৮৩), অ্যা উইম্যান স্টোরি (১৯৮৮), অ্যা গালর্স স্টোরি (২০১৬), হ্যাপেনিং (২০০১), সিম্পল প্যাশন (১৯৯১), আই রিমেন ইনডার্কনেস (১৯৯৮), গেটিংলস্ট (২০২২), এক্সটেরিয়র্স (১৯৯৬), শেইম (১৯৯৫), দ্য পজেশন (২০০৮), অ্যা ফ্রোজেন উইম্যান (১৯৯৪) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

নোবেল পুরস্কার প্রদানকারী সুইডিশ একাডেমি বলেছে, ‘৮২ বছর বয়সী আনি আরনক্স ফ্রান্সের নরম্যান্ডি শহরের পটভূমিতে নিহীত বইগুলো ‘সাহস এবং ক্লিনিকাল তীক্ষ্মতার’ জন্য স্বীকৃত।’ নোবেল সাহিত্য কমিটির চেয়ারম্যান অ্যান্ডার্স ওলসন বলেছেন, ‘আরনক্স কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পান না’। আনি আরনক্সের প্রথম বই ‘ক্লিনড আউট’-এ ফ্রান্সে গর্ভপাত বৈধ হওয়ার আগে তার নিজের গর্ভপাত সম্পর্কে লেখা ছিল। জীবনের চরম সত্যকে স্বীকার করে তিনি অবশ্যই অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। যিনি দীর্ঘকাল নিজেকে যাচাই করেছেন, যাপিত জীবনের ঘটনাই হয়ে উঠেছে সমাজের দর্পণ।

তিনি এমন জিনিস সম্পর্কে লেখেন, যা অন্য কেউ লেখেন না। নিজের গর্ভপাত, ঈর্ষা, একজন প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকা হিসেবে তার অভিজ্ঞতা সবার সামনে মেলে ধরেন। তিনি নিজেও বলেছেন জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কঠিন সত্য। তিনি আরও বলেছেন, ‘ঘটনাগুলো সত্য ও আকর্ষণীয়’। তার মতে, ‘নারী পুরুষের সমতা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি’। ২০১৬ সালে ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত ‘অ্যা গালর্স স্টেরিতে’ কিশোর বয়সে আরনক্সের জীবনে ঘটে যাওয়া যৌন মিলনের বিবরণ, ঘটনাগুলোর পুনর্গঠন, মানসিক প্রভাব, ব্যক্তিগত সত্যকে উপস্থাপন করছেন বিবেকের তাড়নায়। বর্তমানের বহুল আলোচিত নারীবাদী লেখক তিনি। সমগ্র বিশ্বে ও নারী জাতির জন্য সংগ্রাম করছেন তার কলমের জাদুতে। আনি আরনক্স লেখায় স্পষ্টভাবে লেখকের মুক্তির শক্তিকে বিশ্বাস করেন।

ফিলিপ আরনক্সের সঙ্গে ১৯৬৪ সালে বিয়ে হয়—তাদের ‘এরিক’ ও ‘ডেভিড’ নামে রয়েছে দুটো পুত্রসন্তান। ১৯৮০ সালে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে—যা তার ব্যক্তিজীবনকে নতুন মোড়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। ২০০০ সালে অধ্যাপনা পেশা থেকে অবসর নিয়েছিলেন লেখালেখিকে ভালোবসেইে। তার হ্যাপেনিং বইটি একটি চলচ্চিত্রে পরিণত হয়েছিল। চলচ্চিত্রটি ভেনিসের চলচ্চিত্র উৎসবে শীর্ষ পুরস্কার জিতেছে। দ্য ইয়ার্স বইটি ২০০৮ সালে ফ্রান্সে প্রিক্স রেনাউডট এবং ২০১৬ সালে ইতালিতে প্রিমিও স্ট্রেগা পুরস্কার জিতেছিল।

একবছর পর জীবনের সাহিত্যকর্মের জন্য মারগুরাইট ইয়েসেনা পুরস্কারও জিতেছিলেন। ২০১৯ সালে দ্য ইয়ার্স ম্যান বুকার পুরস্কারের জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছে। বিচারকরা এটিকে একটি ‘জেনার-বেন্ডিং মাস্টারপিস’ বলে অভিহিত করেন। বুকারের বিচারকরা বলেছেন, আত্মজীবনীকে একটি নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে। যা বিষয়গত, সূক্ষ্ম-তীক্ষ্ম জীবনের বিশ্লেষণ। ব্যক্তিগত জীবনের খনন। ৩০ বছরের ছোট বয়সের রাশিয়ার পুরুষের সঙ্গে প্রেম, তার পিতা-মাতার মৃত্যু—সবকিছুই জীবনকে নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় তাকে ভাবিত করে তুলেছে।

বিশটিরও বেশি বই তার একক কাজে নিবেদন করেছেন। সাহিত্যের ও সমাজের অন্তর্মুখী ধারায় বিবর্তনের চেষ্টায়। লেখার কৌশল ও শক্তি আসে মনোজগতের সুগভীর চিন্তা থেকে, যা মানবজীবনে প্রতীয়মান হয়। আনি আরনক্স তার লেখায় সে চিত্র অঙ্কন করেছেন।

লেখক: কবি ও গবেষক।

এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন