নারীর একা থাকা না-থাকা
একটা সময় নারীরা ছিল ঘরমুখী। কিন্তু এখন তার স্বভাব ও ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। তারা শিক্ষা গ্রহণ করছে। কেবল প্রাথমিক শিক্ষাই নয়, তারা উচ্চতর ডিগ্রিও লাভ করছে। চাকরিও করছে উচ্চপদে। ফলে তাদের রুচি, মন-মেজাজেরও পরিবর্তন ঘটছে। শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জ্ঞানচক্ষুও খুলে যাচ্ছে। তারা নিজেকে চিনছে, সমাজ চিনছে। চিনছে পারিপার্শ্বও। এমনকি তারা নারীর শক্রমিত্রও এখন সহজে শনাক্ত করতে পারছে। ফলে জীবন-যাপনের বড় পরিবর্তনগুলো মধ্যে যৌথজীবন ও একাকী জীবনের ধারণায়ও এসেছে পরিবর্তন। এখন নারীরা কারও গলগ্রহ হয়ে পড়ে থাকে না, থাকতেও চায় না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের আত্মজাগরণ-আত্মশক্তির উন্মেষ ঘটছে। ফলে তারা যৌথ জীবনের চেয়ে একাকী জীবনকে শ্রেয় মনে করছে। থাকছে একা।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, নারীর জীবনচেতনার সঙ্গে সমাজ-চিন্তারও পরিবর্তন ঘটছে। আগে নারীরা বাবা-ভাই-স্বামীর ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু এখন শিক্ষাকে কেন্দ্র করে নারীর জ্ঞানের পরিধি বেড়েছে। ফলে তারা অনায়াসে ভালো-মন্দ বুঝতে সক্ষম হচ্ছে। এ কারণে তারা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠছে। নারীর এই আত্মনির্ভরশীলতাকে কেন্দ্র করে নিজের কাজের জন্য অন্যের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। ফলে তারা নিজের জীবনকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিচ্ছে। এই গুছিয়ে নেওয়ার পক্ষে নারীরা নিজেদের কল্যাণকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। ফলে তারা অনেক সময় প্রায়-ঝামেলাহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। সঙ্গীকে কেন্দ্র করে নারীকে সব সময় নিজেকে সমর্পণ করতে হয়। এই সমর্পণের সুযোগে নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় অনেক বিধিনিষেধ। এ কারণে বর্তমান শিক্ষিত নারীরা বাইরের থেকে চাপিয়ে দেওয়া বিষয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে পারছে না।
একা থাকা মানে একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতা নয়। বরং নারীর নিজেকে প্রাধান্য দেওয়াই এর মূল। আগে নারীরা নিজের ভেবেও দেখতো না। এই কদিন আগেই কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। তবে তখন কেবল রূপচর্চা আর সমানাধিকার নিয়ে তারা কথা বলতে শুরু করেছিল। কিন্তু তারা এখন জ্ঞানচর্চা-জীবনচর্চাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। জ্ঞানের জগৎ নারীকে নিজের শক্তি সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে। নারী এখন আর কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে চায় না। তার একার ঘরেই প্রদীপ শিখার মতো জ্বলছে জ্ঞানের আলো। এখন প্রশ্ন উঠছে, শুধু কি শিক্ষিত নারীই একা থাকাতে বেশি পছন্দ করছে? না। শিক্ষিত, অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত নারীও জীবনকে অন্য দৃষ্টিতে দেখছে। শুধু শিক্ষিত হয়ে নিজের জীবনের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে, এমন নয়; গ্রামের অনেক মেয়ে বিভিন্নভাবে জীবিকা নির্বাহ করে নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করেও তুলছেন। বাবা বা স্বামীর বোঝা হয়ে এখন তারা থাকতে নারাজ।
বিশ্বায়নের যুগে প্রত্যেকের হাতেই ডিজিটাল ডিভাইস। তাই জীবনচেতনারও পরিবর্তন ঘটেছে। নারীরা নিজের মতো থাকার এই পন্থাটাকে রপ্ত করছে এ কারণে যে, বাইরের কোনো চাপ তারা নিতে চায় না আর। মূলত চাপমুক্ত জীবনযাপন করাই এই একা থাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। নিজের হাতেই যখন নিজের নির্ভরতার চাবি, তখন কেন যেচে মানসিক যন্ত্রণার সম্মুখীন হবে! এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর যখন পাচ্ছে না, তখন তারা একা থাকার পক্ষে দাঁড়াচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন, মানসিক যন্ত্রণা বলতে শুধু যে স্বামীর হাতে মানসিক হেনস্তা, এমন নয়। বরং ব্যক্তি নিজে যেভাবে জীবনযাপন করতে চায়, সে জীবনযাপন প্রক্রিয়ায় আরেক জন থাকলে সেখানে স্বাচ্ছন্দ্যের পথে বাধা আসবে। সঙ্গী কোনো রকম বাধা না দিলেও অস্বস্তিতে ভোগে। তাই তারা বাধাহীন, অস্বস্তিমুক্ত জীবন বেছে নিতেই একাকী জীবন-যাপনকে শ্রেয় মনে করছে।
নারীর একা থাকার পেছনে ভারমুক্ত জীবনযাপন যেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, তেমনই জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর দায় থেকেও মুক্ত থাকার বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। আজকের নারীরা এতটাই স্বাধীনচেতা যে, তারা অন্যের কাছে মাথা নত করাকে আত্মহননের শামিল মনে করছে। জবাবদিহিতা করাকেও তাদের কাছে অনেকটা বিরক্তিকর মনে হচ্ছে। তাই যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার আগেই তারা সে পথই মাড়াতে চায় না আর।
এ ছাড়া নারীরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। তারা নিজেদের মন ও দেহের ওপর পুরুষতন্ত্রের প্রভুত্ব-কর্তৃত্ব মেনে নিতে আর চায় না। তাদের মধ্যে মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচারের ক্ষমতা বাড়ছে। তারা ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভ, ন্যায়-অন্যায়, সুন্দর-অসুন্দর, সুর-অসুরের পার্থক্য করতে পারছে নিমিষেই। এ কারণে তারা আনন্দ ও সৌন্দর্য দ্রুত ও সহজেই ধরতে পারে। একইসঙ্গে মনের আনন্দ ধরে রাখতে নিজেকে প্রাধান্য দিচ্ছে। নিজের ক্যারিয়ারকে প্রাধান্য দিচ্ছে। অনেক সময় নিজের অভিরুচি-স্বপ্নের পথে হাঁটার মতো যোগ্য সঙ্গীর অভাবও বোধ করছে তারা। অযোগ্য ও মতের মিলহীন কাউকে সঙ্গী করে জীবন চলার পথে তারা ঝুঁকি বাড়াতে চায় না। এ কারণেও তারা একলা পথের পথিক হওয়ার দিকে বেশি ঝুঁকছে।
সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠছে! ফলে তারা ঘরে-বাইরে নিজেকে ফিট রাখতে এত দ্বন্দের সম্মুখীন না হয়ে একা থাকাটাকেই শ্রেয় মনে করছে। এর বাইরে নারীদের একা থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। এতে নারী-পুরুষ উভয়ই নিজের মত-পথের গুরুত্ব বেশি দিচ্ছে। আগের মতো কোনো বিষয়ে ‘জি হুজুর-জি হুজুর’ কিংবা ‘স্বামীই সতীর গতি’ তত্ত্বে আর নারীর বিশ্বাস নেই। এ ছাড়া ব্যক্তিগত সম্পত্তির নিরাপত্তার কারণেও নারীরা বর্তমানে একা থাকাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।
একদিকে নারীরা নিজের মতকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে একা থাকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, অন্যদিকে ধর্মগুরুরা নানাভাবে তার বিরোধিতা করছেন। কিন্তু নারীর মূল পরিচয় সে মানুষ। তাহলে নারী হিসেবে না দেখে বরং একজন মানুষ যেভাবে জীবনযাপন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, তাকে সেভাবেই থাকতে দেওয়া উচিত। যেখানে অন্যের কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই, সেখানে নারী বা পুরুষ কীভাবে জীবনযাপন করবে, সেটা একান্ত তার ব্যক্তিগত অভিমত, রুচি ও বিশ্বাসের ব্যাপার। আবার নারীর একা থাকাকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় গুরুরা ওই নারীর দিকে আঙুল তোলেন, তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কিন্তু একজন পুরুষের জন্য সমাজের সেই বিধান কোথায়!
কিন্তু কেন! পুরুষরা নিজেদের ভালো-মন্দ বুঝে সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে পারবেন। কিন্তু নারীরা তা পারবেন না! এই প্রশ্নের জবাবে ধর্মীয় গুরুরা বলেন, তারা নারী তাই! কিন্তু নারীও যে মানুষ। তারও নিজস্ব অভিমত আছে, পছন্দ আছে, জীবনচেতনা আছে। নারীরা নিজেদের জীবনকে পরিচালনার ক্ষমতা অর্জন করছেন, ফলে তাকে ফাঁকা বুলিতে না বেঁধে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।
সামাজিক প্রথাকে কেন্দ্র করে অনেকেই নারীর চলার পথে বাধা সৃষ্টি করেন। আবহমানকাল ধরে চলে আসা প্রথাটাকেই তারা বেদবাক্যের মতো এখনো মেনে চলতে চান। কিন্তু যুগের পরিবর্তনের ফলে প্রথা-রীতিরও পরিবর্তন জরুরি। প্রকৃতি বনযাপনের যেহেতু পরিবর্তন ঘটেছে, তাই সামাজিক প্রথাগুলোরও আধুনিকায়ন জরুরি। তবে নারী যতই একা থাকার পণ করুক, তার সেই প্রতিজ্ঞার পথে কিছু শক্ত বাধা রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় বাধা হলো পরিবার।
পরিবারগুলো কোনোভাবেই নারীর একা থাকাকে সমর্থন করে না। কারণ প্রথম সমস্যা নারীর নিরাপত্তা! পরিবার মনে করে, মেয়ে বড় হলে তাকে পাত্রস্থ করা নৈতিক দায়িত্ব। আর সেই নৈতিকতাবোধের সঙ্গে যুক্ত হয় ধর্মীয় বিধানও। তাই নারীর জীবনকে নিজের মতো স্বাচ্ছন্দ্যে কাটনোর বিপক্ষে অবস্থান নেয় পরিবার ও ধর্ম।
তারা বরং সঙ্গী বেছে নেওয়ার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়। এ ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে গড়ে ওঠা মানসিকতাও দায়ী। কারণ মেয়ে বড় হলে তার নিরাপত্তার দায়িত্ব বাবার কাঁধ থেকে স্বামীর কাঁধে হস্তান্তর করা সবচেয়ে বড় সামাজিক প্রথা। মেয়ের জন্য বাবা-মা সামাজিকভাবে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চান না। তাই তারা নারীর একা থাকার বিপক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য হন।
এর বাইরে আছে বিভিন্ন সংগঠন-প্রতিষ্ঠান। এসব সংগঠন-প্রতিষ্ঠানও নারীর একা থাকার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। নারীর মুক্ত চিন্তা, স্বাধীনভাবে বাঁচাকে সাধুবাদ দিতে চায় না। বরং বর্বর যুগের মতো এই শ্রেণিও ধরে নেয়, নারী প্রভুত্ব মেনে, দাসত্ব স্বীকার করে জীবন পার করবে। অবশ্য এসব সংগঠন-প্রতিষ্ঠানের মূল হোতা পুরুষতন্ত্র। একশ্রেণির নারী-পুরুষ আছে, যারা সব সময় স্বাধীনচেতা নারীর কোনো ভালোও সহ্য করতে পারে না। বরং ভালোর মধ্যেও খুঁত ধরার চেষ্টা করে নিরন্তর। আর পান থেকে চুন খসলে তো কথাই নেই। ‘অন্নপাপের’ মতো গুরুতর পাপের অভিযোগ তোলে তারা। নারীর প্রাগ্রসর চিন্তা-চেতনাকে শ্রদ্ধা-সম্মান না করে তার জীবনকেও বিষিয়ে তোলাই যে পুরুষতন্ত্রের একমাত্র তপস্যা।
কিন্তু যে নারী এক জীবন-যাপনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, সে এসব প্রতিবন্ধকতা নিজের যোগ্যতা, মানসিক শক্তি দিয়ে জয় করে নেয়। থাকে একা। জয় করে হিমালয়ের মতো পর্বতসমান বাধাও। উন্নত জীবন ও আত্মিক বিকাশের পথে একাই চলে নারী। নিজের জীবনের ভার নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া সেই সব নারীর জয় হোক, মঙ্গল হোক একলা চলার নারীজীবনের। নারীর একা থাকাকে সমাজপতিরা কোনোভাবেই স্বীকৃতি দিতে চান না। কারণ তাদের মানসিকতা বর্বর যুগেই থমকে গেছে। যদি বিচারবুদ্ধি দিয়ে সঠিকতা নির্ধারণ করেন। তবেই বুঝবেন নারীকে নারী নয় বরং মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা আছে এবং ব্যক্তির সিদ্ধান্তের ওপর শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
সব ক্রটি-বিচ্যুতি কাটিয়ে মানুষকে মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করতে হবে। যে নারী একা থাকতে চায়, তাকে একা থাকতে দেওয়া উচিত। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সবারই উচিত নারীকে তার পছন্দের জীবনযাপন পদ্ধতি নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া, স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। এ ছাড়া বিয়ে-সংসার-সম্পর্ক বিষয়ে তার ওপর জবরদস্তি না করা। তাই যে একা থাকতে চায়, তার সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করার দায়িত্ব প্রথমে পরিবারের, পরে সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিতে হবে। নারীকে তার ইচ্ছা অনুযায়ী বাঁচার সঠিক পরিবেশ আমাদেরই তৈরি করতে হবে।
এসইউ/জেআইএম