ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

তাইজুল ইসলামের গল্প: সংসার

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:৪৮ পিএম, ২০ এপ্রিল ২০২২

পঁইপঁই করে বারণ করা সত্ত্বেও কখনো আমার কথা শুনতেন না মানুষটি। কাজের ফাঁকে দু’দণ্ড জিড়িয়ে নিলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত, বুঝি না বাপু! রাতে মাত্র ঘণ্টা চারেক ঘুমোতো; তাও এপাশ-ওপাশ করে করে। মাঝেমধ্যেই দেখতাম, আবার রাতভর জেগে আছেন।

‘দিনভর তো কম খাটুনি বিতায়নি শরীরটার ওপর দিয়ে, এখন ঘুমুতে এসো।’
অমনি বলতেন, ‘যাই গিন্নি!’

দেখতাম, চোখেমুখে জল ছিটিয়ে অগত্যা কাজ করেই যাচ্ছেন। রাগ হতো ভীষণ। গাল ফুলিয়ে চলে যেতাম শুতে। টের পেয়ে ভাবগম্ভীর গলায় বলতেন, ‘রাত জেগে কাজ করেও যদি দু’পয়সা আয় বাড়ানো যায়, তাতে ক্ষতি কি বলো তো! আখেরে সংসারেরই তো লাভ! জীবনটা তো সামনে পড়ে আছে। কতো ঘুমুতে পারবো! তুমি দেখে নিও।’

বড্ড কাজপাগল ছিলেন আমার মানুষটি। কীভাবে দু’পয়সা আয় বাড়ানো যায়, সেদিকেই কেবল ঝোঁক ছিল তার। শাশুড়িমার মুখে শুনেছি, ‘ছেলে-মেয়েগুলো আমার ছোট ছোট রেখেই তিনি এ সংসারের মায়া ছেড়ে পরপারে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন। অসুখ করে বিছানায় পড়েছিলেন বেশ কিছুদিন। সংসারের ওপর দিয়ে অভাব কিছু কম যায়নি। যাবার আগে পাঁচ ছেলে-মেয়েসহ অভাবি সংসারটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘ওদের দেখে রেখো মিনু!’।’

একা হাতে সংসার সামলাতে রোজ হিমশিম খেতে হচ্ছিল। বড় খোকা তখন মাধ্যমিকের গণ্ডিতে পা রেখেছে সবে। মায়ের কষ্ট তার আর সইছিল না। এদিকে যাওয়ার আগে বাবাও তাকে ছোট ছোট ভাই-বোনগুলোকে দেখে রাখতে বলে গেছেন।

সজয়-তনু ছয় ক্লাসে একই সঙ্গে পড়ে। রানু ওদের তিন ক্লাস নিচে। আর অজয়টা তখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি। সারাক্ষণ দিদিদের সঙ্গেই থাকতো। তনু-রানু কোলেপিঠে করে রাখতো ওকে। আর সজয় ঘাড়ে করে সারা পাড়া ঘুরে বেড়াতো।

ভাই-বোনদের পড়াশোনা শেখাতে বড় খোকা আর স্কুলমুখো হয়নি। মা, ভাই-বোন আর অভাবি সংসারটার মুখ চেয়ে নয়-ক্লাসের স্কুলবিদ্যা অভাবের শিকায় তুলে সেই যে কোমর বেঁধে নেমেছে, এখনো তার যাত্রা থামেনি। কখনো দু’বেলা খেয়ে বা না খেয়ে কিংবা আধপেট খেয়ে দিন কাটতো মা-বেটার। কখনো বা আবার রাতে না খেয়ে কেবল অজয়কে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকতো। তাতেই নাকি ওর ক্ষুধা মিটতো। অজয়টা ছিল ওর চোখের মণি।

পেটে পাথর চেপে কাজ করতো ছেলেটা আমার। আমি আর কতটুকুই বা করেছি! সংসারটা ও-ই ধরে রেখেছে। ভাই-বোনদের পড়াশোনা শিখিয়ে তাদের শিক্ষিত করে তুলেছে। সংসারটা ওর কাছে ঋণী হয়ে আছে, বৌমা!

মানুষটা জীবনভর খেটে এসেছেন। সংসারটাকে একটা ঠিকঠাক জায়গায় এনে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। শাশুড়ি চলে যাওয়ায় অনেকটা ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। তাই বলে থেমে থাকেননি। ভাই-বোনদের পরে এবার ছেলে-মেয়ে মানুষ করার ভার কাঁধে চাপে। শুনেছি, তিনি পড়াশোনা করে বড় ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইতেন। কপাল তা চায়নি। একটা অভাবের সংসার আর এক আকাশ দায়িত্ব চাপিয়ে দেয় কাঁধে। তাই মাধ্যমিকটাও পড়া হয়ে ওঠেনি।

পড়াশোনার পাঠ চুকাতে পারেননি বলে হা-হুতাশ করতে দেখিনি কখনো। বরং তার যে স্বপ্ন ছিল, তা ভাই-বোনদের দিয়ে পূরণ করতেই হাড়মাস কালি করেছেন। দিন-রাত এক করে খেটেছেন। সজয়ের চোখে ছিল তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন। আর অজয়টার চোখে দেখতেন মস্ত বড় এক ডাক্তার।

মাঝেমধ্যেই বলতেন, ‘আমাদের অজয়বাবু হবেন এই শহরের নামকরা ডাক্তার। বাবার মতোন কারোরই আর অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মরতে হবে না।’ বলতে বলতে চোখ মুছতেন মানুষটা। সজয়টা আজ ইঞ্জিনিয়ার। আর অজয়টা শহরের নামকরা ডাক্তারদের একজন। বোনদেরও বনেদি ঘরে বিয়ে দিয়েছেন। বাবাকে দেওয়া কথা অক্ষরে-অক্ষরে রেখেছেন। তারপর রাখলেন নিজেকে দেওয়া কথা।

তোদের তিন ভাইকে মানুষের মতোন মানুষ করেছেন। কত নামকাম হয়েছে আজ তোদের! মানুষটা থাকলে দেখতিস, আজ গৌরবে কেমন বুক ফোলাতেন!

দিন কয়েক বাদেই আমাদের একমাত্র মেয়ে অনুটার বিয়ে। ভালো ঘর থেকে সম্বন্ধ এসেছে। আত্মীয়-স্বজনে ঘরময় গমগম করছে। ছোট ছোট নাতি-নাতনিদের হই-হুল্লোড় বাড়িটা মাথায় করে রেখেছে। অথচ এই অনুকে নিয়েই কত আফসোস ছিল মানুষটির। বলতেন, ‘সেই ছোট্টটি থাকতে বাবাকে হারিয়েছি। সংসারটা যেই একটু মাথা উঁচু করে দাঁড়ালো, সেই মাকে হারালাম। মাকে হারানোর পর আমরা অনুকে পেলাম। অনুটা আমাদের বড় কপালপুড়ি। ওর জন্য আর কিছু করে যেতে পারলাম না!’

‘অনুকে নিয়ে ভেবো না। ওর মাথার ওপর তিন তিনটে দাদা আছে।’

সেই অনুটার আজ বিয়ে। আলোক-রোশনাইয়ে বাড়িটা ঝকমক করছে। আনন্দ আর হই-হুল্লোড়ে পাড়াসুদ্ধ লোক ঘুমোতে পারছে না। অথচ মানুষটা দিব্যি ঘুমোচ্ছে। এত চিৎকার-চেঁচামেচি, কিচ্ছু তার কানে যাচ্ছে না। এত আলোক-রোশনাই তার ঘুম ভাঙাতে পারছে না। মেয়ের বাবা হয়ে কী করে এমন ঘুম ঘুমোচ্ছে, বুঝে আসে না আমার।

একমাত্র মেয়ের বিয়ে না দিয়েই এ সংসার ছেড়ে ওপারে গিয়ে মাথা গুজেছেন মা-বাবার কোলজুড়ে। এত আত্মীয়-স্বজন, হই-হুল্লোড় আর আলোক-রোশনাইয়ে বাড়িটা গমগম করলেও সংসারটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

ইট-পাথরে গাঁথা চারটে দেওয়াল আলোতে মুড়ে দিলেই যে সংসার হয় না, মানুষটা কি তা জানতো না? সংসারে যে প্রাণ বসায়, তাকে ছাড়া এই আনন্দ-উল্লাস, এই আলোর রেখা, সবকিছুতে একটা ফিকে ছায়া নেমে আসে। চার দেওয়ালে একটা হাহাকার, একটা চিৎকার দাপিয়ে বেড়ায় তার নামে। সংসারের কর্তা ছাড়া সংসারটা যে অপূর্ণ থেকে যায়!

লেখক: শিক্ষার্থী, সম্মান, ৩য় বর্ষ, ইংরেজি বিভাগ, সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ, গোপালগঞ্জ।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন