ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

আকবর আলি খান: একজন স্পষ্টভাষী সুবক্তা

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ | প্রকাশিত: ০৩:১৯ পিএম, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

আকবর আলি খান একাধারে সরকারি কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদ, লেখক, সুবক্তা এবং শিক্ষাবিদ ছিলেন। তিনি ১৯৪৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে জন্মগ্রহণ করেন। ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাই স্কুলে বিদ্যালয় জীবন শেষ করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৬১ সালে আইএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে ১৯৬৪ সালে সম্মান ও ১৯৬৫ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।

সরকারি চাকরিতে যোগদানের আগে তিনি কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৬৭-১৯৬৮ সালে তিনি লাহোরের সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৭০ সালে হবিগঞ্জ মহাকুমার এসডিও হিসেবে পদোন্নতি পান। তিনি তার এলাকায় ১৯৭০ সালের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সক্রিয়ভাবে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। ফলে পাকিস্তান সরকার তার অনুপস্থিতিতে তাকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়।

যুদ্ধ শুরুর আগের অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সমর্থন দেন। পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে হবিগঞ্জ পুলিশের অস্ত্র সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সবাইকে মুক্তিযুদ্ধ করতে অনুপ্রাণিত করেন। মুজিবনগর সরকার তখনো প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় অনেক সরকারি কর্মচারী লিখিত অনুমতি ছাড়া অস্ত্র জোগান দিতে অস্বীকার করে। ফলে তিনি নিজহাতে লিখিত আদেশ তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র, খাদ্য ও অর্থ জোগান দেওয়ার আদেশ দেন।

তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তহবিল তৈরি করতে ব্যাংকের ভল্ট থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা উঠিয়ে ট্রাকে করে আগরতলায় পৌঁছে দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য জোগান দিতে গুদামঘর খুলে দেন। পরে আগরতলায় চলে যান। সেখানে যাওয়ার পর সহযোগীদের নিয়ে একটি পূর্বাঞ্চলীয় প্রশাসন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। যার লক্ষ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করা। একই সঙ্গে উদ্বাস্তু শিবিরে যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই শরণার্থীদের সহায়তা করা।

প্রথমদিকে তাদের প্রচেষ্টা ছিল স্বনির্ভর। এপ্রিলে মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর মে মাসে তিনি যোগাযোগ শুরু করেন। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে তাকে সরকারে যোগ দেওয়ার জন্য কলকাতায় যেতে বলা হয়। সেখানে তিনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ডেপুটি সেক্রেটারি বা উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। আগস্ট মাসে তাকে উপসচিব হিসেবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর দেশের স্বাধীনতা লাভ করা পর্যন্ত তিনি এ পদেই চাকরি করেছেন।

স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং সচিবালয়ে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। সেখানে ৬ মাস চাকরি করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান থেকে ফেরত মানুষকে চাকরি পেতে সহায়তা করেন। পরে তাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতায় যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। তবে পদত্যাগপত্র জমা দিলেও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। তাকে অবসর না দিয়ে শিক্ষকতা করার জন্য ছুটি দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যে ‘রাজাকার’ চিহ্নিত করা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধু তখনকার শিক্ষামন্ত্রীকে ডেকে এ বিষয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দেন। শিক্ষামন্ত্রী এ দায়িত্ব আকবর আলি খানকে হস্তান্তর করেন। রাজাকারদের জন্য তখন একটি আইন প্রচলিত থাকায় সে আইনের অধীনে এ তদন্ত সম্ভব নয় বলে নির্দেশানুযায়ী তদন্ত প্রতিবেদন পরিবেশন করে তার অসন্তোষের কথা উল্লেখ করেন।

পরে তার নোটসহ তদন্ত প্রতিবেদন তখনকার রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে গেলে তিনি বিষয়টি বুঝতে পারেন। তিনি শিক্ষামন্ত্রীকে ডেকে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়ে বলার পরামর্শ দেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘যখনই যা আমার কাছে পছন্দ বা আইনসিদ্ধ মনে হয়নি আমি লিখিত নোট দিয়েছি এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা বলছে যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা গৃহীত হতে বাধ্য।’

আকবর আলি খান কমনওয়েলথ বৃত্তির জন্য মনোনীত হওয়ার আগে অল্প সময়ের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। বৃত্তির জন্য তিনি কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেখানে অর্থনীতি বিভাগে মাস্টার্স এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৯ সালে দেশে ফেরার পরে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। তাকে আবারো প্রশাসনের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়।

১৯৮৪ সালে তিনি সাভারের বিপিএটিসিতে মেম্বার ডাইরেক্টিং স্টাফ (এমডিএস) হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৭ সালের আগ পর্যন্ত পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন সচিবালয়ে কাজ করেন। তিনি ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাসে মিনিস্টার (ইকোনমিক) পদেও যোগ দেন। ঢাকায় ফিরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগে অতিরিক্ত সচিব পদে যোগ দেন। তার সময়ে বিসিসিএল ব্যাংকের পুনর্গঠন এবং বেসিক ব্যাংক অধিগ্রহণের কাজ করেন।

অল্প সময়ের জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে কাজ করে ১৯৯৩ সালে সরকারের সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে অর্থ সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০০১ সালে বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বিকল্প কার্যনির্বাহী পরিচালক (অল্টারনেটিভ এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর) পদে যোগদান করেন। বিশ্বব্যাংকে ২০০২ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কাজ করেন।

বিশ্বব্যাংক থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর গভর্নমেন্ট স্ট্যাডিজ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা হয়েছিলেন। পরে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন না হওয়ার আশঙ্কায় তিনজন উপদেষ্টার সঙ্গে পদত্যাগ করেন। এ ছাড়াও তিনি রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন।

২০১০ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন টেলিভিশন টক শোতে উপস্থিত হয়ে দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার জন্য জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের উন্নয়ন করতে হলে সাম্প্রদায়িকতা বন্ধ করতে হবে।’ তিনি আরও মনে করেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আজ দেশ থেকে নির্বাসিত। মানুষকে ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করার কোন তাৎপর্য নেই।’ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে তিনি বলেছেন, ‘সংবিধান মানুষের জন্য, মানুষ সংবিধানের জন্য নয়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।’

জীবনের বর্ণিল কর্মকাণ্ডের মধ্যে নিমগ্ন থেকেও আকবর আলি খান দেশের ঐতিহাসিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তন ও অগ্রগতি নিয়ে গবেষণা করছেন। একই সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়েও গবেষণা করছেন। তার বই ‘হিস্টোরি অব বাংলাদেশ’ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশ করেছে। বইটিতে তিনি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক-সামাজিক উত্থান ও পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করার পাশাপাশি দেশে ইসলাম ধর্মের বিকাশ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার অর্থনীতিবিষয়ক বই ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’তে তিনি সরস ও প্রাঞ্জল ভাষায় অর্থনীতির জটিল বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করেছেন।

তার বই ‘Some Aspects of Peasant Behaviour in Bengal : A Neo-classical Analysis’ ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘Discovery of Bangladesh’ বইটি। ‘জীবনানন্দ দাশের কবিতা’ প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালের বইমেলায়। এর বিষয়বস্তু বনলতা সেনসহ কবি জীবনানন্দ দাশের অনেকগুলো কবিতার আলোচনা। তিনি জনপ্রশাসন বিষয়ের ওপর ইংরেজি ভাষায় ‘গ্রেশাম’স ল সিনড্রোম অ্যান্ড বিয়ন্ড, অ্যান অ্যানালাইসিস অব দ্য বাংলাদেশ ব্যুরোক্রেসি’ নামে একটি বই রচনা করেছেন। এটি ২০১৫ সালে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড প্রকাশ করেছে।

স্পষ্টভাষী এই মানুষ গত ৮ সেপ্টেম্বর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে যাওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সেই তিনি মারা যান। হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে রাত ১০টায় মৃত ঘোষণা করেন। তার মৃত্যুর পর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ‘আকবর আলি খানের অর্থশাস্ত্রের ওপর গবেষণা অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং সেখান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। তিনি ১৭টি বই রচনা করেছেন। এ বইগুলো খুবই উন্নতমানের গবেষণাধর্মী বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞানে এ গ্রন্থগুলো বিশেষ অবদান রেখে চলছে। কোটা সংরক্ষণ নিয়ে তার একটি গবেষণাধর্মী বই রয়েছে, যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত মূল্যবান।’

তথ্যসূত্র
১. সাক্ষাৎকার
২. Dr. Akbar Ali Khan, BRAC University
৩. লেখক পরিচিতি, ইউপিএল বুকস
৪. বিডি নিউজ
৫. জাগো নিউজ

এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন