প্রতীচ্যের চোখে রবীন্দ্রনাথ
আয়ারল্যান্ডের স্লিগো শহর। জনসংখ্যা মাত্র বিশ হাজার। এই শহরের মাঝখানে রবীন্দ্রনাথের একখানা আবক্ষ ব্রোঞ্জ মূর্তি স্থাপন করা হলো ২০১৫ সালে। এটি সেখানকার ভারতীয় দূতাবাসের আইরিশ সরকারকে দেওয়া উপহার। ঠিক একশ’ বছর আগে এই দেশের মানুষ রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধার চূড়ান্ত সিংহাসনে স্থান দিয়েছিলেন। যে গীতাঞ্জলির জন্য তিনি এই সম্মাননা পান তার অনুবাদের ক্ষেত্রে যে কবি সহযোগিতা করেন; সেই ডাব্লিউ বি ইয়েটস চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন এই শ্লিগো শহরের ড্রামক্লিফ পেরিস চার্চ সিমিট্রি-তে।
কবি ইয়েটস ছিলেন রবীন্দ্রনাথ থেকে বছর চারেকের ছোট; নোবেল পুরস্কারও পান তাঁর এক দশক পর ১৯২৩ সালে। দু’জনের ভেতর বিস্তর মিল আছে; দু’জনের কাব্যিক সাদৃশ্যও তুলনাহীন। এমনকি রাজনৈতিক সচেতনতাসহ অনেক বিষয় ঘিরেই দু’জন সমমুখী। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের একজন মনে করতেন। ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে ইয়েটসকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘যদি আমাদের মাঝে তোমাকে আমি পাই তাহলে সেই আনন্দ কিছুতেই অন্য কোনকিছুর সমকক্ষ হবে না’। যুদ্ধ শেষে তিনি আশা করেন ভারতবর্ষে তাঁদের সাক্ষাৎ ঘটবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর একটা বক্তৃতার আয়োজন করবেন বলে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কথা দেন। আইরিশ এই কবি ‘জীবনের সমন্বিত ঐক্য’ অনুসন্ধান করেছেন আজীবন। বাংলার লোক সাহিত্যের মাঝে জীবনের যে একান্ত গভীর অনুভূতির কথা ব্যক্ত আছে, সেটা এই কবি বুঝেছিলেন। এমনকি যৌবনে তিনি আইরিশ জীবন-চরিতের মাঝে যে দর্শনগত অনৈক্য আছে তার সমন্বয় চেয়েছিলেন। গীতাঞ্জলির মাঝে জীবনের যে বিপুল ঐকতান ও অভিন্ন সুরের স্রোতধারা প্রবাহিত হয়েছে এ কারণেই ইয়েটস বলে ওঠেন, ‘...display in their thought a world I have dreamed of all my life long’। এক সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের লেখা বিলেত তথা ইউরোপে প্রকাশের ব্যাপারে ইয়েটসসহ আরও কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রে অন্তত এই আভাসটুকু পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথের সাথে ইয়েটসের সম্পর্কটা ভালো-মন্দ মিশিয়ে ছিল কয়েক দশক। Harold M. Hurwitz তার ‘Yeats and Tagore’ প্রবন্ধে লিখছেন, লন্ডনে ১৯১২ সালের জুন মাসে উইলিয়াম রোটেনস্টাইন ইয়েটসের কাছে গীতাঞ্জলীর কিছু অনুবাদ দেখান, যে অনুবাদগুলো রবীন্দ্রনাথ নিজেই করেছিলেন। উল্লেখ্য, রোটেনস্টাইন ছিলেন একজন চিত্রশিল্পী যিনি শান্তিনিকেতন থেকেই কবির সাথে পরিচিত। ইয়েটস ছাড়াও তিনি এই পাণ্ডুলিপিগুলো দিয়েছিলেন এন্ড্রু সিসিল ব্রাডলি (A C Bradely) ও স্টপফোর্ড ব্রুকের (Stopfrod Brooke) কাছে। এঁরা দু’জনই তখন সাহিত্য-জগতে ভীষণ নামকরা। ইংরেজ সাহত্যিক এন্ড্রু সিসিল ব্রাডলি ছিলেন শেক্সপিয়ার বিশেষজ্ঞ অন্যদিকে স্টপফোর্ড ব্রুক ছিলেন আইরিশ চার্চম্যান ও লেখক।
সত্যি বলতে কি, রবীন্দ্রনাথের এই লেখাগুলো ইয়েটসের মনের ভেতর এক অভাবনীয় সাড়া ফেলে। এর পরপরই ইয়েটস এক কাজে লন্ডনে যান। লন্ডনে গিয়ে তিনি ট্রেন স্টেশন, বাস, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি যেসব জায়গায় যাচ্ছিলেন; সেখানেই এই কবিতাগুলো পড়তে থাকেন। তিনি লিখছেন, ‘এগুলো পড়ার ফাঁকে প্রায়শই বন্ধ রাখতে হচ্ছিল, পাছে কেউ দেখে ফেলে আমার উন্মাদনা’! ২৭ জুন সন্ধ্যায় তাঁদের মাঝে বিস্তর আলাপ হয়, সেটাই ছিল দু’জনের প্রথম সাক্ষাৎ। এরপর ৭ জুলাই বসানো হয় একটা সাহিত্য আসর। এই আসরে আমন্ত্রণ জানানো হয় এজরা পাউন্ড, আর্নস্ট রেইস, মে সিনক্লিয়ার, এলিস মেইনেইল, চার্লস ট্রেভেলান, সি এফ এন্ড্রুজ, (পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাম দেন দীনবন্ধু এন্ড্রুজ), এইচ ডাব্লিউ নেভিন্সন, এ এইচ ফক্স প্রমুখ ব্যক্তি যাদের অনেকেই সাহিত্য ছাড়াও অন্যান্য শাখায় বিস্তর নাম করেছিলেন। সাহিত্য আসরে ঔপন্যাসিক সিনক্লিয়ার দারুণ এক মন্তব্য করেন এবং বলেন, ‘মুহূর্তটা ছিল অত্যন্ত মূল্যবান... যে অভিজ্ঞতা হলো সেটা অনবদ্য এবং এতটাই আত্মমুখীন যে সহজেই সেটা ভাষাতেই প্রকাশ করা সম্ভব’। এই সাহিত্য আলোচনার মধ্য দিয়ে এসব মানুষ ভারতীয় চিন্তা বিশেষ করে দর্শন ও জীবনবোধ সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়। Harold M. Hurwitz এর ভাষ্যমতে এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ লন্ডন সাহিত্য সভার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ইয়েটসের এই মুগ্ধতা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় এক সময় তিনি বলেই ফেলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ আমাদের সবার চেয়ে ওপরে’।
রোটেনস্টাইনের বাসা ছিল উবার্ন বিল্ডিংয়ে। এখানেই এই কবিতাগুলোকে আরও ভাষিক সৌন্দর্য দেন ইয়েটস। ১৯১২ সালের ১২ জুলাইয়ের সন্ধ্যায় ‘দ্য নেশন’–এর আয়োজনে লন্ডনের ট্রকেডেরো রেস্ট্রুরেন্টে একটি ডিনার পার্টির ব্যবস্থা করা হয়। ইয়েটস ছিলেন সেই পার্টির আয়োজক। এই পার্টি থেকে ইয়েটস উপস্থিত সভ্যজনদের জানিয়ে দেন তিনি রবীন্দ্রনাথের কতদূর ভক্ত হয়ে উঠেছেন! তিনি বলে উঠলেন, ‘Is one of the great events in my artistic life. I know of no man in my time who has done anything in the English language to equal these lyrics’। এ সময়ে ইয়েটস তাঁর বান্ধবী মউড গনের (Maud Gonne) নরম্যান্ডির বাড়িতে অবস্থানকালে অনুবাদগুলোকে পরিমার্জন করেন। ইতোমধ্যে আরেকজন আইরিশ কবি জেমস এইচ কাজিনস (James H. Cousins) রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়েন। তিনি ছিলেন ইয়েটসেরই প্রতিবেশী। অতি আবেগ-মথিত স্বরে সেদিন তিনি উচ্চারণ করেন, ‘নৈশভোজ পরবর্তীতে এই ভারতীয় কবির কবিতাগুলোর আবৃত্তি নতুনভাবে আজ আবিষ্কৃত হলো, ...যেখানে আমার সাথে ছিল আমার স্ত্রী। সেটা যেন একটা নতুন দ্বার উন্মোচন’। এই বছর নভেম্বরে ভারতীয় সোসাইটি ইয়েটসের ভূমিকা সম্বলিত গীতাঞ্জলি প্রকাশ করে। যে ভূমিকা ইয়েটস লেখেন, সেটি অত্যন্ত আবেগাত্মক, প্রাণোচ্ছল, উদ্বেলিত প্রাণের অকুণ্ঠ প্রকাশ।
গীতাঞ্জলির কবিতা অতি উচ্চমার্গিক আধ্যাত্মবোধে আকীর্ণ, যা ছিল অপূর্ব নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ। অনেকে এটিকে ‘সং অব ছলোমন’র সঙ্গে তুলনা করেছেন। আবার অনেকে এটিকে মরমী ধর্মাচরণের নিদর্শন বলেও আখ্যা দেন। আসলে এটি ছিল, এক বিশেষ ধরনের নান্দনিক আস্তিকতা, যার জন্য এর আরেকটি নাম দেওয়া হয়েছে ‘সং অফারিংস’। তবে গীতাঞ্জলি ও সং অফারিংসের মাঝে একটু তফাৎ আছে। সং অফারিংস সরাসরি গীতাঞ্জলির বাংলা নয়। গীতাঞ্জলির কবিতার সংখ্যা যেখানে ১৫৭টি সেখানে সং অফারিংসে আছে মাত্র ১০৩টি। এর গভীরতা এবং কাব্যিক সৌন্দর্য কয়েকটি শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রলম্বিত হয়েছে অসীমের দিকে, ফুটে উঠেছে সীমার সাথে অসীমের অপরূপ লীলা। কবিতাগুলোর মধ্য দিয়ে প্রাচ্যের চিরায়ত দার্শনিক অনুধ্যানগুলো এক দক্ষ তুলির আঁচড়ে জীবন পেয়েছে, ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক অনির্বচনীয় আধ্যাত্মবোধ ও উচ্চমার্গীয় ভাববাদী দর্শন। প্রকৃতির সাথে নিবিড় যোগ ও তার একান্ত মরমী ইন্ট্রোস্পেকশনের মধ্য দিয়ে যে সুররস তিনি পান করেছেন, সেটিই মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর তুলির স্পর্শে।
পাশ্চাত্যের মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অনেকটাই রহস্যাবৃত। তাঁকে নিয়ে সে সময় যত লেখালেখি হচ্ছিল, সবগুলোর শেষে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন থেকে গেছে। প্রশ্নটি যতটা তাঁকে নিয়ে তার থেকেও বেশি ছিল ভারতবর্ষের হাজার বছরের রহস্যাবৃত মিষ্টিসিজমকে ঘিরে। আসলে ওমর খৈয়াম কিংবা শোপেনহাওয়ের কল্যাণে পাশ্চাত্য দেশের মানুষ ভারতবর্ষ সম্পর্কে যতটুকু জেনেছে তা ছিল ওই অস্পষ্টতা আর মিষ্টিসিজমের সংমিশ্রণ। এ কারণেরই নীরদ চৌধুরী এ মহাদেশের ওপর লিখিত বইয়ের নাম দিয়েছিলেন ‘কন্টিনেট অব সার্সি’। ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণকারী নোবেল পুরস্কার পাওয়া ইংরেজ সাহিত্যিক রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের কাছ থেকে সে দেশের মানুষ হয়তো জেনেছিলেন এখানকার কথা। কিপলিং ১৮৬৫ সালে মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন। সে হিসেবে কিপলিংকে অনেকেই ভারতবর্ষের সাহিত্যিক হিসেবে মনে করে থাকেন! তবে কিপলিং ভারতবর্ষকে যতটা ভালোবাসতেন, ভারতবাসীকে ঠিক তার উল্টো। জন্মস্থান হিসেবে হয়তো তার ভালোবাসা ছিল, কিন্তু এদেশের মানুষ ও তার দক্ষতা নিয়ে তিনি প্রচ্ছন্নভাবে তার সাহিত্যে প্রশ্ন (undisguised contempt) তুলেছেন। বিশেষকরে তার ‘কিম’ ও ‘জঙ্গল বুক’–এ। তবে রবীন্দ্রনাথ কিপলিংয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ভোলেননি।
১৯৩৬ সালের ১৮ জানুয়ারি কিপলিংয়ের দেহাবসান হলে রবীন্দ্রনাথ এক শোকবার্তায় লেখেন, ‘যে কণ্ঠ ইংরাজি ভাষায় নূতন শক্তি সঞ্চার করিত তাহা আজ নীরব হইয়াছে। ইংরাজি সাহিত্যানুরাগীদের মধ্যে আমি তাঁহার মৃত্যুতে আন্তরিক শোক প্রকাশ করিতেছি।’
চলবে...
এসইউ/জেআইএম