যে প্রেক্ষাপটে গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছিলেন ‘একুশের গান’
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’- এই গান বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর। একুশ এলেই এই গান বেজে ওঠে কোটি বাঙালির হৃদয়ে। গানটির স্রষ্টা সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সাহিত্যিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। গীতিকার হিসেবেও যিনি এক গানেই হয়ে থাকবেন চির অমর। ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুনের বয়ানে ‘পৃথিবীতে একটি মাত্র গান লিখে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি গাফ্ফার চৌধুরী।’
সাংবাদিকতা, সাহিত্য সাধনা ও কলাম লেখকের পরিচয় ছাপিয়ে কখনো-সখনো তিনি অমর একুশের মহান এক গানের স্রষ্টা হিসেবে বাঙালি জাতির কাছে পৌঁছেছেন অনন্য উচ্চতায়। স্থান করে নিয়েছেন গণমানুষের হৃদয়ে। একুশের ফ্রেব্রুয়ারির প্রভাতফেরি, অনুষ্ঠানমালা আর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর এ গান যেন অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে আমাদের শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতিতে। বাংলাভাষী মানুষের কাছে ভাষাপ্রেম যেন বহুগুণে বাড়িয়ে দেয় এই গানের সুর।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশের ফেব্রুয়ারি’- অমর এ গানের সৃষ্টির পেছনে রয়েছে একটি মর্মস্পর্শী ইতিহাস।
ইতিহাস ঘেঁটে ও উকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়। এতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ ছাত্র হতাহত হন। সেসময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেলে যান আহত ছাত্রদের দেখতে। ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিল ভাষা সংগ্রামী রফিকের। লাশটি দেখে তার মনে হয়, এটা যেন তার নিজের ভাইয়েরই রক্তমাখা লাশ। তৎক্ষণাত তার মনে গানের প্রথম দুইটি লাইন জেগে ওঠে।
পরে কয়েকদিনের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি গানটি লেখেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি ‘একুশের গান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনেও এটি প্রকাশিত হয়।
তৎকালীন যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক কবিতাটি আব্দুল লতিফকে দিলে তিনি এতে সুরারোপ করেন। আব্দুল লতিফ তখন এটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়া শুরু করেন। ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার স্থাপনের চেষ্টা করার সময়ও গানটি গেয়েছিলেন। গানটি গাওয়া ও লেখার অপরাধে ঢাকা কলেজ থেকে ১১ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়।
১৯৫৪ সালে নামকরা সুরকার আলতাফ মাহমুদ গানটিতে পুনরায় সুরারোপ করেন। ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদের সুরে প্রভাতফেরিতে প্রথম গানটি গাওয়া হয়। কিন্তু গান গাওয়ার অপরাধে ঢাকা কলেজ থেকে ১১ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়। বর্তমানে এটিই গানটির প্রাতিষ্ঠানিক সুর হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।
ভাষাশহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে এই গান গেয়ে সবাই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাযন। বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান লাভ করেছে।
একুশের গানের গীতিকার আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেলেও জাতি তাকে সহস্র বছর মনে রাখবে।
গাফ্ফার চৌধুরীর অমর সেই গান
একুশের গান
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া-এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।।
জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা
শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,
দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবী
দিন বদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?
না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।
সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকনন্দা যেন,
এমন সময় ঝড় এলো এক ঝড় এলো খ্যাপা বুনো।।
সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।
তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহীদ ভায়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে
দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবো ফেব্রুয়ারি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।
এমএমএফ/এএসএ/এমএস