ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

ভোরের সামনে দাঁড়িয়ে

খান মুহাম্মদ রুমেল | প্রকাশিত: ০২:০৫ পিএম, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

অনেক দিন পর ভোর দেখছি।
অনেক দিন না, আসলে অনেক বছর পর। মাত্র ফজরের নামাজ শেষ হয়েছে। পুব আকাশে এখনো ঝুলে আছে আবছা অন্ধকার এবং একটি তারা। কী যেন নাম তারাটার? জানি না! এসব জানে তো রাই। এখন আর রাইকে ফোন করে জিজ্ঞেস করার উপায় নেই—তারার নাম কী! হয়তো সে এখন গভীর ঘুমে বিভোর। অথবা কে জানে, রাইও হয়তো এখন ভোর দেখছে! হয়তো দেখে নিয়মিতই। কী আশ্চর্য! ঘুরেফিরে এখানেও রাই চলে আসছে ভাবনায়। অথচ এই নরম সুন্দর ভোরে আমি রাইয়ের কথা ভাবতে চাই না মোটেও।

আকাশটা ধীরে ধীরে ফর্সা হচ্ছে! নির্দিষ্ট একটি জায়গায় সূর্য উঠছে না। তার বদলে পুব আকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে কমলা রঙের ছোপ ছোপ আলো। তার সঙ্গে মাঝে মাঝে কালচে রঙের মেঘের পোচ। যেন মনোরম এক পেইন্টিং আঁকছে কেউ নরম তুলিতে। আকাশ মেঘলা। শেষরাতের দিকে হয়তো বৃষ্টি হয়েছিল। বারান্দা দিয়ে চোখে পড়ে নিচের জলজমা পথ। স্ট্রিট লাইটটা এখনো নিভে যায়নি। তার আলোয় চকচক করছে জমে থাকা বৃষ্টিজল। বাতাসে জলজ গন্ধ। সুনসান রাস্তায় হেঁটে চলেছেন দুয়েকজন নামাজ ফেরত মানুষ। ভোরের এই সময়টা যেন ধরে রেখেছে অপার্থিব গাম্ভীর্য। আশাপাশেই কোথাও কেউ সুর করে কোরআন তেলাওয়াত করছেন, ‘ফাবি আইয়্যি আ-লা-ই রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান—আমার কোন কোন নেয়ামতকে তুমি অস্বীকার করবে?’ খুব ভালো লাগে শুনতে। বারান্দার পাশের ঝাঁকড়া নিম গাছটার দিকে চোখ পড়ে। পাতায় পাতায় লেগে আছে বৃষ্টির জল। ছোট্ট একটা পাখি বসে আছে ডালে নিশ্চুপ। নাম জানি না তার। বড় ভালো লাগে আমার। এই পাখির নামটাও রাই বলে দিতে পারতো। অবশ্যই পারতো! সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা করে। কিন্তু এই পবিত্র, নরম, বিশুদ্ধ সকালকে নিকোটিনের ধোঁয়ায় বিষাক্ত করতে ইচ্ছা করে না। তার চেয়ে বারান্দায় বসে থাকি চুপচাপ। বাতাস বইছে—শীতল।

হঠাৎ মনে পড়ে এক অপরূপ ভোরের কথা। বরিশাল গিয়েছি লঞ্চে করে রাশেদের সঙ্গে। তার বোনের বাড়ি। সদরঘাট থেকে যাত্রা করে রাতের পেটে সওয়ার হয়ে বরিশাল টার্মিনালে যখন নামছিলাম—তখনো এমন ভোর নেমেছিল। কে জানে হয়তো সেই ভোর আরও সুন্দর ছিল। শেষরাতের দিকে লঞ্চ যখন চরমোনাই ঘাটে ভিড়েছিল, আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছিল রাশেদ।
দোস্ত ওঠ। বাইরে আয়।
ঘুম জড়ানো চোখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে কেবিন থেকে বের হতেই দু’চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল তীব্র কুয়াশা। যেন আমরা হারিয়ে গিয়েছিলাম সাদা মেঘের দুনিয়ায়। সেটা কি মাস ছিল এখন আর মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, ঢাকায় তখন বেশ ভালোই গরম ছিল। আর আমাদের সঙ্গে কোনো গরম কাপড় ছিল না। কিন্তু সেই কুয়াশায় আমাদের খুব শীত লাগছিল। মাত্র সাত কি আট মিনিট লঞ্চ দাঁড়িয়েছিল চরমোনাই ঘাটে। ঘুমভাঙা চোখে নেমে যাচ্ছিলেন যাত্রীরা। তারপর মুহূর্তেই হারিয়ে যাচ্ছিলেন কুয়াশার ভেতর। এরপর লঞ্চ ছেড়ে দিলে আমরাও ঢুকে যাই কেবিনের ভেতর। ঘণ্টাখানেক পর লঞ্চ গিয়ে ভেড়ে বরিশাল ঘাটে। আর সবাই নেমে যাওয়ার একটু পর ধীরেসুস্থে নেমেছিলাম আমি আর রাশেদ।

নেমেই আমরা পড়েছিলাম একটা নতুন দিনের, নতুন সূর্যের জন্মের সাক্ষী হওয়ার মুহূর্তের মুখোমুখি। যতদূর মনে পড়ে বরিশাল লঞ্চঘাটটা দক্ষিণমুখী। অর্থাৎ ঘাটের দক্ষিণমুখে প্রসারিত নদী। আর উত্তর প্রান্তে বিস্তৃত বরিশাল শহর। তো, সেদিন লঞ্চ থেকে নেমেই ঘাটের পন্টুনে দাঁড়িয়ে মাথার উপরের দিকে ডানপাশে দেখেছিলাম ডিমের কুসুম রঙের সূর্যটাকে। আধাসেদ্ধ ডিমের কুসুম যেমন গাঢ় কমলা রঙের হয়, সেদিনের সূর্যের রংটাও ছিল তেমন। নদী পাড়ের কুয়াশা ভেদ করে সূর্যটা উঠে আসছিল একটু একটু করে। নদীর ঘোলা জল সূর্যের আলোয় কমলা রং ধারণ করেছিল। অপরূপ সেই সৌন্দর্য দেখে মনে হচ্ছিল—সার্থক হলো বরিশাল আসা। ঠিক একই রকম এক সূর্য দেখেছিলাম এক বিকেলে নরসিংদীর রায়পুরার বিলে নৌকায় ফেরার পথে। মোহময় আলোয় সোনারং রূপ ধারণ করেছিল পুরো এলাকা। আমরা ফিরছিলাম শামসুর রাহমানের গ্রাম পাড়াতলী থেকে। কী যে সুন্দর, কী মনোহর ছিল সেই রূপ। বিলের জল কেটে কেটে এগিয়ে চলছিল আমাদের ইঞ্জিনের নৌকা। ভটভট শব্দ খুব অসহ্য লাগছিল। মাঝিকে বললে কিছুটা অনিচ্ছা নিয়ে ইঞ্জিনটা বন্ধ করে দেয়। আর তখন চোখে পড়ে বিলের পাড় ধরে দৌড়াচ্ছে সাত বছরের একটি ছেলে! ছেলেটি কেন দৌড়াচ্ছিল কে জানে? এত বছর পরও আমার মাঝে মাঝেই সেই ছেলেটির কথা মনে পড়ে। কত অপ্রয়োজনীয় স্মৃতি যে জমা হয়ে থাকে আমাদের মাথায়! খুব অদ্ভুত লাগে মাঝে মাঝে।

রাশেদ এখন কোথায় আছে কে জানে? অনেক দিন হলো কোনো খোঁজ পাই না। বছর কয়েক আগে শুনেছিলাম রুমানিয়া চলে গেছে সে। তারপর সেখান থেকে ঘুরতে ঘুরতে পর্তুগাল, ফ্রান্স হয়ে শেষমেশ কোথায় ঠাঁই গেড়েছে কেউ বলতে পারে না। বন্ধুরা সব হারিয়ে যাচ্ছে একে একে। নাকি আমিই হারিয়ে যাচ্ছি—কে জানে? প্রায় কারোর সাথেই কোনো যোগাযোগ নেই। হয়তো এমন হতে পারে, বন্ধুরা সবাই এখনো যুথবদ্ধ হয়ে আছে আগের মতোই। হয়তো এখনো একসঙ্গে উদ্দাম জোছনায় ভাসে তারা। একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজে। সবাই মিলে ছুটির দিনে হু্ল্লোড় করতে যায় কোনো সুন্দর জায়গায়। আমিই হয়তো শুধু ছিটকে পড়েছি—বৃন্ত থেকে, বৃত্ত থেকে।

অনেক বছর পর আজ মনে পড়ছে মনির কথা। আমার কলেজ জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু কামরুল হাসান মনি। এইচএসসির পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি আমরা। তখন তো মোবাইল ফোন, ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপের যুগ ছিল না। ফলে কলেজের শেষদিনে একটা ডায়েরিতে সবাই সবার ঠিকানা লিখে নিয়েছিলাম। কথা দিয়েছিলাম নিয়মিত চিঠি লিখবো। কিন্তু এই এত বছরে একটা চিঠিও লেখা হয়নি কাউকে। আসেওনি কারো কাছ থেকে কোনো চিঠি। ঠিকানা লেখা খাতাটাও হারিয়ে গেছে সেই কবে! মনির সঙ্গে সবশেষ দেখা হয়েছিল চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার রাতে তূর্ণা নিশীথা ট্রেনে দেখা হয়ে যায় মনির সঙ্গে। তারপর দুজনে একসঙ্গে যাওয়া। আমার পাশের সিটে ছিলেন এক বয়স্ক লোক। তাকে অনেক অনুরোধ করে সিট বদল করেছিলাম। তারপর দুই বন্ধুর পাশাপাশি যাত্রা। সেটি ছিল আমার এবং মনি দুজনেরই প্রথম চট্টগ্রাম যাত্রা।

ভোরবেলা চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে নেমে শাটল ট্রেন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়। সারাদিন পরীক্ষা দিয়ে আবার শহরে ফেরা। আমার ছিল সন্ধ্যার বাসের টিকিট কেনা। মনির কীভাবে ফেরার কথা ছিল মনে নেই। তবে সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে বাস কাউন্টারে গিয়ে দুজনে মিলে অনুরোধ করি, ‘ভাই আমার এই টিকিটটা বদলে রাতের শেষ বাসের টিকিট দিন। আর একটা না, দুইটা টিকিট নিতে চাই আমরা।’ বাস ছাড়তে মাত্র বিশ মিনিট বাকি, কাউন্টারের লোক এই সময়ে টিকিট বদলে দিতে রাজি হন না। আমরাও গাঁইগুঁই করতে থাকি। এমন সময় বাসের অপেক্ষায় বসে থাকা এক মহিলা, কাউন্টারের লোকটাকে বলেন—বাচ্চা ছেলেপেলে চাইতেসে। দেন না টিকিটটা বদলে! কী মনে করে লোকটাও আমাদের টিকিট বদলে দেন। সেই মহিলাকে একটা ধন্যবাদও দেওয়া হয়নি তখন। জীবনে এমন কতো জায়গায় কতো অপরিচিত, অচেনা মানুষের ভালোবাসা, সহমর্মিতা যে আমি পেয়েছি তার হিসাব নেই! শুধু পেলাম না রাইয়ের কাছ থেকে। ছি! আবারও রাইয়ের কথা ভাবছি? আমি তো নিজেকে কথা দিয়েছি, রাইকে কথা দিয়েছি—আর কখনো ভাববো না তার কথা। সে রাতে টিকিট বদলের পর আমি আর মনি দুই বন্ধু টো টো করে ঘুরে বেড়িয়েছি চট্টগ্রাম শহর। গিয়েছিলাম শুলক বহর। অনেক খুঁজে পেতে বের করি রবিন ভাইয়ের বাসা। রবিন ভাই তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রির ছাত্র। শুলক বহরে বন্ধুরা মিলে একটা বাসা ভাড়া করে থাকেন। তার এখানে গোসল টোসল করে ফ্রেশ হই। রাতে একটা রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খাওয়ান রবিন ভাই। মাঝরাতে বাসে উঠেই ঘুমে নেতিয়ে পড়েছি। রাতে হঠাৎ বৃষ্টি নামে অঝোর ধারায়। আমার প্রচণ্ড শীত লাগতে থাকে। মনি আমাকে একটি বড় তোয়ালে দিয়ে পেচিয়ে ধরে শীত কমানোর চেষ্টা করেছিল। আহারে, কী মায়াময় ছিল, কী আনন্দের ছিল, কী স্বপ্নময় ছিল সে দিনগুলো।

শেষরাতে বাস আমাদের নামিয়ে দিয়েছিল ঢাকায়। ফার্মগেট মোড়ে নেমে আমি আর মনি বসেছিলাম ওভারব্রিজের গোঁড়ায় একটি নড়বড়ে কাঠের চৌকিতে। দিনের বেলা ফার্মগেটের ফুটপাতে কাপড়-চোপর বিক্রি করেন যেসব হকার, তাদের কোনো একজনের চৌকি ছিল সেটি। অত রাতেও ফার্মগেট মোড় সুনসান নীরব ছিল না। এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন রাতজাগা কিছু মানুষ। একটার পর একটা গাড়ি চলে যাচ্ছিল সাঁই সাঁই করে। উত্তরবঙ্গের দিক থেকে আসছিল সবজি বোঝাই ট্রাক, পিকআপ। সেসবের পেছনে রুদ্ধশ্বাসে ছুটছিল উঠতি বয়সের কিছু কিশোর এবং বয়স্ক মানুষ। ত্রিপল অথবা নীল প্লাস্টিকে ঢাকা পর্দা টেনে উঠিয়ে নেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা তাদের—কাঁকরোল চিচিঙ্গা, ঝিঙে জাতীয় সবজি। আমরা দুই বন্ধু জড়োসড়ো বসে থাকি কাঠের চৌকিটায়। আমি তখন থাকি বেগুনবাড়ি এলাকায়। আর মনি ওইদিনই চলে যাবে জামালপুর। কিন্তু এই শেষরাতে দুজনের কেউই সেখান থেকে সরতে সাহস পাই না।

ঘণ্টাদুয়েক বসে বসে মশার কামড় খাওয়ার পর সকাল হতে শুরু করে। মনি প্রস্তাব দেয়—চল, সংসদ ভবনের দিকে যাই। তেজগাঁও কলেজের সামনে থেকে রিকশা নিয়ে দুজন সংসদ ভবন এলাকায় যাই। যখনকার কথা বলছি, তখন সংসদ এলাকা এখনকার মতো নিরাপত্তায় ঘেরা ছিল না। অনায়াসে বিনা বাঁধায় চলে যাওয়া যেত মূল ভবনের একেবারে সামনের সিঁড়ি পর্যন্ত। রিকশা থেকে নেমে সেই সকালেও আমরা দেখেছিলাম সংসদ ভবন এলাকায় মানুষের ভিড়। বেশিরভাগ মানুষ আসছেন স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়ম মাফিক হাঁটায়। আর কিশোরী থেকে শুরু করে মধ্য বয়স পেরিয়ে যাওয়া কিছু নারী চোখে পড়েছিল—যারা কেউ কেউ ক্লান্ত পায়ে বাড়ির পথ ধরেছেন। কেউ কেউ বিবশ ভঙ্গিতে হাত-পা এলিয়ে বসে আছেন ফুটপাতে অথবা রেলিঙে। কী উদাস তাদের দৃষ্টি। কাউকে আবার দেখছিলাম সমানে খিস্তি করে চলেছে। কাদের উদ্দেশ্যে এই বকাবকি—কে জানে! সেদিন বেশিক্ষণ ছিলাম না আমরা। অল্প সময় পরই বাড়ির পথ ধরেছিলাম। যাওয়ার বেলায় বলেছিলাম—একজন অপরজনকে, বন্ধু চিঠি দিস। আর চিঠি লেখা হয়নি আমাদের। আর দেখাও হয়নি। শুনেছি মনি এখন জামালপুর কোর্টের বড় উকিল। রাজনীতিতেও নাম লিখিয়েছে।

আরেকটি ভোরের কথা মনে পড়ছে আজ। সেটিও ছিল শেষরাত পেরিয়ে ভোর দেখার গল্প। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার কালে কাপ্তাই লেকে বেড়াতে গিয়ে ঝড়ের কবলে পড়েছিলাম আমরা। সেই ঝড়ে নৌকা থেকে লাফ দিয়েছিল আমাদের বন্ধু মাসুম। পানি-টানি খেয়ে জেরবার অবস্থা হয়েছিল তার। হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা-টিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল। এ ছাড়া লাফ দিয়েছিল আরও একটি মেয়ে। তার নাম আজ আর মনে পড়ছে না। পা ভেঙে গিয়েছিল মেয়েটির। না, মনে পড়েছে। ওর নাম ছিল সুমি। তিনটা সুমি পড়তো আমাদের সঙ্গে। এরমধ্যে ওকে ডাকতাম যশোরের সুমি। কী ভয়ানক অবস্থা। একসঙ্গে পড়েছি পাঁচ বছর। তবুও আজ এক সহপাঠীর নাম মনে পড়ছিল না! এত সব ঝক্কি-ঝামেলা দেখে মিলটন স্যার ট্রিপ ক্যানসেল করে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। সন্ধ্যার পর রাঙ্গামাটি থেকে রওয়ানা দিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরেছিলাম শেষরাতে। মামুন স্যার দাঁড়িয়ে ছিলেন কলা ভবনের সামনে। আমাদের রিসিভ করার জন্য। সঙ্গে দেলোয়ার স্যার, আশফাক স্যারসহ আরও বেশ কয়েকজন। আমাদের দলে থাকা মেয়েদের সবাইকে নিজ নিজ হলে পৌঁছে দিয়েছিলেন স্যাররা। যেসব মেয়ে হলে থাকতো না, তাদের স্যারদের বাসায় রাখা হয়। রাতের বেলা অভিভাবক ছাড়া কাউকে ছাড়েননি স্যাররা। রাই কেমন করে যেন স্যারদের চোখের আড়াল হয়ে গিয়েছিল। সবাই চলে যাওয়ার পর আমি যখন হলের দিকে হাঁটা শুরু করেছি—পেছন থেকে মিহি স্বরে, ছোট্ট করে ডেকে উঠেছিল, ‘পাভেল?’ পেছন ফিরতেই দেখেছিলাম কলা ভবনের পুব দিকের গেটের কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রাই। শেষরাতের জোছনার আলো কৃষ্ণচূড়ার ফাঁক গলে পড়ছে তার চোখেমুখে। মুখ জুড়ে তৈরি হয়েছে অপরূপ সব নকশা!
তুমি যাওনি? অবাক জিজ্ঞাসা আমার।
গেলে কি আর এখন তোমার সামনে দেখতে? পাল্টা প্রশ্ন রাইয়ের।
রাতের বাকি সময়টুকু আমরা কাটিয়ে দিয়েছিলাম ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ার বারান্দায় বসে। রাতের নির্জন ক্যাম্পাসে হঠাৎ আমার হাত ধরেছিল রাই। সেটা কি আবেগে নাকি কোনো কারণে ভয় পেয়ে—বুঝতে পারিনি সেদিন। বুঝি না আজও। তবে সেদিন ভোরের আলো ফোটার আগে আগে রাইয়ের ঘাড়ে একটা চুমু খেয়েছিলাম। রাই কি মনে করেছিল কে জানে? অবাক চোখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। তবে এরপর বেশ কিছুদিন রাইকে দেখলে লজ্জায় লাল হয়ে যেতাম আমি। কিন্তু সেই ভোরের, সেই কাণ্ড নিয়ে রাই কোনো কথা বলেনি কোনো দিন। আস্তে আস্তে আমিও স্বাভাবিক হয়ে যাই। তবে সেই ভোরকে, সেই ভোরের স্মৃতিকে সযতনে নিজের মাঝে রেখে দিয়েছি বছরের পর বছর।

রাইয়ের যেদিন বিয়ে হয়ে যায়; সেদিন আমি ছিলাম বান্দরবান। নতুন চাকরি পেয়েছি সবে। বান্দরবান পোস্টিং। মোবাইল নেটওয়ার্ক তখন পার্বত্য এলাকায় খুব সহজ বিষয় ছিল না। এক কাকডাকা ভোরে আমার বান্দরবানের ডেরায় হাজির হয়ে খবরটা দিয়েছিল তুহিন। যে ভোরে তুহিন আমার কাছে পৌঁছায়, তার আগের রাতেই নাকি বিয়ে হয়ে গেছে রাইয়ের! সব শুনে নিথর-নিস্তব্ধ আমি প্রশ্ন করি—কাল রাতে বিয়ে হয়ে গেল, তুই আজকে এলি কেন?
তুহিনের পাল্টা প্রশ্ন ছিল—আগে এলে কী করতি?
তাই তো আগে এলে কী করতাম! কী করার ছিল আমার?
সেই ভোরে খুব কুয়াশা ছিল। দুহাত সামনের জিনিসও দৃষ্টিতে আসে না—এমন তীব্র কুয়াশা।

এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন