সাকি সোহাগের গল্প: টান
‘রুদ্র, বাবা রুদ্র, শুনতে পাচ্ছো? রুদ্র ও রুদ্র।’ বলে সেই অনেকক্ষণ ধরেই ডাকছিল রুদ্রর বাবা জুনায়েদ সিদ্দিক। একটা সময় এসে বাড়িওয়ালার স্ত্রী তাদের ফ্লাটের দরজা খুলে জুনায়েদকে বলেই উঠলেন, ‘বাবা জুনায়েদ, রুদ্রর বয়স তো সবেমাত্র ন’মাস। তোমার ডাকে কি ও সাড়া দিতে পারবে? বউমাকে ডাকছো না কেন?’
জুনায়েদ মাথায় হাত বুলিয়ে কাচুমাচু করে কিছু একটা বলতে যাবে; ঠিক তখনই রেহানা দরজা খুলে দেয়। জুনায়েদের আর কিছু বলা হয়ে ওঠে না। লজ্জায় হুড়মুড় করে নিজেদের ফ্লাটে ঢুকে পড়ে। জুনায়েদ কিছু না বললেও বাড়িওয়ালার স্ত্রী অনেকটাই জানে মূল ঘটনা। কারণ তিনি শুধু বাড়িওয়ালার স্ত্রীই নন। জুনায়েদ ও রেহানার গার্ডিয়ানও বলা যেতে পারে।
দোতলায় মাত্র দুটি ইউনিট। একটিতে বাড়িওয়ালা আব্দুস সাত্তার তার পরিবার নিয়ে থাকেন। অন্যটিতে জুনায়েদরা থাকে। নিচতলা গোডাউন। সেটাও ভাড়া দেওয়া। দোতলায় দুটি পরিবার থাকায় বেশ মিল তাদের মধ্যে। জুনায়েদ যে ভাড়াটিয়া, সেটি বাড়িওয়ালা মনেই করেন না। নিজের ছেলের মতো ভাবেন। কারণ আব্দুস সাত্তারের কোনো ছেলে নেই। শুধু দুটি মেয়ে। জুনায়েদের কাছ থেকে বাসা ভাড়াও নিতে চান না। জুনায়েদ ইচ্ছে করেই দেয়। সকালে অফিসে গেলে রেহানা বাড়িওয়ালার স্ত্রীর কাছে গিয়ে সারাদিন গল্প করে। তাকে খালামণি ডাকে। তাই রেহানার সাথে যে জুনায়েদের একটু খুনসুটি হয়েছে, তা অজানা নয়। তবে এবারের খুনসুটিতে রেহানা একটু বেশিই রেগে গিয়েছিল। অনেক কিছু বলে ফেলছে জুনায়েদকে।
ঘটনাটি মূলত একদিনের নয়। প্রায় চার দিন হয়ে গেলেও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি। রেহানার সাথে সরাসরি কথা বলে না জুনায়েদ। সব কথা নয় মাসের ছেলের মাধ্যমেই হয়, ‘রুদ্র তোমার আম্মুকে বলো জমানো টাকা থেকে একহাজার টাকা দিতে। প্রয়োজন আছে আজ।’
‘কী করবে টাকা তুমি?’
‘রুদ্র তোমার আম্মুকে বলো প্রয়োজন আছে আমার। অফিসে দেরি হচ্ছে। দ্রুত দিতে বলো।’
‘এই নাও টাকা। আর বস আপনার ছেলে সবেমাত্র নয় মাসের শিশু। সে আপনার কথা শুনছে না, উত্তরও দিচ্ছে না জেনেও তাকেই কেন বারবার বলছেন? আমাকে চোখে পড়ে না?’
রেহানার মুখে মিষ্টি হাসি থাকলেও জুনায়েদ সেদিকে খেয়াল করে না। ছেলেকে আদর করে রেহানার কোলে দিয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে বলল, ‘রুদ্র দরজা লাগিয়ে দাও বাবা।’
রেহানা মুচকি হাসলেও একটু পরেই সে হাসি ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কেন এমন করছে জুনায়েদ? এতটা রাগ সে এর আগে কখনোই করেনি। মাঝেমাঝে একটু ঝামেলা হলে দু’জনই মীমাংসা করে নেয়। এই ছোট ঝামেলাটা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না জুনায়েদ। ভুল না হয় রেহানাই করেছে; তাই বলে গত চারটা দিন ধরেই এভাবে চলবে? এটার কোনো মানে হয়?
জুনায়েদ মধ্যরাত পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে মোবাইল টিপছিল। রেহানা অনেক চেষ্টা করেও কথা বলাতে পারছিল না। একটা সময় রুদ্রকে বিছানার একপাশে কোলবালিশ দিয়ে শুইয়ে দিলো। বিছানার মাঝখানে এসে জুনায়েদকে জড়িয়ে ধরে। গালে কামড় দেয়। বুকের ওপর মাথা দেয়। হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নেওয়ার জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু জুনায়েদ কিছুতেই নরমালে ফিরছিল না। একসময় জুনায়েদ উঠে গিয়ে পাশের রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। শুধু ঘুমায়নি রেহানা। বাকি রাতটুকু কেঁদে পার করেছে। জুনায়েদ যে এতটা সিরিয়াস হবে জানলে কথাটা রেহানা বলতো না। তা ছাড়া রেহানা কি মন থেকে অমন কথা বলতে পারে? সে তো রাগে মুখ ফসকে অমন কথা বলে ফেলেছে। পরের দিন রেহানা খালামণির সাথে বিষয়টি শেয়ার করে। তিনি বলেন, ‘অফিস থেকে ফিরে তোমাকে না ডাকা পর্যন্ত দরজা খুলবে না। রুদ্রকে যতই ডাকুক।
ফলে জুনায়েদ যখন নিজের ছেলেকে এত করে ডেকে যাচ্ছিল; তখন রেহানা দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। অপেক্ষায় ছিল ওর নামটা জুনায়েদের মুখে শোনার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য।
রেহানা। পুরো নাম রেহানা তাবাসসুম। বাবার তিন মেয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে সেনাবাহিনীর এক সৈনিকের সাথে। বিয়ের পরদিন সে চলে যায় ক্যাম্পে। কারণ ছুটি শেষ হয়ে আসছিল। বিয়েটা হয়েছে শুধু বাড়ির আশেপাশের লোকজনের উপস্থিতিতে। একদম হুট করে। রেহানার বাবার বেশ মন খারাপ হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে বিয়েটা দেয়। ছেলেটা বেশ ভালো। দেখতে শুনতে ও পারিবারিকভাবেও ভালো।
পাড়ার অনেক লোকের কথা শুনতে হয়েছিল রেহানার বাবাকে। সেগুলো হজম করে ফেললেও নিজের আত্মীয়-স্বজনের কথা হজম করতে বেশ কষ্ট হয়ে দাঁড়াতো। ‘বড় মেয়েকে কেউ এভাবে বিয়ে দেয়? কত টাকা লাগতো নিজের আত্মীয়-স্বজনদের খাওয়াতে? সরদার টাকা চেনে।’ কিন্তু সত্যিকার অর্থেই রেহানার বাবা জলিল সরদার টাকাকে পরোয়া করেন না। জীবনে অনেক টাকা কামিয়েছেন। এখনো পেনশন পান। আসলে বিয়েটা হয়েছে হুট করে, এটা কাকে বোঝাবে? মানসিকভাবে একটু ধাক্কা খায় মানুষটা। নিজেকে একটু গুটিয়ে নেয় সবার থেকে। মনে মনে পরিকল্পনা করেন, মেজ মেয়ের বিয়েতে পুরো গ্রামসহ সব আত্মীয়-স্বজনকে খাওয়াবেন। দেখিয়ে দিতে চান, সরদার টাকাকে পরোয়া করেন না। সেই অপেক্ষায়ই ছিলেন প্রায় ছয় বছর। তারপর মেজ মেয়ের অনার্স শেষ হলে জলিল
সরদার মেয়ের বিয়ের জন্য ছেলে খুঁজতে থাকেন। যদিও রেহানা তখনো বিয়ে করতে রাজি নন। কারণ তার মাস্টার্স শেষ হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, জুনায়েদ তখনো বেকার। অন্যদিকে বাবার বয়সও বেশ জমিয়ে নিয়েছে দেহটাকে। একদিন খাবার টেবিলে তো রেহানা বলেই বসলো মাকে, ‘মা আমার তো মাস্টার্স শেষ হয়নি।’
‘বিয়ের পরেও শেষ করা যাবে।’
‘বোঝার চেষ্টা করো। অন্ততপক্ষে একটা চাকরি জোগাড় করি। তারপর না হয়...’
‘আমরা চাকরিজীবী ছেলের সাথেই তোর বিয়ে দেব। তোকে চাকরি করতে হবে না।’
জুনায়েদের মুখচ্ছবি ভেসে উঠলো মনের দেওয়ালে। গলা দিয়ে ভাত আর নামলো না। প্লেটেই হাত ধুতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে বাবা আসেন, ‘খাবার নষ্ট করিস না মা। খেয়ে নে।’
‘খাব না আর। ভালো লাগছে না। তোমরা আমার কথা কেউ শুনছো না।’
‘মা রে জানিস তো, আমি ছাড়া তোদের আর কেউ নাই। আমি চাচ্ছিলাম আমি বেঁচে থাকা অবস্থায়ই অন্ততপক্ষে তোর একটা ব্যবস্থা করে যাই। হয়তো তোদের ছোট বোনের বিয়েটা আমি দিয়ে যেতে পারব না। তার আগেই চলে যেতে হবে। তাই ভাবছিলাম...’
‘বাবা কেন বুঝতে চাচ্ছ না? আর মাত্র দুইটা বছর!’
বাবার মুখের ওপর এই প্রথম বোধহয় এতটা উচ্চস্বরে কথা বললো রেহানা। বাবা একদম চুপ হয়ে গেলেন। অনেকটা অবাক হয়েছেন তিনি। নিজের মেয়ে এত জোর দিয়ে কথা বললো তার সামনে? ছোটবেলায় আঙুলে সুতি কাপড় পেচিয়ে যে মেয়ের মুখ পরিষ্কার করে দিতো; সেই মেয়ে ওই মুখে এত জোর দিয়ে কথা বললো? কষ্টে বুকটা কেঁপে ওঠে। খুব ইচ্ছে ছিল তার, মেজ মেয়ের বিয়েটা বেশ জাঁকজমক করে দেবেন। বেশ আনন্দ করবেন। মানুষকে দেখিয়ে দেবেন। তা বোধহয় আর হলো না। স্ত্রী পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘তুমি একদম টেনশন করবে না। ছোট মেয়ে তাই এমন করেছে। ভালো একটা ছেলে পেলে ও ঠিক পছন্দ করে ফেলবে।’ কথাটা অনেকটা স্বস্তি এনে দেয় জলিল সরদারকে। তার মতে, পৃথিবীতে নারী জগতে মায়ের পরের স্থান যে নারীর; সে স্ত্রী। মা জন্ম দেন, স্ত্রী বাবা ডাক শোনান।
কথাটা শুনেই জুনায়েদ প্রায় রেগে ওঠে, ‘আরে ধুর, কী বলো এসব রেহানা? কীভাবে সম্ভব তুমি বলো? না পড়াশোনা শেষ হয়েছে, না জব আছে! বোঝাও তোমার বাবাকে।’
‘আমি অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু উনি বিয়ে দিবেই। সো তুমি প্রস্তাব রাখো বাবার কাছে।’
‘ধুর! তুমিও বুঝতেছ না। বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য নুন্যতম যে যোগ্যতাটুকু লাগে সেটা কি আমার
আছে? অন্ততপক্ষে একটা কর্ম তো থাকা লাগতো। আমার তো তাও নাই।’
‘প্লিজ জুনায়েদ! কিছু একটা করো। তোমাকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে ভাবতেও পারি না।’
শুধু রেহানার বাবা বলেই কথাটা নয়! প্রতিটি মেয়ের বাবাই চান ছেলে অন্ততপক্ষে একটা কিছু করুক। এরকম একটি বেকার ছেলের সাথে কীভাবে নিজের মেয়েকে বিয়ে দেবেন? সুতরাং জুনায়েদকে না বলে দিয়েছেন রেহানার বাবা। অন্যদিকে সেদিনই মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন একটি সরকারি চাকরিজীবী ছেলের সাথে। আগামী সপ্তাহেই বিয়ে। বেশ ধুমধাম করে বিয়েটা দেবেন জলিল সরদার। এদিকে কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না রেহানা। তখন রেহানা মায়ের কাছে বলে দেয় জুনায়েদের সাথে তার রিলেশনের কথা।
কথাটি শোনার পরই জলিল সরদার বুকে হাত দিয়ে বসে পড়েন। বুক ডলতে ডলতে সোফায় বসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। পাত্রপক্ষকে কথা দেওয়া হয়েছে। মোটামুটি অনেককে বলাও শেষ। কী করবে ভেবে পাচ্ছিলেন না। মেয়েকে ডেকে পাঠাতে গিয়ে জানা যায়, রেহানা বাসায় নেই। সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন জলিল সরদার।
জলিল সরদার যখন হাসপাতালে হবু জামাইয়ের হাত ধরে কাঁদছিলেন; তখন রেহানা জুনায়েদের পিঠে দু’হাত রেখে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। বিয়ে সম্পন্ন করে দূরে চলে যাওয়ার জন্য বাসে ওঠে ওই রাতেই। সারারাত জুনায়েদের হাতটা শক্ত করে ধরে ছিল রেহানা। সকালে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় গিয়ে নামে। টানা তিন দিন হোটেলেই থেকেছে ওরা। কিন্তু এভাবে কয়দিন? পকেটের অবস্থাও তো বেশ একটা ভালো নয়।
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই নাকি সন্ধ্যা হয়, এ কথা যেমন সত্য; তেমনই সত্য নতুন পথের শুরুটা হয় চলতি পথের শেষ থেকেই। পতেঙ্গা সাগর পাড়ে একটি মেয়ের সাথে বেশ ভালো খাতির হয় রেহানার। বেশ জমিয়ে আড্ডা হয় মেয়েটার সাথে। জুনায়েদ যখন চিন্তামগ্ন সাগরের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে; তখন রেহানা মেয়েটার সাথে খলখল করে হেসে ওঠে। সবকিছু শোনে মেয়েটা। মেয়েটার নাম তন্নি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, রেহানা ও জুনায়েদের মতো ওরাও একই ঘটনা ঘটিয়েছিল। প্রায় চার বছর পর ছেলে নানার দরজায় গিয়ে ‘নানা’ বলে ডাক দিতেই তন্নির বাবা দরজা খুলে দেন। তারপর নাতিকে কোলে নিয়ে সে কী কান্না। পুরো এলাকার মানুষকে ডেকে নাতিকে দেখিয়েছেন। সাথে দারুণ একটা ভোজের ব্যবস্থাও করেছিলেন। যদিও তন্নির সাথে তখনো কোনো কথা বলেননি। তবে জামাইয়ের আদর কমতি রাখেননি তন্নির বাবা।
রেহানা ও জুনায়েদ তন্নির বাবা আব্দুস সাত্তারের বাসায় ওঠে। বাসা ভাড়া নেওয়া তো দূরের কথা, প্রায় একমাস খাওয়ারও খোঁজ রেখেছেন তন্নির বাবা। একমাস বাদে জুনায়েদের কর্ণফুলী ইপিজেডে চাকরি হয়। চাকরির পরও দুই মাস বাসা ভাড়া দেয়নি জুনায়েদরা। তারপর থেকে প্রতিমাসে নিজের ইচ্ছেমতো ভাড়া দিয়েছে। অফিস থেকে ফেরার সময় রেহানার জন্য কিছু কিনলে বাড়িওয়ালার ছোট মেয়ের জন্যও তা কিনে নিতো জুনায়েদ। খালামণি বেশ খুশি হতেন। বাসায় ভালো কিছু রান্না হলে প্রায় অর্ধেকটা পাঠিয়ে দিতো বাড়িওয়ালার ইউনিটে। বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরি হয় তাদের সাথে।
রেহানা বাসা থেকে পালিয়ে আসার পর থেকেই জলিল সরদার বেশ অসুস্থ। বাবা-মায়ের সাথে কথা না হলেও ছোট বোনের সাথে মাঝেমধ্যেই কথা হতো রেহানার। প্রায় দুই বছর পর রেহানা অন্তঃসত্ত্বা হলে মা একদিন বড় মেয়ের বাসায় ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে রেহানার বাসায় আসেন। মেয়েরা ছাড়া কেউ জানে না বিষয়টা। দুদিন থেকে মেয়েকে দেখে আবার চলে যান। অন্যদিকে প্রায় দুই বছর থেকে মেয়েকে না দেখা মানুষটা মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারেন না। তারও যে মেয়েকে দেখতে মন চায়। এটা সে কাউকেই বলতে পারেন না। অন্য কেউ মেয়েকে দেখার কথা বললে উল্টো রেগে যান। রাগটা যে উপরে উপরে সেটাও কেউ বুঝতে চায় না। আড়ালে একা একা কাঁদেন মেয়েটার জন্য।
আগের থেকে বেশ অসুস্থ জলিল সরদার। রেহানার যে ছেলে হয়েছে, সেটি অনেক পরে জেনেছেন জলিল সরদার। যেদিন শুনেছেন; সেদিন বিছানায় শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। সব লাজ-লজ্জা ভুলে নাতিকে দেখার আহ্বান জানান। রুদ্রর কথা শুনে ভেতরে ভেতরে বেশ চাঙা হয়ে উঠেছেন।
রেহানাকে খবরটা দেওয়া হলে ওরা দুজনই বেশ খুশি হয়। পরিকল্পনা করে তিনদিনের ছুটি নিয়ে বৃহস্পতিবারই বাড়িতে যাবে। সাথে বাড়িওয়ালার ছোট মেয়ে রিম্পিকেও নিয়ে যাবে। আনন্দে ভেতরটা ভরে ওঠে জুনায়েদের। নিজের আর ছেলের পাঞ্জাবির সাথে ম্যাচিং করে রেহানার জন্য শাড়ি কেনে জুনায়েদ। মূল ঘটনা আসলে এখানেই। শাড়িটা রেহানার পছন্দ হয়নি। এতদিন পর বাড়িতে যাবে, নিজের মনের মতো করে একটু কাপড় পরে যাবে না? জুনায়েদ যখন জানে রেহানা শাড়িটা পছন্দ করেনি। তখন সে শাড়িটা নিয়ে পাশের রুমে ঢোকে। একটু পরে কুচিকুচি করে কেটে নিয়ে বের হয়। রেহানার শাড়িটা পছন্দ না হলেও জুনায়েদ যখন কিনে ফেলছে, সে পরতে পারতো। কিন্তু যখন শাড়িটা এভাবে কেটে এনে রেহানার সামনে রেখেছে, রেহানা তো রাগে আগুন। অনেক বকাঝকা করলো স্বামীকে। জুনায়েদ বেশ শান্ত প্রকৃতির মানুষ। এতগুলো কথা বলার পরেও কিছুই বলেনি রেহানাকে। যাচ্ছেতাই বলে বকাঝকা করেছে জুনায়েদকে। শাড়িটা যখন কিনেই ফেলছো, তা আবার কাটতে গেলে কেন? একপর্যায়ে রাগে রেহানা বলে ফেলে, ‘আজকের পর থেকে আমার সাথে আর কথা বলবি না। যদি কথা বলিস, তোর ছেলেকে গলা টিপে মেরে ফেলব। বলে দিলাম।’
আকাশ ভেঙে মাথায় পড়ল জুনায়েদের। নরম প্রকৃতির মানুষটাও রেগে গিয়ে রেহানার গালে কষে একটা থাপ্পড় মারে। রেহানা জুনায়েদের হাতে কামড় বসায়। কোনোমতে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে আবার কয়েকটা থাপ্পড় মারে। বাসা থেকে বের হয়ে যায়। সে রাতে আর বাসায় ফেরেনি। এর আগেও এমন অনেকবার হয়েছে ওদের মধ্যে। তবে সেটি যখন হয়; তখন থেকে সর্বোচ্চ একটি রাত পর্যন্ত গড়ায়। সকালে ঘুম থেকে তুলে দেয় জুনায়েদকে। নাস্তা বানায় রেহানা। কিন্তু এই ঘটনার প্রায় চারদিন হয়ে গেলেও জুনায়েদ কথা বলে না রেহানার সাথে।
বাড়িওয়ালী খালামণির কথামতো রেহানা রুদ্রকে নিয়ে খালামণির বাসায় ওঠে জুনায়েদ অফিস থেকে আসার আগে আগে। জুনায়েদ বাসায় এসে দরজার হাতলে হাত দিতেই দেখে দরজা খোলা। ভেতরে কেউ নেই। ‘রুদ্র, রুদ্র’ বলার পরও যখন কেউ সাড়া দিচ্ছিল না; তখন রেহানা বলেই ডাক দিলো চারদিন বাদে। রেহানাও নেই। টেনশনে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। কিছুক্ষণ পর চিৎকার করে রেহানাকে ডাকতে শুরু করল। চোখে পানি টলমল করছে। এই বুঝি কেঁদে ফেলবে। খালামণি যখন জানালেন তিনি কিছুই জানে না; তখন জুনায়েদ চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল। সাথে সাথেই রুমের মধ্যে মায়ের কোলে রুদ্রও কেঁদে উঠল।
রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে কে কাকে সরি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। জুনায়েদ একাবার সরি বললে রেহানা জুনায়েদের মুখে হাত রেখে তিনবার সরি বলছে। একসময় দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে। ঠিক তখনই রেহানার ফোন বেজে ওঠে। জুনায়েদ ফোনটা হাতে নিয়ে বলে, ‘ধুর, আর সময় পেল না।’
রেহানার বাবা বেশ অসুস্থ। কিন্তু কালকেও জুনায়েদকে অফিস করতে হবে। জুনায়েদের বসকে কল দিলেও কোনো কথা হলো না। তারপর আবার কল আসে রেহানার ফোনে, ‘আপু, বাবা কথা বলবে তোর সাথে।’
‘বাবা, বাবা, আমি রেহানা, বাবা।’
‘মা, মা, আমার মা, মা তোরে দেখতে মন চায় মা। তোরে মনে হয় একটা নজর আমার আর দেখা হলো না মা। মা, মা গো।’
বারবার বাবার কথায় সাড়া দিলেও জলিল সরদার আদুরে কণ্ঠে মেয়েকে মা বলে ডেকেই যাচ্ছিল। চাকরির কী হবে সেটা পরের ব্যাপার। সে রাতেই জুনায়েদরা রওনা দিলো বাড়ির উদ্দেশে। বাড়িওয়ালা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এসে বাসে তুলে দিয়ে রুদ্রর হাতে দুই হাজার টাকা দেন। গত তিন বছর থেকে ওরা এখানে আছে বাবা-মা ছাড়া। বাবা-মায়ের মতোই বাড়িওয়ালা ও তার স্ত্রী দেখে এসেছেন তাদের। বাসে ওঠার সময় বাড়িওয়ালার পায়ে হাত রেখে সালাম করে জুনায়েদ।
কুমিল্লা এসে বাসের চাকা পাংচার হয়ে গেল রাত তিনটার সময়। ফজরের অনেক পর সেখান থেকে বাস আবার ছাড়ে। ওদিকে রেহানার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। জুনায়েদের মোবাইল নাম্বার শ্বশুরবাড়ির কারো কাছে নেই। ওর ফোনেও তাদের নাম্বার নেই। বাস থেকে নামে বিকেল তিনটায়। তারপর সিএনজি করে আসে কিছুটা পথ। তারপরে বাড়ির পথে চলে রিকশায়। রাতভর জার্নি করে রেহানা প্রায় ক্লান্ত। রুদ্রকে কোলে নিয়ে রিকশায় বসে আছে জুনায়েদ। ততক্ষণে সূর্যটা পশ্চিমাকাশের কোলে হেলে পড়ে জানান দেয় গোধূলি লগ্নের। রিকশা যখন হান্নান মোল্লার মুদি দোকান পার হয়ে মোড় নিয়ে মসজিদের দিকে যায়; তখন দেখা গেল মসজিদের পাশের খোলা মাঠে অনেক মুসল্লি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইমাম সাহেব ‘আল্লাহ আকবর’ বলে শেষ তাকবির দিতেই রেহানা মাথার কাপড়টা টেনে নেয়। জুনায়েদ যখন রিকশা ভাড়া দিচ্ছিল; ঠিক তখনই রেহানার বড় বোন রেহানাকে দেখে চিৎকার দিয়ে ওঠে।
এসইউ/এমএস