প্রতীচ্যের চোখে রবীন্দ্রনাথ: পর্ব-০৩
পাশ্চাত্যের কর্মমুখর জীবনের মধ্যে যে অস্থিরতা ছিল, যে অপ্রাপ্তি ছিল, যে অসম্ভব উত্তেজনা তাদের প্রতিনিয়ত তাড়িত করতো; যার জন্য তাদের দরকার ছিল অনাবিল প্রশান্তি আর অবিমিশ্র সুখ। এ কারণেই কবির কবিতা দীর্ঘ তৃষিত হৃদয়ে শ্রাবণধারার মতন স্নিগ্ধ করে তোলে পাশ্চাত্যের হৃদয়। অনেকের ধারণা পাশ্চাত্যের বস্তুকেন্দ্রিকতা তাদের অশান্ত করে তুলেছে, ফলশ্রুতিতে বেড়ে গেছে তাদের অসুখ, হারিয়ে গেছে মানসিক তৃপ্তি। সত্যটা হলো, বস্তুগত সুখের যে সীমানা তারা ছুঁতে চেয়েছেন; সেটা হয়ে উঠেছে অধরা, বেড়েছে উন্মাদনা, বেড়েছে মনোবৈকল্য। এটা দ্বিধাহীনভাবে বলা চলে, পশ্চিমের রুক্ষ্ম ও শুষ্ক বুকে কবির ছন্দপরশ পরম এক আবেশে তন্ময় করে তোলে সবাইকে। তিনি যখন লেখেন, ‘আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে’, তখন কী আর বাকি থাকে! ভোগের মাঝে যে ভয়ানক অতৃপ্তি রয়ে যায়, সেটা কিন্তু প্রতীচ্যের মানুষ উপলব্ধি করেছে। সাথে সাথে এটাও বুঝেছে ভোগের থেকে বেরুবার পথও নেই। তাহলে পথ কোথায়? এ দু’য়ের সমন্বয় কি জীবনের অর্থ দান করে না? রবীন্দ্রনাথের কাছে এর উত্তর পাওয়া যায়ঃ তিনি এই গীতাঞ্জলিতেই বলছেন,
‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়।
অসংখ্য বন্ধন-মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ। এই বসুধার
মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারংবার
তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত
নানা-বর্ণগন্ধময়। প্রদীপের মতো
সমস্ত সংসার মোর লক্ষ বর্তিকায়
জ্বালায়ে তুলিবে আলো তোমারি শিখায়
তোমার মন্দিরে-মাঝে।
ইন্দ্রিয়ের দ্বার
রুদ্ধ করি যোগাসন, সে নহে আমার
যে-কিছু আনন্দ’ (৭৩)
রবীন্দ্রনাথ যেন বোধাতীত উৎস থেকে নির্গত মহৎ আদর্শের প্রতি বিশ্বাস নিয়ে প্রকৃতির ভাষা শুনেছেন। ভার্নার ভন হেডেনস্ট্রম নামে এক কবি, যিনি নিজেও নোবেল পুরস্কার পান ১৯১৬ সালে; তিনি লিখেছেন, ‘তীব্র অনুভূতি নিয়ে কবিতাগুলো পাঠ করেছি এবং বলতে পারি বেশ কয়েক দশকের মধ্যে কাব্য সাহিত্যে এগুলোর তুল্য কিছু পাইনি। কবিতাগুলোর সাথে যে সময়টা কাটিয়েছি তা আমার কাছে বিশেষ মূল্যবান। যেন আমি স্বচ্ছ ঝরঝরে ঝরনার জল পান করার সুযোগ পেয়েছি।’ লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি তার কাছে এই কবিতার বইটি পাঠায়।
Dr. A. Aronson তাঁর Rabindranath Through Western Eyes গ্রন্থের শুরুতেই লিখেছেন, ‘লক্ষ লক্ষ পশ্চিমারা রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন ও পড়েছেন এবং সাড়া দিয়েছেন। কিছু মহান এবং উন্মুক্ত মানুষ আন্তরিকভাবে এবং দ্বিধাহীনভাবে সাড়া দিয়েছেন। কয়েকজনের কঠিন লড়াই করতে হয়েছে এবং তারা শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছেন। কিন্তু অনেকেই ব্যর্থ হয়েছেন হয় রবীন্দ্রনাথকে ভুল উপায়ে এবং ভুল কারণে প্রশংসা করার কারণে অথবা তারা কখনোই নিজেদের ক্ষুদ্র আত্মা এবং তাদের স্ব-পরিপাক ঐতিহ্য থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে পশ্চিমে তাঁর জীবদ্দশায় প্রাচ্যের আর কোনো মহান কবি এত বেশি সম্মান পাননি।’
২০১৩ সালে ইংল্যান্ডে ১২ হাজার বই প্রকাশিত হয়েছিল, বছর শেষের এক জরিপে দেখা গেল যেসব বই ওই বছর খুব জনপ্রিয়তা পায়, তার মধ্যে ক্যাপ্টেন স্কটের ‘দ্য ডাইরি অ্যান্ড অ্যান্টারটিক জার্নাল’, রোনাল্ড এমান্ডসেনের ‘দ্য সাউথ পোল’ অন্যতম। এ ছাড়াও ছিল রুজভেল্টের ‘অটোবায়োগ্রাফি’, অগাস্ট বেবেলের ‘মাই লাইফ’, ই টি কুকসের ‘লাইফ অব ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেল’ ইত্যাদি। তবে এই বছর সবচেয়ে ভালো কবিতার যে বই প্রকাশিত হয়, সেটা এই ‘গীতাঞ্জলি’। ১৯১৩ সালের ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর সব পত্রপত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের কথাবার্তা ছাপা হতে শুরু করে। তবে এসব জায়গায় রবীন্দ্রনাথের কাব্য-বিচার থেকেও গুরুত্ব পায় তার অন্যান্য বিষয়। বিশেষ করে গীতাঞ্জলির যে ভূমিকা ইয়েটস লিখে দেন সেটার ওপর। তবে সে সময় একজন ‘নন-হোয়াইট’, ‘কলোনাইজড’ দেশের মানুষের এই স্বীকৃতি নিয়ে খুব একটা লোকে মুখ খোলেনি। একটা বিষয় অস্বীকার করার নেই যে, ওইসব পত্রপত্রিকায় ‘ককেশীয়’, ‘ইন্ডিয়ান’ ইত্যাদি সব কথাবার্তা চলতে থাকে যার অর্থ দাঁড়ায় ককেশীয় জাতি হিসেবে ভারতীয়দের থেকে শ্রেষ্ঠ। এখানে উত্তম-অধমের ব্যাপারটা সবাইকে পীড়া দেয়। তবে এটা সত্য, ইউরোপের কিছু জায়গায় বিশেষ করে জার্মানি, আমেরিকা এবং কানাডায় অনেক মানুষ রবীন্দ্রনাথের বিশ্বসাহিত্যে প্রবেশের বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। কানাডার ‘দ্য গ্লোব’ নামে এক পত্রিকা লিখলো, ‘এটাই নোবেল ইতিহাসে প্রথম যে একজন ‘নন-হোয়াইট’ এ পুরস্কারে ভূষিত হন। রবীন্দ্রনাথ নামে একজন মানুষ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন, এটা আমাদের মেনে নিয়ে ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগবে। (আমাদের কি বলা হয়নি পূর্ব আর পশ্চিম কোনোদিন এক হয়ে মিলতে পারবে না?)। এই নামটি শুনতে বেশ খানিকটা খটকা লাগছে। এই প্রথম কোনো ছাপার অক্ষরে তার নামটা পাওয়া গেল যা বাস্তব বলে মনে হচ্ছে না।’ অর্থাৎ সে সময় খুব একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে। তবে রবীন্দ্রানুভূতিটা আমরা দেখে নিতে পারি।
প্রতীচ্যের মানুষের সামনে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্ত করেছেন তাঁর অন্তরের গভীর অনুভূতি। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ৮ বছর পর ১৯২১ সালের ২৬ মে স্টকহোমে তিনি অসাধারণ এক বক্তৃতা দেন। নোবেল পাওয়ার ৮ বছরের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তখন বিশ্ববাসীর মধ্যে অনেক পরিচিত। অনেক সমাদৃত। ততদিনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ। মানুষের মনে একধরনের প্রশান্তি। যে দুঃসহ দিনের শেষে পশ্চিম আকাশে নতুন স্বপ্ন নিয়ে সূর্য উঠেছিল, তার প্রাকমুহূর্তে এই ভাষণ ইউরোপবাসীকে দারুণ উদ্বেলিত করে; পূর্ব-পশ্চিমের মিলনে যে একটি অখণ্ড মানবতা গড়ে উঠতে পারে, সেটা তারা ভীষণভাবে বুঝেছিলেন। নাতিদীর্ঘ বক্তৃতাটি রবীন্দ্র মনোভাবকে বুঝতে সহায়তা করবে বিশেষ করে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মেলবন্ধন কতটা জরুরি সেটা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করা যাবে।
প্রতীচ্য ভাবনা
উল্লেখিত ভাষণের এ বছর শতবর্ষ। রবীন্দ্রনাথ এই ভাষণের পরেও বিশ বছর জীবিত ছিলেন। এই বিশ বছরে বিশ্বের নানবিধ পরিবর্তন তিনি লক্ষ্য করেছেন। বিরাট এক বৈশ্বিক পরিবর্তনের হাত ধরে সময় গড়িয়েছে। আরেকটা বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত তিনি দেখে গিয়েছেন, যার উত্তাপ ইউরোপ আমেরিকা ছাপিয়ে ভারতবর্ষ পর্যন্ত ছড়িয়েছে। দেখেছেন পশ্চিমা বিশ্বের অসহিষ্ণুতা, একের পর এক বিশ্ব দখলের পায়তারা। ইউরোপ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বরাবরই মিশ্র ধারণা আছে। এখানকার ব্যস্ত জীবন, ভিন্ন সংস্কৃতি, দিনভর কর্মচঞ্চলতা, আলাদা জীবনবোধ নিয়ে তিনি লিখেছেন। তিনি জীবন শেষের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ‘সভ্যতার সংকট’।
১৮৭৮ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিলেতে যান, দ্বিতীয়বার যান ১৮৯০ সালে। দ্বিতীয় সফরকালেই তিনি সেখানকার জীবনযাত্রার সাথে বেশি পরিচিত হতে শুরু করেন। ইংল্যান্ডের প্রথম অভিজ্ঞতা তিনি বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘ইংলন্ডে এলে সকলের চেয়ে চোখে পড়ে লোকের ব্যস্ততা। রাস্তা দিয়ে যারা চলে তাদের মুখ দেখতে মজা আছে–বগলে ছাতি নিয়ে হুস হুস করে চলছে, পাশের লোকের ওপর ভ্রূক্ষেপ নেই, মুখে যেন মহা উদ্বেগ, সময় তাদের ফাঁকি দিয়ে না পালায় এই তাদের প্রাণপণ চেষ্টা। সমস্ত লন্ডনময় রেলোয়ে। প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর এক-একটা ট্রেন যাচ্ছে। লন্ডন থেকে ব্রাইটনে আসবার সময় দেখি প্রতি মুহূর্তে ওপর দিয়ে একটা, নিচ দিয়ে একটা, পাশ দিয়ে একটা, এমন চারিদিক থেকে হুস হাস করে ট্রেন ছুটছে। সে ট্রেনগুলোর চেহারা লন্ডনের লোকদেরই মতো, এ দিক থেকে ও দিক থেকে মহাব্যস্তভাবে হাঁসফাঁস করতে করতে চলেছে।’
ইউরোপ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সম্যক ধারণা ছিল, তাদের জীবনাচার, দর্শন, নিত্যদিনের কর্মধারা ইত্যাদি এবং সে কারণেই তিনি নোবেল ভাষণে এই মানুষগুলোর তার কবিতা পছন্দের ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করেন, যেটা তিনি বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেছেন। খুব সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলোর কী মানে ছিল, যা পশ্চিমাদেশের মানুষকে বিমোহিত করল? এর একটা উত্তর খুঁজতে পারি এন্ডার্স ওস্টারলিং নামে একজন সুইডিশ লেখকের কথায়। তিনি A Breath of India নামক ভ্রমণ বইতে লিখছেন, ‘পশ্চিমের সাহিত্যের ওপর বর্ষিত হয়ে চলেছে বৃহৎ শিল্পের ঝুলকালি। সেখানে আর কোনো স্বপ্ন দেখা মানুষ শুভ্রতা রক্ষা করতে পারছে না। রবীন্দ্রনাথের লেখা তার মাঝে অবশ্যই প্রথম গ্রীষ্মের ঊষার এক অপার্থিব অনুভূতি এনে দেয়—এ যেন ভোরের ও পূবের এক ভোর যেখানে আমরা স্বচ্ছ প্রকৃতির মাঝে বিচরণ করতে পারি, যেখানে সূর্যের এক অদৃষ্টপূর্ব অস্তিত্বকে অনুভব করা যায়।’
পাশ্চাত্যে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে। বেড়েছে তাঁর সম্পর্কে নানা উপকথাও। ভেন হেডিন তার Great Man and Kings বইয়ে (১৯৫০) রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কিছু কিছু উপকথা বানিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘যুবক রবীন্দ্রনাথ তাঁদের বাড়ির বাগানে ধ্যানমগ্ন হয়ে স্থির বসে থাকতেন। কাঠবিড়ালিরা তাঁর কাঁধে লাফিয়ে বেড়াতো আর সকালের পাখিরা এসে বসত তাঁর গায়ে-মাথায়। বাড়িতে তিনি সাহিত্য-সংগীতে পরিবৃত থাকতেন আর উপনিষদ ও অন্যান্য প্রাচীন ভারতীয় ধর্মীয় শাস্ত্রের প্রতি তাঁর গভীর প্রীতি ছিল। পরে ওইসব গ্রন্থের নতুন সম্পাদনা প্রকাশের কাজে তিনি অংশগ্রহণ করেন।’
রবীন্দ্রনাথকে একজন নির্ভেজাল রহস্যবাদী হিসেবে কল্পনা করার কারণ মূলত প্রাচ্যের হাজার বছরের পুরোনো অতীন্দ্রিয় ভাববাদী ভাবনা। অনেকে মনে করেন ভারতবর্ষ যুগব্যাপী আধ্যাত্মবাদের পীঠস্থান হিসেবে মানুষের কাছে পুজ্য হয়ে আসছে। সুইডিশ লেখক আকি হলমবার্গ রবীন্দ্রনাথ তথা ভারতবর্ষ সম্পর্কে অতি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সুইডেনে একটা পর্যায়ে। সম্মানসূচক সম্ভাষণ পর্ব নিবে যাওয়ার সাথে সাথেই সবকিছু আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে এলো আর প্রাচ্য সম্পর্কে শিথিল ঔদাসীন্য গ্রাস করলো সবকিছুকে। প্রতীচ্যের গগনমানসে তুর্কি, পারসিক এবং ভারতীয়দের সম্পর্কে একটি ধারণা ছিল, এঁরা নতুন চিন্তাধারাকে অবরুদ্ধ করে রাখে। এর থেকে পশ্চিমের একটি ধারণা জন্মেছে, প্রাচ্য প্রতীচ্যের কাছ থেকে কোনো কিছু শিক্ষা নিতে অক্ষম।’
রবীন্দ্রনাথ ১৯২১ সালের মে মাসে স্টকহোমে পৌঁছালে সেখানকার সাহিত্যিকদের মাঝে অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে। উপসালার সংবাদপত্রে এ সংক্রান্ত এক রিপোর্ট লেখা হয় ২৭ তারিখে। রিপোর্টার বারোনেস এনি আকারহেইলম জানাচ্ছেন, ওই স্টেজটা একদম কমলালেবুর রঙে রঞ্জিত হয়ে গেল। পেছনে বড় একটা পতাকা এবং সারা মঞ্চজুড়ে ফুলে ফুলে ঢেকে দেওয়া হলো। রবীন্দ্রনাথের এই ভাষণ বলতে গেলে দূর দেশ প্রাচ্যের আধ্যাত্মধ্বনির এক অনির্বচনীয় প্রকাশ। তবে এটা ঠিক তাঁর ভাষণে উপস্থিত অনেকেই আশাহত হয়ে ওঠেন। কারণ এই ভাষণে তিনি দু’ধরনের শক্তির বিভাজন দেখানঃ একটা সৃজনশীল অন্যটা ধ্বংসাত্মক। সৃজনশীল বলতে তিনি ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির অর্থাৎ মানুষের সাথে মানুষের মেলবন্ধনের কথা বলেন, যেটা মূলত বুদ্ধ কিম্বা যিশুর বাণীকে স্মরণ করায়। অন্যদিকে যেটাকে তিনি ধ্বংসাত্মক হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন, সেটা পশ্চিমের মূল কর্মোদ্দীপনা বলে তিনি মনে করেন। একটু অন্যভাবে বললে, পশ্চিমের শিল্প-কলের কালো ধোঁয়া যেমন শান্ত গঙ্গার আকাশকে অন্ধকার করে দেয়, তেমনই। এই কালো ধোঁয়া বলতে তিনি পশ্চিমের চরম বস্তুবাদী ও ভোগবাদী দর্শনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
আমেরিকার অভিজ্ঞতা
রবীন্দ্রনাথের আমেরিকার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন W. Gunderson। Tagore’s Visit to Europe and America 1912-1913. তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন ভারতবর্ষ ও পশ্চিমা বিশ্বকে কাছাকাছি আনার চেষ্টা করে গেছেন। যার ফলে একে অন্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার সুযোগ সৃষ্টি হয়।’ Gunderson আরও বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ১৯১২ সাল থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষের একজন অ-সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে পশ্চিম দেশে প্রাচ্যের ঐক্য ও সংহতির বাণী তুলে ধরেন।’ গীতাঞ্জলি প্রকাশের আগে কিছু সময়ের জন্য রবীন্দ্রনাথ বিলেত থেকে আমেরিকা যান। কবিপুত্র রথিন্দ্রনাথ ১৯০৬ থেকে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ইলিনিয়ে পড়াশোনার জন্য অবস্থান করেন। ১৯১২ সালের নভেম্বরের আগেই তিনি পৌঁছে যান। থাকেন ইউনিভার্সিটি অব আরবানা ক্যাম্পাসে। এ সময় তিনি তাঁর কন্যা মাধুরিলতাকে (বেলা) চিঠিতে লিখছেনঃ ‘আমেরিকা পৌঁছানোর পর থেকেই এই ছোট্ট শহর আরাবানাতে ঘরের কোণে কিছুদিন বিশ্রাম নিয়েছি। কারো সাথে সাক্ষাৎ করিনি। এখানকার মানুষ অসম্ভব রকম বক্তৃতা প্রিয়। তারা আমাকে অব্যাহতভাবে বলে যাচ্ছে তাদের জন্য যেন বক্তৃতা দিই। সত্যি বলতে কি, প্রথমত আমি ভেবেছি ইংরেজিতে যদি আমি তাদের সাথে কথা বলি তাহলে আমার মর্যাদা খর্ব হবে। ...কিন্তু আমি তাদের নিমন্ত্রণের প্রেক্ষিতে অবশেষে আরাবানার ইউনিটি ক্লাবে বক্তৃতা দিতে রাজি হলাম। এটা ছিল ছোট্ট একটা সংগঠন, সদস্য সংখ্যা ছিল খুবই কম। কিন্তু আমি আমার বক্তৃতা তৈরি করে ওখানে গিয়ে দেখি মানুষে ভরপুর হয়ে গেছে। আমি সেই মুহূর্তে ওখান থেকে আমার পালিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু হলো না। অবশ্য বক্তৃতা শেষে সবার প্রশংসায় ভাসছিলাম আমি। আমি সেখান থেকে সাহস সঞ্চয় করে পরে আরও পাঁচটি বক্তৃতা দিলাম।’ সত্যিকথা বলতে কি, এটা ছিল তাঁর শুরু। এরপর একের পর এক তিনি হাবার্ড, ইলিনয়, উইস্কন্সিন, নিউইয়র্ক, মিসিগ্যান বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি।
চলবে...
এসইউ/জেআইএম