স্বপ্নপূরণ
সবুর মিয়া সকাল থেকেই রাগে গজগজ করছেন। কলসীপুর গ্রামে এত বড় অনুষ্ঠান আর তিনি গ্রামের প্রাক্তন চেয়ারম্যান হয়েও দাওয়াত পেলেন না। এ সবকিছুর জন্য দায়ী বর্তমান চেয়ারম্যান মাহমুদ সরকার।
সবুর মিয়া জানেন, তার গ্রামে একটি সেতু খুব দরকার। গ্রামের মানুষগুলো খুব সহজেই জেলা শহরে যেতে পারবে। তিনি নিজেও যখন চেয়ারম্যান ছিলেন; তখন খুব করে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি টাকার অভাবে। এবার যখন সরকার সাহেব বুদ্ধি করে গ্রামের সবার থেকে টাকা তুলে সেতু বানানোর বুদ্ধি বের করলেন; তখন প্রথমে হিংসা কাজ করলেও গ্রামের উন্নয়নের কথা ভেবে তিনিও সরকার সাহেবের মতো সমান টাকা দিয়েছেন।
আজ সেতু উদ্বোধনের দিন; গ্রামের সব মানুষ দাওয়াত পেলো। এমনকি আশেপাশের দশ ইউনিয়েনের চেয়ারম্যানরাও দাওয়াত পেলেন। সেখানে সরকার সাহেব তাকে দাওয়াত দেওয়ার কথা চিন্তাও করেননি! এত বড় অপমান কি সহ্য করা যায়?
তিনি সকাল থেকেই চুপচাপ ঘরের মধ্য শুয়ে আছেন। মাঝে মাঝে তার একমাত্র ছেলে রেজার কাছ থেকে খবর নিচ্ছেন। আজকের অনুষ্ঠানের সর্বশেষ খবর কী? প্রত্যেক কথার শেষে তিনি একটি কথাই বলছেন, ‘আমি চেয়ারম্যান হইলে পুরা পৃথিবীরে দেখায়া দিতাম অনুষ্ঠান কারে বলে!’
হঠাৎ তার ছেলে চেঁচিয়ে বলল, ‘আব্বা, সরকার চাচা আইছে। আপনারে ডাকে!’
তিনি দুই মিনিট একটু সামলে নিয়ে রুম থেকেই বললেন, ‘উনারে চইলা যাইতে বল। আমার শরীরটা ভালো লাগতাছে না। আইজ আমি কোথাও যামু না!’
বলেই তিনি চমকে উঠলেন। দরজা খুলে সরকার তার রুমে এসে খাটের পাশে বসে একগাল হেসে বললেন, ‘গ্রামের এত বড় আয়োজন আজকে। আজকে শরীর খারাপ করলে চলবো?’
সবুর মিয়া অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘এত বড় আয়োজন কিন্তু কেউ তো দাওয়াত পর্যন্ত দিলো না।’
সরকার সাহেবের হাসি আরও বিস্তৃত হলো। তিনি বললেন, ‘নিজেগো অনুষ্ঠানে আবার দাওয়াত কীসের? দুই ভাই একলগে যামু, একলগে ফিতা কাটুম। এখন লন, রেডি হন। নইলে দেরি হইয়া যাইবো।’
সবুর মিয়া অন্যদিকে ফিরেই বললেন, ‘আমি যামু না। আমার শরীর খারাপ। তুমি যাও।’
এবার সরকার সাহেব সবুর মিয়ার হাত ধরে বললেন, ‘ভাইজান, আজকে গেলে দুই ভাই একলগে যামু, নয়তো দুই ভাই একলগে এই খাটে শুইয়া থাকুম। সেতু উদ্বোধন করা লাগবো না। আর ভাবছিলাম, সেতু উদ্বোধনের পর গ্রামের মানুষগোরে দু’চারটা ডাল-ভাত খাওয়াবো, তা-ও বাদ। এখন আপনার বিবেচনা, সেতুর ফিতা কাটবেন নাকি বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে থাকবেন?’
সবুর মিয়া কেমন যেন চুপ হয়ে গেলেন। সরকার তার গলা আরও নিচু করে বললেন, ‘ভাইজান, আমাগো ঝগড়াঝাঁটির জন্য গ্রামের মানুষ কেন কষ্ট পাইবো? চলেন ভাই, আজকের দিনের জন্য সব ভুলে যাই। পরে কোনোদিন শুভসময় দেখে আবার ঝগড়া শুরু করুম।’
সবুর মিয়া এবার কিছু না বলে খাট থেকে উঠে গেলেন। সরকার সাহেব পেছন থেকে গলা উঁচু করে বললেন, ‘রেজা, তোর বাপকে বলে দে, আমি কিন্তু তারে ছাড়া যামু না!’
রেজা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। কারণ সে জানে, এবার চমকানোর পালা সরকার চাচার, গ্রামের মানুষদের!
গ্রামের মানুষ সবাই হা করে আছে। চিন্তায় আছে, নতুন সেতু দেখবে নাকি সরকার-সবুর মিয়াকে একসাথে দেখবে! সবুর মিয়া আজ এ অনুষ্ঠানের জন্য নতুন পাঞ্জাবি কিনেছিলেন। তাকে খুব মানিয়েছে। যে দেখছেন; সে-ই বলছেন, আজ নাকি তাকে খুব সুন্দর মানিয়েছে! সরকার তো তাকে বলেই দিলেন, ‘যেই পাঞ্জাবি পরছেন ভাইজান! সেতুর ফিতা আপনার হাতে কাটানোই মানায়।’
সবুর মিয়াও এবার একগাল হেসে বললেন, ‘ফিতা কাটলে দুই ভাই একসাথে কাটুম। নয় আমাগো বাড়িতে বিছানা কিন্তু এখনো পাতা আছে কইলাম।’
কলসীপুর গ্রামে আজ দুপুরে সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। শুধু গ্রামের মানুষই নয়, দূর-দূরন্ত থেকে মানুষ সেতু দেখতে এসে খেতে বসে গেছে। প্যান্ডেলের সামনে সরকার আর সবুর মিয়া বসে আছেন। যে আসছেন, দু’জনই একত্রে সমাদর করে তাকে ভেতরে বসতে বলছেন। পাশের এলাকার চেয়ারম্যান এসে বললেন, ‘কী মিয়া ভাইরা! আপনারা খাবেন না?’
তখন দু’জনই হেসে বললেন, ‘খাইলে একলগেই খামু! নয়তো!’ কথা শেষ না করে দু’জনই হাসছেন।
কলসীপুর গ্রামের মানুষের অনেক দিনের স্বপ্নপূরণ হয়েছে। সেতুর মধ্য দিয়ে সবুর মিয়া আর সরকার সাহেবের এমন সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক দেখে আনন্দিত গ্রামের মানুষ। আনন্দিত তারা দু’জনও।
এসইউ/এমএস