রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পে মনস্তত্ত্ব
সাহিত্য এমন একটি মাধ্যম—যা মরুভূমির বুকেও প্রাণের সঞ্চার করে। বৃক্ষের অঙ্কুরোদ্গমন থেকে ফলবতী হওয়া পর্যন্ত যেমন তার পরিচর্যা প্রধান নিয়ামক, তেমনি মানুষের বুদ্ধির বিকাশ ঘটাতেও সাহিত্য জীবনের প্রধান অনুষঙ্গের ভূমিকা পালন করে। চিন্তাচেতনায় মানুষকে যে সাহিত্য পরিপুষ্ট করে তোলে, তাই-ই তার আরাধ্য হয়ে ওঠে।
‘রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা ছোটগল্পের বীজ, বৃক্ষ, ফুল, ফল এবং পুরনো বাতিল বৃক্ষরাজিকে সমূলে উৎপাটিত করার কুঠারটিও। তিনি সৃষ্টির বিস্ময় যেমন দেখিয়েছেন, সৃষ্টির বিচিত্র করার ক্ষমতাও দেখিয়েছেন, দেখিয়েছেন পুরনো পদ্ধতি নয়, নতুন রীতিতে এই নবজাতক সাহিত্য শাখার জীবনস্পন্দনকে নিত্য বহমান করার পথ এবং প্রয়াসটিও।’১
এ কথা বলা বাহুল্য হবে না—আজও ছোটগল্পের একচ্ছত্র অধিপতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ যেন মহাসমুদ্র, যেখানে নানারকম মণি-মুক্তার সন্ধান মেলে।
রবীন্দ্রগল্পের মূল উপদান মানুষ-প্রকৃতি, গ্রামীণ জীবন, নাগরিক জীবন, অতিপ্রাকৃত ঘটনা, রাজনীতি, মনস্তাত্ত্বিক দিক। গল্পের কেন্দ্রে যেহেতু মানুষের বসতি, তাই তার চাওয়া-পাওয়া, না-পাওয়ার বেদনা, দুঃখ-দুর্দশা, সাংসারিক জটিলতা বহুবিধ বিষয়ের সাক্ষাৎ ঘটেছে রবীন্দ্রগল্পে। রবীন্দ্রনাথের একাধিক গল্পে মনস্তত্ত্বের সন্ধান মেলে বিশেষভাবে। রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘ভিখারিনী’। প্রকাশিত হয়েছিল ১২৮৪ বঙ্গাব্দে। এটি প্রথম গল্প হলেও মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারার পূর্ণ সমাগম এখানে ঘটেছে। লেখক সচেতনভাবেই মনের গহীনে ঢুকে বের করতে চেষ্টা করেছেন আত্মিক জটিলতা! যদিও তার সুরাহা করেননি।
‘ভিখারিনী’ গল্পের প্রধান চরিত্র কমল। কিন্তু কমলকে ঘিরে তার মায়ের আহাজারিই যেন প্রধান হয়ে উঠেছে। নিছক ট্র্যাজেডির অবতারণা করেছেন শেষমেশ। কমলের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। কমল ভালোবাসতো অমর সিংহকে। কিন্তু কাহিনির শুরুতে অমর সিংহ চলে যায় যুদ্ধে। এদিকে, নিয়তির পরিহাসে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটে কমল ও তার মায়ের। একসময় ভিক্ষা করার সময় কমলকে অপহরণ করে দস্যুরা। মুক্তিপণ দিয়ে তার মা মুক্ত করে আনেন। কিন্তু মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে মাকে যেতে হয় মোহনলালের কাছেই। এই মোহনলাল একসময়ে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। কিন্তু এবার যখন সাহায্য চাইতে এলেন কমলের মা, তখন সুযোগ বুঝে বিয়ের শর্তে টাকা দেয়। এ যেন বাঘের মুখ থেকে বাঁচিয়ে এনে কুমিরের কাছে প্রাণ সঁপে দেওয়া। সবমিলিয়ে গোদের ওপর বিষফোঁড়া! কমলকে মানসিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল করে ফেলে এ সব মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা! স্বামীর বাড়ি থেকে মায়ের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে বারবার প্রেমিক অমরসিংহের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চেয়েছে কমল। কিন্তু নিয়তির লিখনে তাও সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। কমলের জীবনে উঠে এসেছে মানসিক দ্বন্দ্বের বিচিত্র দিক। এখানে একটু উদাহরণ দেওয়া যাক:
...অমরসিংহ তাহার প্রতি নিষ্ঠুরাচরণ করিল মনে করিয়া কমল কষ্ট পায় নাই। হতভাগিনী ভাবিত, ‘আমি দরিদ্র, আমার কিছুই নাই, আমার কেহই নাই, আমি বুদ্ধিহীনা ক্ষুদ্র বালিকা, তাঁহার চরণরেণুরও যোগ্য নহি, তবে তাঁহাকে ভাই বলিব কোন অধিকারে! তাঁহাকে ভালোবাসিবো কোন অধিকারে! আমি দরিদ্র কমল, আমি কে যে তাঁহার স্নেহ প্রার্থনা করিব!২
সাদাচোখে মনে হতেই পারে কমলের প্রচণ্ড আত্মপ্রবঞ্চনা কিন্তু এত শুধু অভিমানের ছোঁয়া, যেখানে প্রচ্ছন্ন আছে প্রচণ্ড প্রেমিক হৃদয়! মনের গহীনে নিজেকে প্রবোধদানের অসামান্য ইচ্ছে, যা দিয়ে সে সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করেছে! কমল মরে গিয়ে নিজের দুঃখের অবসান করেছে কিন্তু থেকে গেছে তার মায়ের নীরব হৃদয়ভার!
পুরো গল্প পাঠশেষে একটি জিজ্ঞাসাই বড় হয়ে উঠবে, তাহলে কি সমাজের নিগড় ভেঙে বেরিয়ে আসা কঠিন? না হলে এতো প্রেম থাকার পরও শেষমেশ কেন মিলন হলো না অমর-কমলের! এ প্রেমেও সামাজিক বন্ধনটা দৃঢ় হয়ে উঠেনি? দস্যুদের হাত থেকে বাঁচতে মায়ের অঙ্গীকার রক্ষায় মোহনলালকে বিয়ে করে কমল সামাজিকভাবে প্রথাবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু হৃদয়! সে তো নিয়ম-নীতি-প্রথার ঊর্ধ্বে! সেখানে সে থেকেছে শূন্য। প্রথাগত ভিক্ষাবৃত্তি ছাপিয়ে তাই এগল্পে প্রধান হয়ে উঠেছে হৃদয়বৃত্তি! যার স্বীকৃতি চেয়েছে অমরসিংহের কাছে কিন্তু প্রত্যাখ্যানই তার মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। ‘বালিকার সুকুমার হৃদয়ে দারুণ বজ্র পড়িল। অভিমানিনী কতদিন ধরিয়া ভাবিয়াছে যে, এতদিনের পর যে বাল্যসখা অমরের কাছে ছুটিয়া গেলো, অমর কেন উপেক্ষা করিলো। কিছুই ভাবিয়া পায় নাই।’৩ অমরের কাছে হৃদয়ের প্রাপ্তি যখন সামাজিক বন্ধনের কাছে হেরে গেছে, তখন কমলের মৃত্যুই যেন প্রাপ্য!
১২৯১ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘ঘাটের কথা’। রবীন্দ্রনাথের মনস্তাত্ত্বিক দিকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় এই গল্পে। কুসুম গ্রাম্যবালিকা। দুরন্ত শৈশবে যখন তার খেলার বয়স। ওই সময়ে তার কাঁধে চাপে বিয়ে নামের সামাজিক বন্ধন। মাত্র আট বছর বয়সে কুসুম বিধবা হয়। স্বামী বিদেশে চাকরিরত ছিল। তাই পত্রযোগেই আসে বৈধব্যের সংবাদ। আট বছর বয়সে মাথার সিঁদুর মুছে, গায়ের গয়না ছেড়ে আবার দেশে গঙ্গার ধারে ফিরতে হয় বৈধব্যের ছাপে! বাল্যবয়সে কুসুমের মনে যে প্রলেপ পড়ে তার চরিত্রে ফুটে উঠেছে বারবার।
নিজেকে গুটিয়ে নেয় পৃথিবীর তাবৎ স্বাভাবিক কর্মযজ্ঞ থেকে। যে কুসুম একসময় দুরন্তপনায় মাতিয়ে রেখেছিল ঘাটপাড়-গ্রাম, কথকরূপী ঘাট আজ কুসুমের মধ্যে খুঁজে ফেরে শূন্যতা। তার উচ্ছলতায় ভাটা পড়েছে। নিত্যঘাটের সঙ্গে মিতালি গড়ে ওঠা কুসুম আজ অর্ধমৃত। সামাজিক আচার-নিয়মে রুদ্ধ তার গতি।
‘বর্ষার আরম্ভে গঙ্গা যেমন প্রতিদিন ভরিয়া ওঠে, কুসুম তেমনি দেখিতে দেখিতে প্রতিদিন সৌন্দর্যে যৌবনে ভরিয়া উঠিতে লাগিলো। কিন্তু তাহার মলিন বসন, করুণ মুখ, শান্ত স্বভাবে তার যৌবনের উপর এমন একটি ছায়াময় আবরণ রচনা করিয়া দিয়াছিল যে, সে যৌবন, সে বিকশিত রূপ সাধারণের চোখে পড়িত না। ...এমন করিয়া দশ বৎসর কখন কাটিয়া গেলো, গাঁয়ের লোক কেহ জানিতেই পারিল না।’৪
কুসুমের জীবনে যে পরিবর্তন, তা দৈহিক অপেক্ষা মানসিক। মনের কোণে জমে থাকা কষ্টই তাকে দায়িত্ববোধ বুঝতে সক্ষম করেছে। অল্পবয়সে নির্মম পরিহাস তার বয়সকে তিনগুণ করেছে!
হাঠৎ গ্রামের মন্দিরে গৌরতনু সৌম্যোজ্জ্বল মুখচ্ছবি এক নবীন সন্ন্যাসী শিবমন্দিরে আশ্রয় নেয়। সন্ন্যাসীকে দেখতে প্রতিদিন ভিড় বাড়াতে থাকে। আশপাশের গ্রাম থেকেও সন্ন্যাসীকে দেখার জন্য লোকসমাগম হয়। যে গ্রামে কুসুমের শ্বশুরবাড়ি, সেখান থেকেও অনেক মেয়ে আসে। এসব নারীর মাধ্যমে অনেকটা গ্রামে রাষ্ট্র হয়ে যায়, এই সন্ন্যাসী চাটুজ্জেদের বাড়ির ছোট দাদাবাবু! কুসুমের স্বামীর চেহারার সঙ্গে মিল রয়েছে। সবার সঙ্গে সন্ন্যাসীর সাক্ষাৎ হলেও শুরুর দিকে কুসুমের সঙ্গে হয় না। একদিন কুসুমও সাক্ষাৎ পায় তার। দুজনের মধ্যে এই প্রথম দৃষ্টিবিনিময়।
...ঊর্ধ্বমুখ ফুটন্ত ফুলের উপরে যেমন জ্যোৎস্না পড়ে, মুখ তুলিতেই কুসুমের উপর তেমনি জ্যোস্না পড়িল। সেই মুহূর্তে তাদের উভয়ের দেখা হইলো। যেন চেনাশোনা হইল। মনে হইলো যেন পূর্বজন্মের পরিচয় ছিল! মাথার উপর দিয়া পেচক ডাকিয়া গেল। শব্দে সচকিত হইয়া আত্মসংবরণ করিয়া কুসুম মাথার কাপড় তুলিয়া দিল। উঠিয়া সন্ন্যাসীর পায়ের কাছে লুটাইয়া প্রণাম করিল।
সন্ন্যাসী আশীর্বাদ করিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তোমার নাম কী?’
কুসুম কহিল, ‘আমার নাম কুসুম।’
সে রাত্রে সন্ন্যাসী অনেকক্ষণ আমার সোপানে বসিয়া ছিলেন। অবশেষে যখন পূর্বের চাঁদ পশ্চিমে আসিল, সন্ন্যাসীর পশ্চাতের ছায়া সম্মুখে আসিয়া পড়িল, তখন তিনি উঠিয়া মন্দিরে গিয়া প্রবেশ করিলেন।’৫
এরপর থেকে নিত্যই মন্দিরে এসে সন্ন্যাসীর পদধূলি নেওয়ার পাশাপাশি শাস্ত্রব্যাখ্যা শুনতো কুসুম। সন্ন্যাসী তাকে যা বলতো, বিনাবাক্যে কুসুম তা পালন করতো। কিন্তু এই পালন কি শুধু কুসুমের ধর্ম ভক্তি! না, সেটা গল্পের শেষে রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেছেন স্পষ্টভাবে। কুসুমের অবদমিত প্রেমাকাঙ্ক্ষাই তাকে ধীরে ধীরে সন্ন্যাসীর প্রতি সমর্পিত করেছে। কিন্তু কুসুম নিজেকে লোকচক্ষুর আড়াল করতে চেয়েছে সর্বদা। যা কথকরূপী ঘাটের বর্ণনায় উঠে এসেছে। কিছুদিন থেকে কুসুম আর ঘাটের সান্নিধ্যে আসে না। কুসুমের মনের আবেগ তাকে বিচলিত করলেও তার আত্মদমন দেখতে পাই সর্বত্র। সমাজিক প্রথার জটাজালে বিদ্ধ কুসুম। বিধবার প্রেম গর্হিত। তাকে আর যাই হোক জীবন সাজাতে নেই। কিন্তু হৃদয় থেকে উৎসারিত প্রেম তাকে চঞ্চল করে তোলে। কুসুমের জবানিতে উঠে এসেছে:
‘প্রভু, আমি একজনকে দেবতার মতো ভক্তি করিতাম, আমি তাঁহাকে পূজা করিতাম, সেই আনন্দে আমার হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া ছিল। কিন্তু একদিন রাত্রে স্বপ্নে দেখিলাম, যেন তিনি আমার হৃদয়ের স্বামী, কোথায় যেন এক বকুলবনে বসিয়া তাঁহার বামহস্তে আমার দক্ষিণহস্ত লইয়া আমাকে তিনি প্রেমের কথা বলিতেছেন। এ ঘটনা আমার কিছুই অসম্ভব, কিছুই আশ্চর্য মনে হইল না। স্বপ্ন ভাঙিয়া গেলো, তবু স্বপ্নের ঘোর ভাঙিল না।’৬
রবীন্দ্রনাথ এই গল্পে বিধবার অবদমিত প্রেম দেখালেন স্বপ্নের মাধ্যমে। কিন্তু এ শুধু স্বপ্ন নয়, কুসুমের অবচেতন মনের আকাঙ্ক্ষাও, যা প্রকাশে সে ভীত। সামাজিক দায়বোধ তাকে অবদমনে বাধ্য করেছে, কিন্তু প্রাণে রক্ষা করতে পারেনি। সন্ন্যাসীর কাছে প্রেম ব্যক্ত হলে কুসুম প্রত্যাখ্যাত হয়, যা তাকে আত্মহননের পথে চালিত করে। সন্ন্যাসী বলেছে:
‘তুমি আমার সকল কথাই পালন করিয়াছ; আর-একটি কথা বলিব, পালন করিতে হইবে। আমি আজই এখান হইতে চলিলাম; আমার সঙ্গে তোমার দেখা না হয়। আমাকে তোমার ভুলিতে হইবে। বলো এই সাধনা করিবে।’৭
সন্ন্যাসী না হয়ে যদি তিনি সাধারণ পুরুষ হতেন, তবে প্রশ্ন থাকতো রবীন্দ্রমানস নিয়ে। যে নারীর ডাকে কেন পুরুষ সাড়া দেবে না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এখানে সেই প্রশ্নকে উত্থাপন করার সুযোগ শিথিল করে দিয়েছেন! কারণ সন্ন্যাসী তো ঘর-সংসারের ঊর্ধ্বে! তিনি সচেতনভাবে তৎকালীন সমাজের মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রেখেছেন। সামাজিক বৃত্ত তিনি ভাঙতে চাননি বা তা এড়িয়ে গেছেন। তাই সবকিছুর ঊর্ধ্বে এসে কুসুমের মৃত্যু অবধারিত। গল্পে পাই, ‘চাঁদ অস্ত গেলো, রাত্রি ঘোর অন্ধকার হইলো। জলের শব্দ শুনিতে পাইলাম, আর কিছু বুঝিতে পারিলাম না।’৮
‘ঘাটের কথা’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন, বিধবাকে বৈধব্যই পালন করতে হবে। তার মনে কামনা-বাসনা জাগা অনুচিত। তাই তিনি কুসুম আত্মহত্যার মধ্য দিয়েই তার অবদমনকে রক্ষা করেছেন। বৈধব্যের বাঁধ ভাঙার সুযোগ দেননি। তবে, ‘... প্রাচীন এক ভাঙা ঘাটের রূপকে জীবনের সুখদুঃখময় কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।’৯
রবীন্দ্রনাথের বহুল পঠিত ও আলোচিত গল্প ‘পোস্টমাস্টার’। গল্পটি ১২৯৮ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত। ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে মনস্তাত্ত্বিক পরিচয় মেলে। গল্পের প্রথমেই দেখতে পাই, কলকাতা থেকে এক পোস্টমাস্টার উলাপুর গ্রামে আসে। জলের মাছকে ডাঙায় তুললে যা হয়, কলকাতা থেকে গণ্ডগ্রামে এসে পোস্টমাস্টারেরও একই হাল হলো। বেতন কম। তাই পোস্টমাস্টারের শনির দশা যেন কাটতেই চায় না।
পোস্টমাস্টারকে কষ্টেসৃষ্টে রান্না করে খেতে হয়। গ্রাম্য একটি অনাথ বালিকা খাওয়ার বিনিময়ে ঘরের বাকি কাজগুলো করে দেয়। মেয়েটির নাম রতন, বয়স বারো-তেরো বছর। পোস্টমাস্টারের সঙ্গে রতনের একতরফা সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যেখানে পোস্টমাস্টারের হৃদয়ের কোনোই সংযোগ থাকে না। কিন্তু রতন যে তাকে কতটা আপনার ভাবে, তা গল্পের প্রথম থেকে শেষাবধি প্রকাশিত হয়েছে।
‘যে সকল কথা সর্বদাই মনে উদয় হয় অথচ নীলকুঠির গোমস্তাদের কাছে যাহা কোনোমতেই উত্থাপন করা যায় না, সেই কথা একটি অশিক্ষিত ক্ষুদ্র বালিকাকে বলিয়া যাইতেন, কিছুমাত্র অসঙ্গত মনে হইত না। অবশেষে এমন হইল, বালিকা কথোপকথনকালে তাঁহার ঘরের লোকদিগকে মা দিদি দাদা বলিয়া চির-পরিচিতের ন্যায় উল্লেখ করিত। এমন-কি তাঁহার ক্ষুদ্র হৃদয়পটে বালিকা তাঁহাদের কাল্পনিক মূর্তিও চিত্রিত করিয়া লইয়াছিল।’১০
রতনের প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও মনের অলক্ষ্যে গড়ে ওঠা হৃদয়বৃত্তির কোনো মূল্য ছিল না শহর থেকে আসা পোস্টমাস্টারের কাছে। বাপ-মা মরা রতন যাকে একমাত্র আশ্রয় ভেবে নিত্যদিন মনের গহীনে স্বপ্নের জাল বুনেছে, তা নিমিষেই থমকে যায় পোস্টমাস্টারের উলাপুর ত্যাগ করার সিদ্ধান্তে। কিন্তু এই বালিকা রতনই একসময় পোস্টমাস্টারের সেবাশুশ্রুষা করে সারিয়ে তুলেছিল। অসুস্থ পোস্টমাস্টার রোগশয্যায় যখন আপনজনের কাউকে পাশে প্রত্যাশা করেছিল, ওই সময় রতন আর বালিকা থাকে না। তার পরম স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে বিনিদ্র রজনী শিয়রে জেগে থেকে সুস্থ করে তোলে পোস্টমাস্টারকে। কিন্তু পোস্টমাস্টার সুস্থ হয়েই উলাপুর ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানে রতন নিতান্ত তুচ্ছ বস্তুসর্বস্বের নাম মাত্র! তার মত-পথ কোনোটাই রুদ্ধ করতে পারেনি পোস্টমাস্টারকে। এমনকি তাকে সঙ্গে নেওয়ার কথা অনুরোধও অযাচিত আবদারের মতোই পোস্টমাস্টার উড়িয়ে দেয়। হৃদয়ের সংযোগ যেখানে ন্যূনতম স্পর্শ করে না। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, ‘দাদাবাবু, আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে? পোস্টমাস্টার হাসিয়া কহিলেন, সে কী করে হবে।’১১
ব্যাপারটা বালিকা রতনের ঠিক বোধে আসে না কিন্তু সচেতন পাঠক মাত্রই বুঝতে পারে—রবীন্দ্রনাথ এখানে শ্রেণিসচেতন! তিনি উচ্চশ্রেণির সঙ্গে নিম্নশ্রেণির মিলনকে এড়িয়ে গেছেন। ‘ঘাটের কথা’ গল্পে যেমন কুসুম ও সন্ন্যাসীর মিলন সম্ভব হয়নি, তেমনি ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পেও পোস্টমাস্টার ও রতনের মিলন হয়নি। রতনের শ্রেণি পোস্টমাস্টার থেকে ভিন্ন। তাই পোস্টমাস্টার কল্পনা করতে পারে না রতনকে তার সঙ্গে নেবে বা তার প্রতি ন্যূনতম সহানুভূতিশীল হবে। উলাপুর ছাড়তে গিয়ে তার মনের গহীনে কোথাও আমরা রতনের প্রতি হৃদয়ের উষ্ণ অনুভব পাই না। যেটুকু পাই তাকে আর যাই বলা যাক আত্মিক টান বলে না, ক্ষণিকের হৃদয়াবেগ মাত্র। গল্পের খানিক উদ্ধৃত করে বিশ্লেষণে অগ্রসর হবো।
‘যখন নৌকায় উঠিলেন এবং নৌকা ছাড়িয়া দিল, বর্ষাবিস্ফারিত নদী ধরণীর উচ্ছলিত অশ্রুরাশির মতো চারি দিকে ছলছল করিতে লাগিল, তখন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন, একটি সামান্য গ্রাম্য বালিকার করুণ মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল। একবার নিতান্ত ইচ্ছা হইল, ‘ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি’—কিন্তু তখন পালে বাতাস পাইয়াছে, বর্ষার স্রোত খরতর বেগে বহিতেছে, গ্রাম অতিক্রম করিয়া নদীকূলের শ্মশান দেখা দিয়াছে, এবং নদীপ্রবাহে ভাসমান পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।’১২
একদিকে পোস্টমাস্টার অন্যদিকে রতন। দুজনের মনের গতিবেগ ভিন্ন মাত্রায় প্রবাহিত! পোস্টমাস্টার নিতান্ত তুচ্ছ দর্শনের অবতারণা করে হৃদয়কে নিবৃত্ত রেখেছে, যদিও গল্পের কোথাও তার পক্ষ থেকে কোনো ভালোবাসার আবহ সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু রতনের একতরফা হৃদয়ের টান তাকে মর্মাহত করেছে। তাই প্রচণ্ড অভিমান তার ভেতর জমা করেছে। পোস্টমাস্টার তার চাকরির শেষ টাকাটুকু যখন রতনকে দিতে চায়, তখন রতনের করুণ আর্তি পাঠক হৃদয়কে বিগলিত করে। পোস্টমাস্টারের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ আসে। কেন সে অনাথা বালিকাকে সঙ্গে নিতে পারলো না! কী সেই প্রশ্নের উত্তর! আলোচনার মাঝভাগেই বলেছি, এ যেন উচ্চশ্রেণির সঙ্গে নিম্নশ্রেণির প্রভেদ! রবীন্দ্রনাথ নিজেও জমিদার শ্রেণির ছিলেন। তাই মনের কোনো এক কোণে জমিয়ে রাখা ইচ্ছেই হয়তো গল্পে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে! রতনের ভাগ্যে জুটেছে সামাজিক প্রভেদ ও পোস্টঅফিসের চারিদিকে অশ্রুজলে সিক্ত করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না অনাথিনী বালিকার।
‘গিন্নি’ রবীন্দ্রনাথের শিশু মনস্তত্ত্বকে ঘিরে গড়ে ওঠা ছোটগল্প। গল্পটিও পোস্টমাস্টার গল্পের সমসাময়িক কালে লেখা, ১২৯৮ বঙ্গাব্দে। কলেবর ছোট। গল্পে ২টি প্রধান চরিত্র। শিবনাথ ও আশু। এ ছাড়া রয়েছে কিছু অপ্রধান চরিত্র। শিবনাথ কড়া মাস্টারমশাই। সবাই তাকে যমের মতো ভয় করে। বালকদের মারার জন্য শিবনাথের একটি অস্ত্র ছিল। শুনতে তা যৎসামান্য মনে হলেও তা প্রকৃতপক্ষে নিদারুণ। তিনি ছেলেদের নতুন নামকরণ করতেন! আর এই নামকরণকে ঘিরে বালকদের মনে নানারকম দ্বন্দ্ব কাজ করতো। গল্পের একটি পাঠ এই পর্যায়ে জরুরি: ‘...মানুষ বস্তুর চেয়ে অবস্তুকে বেশি মূল্যবান জ্ঞান করে, সোনার চেয়ে বানি, প্রাণের চেয়ে মান এবং আপনার চেয়ে আপনার নামটাকে বড়ো মনে করে।’১৩
শিবনাথ পণ্ডিত আশুর নামকরণ করেন গিন্নি। এ নামাঙ্কারণের পশ্চাৎ ইতিহাসটাও চমকপ্রদ। আশু তার সমবয়স্ক ছোটবোনের সঙ্গে পুতুল খেলায় মত্ত। এমন সময় প্রচণ্ড ঝড়-ঝাপটা শুরু হওয়াতে তাদের বাড়ির গাড়ি বারান্দায় ঠাঁই নেন মাস্টারমশাই। পুতুলের বিয়েকে কেন্দ্র করে পুরুতঠাকুর করতে একসময় আচমকা ডাক পড়ে মাস্টারমশায়ের। আশুকে পুতুল খেলার সঙ্গী হওয়ায় একসময় মাস্টারমশাই আশুর নাম দেন গিন্নি। নাম জিনিসটা শব্দ বৈ কিছু না হলেও মানুষ তার নামকে ভালোবাসে। শুধু তাই নয় তার মনের জটিলতাও বৃদ্ধি পায়।
‘পৃথিবীর সমস্ত মধ্যাকর্ষণশক্তি সবলে বালককে নীচের দিকে টানিতে লাগিল, কিন্তু ক্ষুদ্র আশু সেই বেঞ্চির উপর হইতে একখানি কোঁচা ও দুইখানি পা ঝুলাইয়া ক্লাসের সকল বালকের লক্ষ্যস্থল হইয়া বসিয়া রহিল। এতদিনে আশুর অনেক বয়স হইয়া থাকিবে, এবং তাহার জীবনে অনেক গুরুতর সুখ-দুঃখ-লজ্জার দিন আসিয়াছে—সন্দেহ নাই, কিন্তু সেইদিনকার বালকহৃদয়ের ইতিহাসের সহিত কোনোদিনের তুলনা হইতে পারে না।’১৩
রবীন্দ্রনাথ আলোচ্য গল্পে বালকের হৃদয়ে ভীতি ও একইসঙ্গে লজ্জা-সংকোচপূর্ণ ঘটনার অবতারণা করেছেন। বালক বয়সে মনের ওপর নানারকম দ্বন্দ্ব আসে। সেগুলো মানুষকে কীভাবে প্রভাবিত করে, তা ফুটে উঠেছে গল্পে।
‘জীবিত ও মৃত’ একটি পরিপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক-সামাজিক গল্প। এটি ১২৯৯ বঙ্গাব্দে ‘সাধনা’ পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এই গল্পের প্রধান চরিত্র কাদম্বিনী। রাণীহাটের জমিদার শারদাশংকরবাবুর মৃত ছোট ভাইয়ের বউ সে। শ্বশুর ও পিতৃকুলে তার নিজের বলতে কেউই ছিল না। শারদাশংকরের ছোটো ছেলেটি কাদম্বনীর চোখের মণি। একদিন হঠাৎ কাদম্বিনীর হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশি ঝামেলা এড়াতে জমিদারের চার জন ব্রাহ্মণ কর্মচারী অনতিবিলম্বে মৃতদেহ সৎকারের জন্য শ্মশানে নিয়ে যায়। কাকতালীয়ভাবে কাদম্বনীর হৃদক্রিয়া আবারও সচল হয়। শুরু হয় কাদম্বনীর জীবনের সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বের লড়াই। প্রথম পর্যায়ে সে ছিল বিধবা। তারপরও সমাজ ও প্রথার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে অন্যের সন্তান বুকে করে নিজের দুঃখ মোচনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে শুরু হয় তার জীবন জটিলতা। শশ্মান থেকে কাদম্বিনী সামাজিক অগ্রহণযোগ্যতার জন্য বাড়ি ফিরতে পারেনি। সে চলে গেছে ছোটবেলার সখী যোগমায়ার কাছে।
চলবে...
এসইউ/জেআইএম