বুক ও পিঠের গল্প: আমাদের জীবনের গল্প
‘বুক ও পিঠের গল্প’ পড়ার পর মনে হলো এ আমার গল্প, আপনারই গল্প। তাই কথাগুলো শেয়ার না করে পারলাম না। বুক ও পিঠের গল্পে চড়ে আজ ঘুরে এলাম গল্পকার আইয়ুব আল আমিনের শৈশব থেকে শহর জীবনে। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে আমি তার শৈশব থেকে শুরু করে এই যন্ত্রণাময় শহরের গলি থেকে রাজপথ সবখানে হেঁটেছি গল্পগুলোর পথ ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
শৈশবে দেখেছি আসমার জ্বর। ছোটভাই বারবার বোনের কপালে হাত রাখে। জ্বরের ঘোরে ছোট একটি হাত পরম নির্ভরতা; যখন তাদের মা গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত থাকে। মেনির মাকে (পোষা গাভি) না বেচলে আসমার অসুখ সারানো যাবে না। এ কথা যেমন বোঝে ভাইটি, আবার মনে মনে প্রার্থনা করে আজ যেন মেনির মার বেচা না হয়। প্রিয় কিছুর বলিদানে প্রিয়মুখের হাসি ফেরানো, এ গল্পে গ্রামের মানুষের নৈমিত্তিক চিত্র। লেখক তা সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
বাসা ছেড়ে গেলে দু’একটা জিনিস নিতে ভুলে যায় পুরোনো বাসিন্দারা। একটি গল্পে লেখক সেটি তুলে ধরতে ভোলেননি! বিষয়টিতে আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে, যখন বাথরুমের আয়নায় সবুজ টিপ দেখে চমকে উঠেছে লেখকমন!
অভাব অনটনে বেড়ে ওঠা ছাত্রজীবন, এ জীবনেও কিছু বন্ধু এসে জোটে। এ জন্যই জীবন থেমে থাকে না! হলের একবেলা ভাতের জীবনেও কখনো কখনো জোটে সনজীবের মতো বন্ধু! এ জন্যই বুঝি গান রচিত হয়—‘তোরা ছিলি, তোরাই থাকবি’। নতুন হলে ঢুকতেই সর্বপ্রথম নতুন কাঁথা-বালিশের খোঁজ নেয় কথিত বড় ভাই, যিনি ধর্ম নিয়ে খুব সচেতন। তাই এবারের চিল্লায় নতুন কাঁথা-বালিশ নিয়ে যেতেই হবে। আর তা হতে হবে সদ্য হলে ওঠা নতুন মুখের। যে মুখে বুলি ফোটেনি! বড়ভাইয়ের পরকালের কাজ বলে কথা।
একটা বয়সে কেউই গোপন চিঠির লোভ সামলাতে পারে না, লেখকও পারেননি। সমীরণ নামের কেউ প্রণবকে কী লিখেছে—এ কৌতূহলে খুলে খুলে পড়েন সব চিঠিগুলো। কে এই সমীরণ? তার কেউ নয় তো? যাকে সে কথা দিয়ে রেখে এসেছে গ্রামে! প্রথম অক্ষর দিয়ে মেয়ের নাম, শেষ অক্ষর দিয়ে ছেলের নাম—এটা তো তাদেরই কথা।
মনে পড়ে বড় এক আপুর সাহচর্য। একদিন জ্বরের ঘোরে যে কপালে হাত রেখে বলেছিল, মরতে পারিস না! জ্বরের ঘোরে কপালে রাখা হাতটি পৃথিবীর সবচেয়ে আপন মানুষের হাত বলেই মনে হয়। সেই মানুষটির কাছ থেকে গণিতই ধর্ম, গণিতই প্রেম, গণিতই জীবন, তার কাছ থেকেই শেখা। তবুও লেখক শেষমেষ স্বীকার করেন, জীবন নিয়ে কত ফিরিস্তি কত দর্শন, শেষবেলা শুধুমাত্র লাশ!
মানুষের মুখের ছবি আঁকেন চিত্রশিল্পী আইয়ুব আল আমিন এবং লেখক আইয়ুব আল আমিন। আঁকতে গিয়ে হতাশ হন কখনো কখনো। মানুষের চোখের ভাষা কত বিষণ্ন! অথচ এই ছবি দেখেই বন্ধুরা পিঠ চাপড়ে বলেন, ‘তোর ছবিতে প্রাণ আছে’। এ কথা শুনে লেখকের হাসি পায়। হাসি পায় কেন? জীবনের সাথে ছবির পার্থক্য তিনি টের পান বলে?
এ কারণেই কি মুহূর্তেই অচেনা হয়ে যায় নাইম, যখন শোনে তারই ঔরসজাত সন্তান নিলুফার গর্ভে। অথচ এতদিন মনে হয়েছে নিলুফাই সেরা নারী তার জীবনে। প্রেগন্যান্সির কথা শুনেই তার নিলুফাকে অবিশ্বাস হতে থাকে! নাইম যেন আমাদের পরিচিত নারীদেহভোগী সমাজের মুখ।
কখনো কখনো তুচ্ছ কথার বৃষ্টিতে ভেঙে যায় সুন্দর পরিবার। আমরা রাগ হলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাই বিশ্বস্ত কোনো আত্মীয়ের বাড়ি। এ সময় মা শেখাতে ভোলেন না, আমরা যেখানে যাচ্ছি; সেখানে গিয়ে যদি জানতে চায় কী খেয়েছি, তার উত্তর। বোনের চটপট উত্তর রেডি থাকে তখন। ডিম আলুর তরকারি, চান্দা মাছ ভর্তা, মাসকলাইয়ের ডাল। বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয় মায়ের চোখ!
পোলাও নেই, শুধু পোলাও পোলাও সুবাস ঠিক যেমন; কিছুই নেই তবু জীবন নিয়ে মাতামাতি। ব্যস্ত শহর। কেউ হাঁটছে প্রেমিকার হাত ধরে, কেউ গালি দিতে দিতে হাঁটছে, লেখক হাঁটছেন শৈশব থেকে ঢাকা শহরের কোনো এক ঠিকানায়।
শেষ গল্পে এসে আমার বুকে পিঠ ঠেকে গেল! গাঙ্গুবাঈর সাহসী প্রশ্নের কাছে অর্থবহ উত্তর নেহেরুর। উপদেশ দেওয়া সহজ আর তা বাস্তবায়ন ততটাই কঠিন—এ কথা বুঝিয়েছেন গাঙ্গুবাঈ নেহুরুকে। সৈনিকরা যুদ্ধ করে পুরস্কৃত হয় আর যৌনপল্লির বাসিন্দারা প্রতিমুহূর্ত লড়াই করে, কী জোটে তাদের কপালে? আসলেই তো, যৌনপল্লির জীবন কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি, তারা কত বড় যোদ্ধা? তাদের ঘরে প্রতিদিনই রামলালরা আসে, যারা একটু পরই আসছি বলেন, কিন্তু রামলালরা আর কোনোদিন ফেরে না!
গল্পগ্রন্থ: বুক ও পিঠের গল্প
লেখক: আইয়ুব আল আমিন
প্রচ্ছদ: সৌরীশ মিত্র
প্রকাশক: কিংবদন্তী পাবলিকেশন
প্রকাশকাল: বইমেলা ২০২২
মূল্য: ২৭০ টাকা
এসইউ/জেআইএম