ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

মায়াবতী: পর্ব ৪২

মোহিত কামাল | প্রকাশিত: ০১:৫০ পিএম, ২১ মে ২০২২

কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—

এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা দরকার, লেখক একজন মনোচিকিৎসক। মনোচিকিৎসকের কাছে মানুষ কষ্ট পেয়ে চিকিৎসা নিতে আসে। চিকিৎসকের কাজ না রোগীর গোপনীয়তা ফাঁস করা। এ ক্ষেত্রে রোগীর কোনো গোপনীয়তা ফাঁস করা হয়নি, একইভাবে কোনো ব্যক্তিকে হেয় করাও উদ্দেশ্য নয়। শিক্ষক, ব্যক্তি বা হুজুরের পরিচয় কিংবা বুবলির পরিচয় তুলে ধরা হয়নি। কিন্তু মনোসামাজিক ক্ষতটা সৃজন করা হয়েছে, নির্মাণ করা হয়েছে লেখকের লেখকসত্তার ভেতর থেকে।

সমাজের চিত্রটা কেবল তুলে ধরা হয়েছে―সামাজিক শিক্ষা আরও ছড়িয়ে দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য। সমাজের বাস্তব চিত্রের আলোকে উপন্যাসের গতি তৈরি হয়েছে। উপন্যাস নির্মিত হয়েছে। বাস্তবতার আলো এখানে অনেক বেশি প্রখর। সমাজবিজ্ঞান সমাজের আয়না। এই আয়নায় প্রতিবিম্বিত হবে সত্য। সমাজবিজ্ঞান সেটাই দাবি করে। সামাজিক শিক্ষায় মেয়েরা আলোকিত হবে, অসুন্দরকে পরাজয় করতে শিখবে, সুন্দরের জয় ছিনিয়ে আনবে, এটাও সমাজবিজ্ঞানের গোপন চাওয়া।

আহসান স্যার শ্রদ্ধাস্পদ শিক্ষক। তার নৈতিকতায় থাকা উচিত বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি। ছাত্রীকে ছাত্রী হিসেবেই দেখবেন তিনি। এটাই বাস্তব দাবি। নৈতিকতার দাবি। ছাত্রীকে ফাঁদে ফেলে নারী হিসেবে ভোগ করার অনৈতিক প্রতারণা ভয়াবহ। রক্ষক হয়ে একজন শিক্ষক ভক্ষক হতে পারেন না। এই শিক্ষা সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল কলেজ, অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সব ক্ষেত্রে। এখানে যে সত্যটা উঠে এসেছে, তা হলো শিক্ষকদের অনৈতিক কীর্তিগুলো গোপন থাকে না। চাউর হয়ে যায় স্টুডেন্টদের মধ্যে। সুতরাং নিজের সম্মানের জন্যই শিক্ষকদের নৈতিকশক্তি আরও মজবুত হতে হবে। এটাও এই উপন্যাসের একটা প্রচ্ছন্ন দাবি।

এই চরিত্রগুলো বিশ্লেষণে ফ্রয়েডের আদিম প্রবৃত্তির তাড়না অস্বীকার করা যায় না। গোপন ড্রাইভ আসে যৌনপ্রবৃত্তি থেকে। একই সঙ্গে ভুললে চলবে না নৈতিকতার কথা। বাস্তব দৃষ্টির মূল্যায়নও অস্বীকার করা যায় না।

ফ্রয়েড ছাড়াও মলিকুলার বায়োলজিস্ট অধ্যাপক হেমারের গবেষণায় দেখা যায়, যাদের ব্রেইনে নিউরোট্রান্সমিটার সেরোটনিনের ভারসাম্যহীনতা থাকে তাদের অস্বাভাবিক যৌনকাতরতা বেশি থাকে। এদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বেশি থাকে। যৌনক্ষমতাও বেশি থাকে।

মার্কিন গবেষক হ্যাগোপ একিস্কাল মনে করেন, সেরোটোনিন প্রেমের ব্যাপারে তীব্র দাবানল প্রজ্বলিত করে। তাঁর মতে, রোমান্টিক মনের মানুষ আসলে সাইক্লোথাইমিক রোগী। তারা যখন উৎফুল্ল থাকেন, ব্রেইনে সেরোটোনিনের মাত্রা বেড়ে যায়, তখন দ্রুতই তারা প্রেমে পড়েন, গলে যান। যখন বিষণ্ন থাকেন, সেরোটোনিনের মাত্রা কম থাকে, আত্মঘাতী চিন্তাও তখন চলে আসতে পারে মনে।

আহসান স্যারের ভালো লাগতে পারে মুনাকে।
তিনি তো কেবল মুনাকেই ফাঁদে ফেলেন নাই। প্রতি ব্যাচে টার্গেট করেন। সফল হন। মুনার কাছে ধরা খেয়েছেন তিনি। এই সামাজিক চিত্র ভয়াবহ। আহসান স্যারের এই যৌনকাতরতা কেবল ফ্রয়েড, হেমার কিংবা একিস্কালের বিশ্লেষণ দিয়ে মাপলে চলবে না। একই সঙ্গে মাপতে হবে তার নৈতিকতার মানদণ্ডটা। একজন শিক্ষকের নৈতিকতার ঘাটতি কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।

তেমনইভাবে বলা যায়, হুজুরের কথা। ঘরে ঘরে হুজুররা কোমলমতি মেয়েদের পড়াতে যান। ছাত্রীর মা-বাবা তাদের সন্দেহের চোখে দেখেন না। তাদের খোলসের আড়ালে থাকবে নৈতিকতা। ধর্মীয় অনুভূতি। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটে। সামাজিক ওই চোখ খোলা দরকার। খোলা চোখ পারিবারিক বিপর্যয় রোধ করতে পারে। একই সঙ্গে হুজুরদেরও মনে রাখা উচিত, মা-বাবাকে বলতে না-পারলেও কাউকে না কাউকে সে বলবে গোপন লজ্জার কথা। সেই লজ্জার লেবাস পরিয়ে দেন নৈতিকতার ঝাণ্ডাধারী তথাকথিত হুজুররা।
ছোট্ট কিশোরী বুবলির উপলব্ধি ভয়াবহ সত্যের দুয়ার খুলে দেয় আমাদের সামনে। বুবলিদের প্রতি পুরুষ মানুষের যৌন লালসা কেবল ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের আলোয় বিচার করলে চলবে না।
এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষের নৈতিক শক্তির কোনো বিকল্প নেই।

নৈতিক মূল্যবোধই কিশোরীদের নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই দিতে পারে। সমাজ পরিবর্তন বিবর্তন কিংবা উন্নয়নের জন্য ধর্মীয় মূল্যবোধোর তাই বিকল্প নেই। মনস্তাত্ত্বিক ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলাও জরুরি।
উপন্যাসে বুবলি-আখ্যান রেজার চোখে বিশ্লেষণের আলোয় নির্মোহ পুরুষের চিত্র তুলে ধরে। বিষয়টা আবার উল্লেখ করার প্রয়োজন আছে: ‘রেজা দমে যায়। এত ছোট মেয়ের এই অভিজ্ঞতা! অবাক হয়ে বুবলিকে দেখে। আসলেই বুবলি সুন্দরী, মায়াবতী। কৈশোরের দুরন্ত লাবণ্য ছলকে উঠছে। বিত্তবানের ঘরে আদর পেয়ে সেই লাবণ্য বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতো উছলে উঠছে। হঠাৎ করে রেজার চোখ সেই লাবণ্যের দিকে যায়। বুবলিকে আর ছোট্ট কিশোরী মনে হয় না। মনে হয় বুবলির দেহে চিরন্তন রমণীর রমণীয় পাপড়ি পেখম মেলছে। রেজার বুকে কাঁপন ওঠে, বুবলি কি তবে নিজের ভেতরের পুরুষ সত্তাটাকে চিনে ফেলেছে? সে তো মমতা দিয়েই কথা বলছিল।’

উপন্যাসচিত্রে আমরা লক্ষ্য করি রেজার মনোজগৎ।
আলাপচারিতায় বুবলির প্রতি রেজার অন্য চোখ খুলে যায়। ওই চোখ দেখে বুবলির লাবণ্য। বুবলির দেহ।
দেখেও রেজার মনে যৌনতার ড্রাইভ আসেনি। আসেনি বললে ভুল হবে। এসেছে। সেই ড্রাইভ সে চালিত করেছে ভিন্ন পথে মমতার চোখে মেপেছে কিশোরীটাকে। এটা একধরনের ‘সাবলিমেশন’। ইগো ডিফেন্স মেকানিজমের হেলদি চ্যানেল হচ্ছে সাবলিমেশন।
এইভাবে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা ও নৈতিকতার আলোয় নানাভাবে যৌনপ্রবৃত্তি চালিত হতে পারে। এই শিক্ষা হচ্ছে বিজ্ঞানের শিক্ষা।
এই শিক্ষায় চোখ খুলে যাওয়া উচিত সব পুরুষের। পুরুষ পাঠকের। এভাবে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার একটা পথ। আর এটার একটা পথ হচ্ছে মনোচিকিৎসা গ্রহণ করা।

যৌনপ্রবৃত্তি কেবল পুরুষের একক সম্পত্তি না।
এই প্রবৃত্তি নারীর দেহেও থাকে তীব্র। তীক্ষ্ম। প্রবল। নারী দ্বারাও নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। শিকার হতে আমরা দেখেছি যূথীকে।
অনেক অল্পবয়সী কিশোরও নারী দ্বারা নিপীড়ন ভোগ করে।
দুই বান্ধবীর আক্রমণকে একসময় নিপীড়ন হিসেবে নেয়নি যূথী। দেহভোগের উল্টো পিঠে মজা পেয়েছে। পেয়েছে দেহসুখ। সেই সুখের আগুন জ্বলে ওঠে যৌনপ্রবৃত্তির উদোম উল্লাসের কারণে। দুই বান্ধবীর ইনস্টিংক্ট আদিম সত্তায় বিপুল বিস্ময় ও শক্তির বিস্ফোরণ ঘটায়। ফ্রয়েড এখানে জয়ী। সমলিঙ্গের প্রতি গোপন আকর্ষণ নারী পুরুষের মধ্যে সমানভাবেই কাজ করে। এই উপন্যাসে যূথী চরিত্রের মধ্যে কেবল নারীর দিকটা উঠে এসেছে। এসেছে উপন্যাসের খাতিরে, পার্শ্বপ্রবাহ হিসেবে। পার্শ্বঘটনা হলেও মূল ধারার সঙ্গে পরোক্ষ সংযোগ রয়েছে। যূথীর মনে ধারণা হয়, ‘কী আছে তার দেহে? কেন সবাই তাকে এভাবে চায়?’
এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে আদিম উল্লাস, যৌনপ্রবৃত্তি। ফ্রয়েডীয় মতবাদ উপন্যাসের মূল ধারার সঙ্গে যূথীর উপলব্ধিকে সেঁটে দেয়। আটকে রাখে। তবে সমকামিতার একটা ব্যাখ্যা হচ্ছে, বিশেষ ‘জিনের’ উপস্থিতি। জিনের কোডে সংরক্ষিত ইনফরমেশন ক্ষেত্র-বিশেষে কেবল সমলিঙ্গের প্রতিই আকর্ষণ জাগায়। যূথী চরিত্রে তার ব্যতিক্রম আছে। সে আক্রান্ত হয়েছে, এনজয় করেছে। নিজে আক্রমণ করেনি। নিজে অ্যাকটিভ এজেন্টও হয়নি বরং নিজে সক্রিয় হয়েছে আপন মামার সঙ্গে, তাই যূথীকে লেসবিয়ান বলা উচিত হবে না। তবে দুই বান্ধবীর আচরণে এই বৈশিষ্ট্য অনেক বেশি প্রকট। অশালীন।

ইভটিজিংয়ের যন্ত্রণা সমাজে ব্যাপক। টিনএজ কিশোরী থেকে শুরু করে বয়স্ক নারীরা পর্যন্ত টিজিংয়ের শিকার হচ্ছে। এই উপন্যাসে দুটি এপিসোডে টিজিংয়ের উপস্থিতি দেখতে পাই আমরা। নন্দনের মতো উন্নত শপিং মলের খোলা প্রাঙ্গণে এক যুবক খামছে দেয় বাঁধনের বাহু। টিজিং মুখ বুঝে সহ্য করে নারীরা।
বাঁধন সহ্য করেনি। প্রতিবাদ করতে সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সঙ্গে অংশ নেয় রিয়া, যূথী, কুসুম।
এটা একটা সামাজিক প্রতিবাদের চিত্র।
এই প্রতিবাদের উল্টো পিঠে আছে বাঁধনের সাহস, তেজ।
কিন্তু এই তেজ এবং সাহস সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না। কোথাও কোথাও নীরবে নিভৃতে নারীরা হজম করে।
চারুকলার বকুলতলার নবান্নের উৎসবে রিয়ার প্রতি এমন একটা এপিসোডও আমরা দেখতে পাই। রিয়া ওই সময় একা ছিল। বাঁধন ছিল গ্রুপে। গ্রুপে থাকলে যে সাহস থাকার কথা, সাহস দেখানোর কথা, একা থাকলে সেই সাহস দেখানো যায় না।

তিন তরুণ রিয়ার সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছে। মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলেছে। সিগারেট টেনে ধোঁয়া ছেড়ে দিয়েছে রিয়ার মুখের দিকে। এই যুবকগুলোও ছিল ভদ্রবেশী। মনে হয়েছিল শিক্ষিত।
শিক্ষিত সুদর্শন ছেলেরাও এমন আচরণ করে কেন?
এদের অনেকে মেধাবী। মেধাবীরাও কেন টিজ করে?
এসব প্রশ্নের মনস্তাত্ত্বিক উত্তর কী?
উত্তরের মধ্যে আছে পারিবারিক শিক্ষণের ঘাটতি। পারিবারিক মূল্যবোধের ঘাটতি, ব্যক্তিত্বের নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের দাপট। এই দাপুটে বৈশিষ্ট্য অন্যকে হেয় করে, অন্যকে জখম করে, অন্যকে অপমান করে। হেয় করে, অপমান করে জখম করে নিজে মজা লুটে নেয়। এটা আনন্দ পাওয়ার একধরনের অতৃপ্ত উল্লাস, পৈশাচিক উল্লাস। এই উল্লাসে ভেঙে যায় অনেক নিরাপরাধ মেয়ের মন। অনেক যন্ত্রণা বয়ে বেড়ায় নিরাপরাধ কিশোরী।
অনেকে ফান করে মজা লুটতে গিয়ে সীমা লঙ্ঘন করে। সীমা যে লঙ্ঘন করছে তারা বুঝতে পারে না। ওদের বুঝতে না পারার ফাঁকে ডুবে যায় অনেক মেয়ে, মনস্তাত্ত্বিকভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, সর্বনাশা ইনসিকিউরিটি ফিলিংস ভেঙে দেয় মেয়েদের মনস্তাত্ত্বিক গড়ন। ফান করে মজা লুটেরার দলে থাকে অনেক মেধাবী ছেলে, অনেক শিক্ষিত ছেলে। ওদের মেধা এবং শিক্ষার মর্যাদা মূল্যহীন।
অন্যকে আঘাত করে, অপমান করে মজা লোটার মধ্যে লুকিয়ে আছে স্যাডিস্টিক ইনস্টিংক্ট, অ্যাগ্রেসিভ মনোবৃত্তি। এ ধরনের মনোবৃত্তির আড়লেও কাজ করতে পারে ফ্রয়েডের থিওরি থেনাটোস বা ধ্বংসাত্মক তাড়না।

পুনম চরিত্রটা উপন্যাসের অনেক না-বলা কথার, অনেক লুকোনো সত্যের মোড়ক খুলে দিয়েছে। আবার বলা যায়, খুলে দেয়নি, লুকিয়ে রেখেছে কিছুটা।
পুনম দেখতে কালো। গুণবতী। মায়াবতী। ফিগারও তার আকর্ষণীয়। এক হ্যান্ডসাম ছেলের সঙ্গে অ্যাফেয়ার ছিল। ভালোবাসার মানুষটাকে আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিল। নিজের ‘ডেফিসিট’ নিয়ে সজাগ ছিল। গায়ের রং কালো―এটাই ছিল ঘাটতি। এই ঘাটতি পুষে নিতে সে প্রেমিকের সব ধরনের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, সর্বস্ব অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছে।
বিয়ের প্রসঙ্গ আসার পর ছেলেটা বলছে পুনমের চরিত্র ভালো না। চরিত্রহীন মেয়েকে সে বিয়ে করবে না। চরিত্রবতী মেয়ে খুঁজছে সে। নিজের দৈহিক চাহিদা মেটাতে ছেলেটা তাকে ব্যবহার করেছে। ব্যবহার করে চরিত্রহীন বলে লেবেল পরিয়ে দিয়েছে―এই মানসকিতার আড়ালে আছে নিজের প্রতি নিজের অবিশ্বাস। নিজের চরিত্র খারাপ হওয়ার কারণে ‘প্রজেকশন’ করেছে, পুনমকেই খারাপ বলছে। প্রজেকশন হচ্ছে মনস্তত্ত্বের ভাষা। এই ভাষায় সে সরাসরি ‘না’ করে দিয়েছে পুনমকে।
এ ধরনের অসংখ্য পুনম আছে। অনেকে শিক্ষিত, অনেকে অশিক্ষিত। শিক্ষিত মেয়েরাও এ ভুলটা করে, অহরহ ভুলের ফাঁদে আটকে যায় অনেক জীবন।
ভুলের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে পুনম চাকরি নিয়েছে। চাকরিও রাখতে পারেনি। এখানে ভুল করতে চায়নি সে। ইমিডিয়েট বসের দাবি পূরণ না করে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারীর তেজ নিয়ে সরে আসে চাকরি থেকে।
অর্থাৎ অফিশিয়াল পরিবেশে অনেক মেয়ে এভাবে নিপীড়নের শিকার হয়, কেউ রেহাই পায়। কেউ পায় না। কেউ কেউ ডুবে যায়।

পুনম প্রথমবার রক্ষা পেলেও নিজেকে শক্ত রাখতে পারেনি। নিজের তেজস্বী সত্তা ধরে রাখতে পারেনি।
দ্বিতীয়বার রিয়ার বদান্যতায় চাকরি পায়। রিয়ার বাবা ইমরুল সাহেব সুপ্রিম বস। নিরাপদেই চাকরি করছিল সে। কালক্রমে কী হলো নিজেও বুঝতে পারেনি পুনম। জড়িয়ে যায় কারোর সঙ্গে। জড়িয়ে যাওয়াটা জোর করে ঘটেনি। ইচ্ছায় ঘটেছে। কেউ তাকে জয় করে নারীত্বের শেকড়ে টান দিয়েছে। নিজেকে বিলিয়েছে; বা বিলিয়ে দেওয়ার পরিবেশে আটকে গিয়ে নিজেকে উজাড় করে দিতে বাধ্য হয়েছে। পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায়। এমআর করায় সে। পরবর্তী সময়ে এমআরের জটিলতা নিয়ে ভর্তি হয় হাসপাতালে।
কে এমন কাজের সঙ্গে জড়িত। স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা নেই উপন্যাসে। তবে আলামত আছে। এই আলামত পাঠককে উত্তর খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।
কিছু কিছু সত্য নির্মম। সেই সত্যের প্রকাশ হলে নিরাপরাধ যে কেউ সাজা পেতে পারে, কষ্ট পেতে পারে, নিরাপরাধ কারোর জীবন ছারখার হয়ে যেতে পারে। এই উপলব্ধি থেকে পুনম সরাসরি উত্তর দেয়নি।
পুনম মিথ্যা বলে। এই মিথ্যা হচ্ছে শান্তির জন্য, কল্যাণের জন্য। এখানে পুনমের আচরণ অনেক বেশি ইতিবাচক।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধ্বংস ঠেকাতে সত্য উন্মোচন না-করাই ভালো। এই বিষয়টা দেখতে পাই আমরা উপন্যাসে।

চলবে...

এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন