রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পে মনস্তত্ত্ব: শেষ পর্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পটি সাধনা পত্রিকায় ১২৯৯ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। গল্পটির কাহিনি গড়ে উঠেছে একটি গ্রাম্য-দুরন্ত বালককে কেন্দ্র করে। যার নাম ফটিক। গ্রামের কাদা-মাটিতে বেড়ে ওঠা ফটিক একসময় মামার সঙ্গে কলকাতার উদ্দেশে পাড়ি জমায়। মামাতো ভাই ও মামির অসহনীয় আচরণ কলকাতার জীবনকে বিষিয়ে তোলে। গ্রামীণ জীবনে বেড়ে ওঠা ফটিক যতটা আগ্রহ নিয়ে শহুরে জীবনে প্রবেশ করে, ঠিক ততটাই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। জলের মাছকে অনেকটা ডাঙায় রাখার মতো! ছোট থেকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা ফটিক যখন শহুরে জীবনে চার দেওয়ালে বন্দি, তখন তার মন হয়ে ওঠে উচাটন। গ্রামে ফিরে যেতে চায় বারবার। কিন্তু মমার অনুমতি ও স্কুলের ছুটি মেলেনি। তেরো বছর বয়সী ফটিক জীবনের প্রতি কৌতূহলী। মামা বিশ্বম্ভর যখন কলকাতায় এসে পড়াশোনার কথা বলে ফটিক রাজি হয়ে যায়। শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দেওয়া ফটিক গ্রাম এবং শহুরে জীবনে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ। তাই শহুরে জীবন প্রতিনিয়ত অসহ্য হয়ে উঠেছে। গ্রামের পরিবেশে দুরন্তপনার সুযোগ শহরে গড়ে ওঠেনি। এ ছাড়া মামাতো ভাই, স্কুলের সহপাঠীদের কাছ থেকে পেয়েছে অসহযোগিতা। একদিকে মামির স্নেহহীন চোখ অন্যদিকে মায়ের অপার ভালোবাসা থেকে দূরে অবস্থান তার হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টি করে। প্রকৃতি সবসময় কোমল। ফটিক সেই কোমলতার মাঝে বেড়ে উঠেছে। তাই শহুরের রুক্ষতা তাকে মানসিকভাবে দমিয়ে দেয়। সে দমন-পীড়নে প্রকৃতির সঙ্গে একত্ম হয়েছে স্কুলজীবন, মামি, মামাতো ভাই, স্কুলের মাস্টারের মারধর-অপমান। তেরো বছর বয়সী ফটিকের জীবনের রূঢ়তাকে বোঝার মানসিকতা গড়ে ওঠেনি। তাই তো মনের ওপর চাপ নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে, একসময় শারীরিকভাবেও প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে। যার পরিণতি মৃত্যু। স্বাভাবিকভাবেই গ্রামে বেড়ে ওঠা বালকেরা প্রকৃতির মতো চঞ্চল। মায়াময় পৃথিবীর কোলে আপন বিশ্ব গড়ে তোলে সর্বদাই। ফটিকও তাদের ব্যতিক্রম নয় তাই তো শহরের ইট-পাথরের জীবনে প্রতিনিয়ত নাভিশ্বাস ফেলেছে। স্কুলে মাস্টারের কাছে মার খেয়েছে আবার বাড়িতে এসে মামির ভর্ৎসনার শিকার হয়েছে। এক জায়গা থেকে কষ্ট পাওয়ার পর অন্যজায়গায়ও ভালোবাসার বদলে অবহেলা! ফলে মৃত্যুর মধ্যেই অসহনীয় পরিস্থিতির মুক্তি মিলেছে। ‘ঘরের মধ্যে এইরূপ অনাদর, ইহার পর আবার হাঁফ ছাড়িবার জায়গা ছিল না। দেয়ালের মধ্য আটকা পড়িয়া কেবলই তাহার সেই গ্রামের কথা মনে পড়িত।’২৭
শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে মামির অনাদরের কথা ভেবে ফটিক সেখান থেকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। বিশ্বম্ভর বাবু পুলিশের সহায়তায় ফটিককে অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করে। ফটিকের এই আত্মঅভিমান মায়ের প্রতি। নির্বোধ বালক হলেও মা ছাড়া কেউ যে অসুস্থ অবস্থায় তার সেবা করবে না, সেটা উপলব্ধি করে সে কাতর হয়েছে। তাই তো সে মামার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শেষপর্যন্ত। কিন্তু মামার বাড়ি না বরং চিরতরে পৃথিবী থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে। ‘ফটিক আস্তে আস্তে পাশ ফিরিয়া কাহাকেও লক্ষ্য না করিয়া মৃদুস্বরে কহিল, মা, এখন আমার ছুটি মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।’২৮
‘মধ্যবর্তিনী’ গল্পটি জ্যৈষ্ঠ ১৩০০ বঙ্গাব্দে সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একটি পরিবারের দ্বন্দ্বমুখর দাম্পত্য সম্পর্ককে কেন্দ্র করে গল্পটির প্লট গড়ে উঠেছে। গল্পের মূল কাহিনি নিবারণ ও হরসুন্দরীকে ঘিরে। নিবারণ ও হরসুন্দরী স্বামী-স্ত্রী। দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে ঘাটতি না থাকলেও জীবনের কিছু অপ্রাপ্তি দুজনের মাঝে দেওয়াল তুলে দেয়। বিবাহিত জীবনের বহুদিন পার করলেও সন্তান আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয় না। ফলে হরসুন্দরীর মধ্যে বাড়তে থাকে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। ভালোবাসার সেই ধনকে স্বামীকে উপহার দিতে তাই স্বেচ্ছানির্বাসনে যায়। যার করুণ পরিণতির শিকার শৈলবালা। ছোটখাটো একটি মেয়ের সঙ্গে নিবারণের বিয়ে দিয়ে তার অপূর্ণ বাসনাকে বাস্তব করে তুলতে চায় হরসুন্দরী। কিন্তু নিবারণ যখন শৈলবালাকে কাছে টেনে না নেয়, তখন হরসুন্দরীই তাকে চাপ প্রয়োগ করেছে। যখন নিবারণ শৈলবালার প্রতি মমত্ববোধ প্রকাশ ঠিক তখন হরসুন্দরীর মনের অস্থিরতাও বৃদ্ধি পায়। সে নিজের জীবনকে তুচ্ছ ভাবতে শুরু করে। খুঁজে ফেলে স্বামীর হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা। তাই শৈলবালাকে যত কাছে টানতে থাকে নিবারণ, হরসুন্দরী তত দূরে সরে যায়! যেই দূরত্ব আপাত দৃষ্টিতে মনের হলেও নিতান্তই তা অভিমানের—ক্ষোভের! যেই হরসুন্দরী একসময় স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েকে কেন্দ্র করে উঠেপড়ে লেগেছিল সেই ব্যক্তিই শৈলবালার সঙ্গে কড়ি খেলায় ব্যস্ত দেখে চক্ষুচড়ক গাছ!
‘বুড়ো বয়সের এই খেলা বটে! নিবারণ সকালে আহারাদি করিয়া যেন আপিসে বাহির হইল, কিন্তু আপিসে না গিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়াছে। এ প্রবঞ্চনার কী আবশ্যক ছিল। হঠাৎ একটা জ্বলন্ত বজ্রশলাকা দিয়া কে যেন হরসুন্দরীর চোখ খুলিয়া দিল, সেই তীব্র তাপে চোখের জল বাষ্প হইয়া শুকাইয়া গেল।’২৯
শৈলবালার সঙ্গে স্বামীর প্রেমকে কেন্দ্র করে হরসুন্দরীর হৃদয়ে পাড় ভাঙা কষ্ট দেখা দিয়েছে। জীবনের তীরে এসে নোঙর না ভেড়ানোর কষ্ট তাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। বালিকা বধূকে কেন্দ্র করে নিবারণের প্রেম তার চোখে অসহনীয়। দুই শিশু মিলে বিশ্বজগতে খেলা করার আহ্বান জানিয়ে হরসুন্দরী সমস্ত ভার নিজের কাঁধে তুলে নিতে চেষ্টা করেছে। হরসুন্দরীর দ্বন্দ্ব চিরন্তন। নারী জাতি সবার ভাগ দিলেও স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে পারে না। হরসুন্দরীর মধ্যেও আবহমান বাঙালি বধূর চিরন্তন রূপ ফুটে উঠেছে। বাঙালি রমণী পৃথিবীর শত দুঃখ সহ্য করলেও স্বামীকে আগলে রাখতে চায় পরম মমতায়। নিজের আক্ষেপ, দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেয়ছে মানসিকভাবে। শৈলবালার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পথের কাঁটা দূর হয়। কিন্তু স্বামীকে বহুদিন পর আপনার করে পেলেও হৃদয়বৃত্তির কাছে হেরে যায় হর। নিবারণ আর হরসুন্দরীর মাঝে জাগরুক থাকে শৈলবালার মুখ।
‘একদিন গভীর রাত্রে সমস্ত শহর যখন নিদ্রিত নিবারণ ধীরে ধীরে হরসুন্দরীর নিভৃত শয়নকক্ষে প্রবেশ করিল। নীরবে সেই পুরাতন নিয়ম-মত সেই পুরাতন শয্যার দক্ষিণ অংশ গ্রহণ করিয়া শয়ন করিল। কিন্তু, এবার তাহার সেই চির অধিকারের মধ্যে চোরের মতো প্রবেশ করিল।
হরসুন্দরীও একটি কথা বলিল না, নিবারণও একটি কথা বলিল না। উহারা পুর্বে যেরূপ পাশাপাশি শয়ন করিত এখনো সেইরূপ পাশাপাশি শুইল, কিন্তু ঠিক মাঝখানে একটি মৃত বালিকা শুইয়া রহিল, তাহাকে কেহ লঙ্ঘন করিতে পারিল না।’৩০
হরসুন্দরীর মধ্যে আবাহমান বাঙালি রূপ বিদ্যমান। সন্তান না হওয়ার কারণে স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে দিলেও মন থেকে গ্রহণ করতে পারেনি। হয়তো হরসুন্দরীর আশা ছিল স্বামীকে বিয়ে দিলেও তার প্রতি স্বামীর ভালোবাসা-প্রেমে ভাটা পড়বে না। কিন্তু অল্পবয়সী শৈলবালার উচ্ছলতা নিবারণকে এতটাই মুগ্ধ করে যে হরসুন্দরীর সঙ্গে এতদিনের সংসার জীবন ভুলতে বসে। জীবন জটিলতার এক পর্যায়ে শৈলবালার মৃত্যু হলেও মনের দ্বন্দ্বের মৃত্যু ঘটেনি!
(...) ‘মধ্যবর্তিনীতেও মনস্তত্ত্বের জটিল জাল আছে। নিঃসন্তান দাম্পত্য জীবনে অসুস্থ স্ত্রী স্বামীকে দ্বিতীয় বিবাহের অনুরোধ জানাচ্ছে। (...) মধ্যবর্তিনীতে দ্বিতীয় পত্নী শৈলর মৃত্যুর পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যবর্তিনী হয়েই সে বেঁচে রইলো—অনস্তিত্ব অস্তিত্বের অসামান্য প্রয়োগ।’৩১
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রায়শ্চিত্ত’ গল্পটি সাধনা পত্রিকার ১৩০১ অগ্রহায়ণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। গল্পের কাহিনি গড়ে উঠেছে বিন্ধ্যবাসিনী ও তার স্বামী অনাথবন্ধুকে কেন্দ্র করে। ঘরজামাই অনাথ নিজেকে ‘অতিপণ্ডিত’ ভাবে। পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দেয় না। এরপর কলেজ ছেড়ে দেয়। কিন্তু স্ত্রীকে বোঝায়, তার জন্য ‘এ পরীক্ষা নয়’। সে এত কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নয় যে, তাকে কলেজের পরীক্ষায় পাস দিতে হবে। বিন্ধ্যাও স্বামীর কথায় আস্থা রাখে, স্বামীর যুক্তিকেই ‘ধ্রুব’ জ্ঞান করে। তার স্বামী আর দশটা পুরুষের চেয়ে ভিন্ন, সেটা যেন বিন্ধ্যাও আত্মায় লালন করে।
এদিকে অনাথের মধ্যে দেখা দেয় অতি দাম্ভিকতা। একদিকে স্বামীর প্রচণ্ড ধূর্ত স্বভাব, অন্যদিকে স্ত্রীর পতিপরায়ণ-স্বভাব গল্পকে দিয়েছে জটিল মনস্তত্ত্বের ভিন্নমাত্রা। অনাথবন্ধু সরলা স্ত্রীকে পেয়ে ইচ্ছের দাস বানিয়ে রাখে। ঘরজামাই থেকেও স্ত্রীর সঙ্গে আচরণে প্রভুত্ব দেখানোর ক্ষেত্রে কোনো কমতি নেই। আর বিন্ধ্যবাসিনীকে স্বামীর সেই প্রভুত্ব বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিতে দেখা যায়। বিন্ধ্য আবহমান বাংলার নারীর মানসিকতার প্রতীক। রবীন্দ্রনাথ নিজেও নারীর এই বলয় থেকে তাকে বের করে আনেননি বরং পুরুষতন্ত্রের নিগড়ে নিপীড়িত-নিযার্যাতিতের প্রতিভু হিসেবেই তৈরি করেছেন। স্বামীর শত প্রবঞ্চনা-গঞ্জনার বিরুদ্ধে মুখ খোলে না বিন্ধ্য। উল্টো স্বামীকে ঈশ্বর জ্ঞান করে তার পূজায় নিজেকে সদা ব্যস্ত রাখে। বিন্ধ্যর এই পতিভক্তি যতটা ভালোবাসার, তারচেয়েও বেশি মেরুদণ্ডহীন, পশ্চাদপদ মানসিকতার প্রকাশ। নারী-পুরুষের প্রভুত্ব শিকার করে সেখানে যুক্তি-বুদ্ধি কিছুরই উপস্থিতি থাকে না।
পুরুষ সমাজ তাদের সুবিধার জন্য নারীকে নানা শৃঙ্খল পরিয়ে বশ করে রেখেছে। নারীও পতিব্রতা সাজতে গিয়ে সব ধরনের নির্যাতন-অন্যায়কে হাসিমুখে মেনে নেয়। অনাথ যখন শ্বশুরবাড়ির টাকা চুরি করে বিলাত চলে যায়, তখন সেই চুরির দায় বিন্ধ্য নিজের কাঁধে নেয়। কিন্তু কেন? এর জবাব খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবে, সেখানে ভালোবাসার টান যতটা, তারও বেশি নারীর মানসিকতার বৃত্তকে ভাঙতে না পারার ব্যর্থতা। শত সমস্যার সম্মুখীন হলেও নারী তার স্বামীর সম্মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায় না। এর কারণ শৈশব থেকেই নারীর মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় স্বামীর মুখে মুখে কথা বলতে নেই! উচ্চস্বরে হাসতে নেই, নিজের ভাগ বুঝে নিতে নেই। বাবা-ভাই-স্বামীর কথাই শিরোধার্য। তারা পরিবারের কর্তা। তাই তাদের গাইডলাইনের বাইরে গেলেই বিপদ। যদি যুক্তির কথা হয়, তাও নারী সেখানে চুপ থাকবে; এমন মানসিকতা লালন করে নারীরা। তেমনি বিন্ধ্যার মানসিকতা। সেও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নারীর জীবনকে গড়ে তোলা ছকের বাইরের যেতে পারে না। যেতেও চায়নি। বিন্ধ্যের কাছে স্বামী দেবতুল্য। সেখানে পাপ-পঙ্কিলতার ছোঁয়া থাকতে পারে বলে মানতে পারে না বিন্ধ্যা। এখানে বিন্ধ্যার সারল্যই তার জন্য বিনাশ ডেকে আনে।
‘যে বিন্ধ্যা বাপের কাছে কখনো অর্থ প্রার্থনা করিতে পারে নাই এবং যে স্বামীর লেশমাত্র অসম্মান পরমাত্মীয়ের নিকট হইতেও গোপন করিবার জন্য প্রাণপণ করিতে পারিত, আজ একেবারে উৎসবের জনতার মধ্যে তাহার পত্নী-অভিমান, তাহার দুহিতৃসম্ভ্রম, তাহার আত্মমর্যদা চূর্ণ হইয়া প্রিয় এবং অপ্রিয়, পরিচিত এবং অপরিচিত সকলের পদতলে ধুলির মতো লুণ্ঠিত হইতে লাগিল।’৩২
অনাথ তো টাকা চুরি করে বিলাতে চলে গেল কিন্তু একবারও বিন্ধ্যের জীবনে কী ঘটবে, সে কথা মনেও আনেনি। অন্ধ ভালোবাসার কারণে স্বামীর শত অপরাধ অবলীলায় ক্ষমা করে দিয়েছে, যার সুযোগ গ্রহণ করেছে অনাথ। বিলেত থেকে ফিরে আবার বিন্ধ্য’র বাবার সম্পত্তি করায়ত্ত করার চেষ্টা করেছে।
‘এতদিনকার তুচ্ছ জীবনের সমস্ত দুঃখ এবং ক্ষুদ্র অপমান দূর হইয়া সে আজ তাহার পরিপূর্ণ পিতৃগৃহে সমস্ত আত্মীয়-স্বজনের সমক্ষে উন্নতমস্তকে গৌরবের আসনে আরহণ করিল। স্বামীর মহত্ত্ব আজ অযোগ্য স্ত্রীকে বিশ্বসংসারের নিকট সম্মানাস্পদ করিয়া তুলিল।’৩৩
অনাথ এতটাই ধূর্ত যে বিলাতি নারীকে বিয়ে করলেও বিন্ধ্য সে সম্পর্কে কিছু আঁচ করতে পারেনি বা চায়নিও। কারণ তার কাছে অনাথবন্ধু প্রভু। আর প্রভুর শুধু দাসত্ব করা যায়। প্রশ্ন তোলা জায়েজ না। যে কারণে বিন্ধ্য পতিসেবায় ব্যস্ত থাকলেও পতির স্খলন সম্পর্কে খোঁজ নেয়নি। শেষপর্যন্ত স্বামীর মুখোশ খুলে গেলেও বিন্ধ্য নিজের অবস্থান থেকে নড়ে না। সে বরং নিয়তির হাতেই নিজেকে সমর্পণ করে। এমনকি কখনো আত্ম-জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হয় না। ঠিক-বেঠিক সম্পর্কেও কোনো প্রশ্ন তোলে না। এ ক্ষেত্রে বিন্ধ্যকে যতটা দোষ দেওয়া চলে, তারচেয়ে বেশি আঙুল তুলতে হয় সমাজব্যবস্থার দিকে। কেন নারীকে পুরুষতন্ত্রের দাসিতে পরিণত করা হয়! কেন নারীকে তার যৌক্তিক দাবি নিয়ে দাঁড়াতে দেয় না। পরিবারগুলো কেন নারীকে ‘প্রথম ঘরই ঘর, প্রথম বরই বর’ ভাবার শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখে? কেন নারীর মনে সেঁটে দেওয়া হয়, ‘বেনারসি পরে স্বামীর ঘরে যেতে হয়, কাফনের কাপড় পরে বের হতে হয়!’
প্রায়শ্চিত্ত গল্পের নায়িকা ‘বিন্ধ্য’র সমস্যা আবহমান নারীর সমস্যা। তাদেরই জীবনচেতনার প্রতীক সে। খোদ রবীন্দ্রনাথও নারীকে নিগড় থেকে মুক্তি দিতে চাননি। তার মধ্যে যুক্তি-বুদ্ধি-তর্কবোধ দেননি। এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ সাংবাদিক প্রতিবেদনের মতো শুধু সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন। কিন্তু সেই সমাজ পরিবর্তনের কথা বলেননি। তাই গল্পটি শেষপর্যন্ত পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীকে কোনো স্বপ্ন দেখায় না। বরং পুরুষতন্ত্রের নিগড়ে নারীর জীবনগাথাকে প্রকাশ করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিচারক’ গল্পটি সাধনা পত্রিকায় ১৩০১ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত। গল্পটির কেন্দ্রে অবস্থান করেছে ক্ষীরোদা ও জজ মোহিতমোহন দত্ত। প্রথম থেকে শেষাবধি ক্ষীরোদার উপস্থিতি থাকলেও এই গল্পের মূলে রয়েছে মোহিতলাল। তাকে কেন্দ্র করে গল্পটি শেষপর্যন্ত ট্রাজেডির রূপ নিয়েছে। বিগত যৌবনা, অসহায়, নিপীড়নের শিকার ক্ষীরোদা। পরিবার ও সমাজের কেউ তাকে স্বাভাবিক জীবনে সাহায্য করেনি, এমনকি যেসব পুরুষের আশ্রয় গ্রহণ করেছিল তারাও তাকে জীর্ণ বস্ত্রের মতো পরিত্যাগ করেছে। যৌবনের প্রান্তসীমায় ক্ষীরোদা উপস্থিত হয়ে যাকে ঘিরে স্বপ্ন বুনেছিল, সে প্রণয়ীও তাকে নিঃস্ব করে রাতের অন্ধকারে পলায়ন করেছে। এমনকি সন্তানের প্রতি কোনো কর্তব্য পালন করেনি তার প্রণয়ী! একদিকে সন্তানের ক্ষুধার জ্বালা, অন্যদিকে বখাটেদের উৎপাত ক্ষীরোদাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। নিজের সম্ভ্রম ও বাচ্চার ক্ষুধার তাড়না না মেটাতে পেরে সহজ সমাধান হিসেবে বেছে নেয় আত্মহননের পথ। যে বিভীষিকার বলি হয়েছে তিন বৎসরের দুগ্ধজাত শিশু!
‘ক্ষীরোদা তাহার যৌবনের প্রান্তসীমায় যেদিন প্রাতঃকালে জাগিয়া উঠিয়া দেখিল তাহার প্রণয়ী পূর্বরাত্রে তাহার সমস্ত অলংকার ও অর্থ অপহরণ করিয়া পলায়ন করিয়াছে। (...) দৈবক্রমে একজন পুরাতন প্রণয়ী আসিয়া ক্ষীরো, ক্ষীরো শব্দে দ্বারে করাঘাত করিতে লাগিল। ক্ষীরোদা অকস্মাৎ দ্বার খুলিয়া ঝাঁটা হস্তে বাঘিনীর মতো গর্জন করিয়া ছুটিয়া আসিল; রসপিপাসু যুবকটি অনতিবিলম্বে পলায়নের পথ অবলম্বন করিল। ক্ষীরোদা সেই রোরুদ্যমান শিশুকে প্রাণপণে বক্ষে চাপিয়া ধরিয়া বিদ্যুদবেগে ছুটিয়া নিকটবর্তী কূপের মধ্যে ঝাঁপাইয়া পড়িল।’৩৪
যৌবনে ক্ষীরোদা দেহোপজীবিনী থাকলেও মোহিতমোহনের প্রেম তাকে সঠিক জীবনের সন্ধান দেয়। কিন্তু মোহিতমোহন ক্ষীরোদার পরিচয় পেয়ে তাকে পরিত্যাগ করেছে। ক্ষীরোদা ও মোহিতমোহনের মাঝে ব্যবধান জাত-পাতের। যে দ্বন্দ্ব ভেঙে মোহিতমোহনকে বের করে আনেননি রবীন্দ্রনাথ। কারণ রবীন্দ্রনাথ নিজেও এলিট শ্রেণির প্রতিনিধি। যে কারণে তিনি চাননি স্বশ্রেণিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে! তাই ক্ষীরোদার সঙ্গে মোহিতমোহনের প্রণয়কে পরিণয়ে আবদ্ধ করেননি। বরং তিনি আড়ালেই এর মীমাংসা করেছেন! রবীন্দ্রনাথ নিজের ওপর কখনোই দায় রাখতে চাননি। এজন্যই তার ‘ঘাটের কথা’, ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে জাত-পাতকে দূরে রেখে সাধারণ্যে চরিত্রগুলোতে এমন বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছেন, যেন পাঠকের কথা বলার সুযোগ না থাকে।
ঘাটের কথার কুসুম সন্ন্যাসীর প্রেমে পড়ে, যার প্রণয় দেখালেও পরিণতি মৃত্যু। আবার পোস্টমাস্টারে রতন বালিকা। সেখানেও বয়সের ব্যবধান। ‘বিচারক’ গল্পে ক্ষীরোদা দেহোপজীবিনী। রবীন্দ্রনাথ মননে যে আদর্শকে লালন করেছেন, তাকেই লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি সমাজের বলয় ভাঙতে চাননি। ক্ষীরোদা যে পূর্ব প্রণয়ী আসায় কূপে ঝাঁপ দিলো সেখানে তিনটি বিষয় কাজ করতে পারে। প্রথমত, মোহিতমোহনের দেবতুল্য প্রেম। দ্বিতীয়ত, ক্ষুধায় সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে না পারা। তৃতীয়ত, সন্তানের পরিচয়হীনতা। এই তিনবৃত্ত ক্ষীরোদার জীবনকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করেছে, যেখানে ঘি ঢেলেছে প্রাক্তন প্রণয়ী! গল্পের কোথাও রবীন্দ্রনাথ শিশুর পিতৃপরিচয় তুলে ধরেননি বা পাঠকের সামনে আনতেও চাননি। রবীন্দ্রনাথ অতি লজ্জাপরায়ণ সুপুরুষ ছিলেন। তাই তিনি গল্পের মূল ব্যাখ্যাকে পাঠককে আকারে ইঙ্গিতেই বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। নীরব থেকেছেন চরিত্রগুলোর সঠিক বিকাশে। মোহিতমোহনের আদালতের অভিযুক্ত ক্ষীরোদা। আসামি প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় ক্ষীরোদার কিন্তু যার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে, সেখানে ট্র্যাজেডির রূপায়ণ গল্পটিকে অসাধারণ করে তুলেছে। একটি আংটি, যাকে কেন্দ্র করে মোহিতমোহনের স্মৃতির পাতা খুলে যায়।
(...) মোহিত আংটি হইতে মুখ তুলিয়া একবার ক্ষীরোদার মুখের দিকে ভালো করিয়া চাহিলেন। চব্বিশ বৎসর পূর্বেকার আর—একটি অশ্রুসজল প্রতিসুকোমল সলজ্জশঙ্কিত মুখ মনে পড়িল; সে মুখের সহিত ইহার সাদৃশ্য আছে।
মোহিত আর একবার সোনার আংটির দিকে চাহিলেন এবং তাহার পরে যখন ধীরে ধীরে মুখ তুলিলেন তখন তাঁহার সম্মুখে কলঙ্কিনী পতিতা রমণী একটি ক্ষুদ্র স্বর্ণাঙ্গুরীয়কের উজ্জ্বল প্রভায় স্বর্ণময়ী দেবীপ্রতিমার মতো উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল।’৩৫
মোহিতমোহনের মনে ফাঁসির আসামির প্রতি কৌতূহল জন্মেছে ঠিকই, তখনই আবিষ্কার করে এ তারই প্রণয়ী। যাকে একসময় ছেড়ে এসেছে লোকলজ্জার হাত থেকে বাঁচতে। যদিও মোহিতমোহন নিজেও একাধিক নারীতে আসক্ত ছিল। কিন্তু এখানে চরিত্রের চেয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে শ্রেণিচেতনার যার সঙ্গে আপস করেননি খোদ রবীন্দ্রনাথও। যদি তাই পারতেন তবে ক্ষীরোদার সঠিক জীবনের দিশাকে তিনি সাধুবাদ জানিয়ে মোহিতমোহনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতেন। তা না করে তিনি হৃদয়ের চেয়ে আভিজাত্যবোধে আটকে গেছেন।
তথ্যসূত্র
১. বীরেন্দ্র দত্ত, বাংলা ছোটগল্প প্রসঙ্গ ও প্রকরণ, প্রথম খণ্ড। পুস্তক বিপণী, কলকাতা। প্রকাশকাল, নবম মুদ্রণ-২০১৯। পৃ. ১১
২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গল্পগুচ্ছ, ‘ভিখারিনী’, বিশ্বভারতী, ৯৬/এন মহারানি ইন্দিরা রানি রোড। কলকাতা ৬০। প্রকাশকাল: পুনর্মুদ্রণ- ১৪২৪। পৃ. ৮৪৮
৩. তদেব, পৃ. ৮৪৭
৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গল্পগুচ্ছ, ‘ঘাটের কথা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী, ৯৬/এন মহারানি ইন্দিরা রানি রোড। কলকাতা ৬০। প্রকাশকাল: পুনর্মুদ্রণ- ১৪২৪। পৃ. ৩
৫. তদেব, ‘ঘাটের কথা’। পৃ. ৫
৬. তদেব। পৃ. ৭
৭. তদেব। পৃ. ৭
৮. তদেব। পৃ. ৮
৯. হীরেন চট্টোপাধ্যায় ও কৃষ্ণগোপাল রায় সম্পাদিত সাহিত্য-প্রবন্ধ, প্রবন্ধ-সাহিত্য, প্রকাশক: বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ। কলকাতা। প্রকাশকাল ২০১৪। পৃ. ৭৫৫
১০. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গল্পগুচ্ছ, ‘পোস্টমাস্টার’, বিশ্বভারতী, ৯৬/এন মহারানি ইন্দিরা রানি রোড। কলকাতা ৬০। প্রকাশকাল: পুনর্মুদ্রণ- ১৪২৪। পৃ. ১৮
১১. তদেব। পৃ. ২০
১২. তদেব, পোস্টমাস্টার। পৃ. ২০
১৩. তদেব, গিন্নি। পৃ. ২২
১৪. তদেব। পৃ. ২৩
১৫. তদেব, ‘জীবিত ও মৃত’। পৃ. ৯২
১৬. তদেব। পৃ. ৯৫
১৭. তদেব, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’। পৃ. ৪০
১৮. তদেব। পৃ. ৪১
১৯. তদেব, রাজপথের কথা। পৃ. ১১
২০. তদেব। পৃ.১১
২১. তদেব, ‘মুক্তির উপায়’। পৃ. ৬৪
২২. তদেব। পৃ. ৬৭
২৩. তদেব। পৃ. ৭০
২৪. তদেব, ‘একরাত্রি’। পৃ. ৭৭
২৫. তদেব। পৃ. ৭৮
২৬. তদেব। পৃ.৮০
২৭. তদেব, ‘ছুটি’। পৃ. ১২৬
২৮. তদেব। পৃ. ১২৮।
২৯. তদেব, ‘মধ্যবর্তিনী’। পৃ. ১৫২
৩০. তদেব। পৃ.১৫৮
৩১. হীরেন চট্টোপাধ্যায় ও কৃষ্ণগোপাল রায় সম্পাদিত সাহিত্য-প্রবন্ধ, প্রবন্ধ-সাহিত্য, প্রকাশক: বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ। কলকাতা। প্রকাশকাল: ২০১৪। পৃ.৭৬০
৩২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গল্পগুচ্ছ, ‘প্রায়শ্চিত্ত’। বিশ্বভারতী, ৯৬/এন মহারানি ইন্দিরা রানি রোড। কলকাতা ৬০। প্রকাশকাল: পুনর্মুদ্রণ- ১৪২৪। পৃ. ২৩০
৩৩. তদেব। পৃ. ২৩২
৩৪. তদেব, ‘বিচারক’। পৃ. ২৩৪
৩৫. তদেব। পৃ. ২৩৯
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পে মনস্তত্ত্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পে মনস্তত্ত্ব: পর্ব-০২
এসইউ/জেআইএম