ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

মায়াবতী: পর্ব ৩৮

মোহিত কামাল | প্রকাশিত: ০২:৩১ পিএম, ১৯ এপ্রিল ২০২২

কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—

হোস্টেল থেকে বেরোলেই কলেজ ভবন। কলেজ ভবনে ঢোকার পথে ডান দিকে আছে শহিদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের সমাধি।
স্থানটি দ্রুত অতিক্রম করে যাওয়ার সময় সমাধির সামনে থমকে দাঁড়াল রিয়া।
তাবিন্দা বলল, দাঁড়ালি কেন?
দেখ, সমাধির ভেতরে ঢোকার গেট খোলা।
তাবিন্দা বলল, চল। পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে।
একটু দাঁড়া। গেটটা আটকে দিই।
নাঃ! তোকে নিয়ে পারা যায় না। তুই থাক। আমি যাচ্ছি।
একটু দাঁড়া প্লিজ। খোলা গেট দিয়ে যে-কেউ ঢুকতে পারে, অপরিষ্কার করে ফেলবে সমাধিস্থল।
তাবিন্দা ফেলে দিতে পারে না রিয়ার অনুরোধ। ইতোমধ্যে রিয়াকে তার খুব ভালো লেগে গেছে। মেডিক্যাল ক্যাম্পাসে রিয়াই এখন তাবিন্দার বেস্ট ফ্রেন্ড।

গেট বন্ধ করে ফিরে এলো রিয়া। একবার তাকাল সমাধিস্তম্ভের দিকে।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের গতি বেগবান করেছিল শহিদ ডা. মিলনের রক্ত। স্বৈরাচারের পতনের মূল স্পিরিটে গেঁথে আছে ডা. মিলন। মিলনের জন্য গভীর মায়া বোধ করল রিয়া।
তাবিন্দা তাড়া দেয়, এবার হলো তো। আয় প্লিজ।
রিয়া বলল, চল।
ফিজিয়োলজি ব্লকে এসে দেখে নোটিশ ঝোলানো আছে। আজ সব ক্লাস সাসপেনডেড। এই ডিপার্টমেন্টের একজন কর্মচারী ইন্তেকাল করেছেন।
স্যাররা সবাই জানাজায় যাচ্ছেন।
রিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল। মৃত্যুসংবাদ সইতে পারে না ও। অনিবার্য মৃত্যু আসবে। এই সত্য মানতে রাজি না রিয়া। মৃত্যুসংবাদ দিয়ে দিন শুরু হলো। মন খারাপ হয়ে গেল ওর।

পুনম আপার কথা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করার জন্য সেট বের করে ব্যাগ থেকে। সেট বন্ধ। ভুলে অন করা হয়নি। সেট অন করে বাপিকে ফোন করে।
হ্যালো বাপি, পুনম আপার খবর কী?
ও ভালো। অপারেশন হয়েছে। এখন সুস্থ আছে।
তুমি কখন বাসায় গিয়েছিলে?
ওকে অফিসিয়ালি আমরা জিগাতলায় জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের ধানমন্ডি ব্রাঞ্চে নিয়ে এসেছি। ডা. সেহরিন সব ব্যবস্থা করেছেন। ও এখন ভালো।
ওঃ! গুড বাপি। তুমি কিন্তু ছাড় দেবে না অপরাধীকে।
তুমি নিশ্চিত থাকো। এ অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই। অফিসের প্রধান কর্তা হিসেবে বিষয়টা সিরিয়াসলি দেখব আমি। বলতে গিয়ে তার বুক কেঁপে কেঁপে ওঠে।
থ্যাঙ্কস বাপি।
বেস্ট উইশেস মাই সুইট বেবি।
বাপির সঙ্গে কথা শেষ করে যেবু আপাকে ফোন করল ও। না। মোবাইল বন্ধ। রেজা মামাকেও কল করেছে। ব্যাপার কী! ওদের সিমকার্ড কি বদলেছে! ওদের ফোন বন্ধ কেন? কুসুমকে কল করার জন্য মোবাইল অপারেট করতে থাকে। এ সময় একটা কল আসে।
মনিটরে কারোর নাম ওঠেনি। অর্থাৎ অপরিচিত কেউ কল করেছে। কেটে দিতে গিয়েও ইয়েস বাটনে চাপ দেয় ও।
যাক বাবা, বাঁচা গেল, শেষমেশ তোকে ধরা গেল। কুসুমের স্বরে স্বস্তি ঝরে পড়ে।
ওঃ! তুই! তুই কি নম্বর বদলিয়েছিস?
হ্যাঁ। এক আপার পরামর্শে বদলে ফেললাম। তোর সিমে এডিট করে এ নম্বর ঢুকিয়ে রাখ।
অদ্ভুত কাণ্ড। আমি তোকে ফোন করার জন্য সেট টিপছিলাম।
একেই বলে টেলিপ্যাথি।
টেলিপ্যাথি শব্দটা শোনার সঙ্গে রিয়ার মনে পড়ে যায় অর্কর কথা। অর্কর সঙ্গে মনে পড়ে মাহিনের কথাও।
মাহিন ভাইয়া কোথায়?
এ খবর জানাতেই তো তোকে বহুবার ফোনে ধরার চেষ্টা করেছি।
কী খবর?
মাহিনের স্কলারশিপ হয়ে গেছে। এমএস করতে শিগগির ফ্লোরিডায় যাচ্ছে সে।
তো। তুইও যাচ্ছিস? এত খুশি কেন?
না। আমি যাব না এখন। তবে সুখবর আছে।
সুখবরটা কী?
আমাদের এনগেজমেন্ট সামনের শুক্রবার। তুই অবশ্যই থাকবি।
কনগ্র্যাচুলেশন! শুধু এনগেজমেন্ট?
বিয়েও হয়ে যেতে পারে। মাহিনের ইচ্ছা বিয়ে করে বিদেশ যাবে।
কেন, ভয় পায়? পালিয়ে যেতে পারিস নাকি?
কুসুম হাসল। না। ভয় না। শক্ত গিঁট লেগে গেছে। গিঁট ছুটবে না।
তো, এখনই নোঙর ফেলতে চায় কেন?
‘নোঙর’ শব্দটা শুনে হাসতে লাগল কুসুম। হাসতে হাসতে বলল, ওকেই জিজ্ঞেস করিস।
ভাইয়াকে এখনই আসতে বল। একজনকে দেখাব। মেডিসিন ইউনিট টুতে ৪৭ নম্বর বেডের কাছে চলে আয়।
এখন?
হ্যাঁ। উইদাউট এনি ডিলে, এখন আয়। মাহিন ভাইয়া এ মুহূর্তে কোথায়?
পাশে আছে।
দে উনাকে।
মাহিন ফোনসেট হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিয়া বলল, কোথায় আছেন?
বুয়েট ক্যাম্পাসে।
এখনই চলে আসুন।
কেন?
কেন পরে শুনবেন। আসুন এখনই।
আসছি আমরা।
ফোনটা কুসুমকে দেন।
কুসুম সেট হাতে নিয়ে বলল, বল রিয়া।
যেবু আপার নম্বর আছে তোর কাছে?
ওঃ! তুই জানিস না?
কী, কী জানব?
রেজা মামা আর যেবু আপা গোপনে বিয়ে করেছেন। গোপনে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন জাপানে।

আচমকা কী যেন ঘটে গেল। রিয়ার শরীর-মন ঝাঁকি খেলো। এ তো আনন্দের সংবাদ। আনন্দে মন নেচে উঠল না কেন?
ঝাঁকি সামলে রিয়া শক্ত হয়ে গেল। ওর গলার স্বর পালটে গেল। অন্যরকম স্বর নিয়ে বলল, তুই কোত্থেকে শুনলি?
জাপানে যাওয়ার পর দুজনই ই-মেইল করেছে। সবাইকে মেসেজ পাঠিয়েছে। তোকে তো অবশ্যই পাঠিয়েছে। তুই ই-মেইল বক্স চেক কর। পেয়ে যাবি মেসেজ।
রিয়া বলল, আচ্ছা চেক করব। তোরা এখনই আয়।
রেজা মামাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে। ভালোবাসে। শ্রদ্ধাপূর্ণ ভালোবাসায় মন ছিল ভরা। ভরাট মন কষ্ট পাচ্ছে কেন? মনের ভেতর কি তবে অন্য কোনো ফিলিংস ছিল? জানে না রিয়া। যেবু আপা তাকে সাপোর্ট দিয়েছে। ভালোবাসা দিয়েছে। মমতা দিয়েছে। ওদের বিয়ে তো আনন্দেরই সংবাদ। ওদের বিয়ের খবরে তো মন উল্লসিত হওয়ার কথা। রেজা মামা তাকে নতুন জীবনে ফিরিয়ে আনতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
ওনাদের বিয়ের খবর শুনে মন খুশি হলো না কেন?
গোপনে চলে গেছে বলে!
গোপনে বিয়ে করেছে বলে!
নিজে কি ইগোতে চোট পেল! অপমানবোধ করল? নাকি অন্য অনুভূতি ছিল মামার জন্য।
ভেতর থেকে কান্না আসতে চাচ্ছে। কান্না আটকে দেয় ও। নিজেকে শক্ত হতে হবে। অর্কর কাছে যেতে হবে। ভাবল এবার।
তাবিন্দা এক ক্লাসমেটের সঙ্গে কথা বলছে।
একটু এগিয়ে গিয়ে শক্ত করে ওর হাত ধরে রিয়া।
সাঁড়াশি হাতের চাপ খেয়ে তাবিন্দা উহ্ করে শব্দ করে।
রিয়া পাত্তা না দিয়ে আদেশের স্বরে বলল, আয়। মেডিসিন ইউনিট টুতে যাব।
তাবিন্দা বলল, হাত ছাড়। এমন করছিস কেন। ব্যথা পাচ্ছি তো।
রিয়া হাত ছেড়ে দেয়।
তাবিন্দা অবাক হয়ে রিয়ার মুখের দিকে তাকাল। দেখে ওর চেহারা বদলে গেছে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভিন্নরকম তেজস্বী আরেক রিয়া।

হাঁটতে থাকে ওরা। কলেজ ভবন পেরিয়ে চলে এসেছে হাসপাতাল ভবনে। সিঁড়ি বেয়ে ওরা উঠে গেল দোতলায়। হাসপাতালের ভেতরের হাঁটার লবি অন্ধকারাচ্ছন্ন। দিনের বেলায়ও আলো ঢোকে না, লাইট জ্বলে। লাইটের আলোও কেমন যেন অন্ধকার। অন্ধকার লাগলেও লবিটা আজ বেশ ফাঁকা। সাধারণত ফাঁকা থাকে না। ফাঁকা লবি দিয়ে ওরা হাঁটতে থাকে মেডিসিন ইউনিট টু-এর ৪৭ নম্বর বেডের উদ্দেশে। ওই বেডে শুয়ে আছে অর্ক। রিয়া বলেছিল, আপনি বাঁচবেন। আপনাকে বাঁচতে হবে। রিয়ার কানে বাজতে থাকে অর্কর কথা, মরার আগে আপনার মুখটা দেখতে ইচ্ছা হয়েছিল। আপনাকে আমার কোনো উপকারের জন্য ডাকিনি, খোঁজ করিনি।
ওয়ার্ডে ঢুকে সরাসরি চলে এলো ওরা ৪৭ নম্বর বেডের পাশে।
একি! এ তো দেখছি নতুন রোগী! রিয়া চমকে উঠে তাবিন্দার হাত খামচে ধরে।
এ সময় ডিউটি নার্স কাছে আসে।
রিয়া বলল, উনি তো নতুন রোগী! গতকালের রোগী কি চলে গেছেন?
নার্স প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, আপনি রোগীর কে হন?
রিয়া উত্তর দিতে পারল না। উত্তর জানা নেই তার।
এবার তাবিন্দা জানতে চায়, উনি কি চলে গেছেন?
নার্স উত্তরে বলল, গতকাল মধ্যরাতে মারা গেছেন।
মারা গেছেন? প্রায় চিৎকার দিয়ে ওঠে রিয়া।
হ্যাঁ। মারা যাওয়ার সময় আমার এক বান্ধবী ডিউটিতে ছিল। ওর ড্রেস খামচে ধরে দুবার উচ্চারণ করেছিল, রিয়া! রিয়া! আপনাদের কেউ কি রিয়া?

পাথর হয়ে গেল রিয়ার শরীর। আচমকা পাথর হয়ে গেল ওর মন। চোখের ঘূর্ণি কমে গেল। পাথরের মতো জড় চোখ ফ্রিজ হয়ে গেছে।
তাবিন্দা বাঁ হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল রিয়াকে।
চল। রুমে চল।
কোনো বাধা দিতে পারল না রিয়া। সুবোধ মেয়ের মতো বেরিয়ে এলো ওয়ার্ড থেকে। হাঁটার লম্বা লবির উত্তর দিকে মোড় নিল ওরা। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখল কুসুমকে। মাহিনকেও।
কুসুম আর মাহিন এগিয়ে আসছে।
ওরা রিয়াকে দেখেছে। হাত নেড়ে উচ্ছ্বাস জানাচ্ছে।
ওদের উচ্ছ্বাসে সাড়া দিতে পারছে না রিয়া। সাড়া দিতে না পারলেও জড় অস্তিত্বের ভেতর থেকে স্বতঃস্ফূর্ত নাড়া টের পেতে থাকে রিয়া।
একসময় রিয়ার মনে হতো ড. ইউনূসের প্রেমে পড়েছে কুসুম।
এখন বুঝতে পারছে ব্যক্তিকে নয়, নোবেলজয়ীর স্পিরিটের ভেতর থেকে খুঁজে পেয়েছে সে মাহিনকে। তার অন্তর্গত ভালোবাসার ফুল হচ্ছে মাহিন।
নিজেকে সহজ করার চেষ্টা করে রিয়া। কিছুটা সহজ হয়।
তারপর দুহাত তুলে তাদের আহ্বান জানায় সামনে এগোতে।
সামনে খোলা আছে অনন্ত সম্ভাবনার দুয়ার। সেই দুয়ার দিয়ে কেউ চলে যায় দূরে, বহুদূরে। কেউ আসে কাছে।
তারপরও মনে হলো সে এখন একা। একদম একা। একা হলেও সামনে সম্ভাবনার দুয়ারে আলো দেখতে পেল রিয়া। অনেক আলো।

চলবে...

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন