আনিস ফারদীনের পাঁচটি কবিতা
বিদগ্ধ হৃদয়
বিদগ্ধ হৃদয়ে কষ্টে বেঁচে থাকা
আজও পুড়ে পুড়ে যাই ক্রমশ—
জটিল ধাঁধায় ভ্যাবাচ্যাকা শুধু
স্মৃতিরা যেন হয়ে যায় অবশ।
অপলক ছুটছি শূন্য ধূসরে
এ জীবনে বেঁচে থাকা পরবশ—
জাহাজের মাস্তুল ঢাকে আঁধারে
পুড়ে অঙ্গার-বিদীর্ণ খ্যাতি-যশ।
হিসেবের ভারে ন্যুব্জ সব পথ
সামনে যত বিভক্তি অপযশ—
ভেঙেচুড়ে খাঁক যেন সব কিছু
হৃদয় সীমায় বিরহ কর্কশ।
বিবেকের দংশনে আনমনে
হৃদয় ভেঙে হয়ে যায় নিরস—
নশ্বর পৃথিবী, নিরেট হিসেব
তবু নিজেকে খুঁজে চলি ক্রমশ।
****
নিকোটিনের ধোঁয়া
নিকোটিনের ধোঁয়ায় আসক্ত হয়েছি
সব ভুলে, মেতেছি নিকোটিনে—
ধোঁয়ারা প্রাণ খুলে উড়ে যায় আকাশে
দুঃখরা ভেসে বেড়ায় বাতাসে।
আমার অন্তর পুড়ে, পুড়ে যায় বিবেক,
গল্পরা খেই হারায়,
অলিন্দ-নিলয় পূর্ণ হয় দূষিত বিষাক্ত বাতাসে
তবু অগত্যা বেঁচে থাকা।
অবশ্য এখন আর কোন কিছুর ধার ধারি না
যা যাবার তা তো গেছেই, আর বাকি নেই কিছু
হারাতে হারাতে এখন আমি নিস্ব প্রায়
যা আমার ছিল, তা আজ আমার নয়।
ভাবতে ভাবতে দু’চোখ অশ্রুশূন্য
যতই চাই কান্নারা আসে না,
তারাও পালিয়ে বেড়ায় আমার মতো
পথ খোঁজে নিঃসঙ্গ পাখির মতো,
নীড় ফেলে ছুটে চলে দূরে কোথাও।
আমি যেমন করে পালাতে চাই নিকোটিনে ভর করে
দুঃখদের থেকে, তোমার থেকে, স্মৃতিদের থেকে—
এই সমাজ, মানুষ আর সভ্যতা থেকে
ইট-পাথরের এই শহর থেকে কোন যাযাবরের পথে।
****
ইটের শহর
পৃথিবীটা ইটের শহর হয়ে উঠছে
নগরী ইটের সুরকিতে সাজে
উঁচু-উঁচু, সারি-সারি দালান মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়
চারপাশ বাহ্যিক চাকচিক্যে খোলনলচে পাল্টে যায়।
অসংখ্য যাযাবর মানুষ অবহেলিত হয়ে পড়ে থাকে
আমিও পড়ে থাকি—
ভেতরটা জ্বলসে যায়, রক্তের তীব্র গতিতে স্ট্রোক হয়ে যায় যেন,
তবু বাহ্যিক অবয়বে দারুণ খুশি
হৃদয় খরায় এ যেন মৃত্যুর দাবদাহ।
আকাশ-বাতাস বোঝে,
বোঝে না এ শহরের ইটের সুরম্য অট্টালিকা আর বাসিন্দারা
রঙের খেলায় মাতে, জীবন সুখের হলিতে উদ্বেলিত করে তুলে
কিছু মানুষ অগত্যা কুকুর বিড়াল হয়ে যায়।
আলোয় আলোয় দিন-রাত এক হয়ে যায়
আলো কালো হয়, শুভ্র আর অযাচিত এক সারিতে দাঁড়ায়
আর কালো হয়ে ওঠে আলো।
মুখ আর মনের ভাষার অমিল ধরতে পারা হয়ে ওঠে রাজ্যের কঠিন,
তবু ইটের শহর বাড়তে থাকে আর
আমি অযাচিত হয়ে উঠি আর আমার মতো অসংখ্য মানুষ।
****
আমন্ত্রণ
ওই যে দেখ, সবুজ মাঠ পেরিয়ে আমার বাস
যেখানে আমি নির্মল বাতাসে শ্বাস নেই
গল্পে মাতি সবুজদের সাথে, পাখিদের সাথে;
আকাশের সাথে।
যেখানে আকাশ নীলে সাজে,
মুগ্ধতায় প্রশান্তির দেশে নিয়ে যায়, ভালোবাসায় আপন করে তোলে আঙিনা
সবুজ ঘাস বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে নেচে ওঠে।
সবুজের, এই নাচ পাগল করে তোলে
ক্লান্তির শহর ছেড়ে মুগ্ধতার শহরে চলে যাই অজান্তে
কে যেন আমায় ভালোবেসে যায়, আর আমিও প্রেমে পড়ি।
স্বপ্নবাড়ির ঠিকানা হয়ে ওঠে এ আবাস
সবুজ ঘাসের কচি-ডগা পেরিয়ে গেলেই পেয়ে যাবে আমায়
স্নিগ্ধ কোমল ছায়ায় তনু শীতল করা মায়ায়
যেখানে আমি জড়িয়ে পড়ি।
সবুজ আর নির্মল বাতাসের কোমল পরশে শরীর এলিয়ে দেই
স্বপ্নের ঠিকানা হয়ে ওঠে এ আঙিনা
মাছরাঙার ডুব, সারসের ডাকে শিহরিত হই
আবেগে ভাসি, বারবার প্রেমে পড়ি ওই সবুজের।
তুমিও হতে পারো এ আঙিনার বাসিন্দা
চাইলে তুমিও আবাস গড়তে পারো
যদি চাও—
তবে তোমায় আমন্ত্রণ এ আঙিনায়
স্বপ্ন দেখার আমন্ত্রণ, চলে এসো।
****
সুতোহীন সম্পর্ক
বেপোরোয়া হয়ে ভালোবেসেছি, এখনো বাসি
অথচ তুমি নেই
চলে গেছো কোন অচেনা এক রাজ্যে, অচেনা শহরে
হারিয়েছো তোমার ইচ্ছেতে।
সারি সারি প্রলম্ভিত দুঃখ আমার রাজ্য দখল করে
তোমার বদলে আমি পাই দুঃখদের,
পাই কষ্টদের, অভিশাপের নিগড়ে বন্দি হই
নষ্ট-গল্প বাসা বাঁধে আমার শহরে।
তোমায় হারিয়ে আমি খুঁজে ফিরি, ব্যস্ত শহরের অলিতে-গলিতে
সহস্র মানুষের ভিড়ে তোমার মুখ খুঁজি
ধোঁকায় পড়ে যাই,
কখনো বা তুমি ভেবে কারো সামনে দাঁড়াতে গিয়ে লজ্জায় পুড়ে মরি।
তোমায় খুঁজে চলি, ভালোবেসে যাই
জানি এ শহরে তুমি নেই, তোমার ছায়াও নেই;
আমাদের দেখাও হবে না কোনদিন—
তবু তুমি রয়ে যাও মজ্জা-মগজে,
এ যেন নাটাইয়ের সাথে ঘুড়ির সুতোহীন সম্পর্ক।
এসইউ/জেআইএম