ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

সেলিম আল দীনের ‘অমৃত উপাখ্যান’: পাঠ ভ্রমণের কথালিপি

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ১০:০১ এএম, ১৮ আগস্ট ২০২২

অধ্যাপক ড. মো. ছানোয়ার হোসেন

নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনী জেলার সেনেরখীল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮ আগস্ট ২০২২ এই নাট্যকারের ৭৩তম জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে তাঁকে শ্রদ্ধা ও স্মরণ করছি তাঁর রচিত ‘অমৃত উপাখ্যান’ উপন্যাসের শিল্পরূপ ও বিষয় বিশ্লেষণের মাধ্যমে।

‘দ্বৈতাদ্বৈত’ শিল্পতত্ত্বের প্রবর্তক নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন তাঁর ‘অমৃত উপাখ্যান’-এ ব্যক্তিগত জীবনের এক ঘটনাচিত্র উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেন, ‘কখনও আত্মজীবনীতে আমার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের লুপ্ত অংশগুলো যদি প্রকাশিত হয় তবে এ গল্পের উৎসাভাস পাঠকরা পাবেন নিশ্চয়ই’। আবার লেখক এই উপন্যাসকে ‘উপাখ্যানের লক্ষণযুক্ত’ বলে মনে করেছেন। এজন্যই তিনি তাঁর এই উপন্যাসের শুরুতেই বলেছেন, ‘উপাখ্যান হচ্ছে বিকেলের আলোয় মর্ত-পৃথিবীর উল্টা ছায়া। আঁধারের পাঁচ আঙ্গুল’। একই সঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, ‘উপাখ্যান হলো-বলতে বলতে মধ্যরাতে-কালীগঙ্গার ঢালুতীর-নেশাকর ধোঁয়া বাস্তবে মিশে গুপীযন্ত্রের সাথে হাত ধরাধরি করে নাচে’।

আবার এই উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র হাসান এবং এলিজার কথোপকথনে ঔপন্যাসিক সেলিম আল দীন উপাখ্যান সম্পর্কে বলেছেন, ‘অনেক পুরোনো-সত্যি বা মিথ্যা গল্প-তাকে বলে উপাখ্যান’। লেখক জীবনের একমাত্র উপন্যাস ‘অমৃত উপাখ্যান’র কাহিনি ও শিল্পশৈলী বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর শিল্পীসত্তার পরিচয় বর্ণিত হলো।

মনজুরুল হাসান হাসু এবং এলিজার প্রেম কাহিনি ‘অমৃত উপাখ্যান’ উপন্যাসটির মূল উপজীব্য। এই উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র হাসান একজন টেলিভিশন প্রডিউসার বা প্রযোজক। নবীন প্রযোজক হিসেবে বিতর্ক অনুষ্ঠান, আলোচনা অনুষ্ঠান প্রযোজনা করাই তার কাজ। একদিন টেলিভিশন স্টুডিওতে এক বিতর্ক অনুষ্ঠান ক্যামেরায় ধারণ করার সময় এলিজা চুপচাপ বসেছিল দর্শকসারিতে। ক্যামেরাম্যান কৌতূহলবশত এলিজাকে একাধিকবার ক্লোজশটে ধারণ করে। প্যানেলে বসে এলিজার সেই দৃশ্য হাসান অবলোকন করে আনন্দ মনে। শুধু তাই নয়, ক্যামেরার ক্লোজশটে মেয়েটির ছবি দেখার পর হাসানের মনে ‘এক অনামা নীলবর্ণ নদী রেখা’ তৈরি হয়।

অতঃপর শহরের একটি গানের দোকানে ক্যাসেটে গান রেকর্ডিং করতে গিয়ে হাসান ও এলিজার মধ্যে পরিচয় হয়। এই পরিচয় থেকেই ক্রমে তাদের মধ্যে রোমান্টিক প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। শেষ পর্যন্ত এলিজার আত্মহত্যার মধ্যদিয়ে এর কাহিনি সমাপ্ত হয়।

প্রেমের এই দৃশ্যপটের সঙ্গে হাসানের কল্পনা ও জীবন বাস্তবতার বিচিত্র ঘটনা এবং নানা চরিত্রের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং সুখ ও দুঃখ চিত্রিত হয়েছে অমৃত উপাখ্যান উপন্যাসটিতে। কিন্তু সংক্ষিপ্ত এই কাহিনির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে হাসানের বাল্যকাল থেকে শুরু করে কৈশোর ও যৌবনের নানা ঘটনাচিত্র। এই চিত্রপটে বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে শ্রীনট মুখ এবং নটী কুট্টমিতার প্রসঙ্গ। ফলে হাসান ও এলিজার রোমান্টিক প্রেম কাহিনির ভেতর দিয়ে গড়ে উঠেছে শ্রীনট মুখ ও নটী কুট্টমিতার অন্য এক উপাখ্যান। এই উপাখ্যানের নটী কুট্টমিতার মৃত্যু হয়।

উপন্যাসটির শুরুতেই প্রকাশ পেয়েছে পরাণপুরের মৃত এক পাইথন সাপের গল্প। সেই গল্পের পাইথন সাপটি দেখতে হরিদ্রাবর্ণ। চাঁদরাতে পাতা ঝরা গজারি বনে পাইথন সাপটি আপন মনে খেলা করে। ঔপন্যাসিক সেলিম আল দীন পাইথনের এই সত্য গল্পটি বর্ণনা করেছেন হাসানের কণ্ঠে। সেজন্যেই এলিজাকে উদ্দেশ করে হাসান বলে, ‘সত্যি বলি- পরাণপুরের গজারিবন-তার দক্ষিণে-বিসর্পী গাঙের প্রায় তীর ঘেঁষে আমার এ উপাখ্যানের গীত সাপটির কবর রয়েছে’। পাইথন সাপের এই উপাখ্যানের কথা বলতে বলতে লেখক এ উপন্যাসের কথক ও নায়ক চরিত্র হাসানের মানসভাবনায় সুকৌশলে তুলে ধরেছেন এলিজার প্রসঙ্গ। ‘এপ্রিলের হাওয়ায় উড়ছে এলিজাদের ঘরের দীঘল পর্দা। ওর চোখের পাতা বুঝি উপাখ্যানের সেই গজারিবনের পাতা ঝরার শেষে নতুন কচিপাতা’। তার মানসভাবনার এই কথকতা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে হাসানের কল্পনায় বর্ণিত হয় পিঙ্কির শারীরিক সৌন্দর্য। পিঙ্কির সঙ্গে হাসানের প্রেমের সম্পর্ক নেই। শহরের ধনাঢ্য পিতা-মাতার একমাত্র কন্যা পিঙ্কি। হাসান পিঙ্কিদের বাসায় ভাড়া থাকতেন। সুযোগ পেলেই তারা হাসানকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে পিঙ্কিকে হাজির করে অনেকটা নির্লজ্জ্বভাবে আত্মপ্রচার শুরু করে বলতেন, ‘পিঙ্কিকে একবার অডিশনের ব্যবস্থা করে দিন-দেখবেন আপনাদের স্টার মেয়েগুলোর চাইতে কম যাচ্ছে না’।

এভাবে তাদের আত্মপ্রচার ও অতিরঞ্জন আদর আপ্যায়ন হাসানের মনে বিরক্তির উদ্রেক ঘটায়। হাসান লক্ষ করে ‘পিঙ্কির মধ্যে আত্মপ্রচারের আভাস নেই, তার চলাফেরার মধ্যে একটা সম্ভ্রমবোধ’ আছে। স্পষ্টতই উপলব্ধি করা যায় পিঙ্কির মানসিকতা বা জীবনদর্শন তার পিতা-মাতার চাইতে স্বতন্ত্র। অর্থাৎ পিঙ্কির আচরণে ধনাঢ্য পরিবারের চাকচিক্য জীবন যাপনের রীতিনীতি প্রত্যক্ষ করা যায় না। বাবা-মায়ের আত্মগৌরব সে খুব একটা পছন্দ করে না। হাসানের সামনে যখন তার বাবা-মা তাকে নিয়ে অতিমাত্রায় প্রশংসা করতে থাকে তখন সে মনে মনে বিরক্তবোধ করে। এসব কারণেই পিঙ্কিকে দেখামাত্রই হাসানের হৃদয় চত্বরে প্রেমাকাঙ্ক্ষা চিত্রিত হয়। মনের অজান্তেই সে উচ্চারণ করে, ‘পিঙ্কির রেশমের মতো চুল পিঠে ছড়ানো। গাঢ় নীল আর জারুল ফুলের রঙ প্রিন্ট শাড়ি। আমার চোখে ঠান্ডা শীতল হাওয়া লাগে’।

হাসান ও পিঙ্কির স্বপ্ন, কল্পনা ও বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে লেখক তাঁর এই উপন্যাসটিতে একদিকে যেমন হাসানের তাৎক্ষণিক মানসিক ভাবনা প্রকাশ করেছেন অন্যদিকে ঠিক শহরের উচ্চবিত্ত পরিবার ও ব্যক্তি মানসের একটি খণ্ডচিত্র তুলে ধরেছেন অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে।

আবার টেলিভিশন ভবনের ক্যান্টিনে সেভেন-আপ পানরত অবস্থায় হাসান এলিজার পরিহিত পোশাক ও তার শরীরের সৌন্দর্য বর্ণনা করে। এই সময় তার মনের আয়নায় বাতাস বয়ে যায় নটী কুট্টমিতার কথা। সে আপন মনে বলে, ‘কুট্টমিতার গায়ের গন্ধ আমি পেলাম এলিজার মধুস্বাদী ত্বকের নিচে-
চিরকালের রক্তনদীর ধারে ধারে। আমি পুরাণ ও প্রেমকে একপাত্রে আর বিষ মধু গুলে খাই’। এ যেন প্রেমের বিচিত্র ঘটনাচিত্রের সঙ্গে পুরাণ ঘটনার মিশেলে প্রণীত হয়েছে উপন্যাসটির কাহিনি।

নটী কুট্টমিতা চাড়াল পল্লীর নমশূদ্রের মেয়ে। সে সুভদ্রার এক প্রশ্নের উত্তরে বলে, ‘মা খুব সুন্দরী ছিলেন। গত বছর পরগনার ফৌজদারের জন্য ঘোড়সওয়ার বাহিনী মাকে তুলে নিয়ে গেয়েছে’। তার মা আর কখনো ফিরে আসেনি। হয়তো কামার্তু ফৌজদারের সয্যাসঙ্গিনীরূপে সে মিলিয়ে গেছে প্রকৃতির লীলাভূমিতে। মাটির পুতুল তৈরিতে দক্ষ তার পিতার মৃত্যু হয়েছিল ক্ষয়কাশে।

বাবার তৈরি সেই মাটির পুতুলের মতোই পিতৃমাতৃহীন কুট্টমিতার জীবন চলে লীলাযাত্রার আসরে আসরে নাচ, গান আর অভিনয় করে। অভিনয়ে সে স্বতঃস্ফূর্ত, পারঙ্গম। অভিনয় সাধনায়রত কুট্টমিতা ধীরে ধীরে দর্শকদের কাছে হয়ে ওঠে দেবীতুল্য। উপন্যাসটির বর্ণনায় আছে: ‘কুট্টমিতা বারাঙ্গনা পল্লীতে প্রায় নগ্ন হয়েছিল মেঘদূতের অভিনয় কালে। কিন্তু দর্শকবৃন্দ তাকে দেবীর সন্মান দিয়েছিল। সমস্ত নকশা করা গৃহ থেকে পায়ের কাছে এসে পড়েছিল ফুল-তামার পয়সা- চাঁদি’।

এই কুট্টমিতাই সেই কালো মেয়ে, যার কাছে কৈশোর বয়সে হাসান মুরিদ হতে চেয়েছিল। রাতভর গাঁজা খেয়ে শুনিয়েছিল ‘এক সুন্দরীকে- কোনো এক জ্যোৎস্নারাতে কোনো এক পাইথন গিলে ফেলার’ গল্প। কৈশোরের এসব স্মৃতিচিহ্ন হাসানের মন থেকে মুছে যায় না। ক্ষণে ক্ষণে ভালোবাসার প্রিয় মানুষ এলিজার সঙ্গে ফোনে আলাপের সময় তার ভাবনায় ক্রিয়াশীল হয় নটমুখের পুতুল নাচ প্রদশর্নী দেখার অতীত স্মৃতি।

এই স্মৃতি রোমন্থনের মধ্যদিয়েই এলিজার শারীরিক সৌন্দর্য আর কামভোগের স্বপ্নস্বাদ বর্ণনা করে হাসান। কুট্টমিতা এবং শ্রীনটমুখ-এর মুখস্মৃতি বার বার ভেসে ওঠে হাসানের কল্পনায়। মনের অজান্তেই সে বলে, ‘চাড়াল পল্লী ছেড়ে কিশোরী কুট্টমিতা চলে যাক না নটমুখের ময়ূরপঙ্খী নৌকায়’। এরূপ ভাবনা খেলা করে যখন তার মনে ততক্ষণে নটমুখের নৌকা লীলাযাত্রার দল নিয়ে ভুরঙ্গা, করতোয়া ও ব্রহ্মপুত্র নদী পেরিয়ে উপস্থিত হয় সেই বিসর্পী নদীর তীরে। যেখানে পাইথন সাপটির কবর দেওয়া হয়েছিল।

সুভদ্রার মৃত্যুর পর নটমুখের সঙ্গে কাম চরিতার্থ করার জন্য কুট্টমিতা অস্থির হয়ে ওঠে। কাম উত্তেজনায় ক্ষণে ক্ষণে পাগলের মতো আচরণ করে সে। শিল্প আর কাম বাসনা তার দেহমনে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। এভাবে শিল্প সাধনা আর কামখেলায় কুট্টমিতার জীবনস্রোত হঠাৎ থেমে যায় বিসর্পী নদীর তীরে চাড়াল পল্লীর আসরে। হাসানের কল্পনায় যে সামন্তরাজ দরবারে সুভদ্রার নাচ উদ্ভাসিত হয়েছিল, সেই ‘সামন্তরাজ এসে প্রধান-প্রধান অভিনেতা অভিনেত্রীদের তার গৃহে নিয়ে যায় সাদর সম্ভাষণপূর্বক। নৈশ আহারের পর কুট্টমিতা সামন্তরাজের সঙ্গে মদপান করে তার সয্যায় চলে যায়। ফিরে শেষ রাতে’।

কুট্টমিতা নেশার ঘোরে চীৎকার করে, সেই পাইথন সাপের গল্পের মতো গজারিবনে বাঁশির শব্দ শুনে। সেই বাঁশি তাকে আরও মাতাল করে তোলে। একপর্যায়ে ‘নেশাগ্রস্ত কুট্টমিতা কাম উত্তেজনায় জড়িয়ে ধরে নটমুখের শরীর- আশ্লেষে চুম্বনে ভরে তুলে ঘুমন্ত শরীর’। জ্ঞানে অজ্ঞানে অভয়ের মধ্যে কাম উত্তেজনার তৃপ্তস্বাদ রচিত হয়। কিন্তু নেশা কেটে গেলেই উভয়ের মনে অপরাধবোধ জেগে ওঠে। কুট্টমিতা অনুশোচনায় ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। চিৎকার করে সে ছুটে চলে বিশাল গজারি বনের দিকে। পেছন থেকে নটমুখ ডাকে কুট্টমিতাকে। তার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে সে উম্মাদিনীর মতো ছুটতেই থাকে ‘জ্যোৎস্নায় বনের ঝরাপাতা’ মাড়িয়ে। হঠাৎ সে দেখতে পায় গজারি ডালে ঝুলন্ত পাইথন। তার ‘শরীর সোনালি ছোপ চাঁদের আলোয় চিক চিক করে ওঠে। কুট্টমিতা তাকে দেখে চিৎকার করে ওঠে বংশীধারী- নাওতো আমাকে। শূদ্রের জন্ম আমার সার্থক কর। আমি পিতাকে করেছি আমার অঙ্কশায়ী। আমি ধর্মহীনা-পাপিষ্ঠা’। অতঃপর গজারির ডালে অপেক্ষমাণ সেই পাইথনটি গিলে ফেলে কুট্টমিতাকে।

কুট্টমিতা পিতৃতুল্য নটমুখের সঙ্গে কামবাসনা পূর্ণ করার পর তার মনে পাপবোধ সঞ্চারিত হয়। এই পাপবোধ থেকেই পুনরায় সে মদ্যপান করে বলে: ‘ধর্ম আমার হলো না- শিল্পের ঘরে পারলাম না পৌঁছাতে। কাম আমাকে ভাসিয়ে নিলো’।

এরূপ বর্ণনাত্মক দৃশ্যচিত্রের মধ্যদিয়ে হাসান ও এলিজার রোমান্টিক প্রেম এবং শ্রীনটমুখ ও নটী কুট্টমিতার প্রেমলীলার আলোচ্য কাহিনিতে কাম ও শিল্প সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। অর্থাৎ প্রেম, কাম ও শিল্প-এই ত্রিবিধ বিষয়বস্তুর ব্যঞ্জনা অসাধারণ শিল্প সৌকর্যে রূপায়িত হয়েছে ‘অমৃত উপাখ্যান’ উপন্যাসটি।

এতে হাসানের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনের নানা প্রসঙ্গ যেমন আছে, ঠিক তেমনি আছে স্বদেশী আন্দোলনের বৈরীচিত্র। এছাড়া আন্ডার গ্রাউন্ড রাজনীতির জীবন বাস্তবতা, স্বৈরশাসকের শাসন-শোষণ, সামন্তরাজার কামভোগের খণ্ডচিত্র, রক্ষীবাহিনীর হিংসাত্মক কার্যকলাপ, রাজাকার বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ, সমকালীন সমাজ ও রাজনীতির উৎপীড়নের বাস্তব রূপায়ণ প্রত্যক্ষ করা যায় এতে। এতদ্ব্যতীত শাড়ির দোকানের শো-কেশে সাজানো ক্লেশবিহীন নারীর পুতুল প্রতিমা, আধুনিক নগর জীবনের চলমান যানজট, টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের নগ্নচিত্র, তৎকালীন সময়ে টেলিভিশনে ‘হাম্দ ও নাত’ রেকর্ডিং প্রসঙ্গে বাংলা গান নিয়ে উপহাস, সিনেমা হলে কিংবা সুপার মার্কেট প্রাঙ্গণে তরুণ-তরুণীদের শিষ দেওয়া নেওয়ার ইঙ্গিতপূর্ণ আড্ডার কথকতা, শ্রীনটমুখ এবং নটী কুট্টমিতার জীবনবোধ ও শিল্পী জীবনের চলনচিত্র, হাসান ও এলিজার মহোনীয় প্রেম ইত্যাদি প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণিত হয়েছে আলোচ্য উপন্যাসটিতে।

একই সঙ্গে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা, বৈশাখী মেলায় উড়ানো ঘুরি বাওকুড়ানির হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া, লালনের মেলায় একতারা হাতে কালো মেয়ের নাচ ও গান, মাটির পুতুল তৈরি ও পুতুল নাচ, জয়দেবের গীত গোবিন্দ, লীলাযাত্রা বা রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা ইত্যাদি বিচিত্র বিষয় সমন্বিত রূপে ও অসাধারণ কাহিনি নির্মাণ কৌশলে চিত্রিত হয়েছে উপন্যাসটিতে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, বিষয় ভাবনা, ভাষাশৈলী, চরিত্র রূপায়ণ ও রচনা কৌশলের অভিনবত্বের কারণেই এ উপন্যাস স্বতন্ত্র মর্যাদার দাবি রাখে। কেননা এলিজা, শ্রীনটমুখ, কুট্টমিতা কিংবা পিঙ্কির প্রেম ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন দর্শনসহ নানা বিষয় ঔপন্যাসিক হাসানের মানসচেতনায় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করেছেন লেখক তাঁর এই উপন্যাসে। গঠন কৌশলে উপন্যাসটি মধ্যযুগের উপাখ্যান শিল্পরীতির নবরূপ।

লেখক: অধ্যাপক, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/ফারুক/এএসএম