মামুন মুস্তাফার কবিতা: যাপিত জীবনের জটিল বিন্যাস
মামুন রশীদ
মামুন মুস্তাফা কবি। সময়ের বিচারে বিংশ শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের কবি। প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে সচল মামুন মুস্তাফা কবিতা লেখার ক্ষেত্রে শুধু উপস্থাপন কৌশল ব্যবহার করতে চাননি। তিনি ভাব ও ভাষার ওপর ভর করেই পাঠককে তৃপ্তি দিতে চেয়েছেন। আত্মতৃপ্তিও খুঁজেছেন।
কবিতা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। তার গতিপথ পরিবর্তন করছে। তবে কবিতা লেখার ক্ষেত্রে ভাব ও ভাষার পরিবর্তন খুব ধীরে হলেও, শুধুমাত্র উপস্থাপন কৌশলকে আয়ত্ত করেই অনেকে পাল্টে দিতে চেয়েছেন কবিতার মেজাজ, গতিপথ। মামুন মুস্তাফা সে পথেও হাঁটেননি।
তিনি শিল্পের শুদ্ধতায় বিশ্বাসী। ইতোমধ্যে পাঠককে উপহার দিয়েছেন নির্বাচিত কবিতার সংকলন ‘দশ দশমী’ এবং অনুকাব্য ‘শায়কচিহ্ন’সহ মোট ১২টি কাব্য। প্রতিটি কবিতাগ্রন্থের ভেতর দিয়ে তিনি প্রতিবার নতুন করে উপস্থিত হয়েছেন। সচেতন ভাবেই প্রতিবার নিজেকে পাল্টেছেন। সেই পাল্টানো কাব্যিক ভাষায় যতোটা না, তার চেয়ে বেশি কাব্যিক বোধে। বিষয় ও প্রকরণের দিক থেকে প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই মামুন মুস্তাফা নতুন হয়ে ধরা দিয়েছেন।
মামুন মুস্তাফা সৃষ্টিশীল মানুষ, সংবেদনশীল মানুষ। তার কবিতায় স্মৃতিকাতরতা আছে, আছে ফেলে আসা জীবনের জন্য হাহাকার। তিনি ইতিহাস ও সমকালকে উপেক্ষা করেননি। তার কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় বাঙালির মহৎ অর্জন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরত্বগাথা। খুঁজে পাওয়া যায় ব্যক্তিগত পাওয়া না পাওয়ার হিসেব, আছে গল্পের আবহ, আছে মিথ ও পুরাণের বহুমাত্রিক উপস্থাপন। এই সবকিছুর একটা সমন্বয় আমরা লক্ষ্য করি কবির ‘একাত্তরের এলিজি কাব্যে’।
মামুন মুস্তাফা বেড়ে উঠেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশের মধ্য দিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই সেই প্রভাবকে তিনি ধারণ করছেন, আর সেই ধারণকেই রূপ দিয়েছেন শিল্পে। আমাদের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের যে গৌরবময় উপস্থিতি, তা তার কবি মানসেও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ও অহংকারকে ধারণ করেই তিনি রচনা করেছেন ‘একাত্তরের এলিজি’। এই কবিতাগুলোয় মামুন মুস্তাফা এমন কিছু মানুষের কথা বলেছেন, এমন কিছু ঘটনার কথা তুলে এনেছেন—যা মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় স্মারক। কাব্যগ্রন্থটিতে চল্লিশ জন মুক্তিযোদ্ধার চিঠি অবলম্বনে মামুন মুস্তাফা তুলে এনেছেন স্বাধীনতাকাঙ্ক্ষী মানুষের উপলব্ধি। প্রতিটি কবিতার শিরোনামের পরেই স্থান পেয়েছে—সেই লেখাটি কোন মুক্তিযোদ্ধার চিঠি অবলম্বনে রচিত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস আমরা প্রতিনিয়ত যে অনিশ্চয়তা, যে বিপদসঙ্কুল পরিবেশ, যে নির্যাতন আর ভয়াবহ জঘন্য গণহত্যার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছি, সেই সময়ের ইতিহাস উঠে এসেছে কবিতাগুলোয়। সম্পূর্ণ গদ্যফর্মে লেখা কবিতাগুলোর ভেতর দিয়ে তিনি যুদ্ধকালীন বাস্তব পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিভীষিকা দেখা মুক্তিপাগল মানুষের কাছে একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি উঠে আসে, তেমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধের পরের প্রজন্মের কাছে উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের অদেখা-অজানা অধ্যায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠি, নানামুখী স্মৃতিকথা, হারিয়ে যাওয়া দিনপঞ্জির পাতা থেকে ছেঁকে তোলার মতো করে তিনি কবিতায় তুলে এনেছেন আমাদের গৌরবের সোনালি হরফ। যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থাকে তুলে ধরেই তাই স্মৃতি ও কথা’৭১ থেকে সংগৃহীত একটি চিঠি অবলম্বনে লেখা ‘শ্রীমতীর বাড়ি’ কবিতায় তিনি বলতে পারেন, “জানতে ইচ্ছে হয় স্বাধীনতা আনতে গিয়ে শ্রীমতী কতটুকু মেলেছিলো বসন দেহের? কতটুকু ছিলো ওই বুকে উষ্ণ সহবাস?” পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতাকেও কবিতায় স্পষ্ট করে তুলেছেন তিনি। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শাফী ইমাম রুমীর চিঠি অবলম্বনে লেখা ‘ভোর হবেই, আরোগ্য অরুণোদয়’ কবিতায় তিনি বলেন, “আগুন কতটুকু পুড়িয়ে মারে? কিন্তু ওদের নৃশংসতা, যা শুনতে পাও—তার থেকেও বীভৎস!” আর স্বাধীনতার সোনালি সূর্য দেখার পূর্বাভাস দেন তিনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের চিঠি অবলম্বনে লেখা ‘নিঃশেষে শোষণ করি পরাধীনতা’ কবিতায়। এ কবিতায় কবি বলেন, “প্রতি নিঃশ্বাসে আমি নিঃশেষে শোষণ করি’ পরাধীনতা। ওই শৃঙ্খল ভেঙে একদিন জেগে উঠবে উজ্জ্বল ভোর, নতুন পাতা, বাংলার ঘরে ঘরে হবে নবজন্ম;—সেই পর্যন্ত কেবল অসম্ভব অসহ্য মৃত্যু।” সত্যিকার অর্থেই মামুন মুস্তাফা কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিক ইতিহাস তুলে ধরার প্রক্রিয়ায় যে নীরিক্ষা করেছেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কবিতার ভুবনে তা অনন্য উদাহরণ। এর বাইরেও মামুন মুস্তাফার কুহকের প্রত্নলিপি, এ আলোআঁধার আমার, শনিবার ও হাওয়া ঘুড়ি, ব্যক্তিগত মেঘ ও স্মৃতির জলসত্র, কফিনকাব্য কবিতাগ্রন্থগুলো আমাদের কবিতায় কবিকে তার নিজস্ব স্থান নির্ণয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
নিজের সময়ের সচেতন শিল্পী মামুন মুস্তাফা গত বছরই পঞ্চাশ উত্তীর্ণ করেছেন। আমাদের স্বাধীনতার সমান বয়সী এই কবির দশম কবিতাগ্রন্থ কফিনকাব্যের ১১তম কবিতাটি দিয়ে শেষ করতে চাই—“গোরখোদক আলো জ্বালে। ভাঙে আকাশের নতমুখ, ভাঙে শোকের অবাধ পাথর। তবু তার বুকের ভেতরে হা হা শূন্যতা—ওই হাহাকার নিয়ে বেড়ে ওঠে বায়ুহীন বাঁশি। যমের বাড়ি চিনে নেয় সে কোদালের সখ্যতায়। হাড় ও করোটির কথনে জেনে যায় মানব অন্তরের খেলা। মাটির গভীরে ও কিসের রঙ? গোরখোদক মাটির দলার ভেতরে দেখে নিজেরই চেহারা—এ শয়নকক্ষ কার? নিজের শবযাত্রার কফিন নিজেই নামিয়ে নেয়, বলে—মরণের ভেতরে নির্মাণ করি দেহমাটির ভাস্কর্য...”।
মূলত বাংলাদেশের কবিতায় নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে মামুন মুস্তাফা চিহ্নিত হন। তার কবিতায় যাপিত জীবনের জটিল বিন্যাস, দার্শনিক অন্তর্মুখীনতা এবং ঐতিহ্যনিষ্ঠ স্মৃতিকাতরতা মুখ্য হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে তার কবিতার মেজাজ ও বাকভঙ্গি প্রতীকী, বিশুদ্ধ সিম্বলিস্ট এবং গড়ে তোলেন পরাবাস্তবতার কুহক। কবিতার নিজস্ব পৃথিবী নির্মাণের এক ঐকান্তিক প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় মামুন মুস্তাফার কবিতাগুলোয়।
স্বল্প সময়ে, স্বল্প পরিসরে মামুন মুস্তাফার সামগ্রিক কাজের মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। তা যথেষ্ট দুরূহও বটে। অন্য কোনো সময়ে, অন্য কোনোখানে মামুন মুস্তাফার মতো অন্তর্মুখীন, প্রচারবিমুখ কবিতার সাধককে নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে বলা যাবে, অন্যরাও বলবেন; এ প্রত্যাশা রাখি।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক।
এসইউ/এমএস