রাইসুল এইচ চৌধুরীর তিনটি কবিতা
কখনো কি
কখনো কি জানতে চেয়েছো
কেমন আছি আমি?
কেমন করে দিন কাটে আমার!
কেমন করে রাত কাটে আমার!
আমার কষ্টের সাঁওতাল রং
কতটা নিবিড় হয়েছে তোমাকে ভেবে-ভেবে;
বুকের ব্যথাটা বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে;
যাকে আজকাল মরফিনেও থামানো যায় না!
তোমাকে না পেতে-পেতে;
আমার বাসনার রংগুলো হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে
কর্পূরের মতো কোথায় মিলিয়ে গেছে—
কখনো কি জানতে চেয়েছো?
তোমার অপেক্ষায়;
আর কতকাল আমি দাঁড়িয়ে থাকবো?
শিয়রে রাখা ল্যাম্পপোস্টের মতো
আর কতকাল?
কতকাল!
কখনো কি বুঝতে পেরেছো তুমি
কেমন করে বাঁচি আমি!
কেমন করে ঘুমাই আমি!
কেমন করে থাকি আমি
তুমি বিহনে;
আমার বেঁচে থাকা, মরে যাওয়ার চেয়েও অধম;
আমার ঘুমানো, জেগে থাকার চেয়েও বিষম;
আমার থাকা, না থাকার চেয়েও পরম;
কষ্টকর, দুর্বিষহ!
কখনো কি জানতে পেরেছো তুমি?
কখনো!
কখনো কি ভেবেছো আমায়, ভুলে যাবার ভুলে!
মনে করেছো কি একফোঁটা
নিছক ভুলে যাবার ছলে!
জীবনের যতিচিহ্নে বারবার থেমে-থেমে;
আমি এক ভ্যাগাবন্ড হয়ে;
সর্পিল রেখার এই বেনামি জীবনে
আর কতকাল!
আর কত মহকাল!
ঘুরবো পথে-পথে!
দুয়ারে-দুয়ারে!
কখনো কি ভেবেছো তুমি?
কখনো!
২.
বিধ্বস্ত নগরী
নিজেকে এখন মনে হয় এক বিধ্বস্ত নগরী
যেন আততায়ীর আক্রমণে পরাভূত;
হিরোশিমার মতো ধ্বংস্তূপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি অনাদিকাল ধরে
আমার হাত-পা তোমার আঘাতে আঘাতে
গুঁড়ো গুঁড়ো যেন হাওয়াই মিঠাই
নাগরিক কোলাহলে আমি এক পর্যুদস্ত ব্যর্থ মানুষ
প্রতিনিয়ত তোমার লেলিহান শিখা
পোড়াচ্ছে আমার হাঁড়-গোড় রক্ত-মাংস;
তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে—
আমার ডানপায়ের চারুনখে জমেছে
ক্লান্তির চিহ্ন
বৃদ্ধ জিপসির মতো এবড়োখেবড়ো জীবন;
আমার আপাদমস্তক, স্থাবর-অস্থাবর
অবশিষ্ট নেই বুঝি আর কিছু।
তুমি এক ভিনদেশি অপ্সরী
উঁকি দাও বার বার বুকের রেটিনায়
আর কত ক্ষয়ে গেলে বলবে
ক্ষয়েছে এ শহর!
নিজের সাথে কথা বলে
পথ চলতে চলতে
হারিয়েছি পথের দিশা
এ পথ বুঝি শেষ হবে না কভু!
এ শহরে বেওয়ারিশ জীবন,
শেওলার মতো বেড়ে ওঠা
পরগাছা হয়ে বেঁচে থাকা
নামি-দামি হাজারো মানুষের ভিড়ে
আমি এক যাযাবর বেদুইন
ঘুরি পথে পথে—
তোমার অবহেলা অনাদর
বাড়িয়েছে শুষ্ক বুকে মরুভূমির খরা
আর কত জল ঢালি বলো!
এ বুকের পাঁজরে!
কোন পথে হারালে তুমি চাঁদকুমারী!
আমি খুঁজে-খুঁজে হয়রান এই বোবা শহরে
আলোকিত রাস্তায়, অন্ধকার জীবন
তিলে-তিলে পলে-পলে জ্বলছে চোখের কাফন
তোমার পদতলে পিষে যাওয়া আমার এ জীবন
চোখের নোনাজলে ভাসে এ লোকালয়
কংক্রিটের এ চেনা শহরে
অচেনা হলে তুমি দিনে-দিনে
আর কত অপেক্ষার প্রহর
পোড়া এ শহরে!
আর কত!
৩.
অর্থ
আমার কিছু অর্থ চাই
অল্প কিছু অর্থ
কোনো অনর্থ করার জন্য নয়
শুধু একটু বেঁচে থাকার জন্য
অর্থ চাই
যতটুকু হলে প্রাণটা বাঁচে
বুকের খাঁচাটা ওঠানামা করে
ততটুকু অর্থ;
তারচেয়ে বেশি নয়!
অর্থের অভাবে—
দোয়েল চত্বরে দোয়েলের মতো স্থির দাঁড়িয়ে থাকি;
পটলের দোকানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি
দাঁড়িয়ে থাকি মাছের দোকানে
পাঙাশ মাছও যদি কেনা যেত এক টুকরো
বউয়ের পছন্দ—
মেয়ের পছন্দ—
সামান্য চাহিদা
দামি কিছু চায় না তারা
বেশি কিছু চায় না।
আমার কিছু অর্থ চাই
অল্প কিছু অর্থ
শুধু বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু দরকার ততটুকু
তারচেয়ে বেশি নয়
ছেলেটার খুব শখ লেখাপড়ার
পড়ালেখায় যে অনেক খরচ, বলি বার বার
কাগজ কেনার অর্থ নেই
কলম কেনার অর্থ নেই
শুধু আছে তার আবদার।
আমার কিছু অর্থ চাই
অল্প কিছু অর্থ
আলিশান জীবন
বাড়ি-গাড়ি
অট্টালিকা
নাই কিছু দরকার—
বাবা হয়ে সন্তানের মুখ
স্বামী হয়ে স্ত্রীর চোখ
মেয়ের রাঙা বিষাদের বুক
আর দেখতে চাই না।
আমার কিছু অর্থ চাই
এক ফোঁটা অর্থ
যতটুকু হলে মানুষ বাঁচে
সমাজ বাঁচে
দেশ বাঁচে
ততটুকু অর্থ।
এসইউ/জেআইএম